সুতপা বেদজ্ঞ
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা এবং ডিজিটাল নানা অপরাধ রুখতে সরকার ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করে। বর্তমানে এই আইনের সামান্য পরিবর্তন করে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষাসংক্রান্ত অংশ নিয়েই আলোচনাটি সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রথম অধ্যায়ের ২ ধারায় বিভিন্ন শব্দের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এই ধারার ‘প’-এ বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্থ যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ।’ একই আইনের ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ড বিষয়ে বলা হয়েছে।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। বলা যায়, বিতর্কটিকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। একদিকে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্র সক্রিয় রয়েছে। যেসব মহান চেতনা বা আদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, সেই সব চেতনার কথা দশকের পর দশক জাতির সামনে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে সব সময় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস কৌশলে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত আছে। অন্যদিকে চেতনা রক্ষার্থে আইন তৈরি করা হচ্ছে।
‘চেতনা’ একটি বিমূর্ত শব্দ। চেতনা শব্দটি এমন এক অবস্থাকে প্রকাশ করে, যা একজন মানুষকে এমন অনুভূতিশীল করে, যার ফলে সে নিজের সত্তা ও আশপাশের পরিবেশের মধ্যকার সম্পর্ক অনুধাবন করার ক্ষমতা অর্জন করে। বুদ্ধিবৃত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক, মানবিক চর্চা ছাড়া চেতনা জাগ্রত হয় না। ‘চেতনা মানুষের সচেতন অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। আর এই অস্তিত্বই মানুষের জীবনের সঠিক প্রক্রিয়া।
বাস্তবতাবিহীন কোনো চেতনা তৈরি হয় না।’ ‘মানুষের চৈতন্যের কাজই হলো সমাজজীবনের প্রকৃত অবস্থা জানা এবং সেই অবস্থাকে মানুষের স্বার্থে পরিবর্তিত করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় খুঁজে বের করা।’
আমরা জানি চেতনা সব সময় কতগুলো আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং এই সব আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্যে চেতনা বেঁচে থাকে।সংক্ষেপে দেখার চেষ্টা করি, বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে কীভাবে বেঁচে আছে।
যখন কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও জীবনধারণগত ঐক্য দেখা দেয়, তখন তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়। জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক চেতনা। আমাদের সংবিধানে উল্লিখিত জাতীয়তাবাদকে ক্ষমতাসীনেরা ধর্মীয় ভিত্তিতে রূপ দিয়েছে; যা কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে না।
ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে রাষ্ট্র আর ধর্মকে পৃথকরূপে প্রকাশ করাকে বোঝায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের ওপর নির্ভরশীল থাকে না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই মতবাদ অনুযায়ী সরকার কোনোরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না, কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না এবং কোনো ধর্মকে কোনো ধরনের অতিরিক্ত সুবিধা দেবে না।
প্রতিটি ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে। রাজনৈতিক ব্যবহারের দিক থেকে বলা হয়, ধর্মনিরপেক্ষবাদ হলো ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক করার আন্দোলন, যাতে ধর্মভিত্তিক আইনের বদলে সাধারণ আইন জারি এবং সব ধরনের ভেদাভেদমুক্ত সমাজ গড়ার আহ্বান থাকে।
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ (অনুচ্ছেদ-১২) অনুসারে, সব ধরনের সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। এ ক্ষেত্রে বাস্তবতা হচ্ছে, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্র ধর্ম একই সঙ্গে বহাল রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সব কাজে ধর্মের ব্যবহার করা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইন বহাল রয়েছে।
সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে গণতন্ত্র বলতে এমন একটি ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, যেখানে বাক্স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ভোটের স্বাধীনতাসহ মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে। সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদার গণতান্ত্রিক সূচকে ১৭৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম।
‘নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে’ বাংলাদেশের অবস্থান ১৩১তম। দেশে বর্তমানে রাতের ভোট, বিরোধী মত দমন, নির্যাতন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে রুদ্ধ করা হয়েছে। এ অবস্থা সংবিধানে বর্ণিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে মেলে কি?
মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি আদর্শ সমাজতন্ত্র। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুসারে সমাজতন্ত্র বলতে শোষণমুক্ত ন্যায়ানুগ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (অনুচ্ছেদ-১০), অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটানো (অনুচ্ছেদ-১৫), জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য দূর করা (অনুচ্ছেদ-১৬), অনুপার্জিত (দুর্নীতি বা অনিয়মের মাধ্যমে) আয় ভোগ করার অবসান ঘটানো (অনুচ্ছেদ-২০) ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। এ দেশের স্বাধীনতার ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতি এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা করিবে, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
বর্তমানে দেশে জীবনমানের ক্রমাগত বৈষম্য, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া, সরকারি কলকারখানা ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া, লোকসান দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া, সরকারি চিকিৎসকদের হাসপাতালেই প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুবিধা দেওয়া, বহুমুখী
শিক্ষাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া, প্রাইভেট ও কোচিংয়ের সুবিধার্থে স্কুল-কলেজমুখী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে ধ্বংস করে ফেলা এবং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণে উৎসাহ দেওয়া—এসব কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ?
বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চেতনা সুরক্ষার নামে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারকে আইন দ্বারা আটকে দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রশ্নে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পৃথিবীর কঠোরতম আইনগুলোর মধ্যে একটি।
সংবাদমাধ্যমের তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যত মামলা হয়েছে তার ৮৫ শতাংশের বাদী সরকারদলীয় নেতা-কর্মী। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে এই আইনে ৭ হাজার ১টি মামলা হয়েছে। তথ্য ও মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘আর্টিকেল নাইনটিন’ বলেছে, গত চার বছরে ভিন্নমত ও সরকারের সমালোচনা দমনে এই আইনের নজিরবিহীন অপপ্রয়োগ হয়েছে।
বিভিন্ন মামলায় তিন বছরে ৫৩ জন সাংবাদিককে জেলে যেতে হয়েছে। ওই সংগঠনের দক্ষিণ এশীয় পরিচালকের মতে, ‘ভয়ের পরিবেশ তৈরির জন্যই আইনটা করা হয়েছিল গত নির্বাচনের আগে।’ ফলে সাংবাদিকসহ মুক্তচিন্তার লেখক এবং সামাজিক মাধ্যমে যাঁরা যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব, তাঁরা নিজেদের ওপর ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ আরোপ করেছেন। একটা লাইন এমনকি একটা শব্দ লিখতে গেলেও দশবার ভাবতে হচ্ছে।
এ অবস্থায় সম্পাদক পরিষদ ও জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন আইনটি সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সচেতন ব্যক্তি ও সংগঠন যৌক্তিকতা দেখিয়ে আইনটি পুরোপুরি বাতিলের দাবি করছিল। দেশে বর্তমান সময়ে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে আরও কিছু বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন পাসের উদ্যোগ নিয়েছে। বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ধারা ছিল ১৪টি, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে জামিনযোগ্য ধারা ৮টি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে বাধা হওয়ায় প্রস্তাবিত আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে এবং দুটি ধারায় কোনো পরিবর্তনই আনা হয়নি। নতুন আইনেও আগের মতো অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন আইনে কেবল নামেই পরিবর্তন আসছে, গুণগত কোনো পরিবর্তন এতে নেই। সাজা কমানো কিংবা বাড়ানো কিংবা সাজার মাত্রা পরিবর্তনের ঘটনায় নাগরিকদের অধিকার বা সুরক্ষা হবে না। ‘নতুন আইনেও লেখার কারণে অপরাধ করার যে ভয়, সেই ভয় বিন্দুমাত্র বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। মানহানি,
চেতনায় আঘাত, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া, এগুলোর জন্য শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশে কোনো আইন নেই।’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়নি, পরিবর্তন করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা এক বছর ধরে জেল খাটছেন, আরও অনেকে জেলে রয়েছেন অথবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
যেহেতু আইনটি বাতিল হচ্ছে না, ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নব সংস্করণ সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩-এর কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে চেতনা রক্ষার নামে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের এই আইনের পিঠে সওয়ার হয়ে আরও অনেক নিরপরাধ নাগরিককে ঝুঁকিতে ফেলার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। বাস্তবে চেতনা সুরক্ষার জন্য কোনো আইন হতে পারে না।
লেখক: কলামিস্ট ও নারী আন্দোলনের নেত্রী
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা এবং ডিজিটাল নানা অপরাধ রুখতে সরকার ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করে। বর্তমানে এই আইনের সামান্য পরিবর্তন করে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষাসংক্রান্ত অংশ নিয়েই আলোচনাটি সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রথম অধ্যায়ের ২ ধারায় বিভিন্ন শব্দের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এই ধারার ‘প’-এ বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্থ যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ।’ একই আইনের ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ড বিষয়ে বলা হয়েছে।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। বলা যায়, বিতর্কটিকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। একদিকে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্র সক্রিয় রয়েছে। যেসব মহান চেতনা বা আদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, সেই সব চেতনার কথা দশকের পর দশক জাতির সামনে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে সব সময় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস কৌশলে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত আছে। অন্যদিকে চেতনা রক্ষার্থে আইন তৈরি করা হচ্ছে।
‘চেতনা’ একটি বিমূর্ত শব্দ। চেতনা শব্দটি এমন এক অবস্থাকে প্রকাশ করে, যা একজন মানুষকে এমন অনুভূতিশীল করে, যার ফলে সে নিজের সত্তা ও আশপাশের পরিবেশের মধ্যকার সম্পর্ক অনুধাবন করার ক্ষমতা অর্জন করে। বুদ্ধিবৃত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক, মানবিক চর্চা ছাড়া চেতনা জাগ্রত হয় না। ‘চেতনা মানুষের সচেতন অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। আর এই অস্তিত্বই মানুষের জীবনের সঠিক প্রক্রিয়া।
বাস্তবতাবিহীন কোনো চেতনা তৈরি হয় না।’ ‘মানুষের চৈতন্যের কাজই হলো সমাজজীবনের প্রকৃত অবস্থা জানা এবং সেই অবস্থাকে মানুষের স্বার্থে পরিবর্তিত করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় খুঁজে বের করা।’
আমরা জানি চেতনা সব সময় কতগুলো আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং এই সব আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্যে চেতনা বেঁচে থাকে।সংক্ষেপে দেখার চেষ্টা করি, বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে কীভাবে বেঁচে আছে।
যখন কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও জীবনধারণগত ঐক্য দেখা দেয়, তখন তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়। জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক চেতনা। আমাদের সংবিধানে উল্লিখিত জাতীয়তাবাদকে ক্ষমতাসীনেরা ধর্মীয় ভিত্তিতে রূপ দিয়েছে; যা কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে না।
ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে রাষ্ট্র আর ধর্মকে পৃথকরূপে প্রকাশ করাকে বোঝায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের ওপর নির্ভরশীল থাকে না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই মতবাদ অনুযায়ী সরকার কোনোরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না, কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না এবং কোনো ধর্মকে কোনো ধরনের অতিরিক্ত সুবিধা দেবে না।
প্রতিটি ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে। রাজনৈতিক ব্যবহারের দিক থেকে বলা হয়, ধর্মনিরপেক্ষবাদ হলো ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক করার আন্দোলন, যাতে ধর্মভিত্তিক আইনের বদলে সাধারণ আইন জারি এবং সব ধরনের ভেদাভেদমুক্ত সমাজ গড়ার আহ্বান থাকে।
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ (অনুচ্ছেদ-১২) অনুসারে, সব ধরনের সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। এ ক্ষেত্রে বাস্তবতা হচ্ছে, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্র ধর্ম একই সঙ্গে বহাল রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সব কাজে ধর্মের ব্যবহার করা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইন বহাল রয়েছে।
সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে গণতন্ত্র বলতে এমন একটি ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, যেখানে বাক্স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ভোটের স্বাধীনতাসহ মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে। সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদার গণতান্ত্রিক সূচকে ১৭৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম।
‘নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে’ বাংলাদেশের অবস্থান ১৩১তম। দেশে বর্তমানে রাতের ভোট, বিরোধী মত দমন, নির্যাতন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে রুদ্ধ করা হয়েছে। এ অবস্থা সংবিধানে বর্ণিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে মেলে কি?
মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি আদর্শ সমাজতন্ত্র। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুসারে সমাজতন্ত্র বলতে শোষণমুক্ত ন্যায়ানুগ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (অনুচ্ছেদ-১০), অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটানো (অনুচ্ছেদ-১৫), জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য দূর করা (অনুচ্ছেদ-১৬), অনুপার্জিত (দুর্নীতি বা অনিয়মের মাধ্যমে) আয় ভোগ করার অবসান ঘটানো (অনুচ্ছেদ-২০) ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। এ দেশের স্বাধীনতার ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতি এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা করিবে, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
বর্তমানে দেশে জীবনমানের ক্রমাগত বৈষম্য, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া, সরকারি কলকারখানা ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া, লোকসান দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া, সরকারি চিকিৎসকদের হাসপাতালেই প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুবিধা দেওয়া, বহুমুখী
শিক্ষাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া, প্রাইভেট ও কোচিংয়ের সুবিধার্থে স্কুল-কলেজমুখী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে ধ্বংস করে ফেলা এবং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণে উৎসাহ দেওয়া—এসব কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ?
বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চেতনা সুরক্ষার নামে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারকে আইন দ্বারা আটকে দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রশ্নে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পৃথিবীর কঠোরতম আইনগুলোর মধ্যে একটি।
সংবাদমাধ্যমের তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যত মামলা হয়েছে তার ৮৫ শতাংশের বাদী সরকারদলীয় নেতা-কর্মী। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে এই আইনে ৭ হাজার ১টি মামলা হয়েছে। তথ্য ও মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘আর্টিকেল নাইনটিন’ বলেছে, গত চার বছরে ভিন্নমত ও সরকারের সমালোচনা দমনে এই আইনের নজিরবিহীন অপপ্রয়োগ হয়েছে।
বিভিন্ন মামলায় তিন বছরে ৫৩ জন সাংবাদিককে জেলে যেতে হয়েছে। ওই সংগঠনের দক্ষিণ এশীয় পরিচালকের মতে, ‘ভয়ের পরিবেশ তৈরির জন্যই আইনটা করা হয়েছিল গত নির্বাচনের আগে।’ ফলে সাংবাদিকসহ মুক্তচিন্তার লেখক এবং সামাজিক মাধ্যমে যাঁরা যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব, তাঁরা নিজেদের ওপর ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ আরোপ করেছেন। একটা লাইন এমনকি একটা শব্দ লিখতে গেলেও দশবার ভাবতে হচ্ছে।
এ অবস্থায় সম্পাদক পরিষদ ও জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন আইনটি সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সচেতন ব্যক্তি ও সংগঠন যৌক্তিকতা দেখিয়ে আইনটি পুরোপুরি বাতিলের দাবি করছিল। দেশে বর্তমান সময়ে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে আরও কিছু বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন পাসের উদ্যোগ নিয়েছে। বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ধারা ছিল ১৪টি, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে জামিনযোগ্য ধারা ৮টি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে বাধা হওয়ায় প্রস্তাবিত আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে এবং দুটি ধারায় কোনো পরিবর্তনই আনা হয়নি। নতুন আইনেও আগের মতো অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন আইনে কেবল নামেই পরিবর্তন আসছে, গুণগত কোনো পরিবর্তন এতে নেই। সাজা কমানো কিংবা বাড়ানো কিংবা সাজার মাত্রা পরিবর্তনের ঘটনায় নাগরিকদের অধিকার বা সুরক্ষা হবে না। ‘নতুন আইনেও লেখার কারণে অপরাধ করার যে ভয়, সেই ভয় বিন্দুমাত্র বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। মানহানি,
চেতনায় আঘাত, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া, এগুলোর জন্য শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশে কোনো আইন নেই।’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়নি, পরিবর্তন করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা এক বছর ধরে জেল খাটছেন, আরও অনেকে জেলে রয়েছেন অথবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
যেহেতু আইনটি বাতিল হচ্ছে না, ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নব সংস্করণ সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩-এর কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে চেতনা রক্ষার নামে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের এই আইনের পিঠে সওয়ার হয়ে আরও অনেক নিরপরাধ নাগরিককে ঝুঁকিতে ফেলার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। বাস্তবে চেতনা সুরক্ষার জন্য কোনো আইন হতে পারে না।
লেখক: কলামিস্ট ও নারী আন্দোলনের নেত্রী
রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
১৪ দিন আগেপরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
১৪ দিন আগেরাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় গত দুই মাসে দুই অটোরিকশা চালককে হত্যা করে রিকশা ছিনিয়ে নেওয়া ঘটনা ঘটেছে। পৃথক এই দুই ঘটনায় তদন্তে নেমে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
১৫ দিন আগেপাবনার পদ্মা নদী থেকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ১২ বছরের এক কিশোর এবং ২২ বছরের এক তরুণীর অর্ধগলিত দুইটি মরদেহ উদ্ধার করেছে নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি। উদ্ধারের দুইদিনেও কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। রোববার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাইদুর রহমান।
১৮ দিন আগে