রাহুল শর্মা, ঢাকা
রাজধানীর খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতিঝিলসহ তিনটি শাখায় গত ৯ বছরে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে ভর্তি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির অনুমোদিত আসনসংখ্যার অতিরিক্ত এসব শিক্ষার্থী ভর্তিতে লেনদেন হয়েছে শতকোটি টাকার বেশি।
আইডিয়াল স্কুলে ভর্তিসংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র ঘেঁটে এবং অভিযোগ অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযোগ আছে, দুটি সিন্ডিকেট এই অবৈধ ভর্তি-বাণিজ্যে জড়িত। এই চক্রে ছিলেন বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সদস্য, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতাও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভর্তি-বাণিজ্য, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে ফোন করলে প্রতিষ্ঠানটির মতিঝিল শাখার অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী বলেন, ‘আপনি এগুলো জানার কে? এসব তথ্য কই পান? এ ধরনের প্রশ্ন করার এখতিয়ার আপনার নেই। কোনো তদন্তে অনিয়ম উঠে আসলে মন্ত্রণালয়ে জবাব দেব, আপনাকে না।’ এরপর তিনি মুঠোফোনের সংযোগ কেটে দেন।
১৯৬৫ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিলে যাত্রা শুরু করে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। পরে বনশ্রী ও মুগদাতেও শাখা খোলা হয়। এই তিনটি শাখায় বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম মিলিয়ে শিক্ষার্থী ২৮ হাজারের বেশি। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী সাত শতাধিক।
ভর্তি-সংক্রান্ত নিয়মের বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রতি শ্রেণিতে ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) নির্দেশনা রয়েছে। অনুমোদিত আসনসংখ্যার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির কোনো সুযোগ নেই, এটা অনিয়ম ও অবৈধ। এ বিষয়ে আইডিয়াল কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হবে।
বিদ্যালয়টিতে অবৈধ ভর্তির অভিযোগের বিষয়ে অন্তত ২০ জন অভিভাবক ও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেছেন, ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য ও লটারিতে নাম না আসা শিক্ষার্থীকে টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে ভর্তি করা হয়েছে। এ জন্য শিক্ষার্থীপ্রতি বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নেওয়া হয়। অবৈধভাবে ভর্তির জন্য কেউ প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী, কেউ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, কেউ গভর্নিং বডির সদস্যকে মাধ্যম করেছেন।
জানা যায়, প্রতিটি অবৈধ ভর্তিতে গড়ে লেনদেন হয়েছে চার লাখ টাকা। সেই হিসাবে গত ৯ বছরে অবৈধ ভর্তিতে বাণিজ্য হয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি।
প্রায় ৩ হাজার অবৈধ ভর্তি
ভর্তি-সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের তিনটি শাখায় মাউশি ও স্কুলের গভর্নিং বডির অনুমোদিত আসনসংখ্যার অতিরিক্ত ২ হাজার ৮০৫ জন শিক্ষার্থীকে অবৈধ ভর্তি করা হয়েছে। এসব ভর্তির বেশির ভাগই প্রথম শ্রেণিতে।
২০১৬ সালে বিভিন্ন শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি অবৈধ ভর্তি হয়েছে, ২ হাজার ৩৩৫টি। ওই বছর তিন শাখার বাংলা মাধ্যম ও মতিঝিল শাখার ইংরেজি মাধ্যমে অনুমোদিত আসনসংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭৮০। তবে ভর্তি করা হয় ৬ হাজার ১১৫ জনকে। ২০১৪ সালে অনুমোদিত আসনসংখ্যার অতিরিক্ত ৬৯ জন, ২০১৫ সালে ৫২ জন, ২০১৭ সালে ৩৫, ২০১৯ সালে ৫৩, ২০২০ সালে ১৫৪, ২০২১ সালে ৭৫ ও ২০২২ সালে ৩২ শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে। এগুলো অবৈধ ভর্তি। তবে ২০১৮ সালে অবৈধভাবে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য পাওয়া যায়নি।
২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও ঢাকা-৮ আসনের (মতিঝিল-রমনা-পল্টন) সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। অবৈধ ভর্তির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি অনেক আগে দায়িত্ব পালন করেছি। বিষয়টি আমার জানা নেই।’ তিনি গত ৯ বছরে তিন মেয়াদে তিন বছর সভাপতি ছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইডিয়াল স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, ২০১৭ সাল থেকে প্রথম শ্রেণিতে লটারির মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রম শুরুর ঘোষণার কারণে একটি সিন্ডিকেট ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি অবৈধ ভর্তি করেছিল।
ছয় মাস করে এক বছর প্রতিষ্ঠানটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান ও অতিরিক্ত সচিব ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন। অভিযোগের বিষয়ে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।
২০১৭ সালের ৪ মে থেকে গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অবৈধ ভর্তির তথ্যটি পুরোপুরি সত্য নয়। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর এই অনিয়ম বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছি। আমার দায়িত্বকালে বিশেষ কারণে দু-একটি ভর্তি করা হয়ে থাকতে পারে, তবে ঢালাওভাবে হয়নি।’
ভর্তি-বাণিজ্যের হোতারা
অনুসন্ধানে জানা যায়, অবৈধ ভর্তিতে জড়িত ছিল মূলত দুটি সিন্ডিকেট। এর একটির নেতৃত্বে ছিলেন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সাবেক সদস্য জাহিদুল ইসলাম (২০২২ সালের মার্চে শাহজাহানপুরে গুলিতে নিহত মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু)।
অপরটির নেতৃত্বে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘদিন অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করা শাহান আরা বেগম। অভিযোগ আছে, তাঁর পক্ষে ভর্তি-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন প্রতিষ্ঠানটির উপসহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান। ২০২১ সালের ১ আগস্ট আতিকুরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্তটি চলছে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।
দীর্ঘদিন ভর্তি কার্যক্রমে যুক্ত এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আইডিয়াল স্কুলে ভর্তিতে অনিয়ম হয় মূলত গভর্নিং বডির অনুমোদিত আসনসংখ্যার ব্যত্যয় ঘটিয়ে। এসব ভর্তিতে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়। এর সঙ্গে গভর্নিং বডির প্রভাবশালী সদস্য ও প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহান আরা বেগম বলেন, ‘আমি এখন ওই প্রতিষ্ঠানে নেই, এ বিষয়ে কোনো কথা বলব না।’ উপসহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান বলেন, ‘অবৈধ ভর্তি-বাণিজ্যের সঙ্গে আমার জড়িত থাকার অভিযোগ সত্য নয়। এগুলো মিথ্যা, বানোয়াট। আমি প্রতিষ্ঠানটির কোনো দায়িত্বশীল পদে নেই। আমি কীভাবে ভর্তি-বাণিজ্য করব?’
টিপু হত্যার আসামির জবানবন্দিতে ভর্তি-বাণিজ্য
মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যা মামলার আসামি সুমন শিকদার ওরফে মুসার জবানবন্দিতেও উঠে এসেছে আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি-বাণিজ্যের বিষয়টি। সম্প্রতি আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি অনুসারে টিপু হত্যার নেপথ্য কারণের একটি এই ভর্তি-বাণিজ্যের টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘রুফটপ রেস্তোরাঁর বৈঠকে সবাই জাহিদুলের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বৈঠকে সোহেল শাহরিয়ার বলেন, জিসান ও মানিক মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে যে ১০০ ছাত্র ভর্তির কথা বলেছিলেন, তার কী হলো? তখন মারুফ বলেন, এ নিয়ে জাহিদুলের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। তবে জাহিদুল এ ব্যাপারে কথা বলতে নারাজ। জিসান ও মানিককে ভর্তি-বাণিজ্যের ভাগ দিতে হলে তা অন্যদের অংশ থেকে দিতে বলেছেন জাহিদুল।’
অনিয়মের তদন্ত চলছে
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুটি সংস্থা। ভর্তি-বাণিজ্য, ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ বিভিন্নভাবে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। জানতে চাইলে ৮ মে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহাম্মদ আরিফ সাদেক আজকের পত্রিকাকে বলেন, তদন্তটি চলমান।
তদন্তকারী আরেক সংস্থা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আইডিয়ালে গভর্নিং বডির অনুমোদিত আসনসংখ্যা লঙ্ঘন করে অবৈধ ভর্তির কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। ভর্তি-সংক্রান্ত কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। সংস্থাটির পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ্ মো. আজমতগীর বলেন, তদন্ত কার্যক্রম শেষ হলে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খানকে একাধিকবার ফোন ও এসএমএস করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ভর্তিতে সরকারি নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজধানীর খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতিঝিলসহ তিনটি শাখায় গত ৯ বছরে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে ভর্তি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির অনুমোদিত আসনসংখ্যার অতিরিক্ত এসব শিক্ষার্থী ভর্তিতে লেনদেন হয়েছে শতকোটি টাকার বেশি।
আইডিয়াল স্কুলে ভর্তিসংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র ঘেঁটে এবং অভিযোগ অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযোগ আছে, দুটি সিন্ডিকেট এই অবৈধ ভর্তি-বাণিজ্যে জড়িত। এই চক্রে ছিলেন বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সদস্য, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতাও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভর্তি-বাণিজ্য, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে ফোন করলে প্রতিষ্ঠানটির মতিঝিল শাখার অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী বলেন, ‘আপনি এগুলো জানার কে? এসব তথ্য কই পান? এ ধরনের প্রশ্ন করার এখতিয়ার আপনার নেই। কোনো তদন্তে অনিয়ম উঠে আসলে মন্ত্রণালয়ে জবাব দেব, আপনাকে না।’ এরপর তিনি মুঠোফোনের সংযোগ কেটে দেন।
১৯৬৫ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিলে যাত্রা শুরু করে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। পরে বনশ্রী ও মুগদাতেও শাখা খোলা হয়। এই তিনটি শাখায় বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম মিলিয়ে শিক্ষার্থী ২৮ হাজারের বেশি। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী সাত শতাধিক।
ভর্তি-সংক্রান্ত নিয়মের বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রতি শ্রেণিতে ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) নির্দেশনা রয়েছে। অনুমোদিত আসনসংখ্যার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির কোনো সুযোগ নেই, এটা অনিয়ম ও অবৈধ। এ বিষয়ে আইডিয়াল কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হবে।
বিদ্যালয়টিতে অবৈধ ভর্তির অভিযোগের বিষয়ে অন্তত ২০ জন অভিভাবক ও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেছেন, ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য ও লটারিতে নাম না আসা শিক্ষার্থীকে টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে ভর্তি করা হয়েছে। এ জন্য শিক্ষার্থীপ্রতি বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নেওয়া হয়। অবৈধভাবে ভর্তির জন্য কেউ প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী, কেউ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, কেউ গভর্নিং বডির সদস্যকে মাধ্যম করেছেন।
জানা যায়, প্রতিটি অবৈধ ভর্তিতে গড়ে লেনদেন হয়েছে চার লাখ টাকা। সেই হিসাবে গত ৯ বছরে অবৈধ ভর্তিতে বাণিজ্য হয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি।
প্রায় ৩ হাজার অবৈধ ভর্তি
ভর্তি-সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের তিনটি শাখায় মাউশি ও স্কুলের গভর্নিং বডির অনুমোদিত আসনসংখ্যার অতিরিক্ত ২ হাজার ৮০৫ জন শিক্ষার্থীকে অবৈধ ভর্তি করা হয়েছে। এসব ভর্তির বেশির ভাগই প্রথম শ্রেণিতে।
২০১৬ সালে বিভিন্ন শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি অবৈধ ভর্তি হয়েছে, ২ হাজার ৩৩৫টি। ওই বছর তিন শাখার বাংলা মাধ্যম ও মতিঝিল শাখার ইংরেজি মাধ্যমে অনুমোদিত আসনসংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭৮০। তবে ভর্তি করা হয় ৬ হাজার ১১৫ জনকে। ২০১৪ সালে অনুমোদিত আসনসংখ্যার অতিরিক্ত ৬৯ জন, ২০১৫ সালে ৫২ জন, ২০১৭ সালে ৩৫, ২০১৯ সালে ৫৩, ২০২০ সালে ১৫৪, ২০২১ সালে ৭৫ ও ২০২২ সালে ৩২ শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে। এগুলো অবৈধ ভর্তি। তবে ২০১৮ সালে অবৈধভাবে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য পাওয়া যায়নি।
২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও ঢাকা-৮ আসনের (মতিঝিল-রমনা-পল্টন) সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। অবৈধ ভর্তির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি অনেক আগে দায়িত্ব পালন করেছি। বিষয়টি আমার জানা নেই।’ তিনি গত ৯ বছরে তিন মেয়াদে তিন বছর সভাপতি ছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইডিয়াল স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, ২০১৭ সাল থেকে প্রথম শ্রেণিতে লটারির মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রম শুরুর ঘোষণার কারণে একটি সিন্ডিকেট ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি অবৈধ ভর্তি করেছিল।
ছয় মাস করে এক বছর প্রতিষ্ঠানটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান ও অতিরিক্ত সচিব ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন। অভিযোগের বিষয়ে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।
২০১৭ সালের ৪ মে থেকে গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অবৈধ ভর্তির তথ্যটি পুরোপুরি সত্য নয়। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর এই অনিয়ম বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছি। আমার দায়িত্বকালে বিশেষ কারণে দু-একটি ভর্তি করা হয়ে থাকতে পারে, তবে ঢালাওভাবে হয়নি।’
ভর্তি-বাণিজ্যের হোতারা
অনুসন্ধানে জানা যায়, অবৈধ ভর্তিতে জড়িত ছিল মূলত দুটি সিন্ডিকেট। এর একটির নেতৃত্বে ছিলেন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সাবেক সদস্য জাহিদুল ইসলাম (২০২২ সালের মার্চে শাহজাহানপুরে গুলিতে নিহত মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু)।
অপরটির নেতৃত্বে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘদিন অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করা শাহান আরা বেগম। অভিযোগ আছে, তাঁর পক্ষে ভর্তি-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন প্রতিষ্ঠানটির উপসহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান। ২০২১ সালের ১ আগস্ট আতিকুরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্তটি চলছে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।
দীর্ঘদিন ভর্তি কার্যক্রমে যুক্ত এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আইডিয়াল স্কুলে ভর্তিতে অনিয়ম হয় মূলত গভর্নিং বডির অনুমোদিত আসনসংখ্যার ব্যত্যয় ঘটিয়ে। এসব ভর্তিতে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়। এর সঙ্গে গভর্নিং বডির প্রভাবশালী সদস্য ও প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহান আরা বেগম বলেন, ‘আমি এখন ওই প্রতিষ্ঠানে নেই, এ বিষয়ে কোনো কথা বলব না।’ উপসহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান বলেন, ‘অবৈধ ভর্তি-বাণিজ্যের সঙ্গে আমার জড়িত থাকার অভিযোগ সত্য নয়। এগুলো মিথ্যা, বানোয়াট। আমি প্রতিষ্ঠানটির কোনো দায়িত্বশীল পদে নেই। আমি কীভাবে ভর্তি-বাণিজ্য করব?’
টিপু হত্যার আসামির জবানবন্দিতে ভর্তি-বাণিজ্য
মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যা মামলার আসামি সুমন শিকদার ওরফে মুসার জবানবন্দিতেও উঠে এসেছে আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি-বাণিজ্যের বিষয়টি। সম্প্রতি আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি অনুসারে টিপু হত্যার নেপথ্য কারণের একটি এই ভর্তি-বাণিজ্যের টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘রুফটপ রেস্তোরাঁর বৈঠকে সবাই জাহিদুলের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বৈঠকে সোহেল শাহরিয়ার বলেন, জিসান ও মানিক মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে যে ১০০ ছাত্র ভর্তির কথা বলেছিলেন, তার কী হলো? তখন মারুফ বলেন, এ নিয়ে জাহিদুলের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। তবে জাহিদুল এ ব্যাপারে কথা বলতে নারাজ। জিসান ও মানিককে ভর্তি-বাণিজ্যের ভাগ দিতে হলে তা অন্যদের অংশ থেকে দিতে বলেছেন জাহিদুল।’
অনিয়মের তদন্ত চলছে
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুটি সংস্থা। ভর্তি-বাণিজ্য, ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ বিভিন্নভাবে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। জানতে চাইলে ৮ মে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহাম্মদ আরিফ সাদেক আজকের পত্রিকাকে বলেন, তদন্তটি চলমান।
তদন্তকারী আরেক সংস্থা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আইডিয়ালে গভর্নিং বডির অনুমোদিত আসনসংখ্যা লঙ্ঘন করে অবৈধ ভর্তির কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। ভর্তি-সংক্রান্ত কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। সংস্থাটির পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ্ মো. আজমতগীর বলেন, তদন্ত কার্যক্রম শেষ হলে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খানকে একাধিকবার ফোন ও এসএমএস করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ভর্তিতে সরকারি নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
১৭ দিন আগেপরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
১৭ দিন আগেরাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় গত দুই মাসে দুই অটোরিকশা চালককে হত্যা করে রিকশা ছিনিয়ে নেওয়া ঘটনা ঘটেছে। পৃথক এই দুই ঘটনায় তদন্তে নেমে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
১৭ দিন আগেপাবনার পদ্মা নদী থেকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ১২ বছরের এক কিশোর এবং ২২ বছরের এক তরুণীর অর্ধগলিত দুইটি মরদেহ উদ্ধার করেছে নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি। উদ্ধারের দুইদিনেও কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। রোববার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাইদুর রহমান।
২১ দিন আগে