ধর্ষণে আর কতকাল তালি দেবেন

অর্ণব সান্যাল
প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২১, ১০: ০০
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২১, ১১: ৩৩

যেকোনো ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নেই নিন্দা ও ন্যায়বিচার দাবি করা একজন সচেতন মানুষের কর্তব্য। যদি তিনি শুধু নারী বা পুরুষ না হয়ে মানুষ হয়ে থাকেন এবং অন্যের দুঃখ-কষ্টে সমব্যথী হন। তবে আমাদের সমাজে এখনো বেশ কিছু ক্ষেত্রে অপরাধের অভিযোগ উঠলে উল্টো অপরাধের শিকারকেই কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা চলে। এমন একটি সমাজ আর কত দিন অপরাধীকে আড়াল করার কাজ করে যাবে? 

হ্যাঁ, শিরোনাম দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, অপরাধ বলতে আসলে নারী নির্যাতনকেই বোঝানো হচ্ছে। আর নারীদের প্রতি নিপীড়নের ক্ষেত্রে অগ্রভাগে আছে যৌন নির্যাতন ও হয়রানি। নারীদের প্রতি এমন অপরাধের বিষয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে এই সমাজে একটি নির্দিষ্ট ঘরানার দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেটি হলো, ভিকটিমের ‘ত্রুটি’ খুঁজে বের করার চেষ্টা। সেটি এতটাই প্রবলভাবে করা হয় যে, কখনো কখনো ওই ঘরানার আলোচনায় ঢুকলে মনে হতে পারে, ‘ঠিকই আছে, ধর্ষণই তো করা উচিত’! 

অর্থাৎ, নারীর প্রতি ধর্ষণের মতো একটি চূড়ান্ত মাত্রার অপরাধের পক্ষে একধরনের সাফাই গাওয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজে প্রবলভাবে বিদ্যমান। এটি হয়তো আগেও ছিল। বর্তমানে মার্ক জাকারবার্গ নিজের যেকোনো ধরনের মতামত প্রকাশের ‘সুযোগ’ করে দেওয়ায়, সেটি চোখে পড়ছে বেশি।

একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষদের একটি বড় অংশই এমন কার্যকলাপে অংশ নেবে, সেটি অস্বাভাবিক নয়। বিশ্বজুড়ে ধর্ষণের ইতিহাস বেশ লম্বা। সব সময়ই এ ধরনের মনোভাব, ধর্ষণের ঘটনাকে অপরাধের মাত্রায় লঘু হিসেবে দেখানো এবং ধর্ষকের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। যখন থেকে ইতিহাস লেখা শুরু হয়েছে, সেই প্রাচীন গ্রিসের সময় থেকে শুরু করে এই ঘৃণ্য অপরাধের বর্ণনা বা লিপিবদ্ধ করার কাজটি মূলত পুরুষেরাই করে গেছে। ফলে বিতর্ক আছেই যে, আদতেই নারীর প্রতি নিপীড়নের সঠিক ইতিহাস আমরা জানি কি না। কারণ, একজন পুরুষ তাঁর বা তাঁর সম্বন্ধীয় অপরাধ বেশ কিছুটা লঘু করে শোনাবেন, সেটি ভেবে নেওয়াই তো স্বাভাবিক। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসের অধ্যাপক শ্যারন ব্লক এক নিবন্ধে বলেছিলেন, ‘নারীদের সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় সেসব ধর্ষণের ঘটনাকেই ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে, যেগুলোয় পুরুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ অর্থাৎ, নিজে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে পুরুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি ধর্ষণের ঘটনায় উদাসীন আচরণ করেছে। ঠিক যেমনটা এ দেশে ঘটে। নারীর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে, প্রথমেই তার চরিত্র নিয়ে টানাটানি করা শুরু হয়। চলে নানামুখী বিশ্লেষণ। ভাব দেখে মনে হয়, যাঁরা টানাটানিটা করছেন, তাঁদের চরিত্র পুষ্পময়!

আলোচনা করা যাবে না, তা নয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে অন্তত অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত—দুই পক্ষের প্রতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের সমাজে সেটা একপেশে হয়ে থাকে। তাই কোনো নারী হয়রানি ও অপরাধের শিকার হলে, শুরুতেই প্রশ্ন তোলা হয়, ‘উনি সেখানে ওই সময় গেল কেন?’ 

এবার এমন সামাজিক প্রবণতার সঙ্গে বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নিপীড়নের ঘটনার সংখ্যা মেলান। এ দেশে এই হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। শুধু ধর্ষণের প্রসঙ্গে আসি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ২৪৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর মারা গেছেন ৪৬ জন। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। আর এর বাইরে ধর্ষণচেষ্টা হয়েছে আরও ২৮৬ জন নারীর ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, ধর্ষণের মতো অপরাধ করার (সেটি সফল হোক বা ব্যর্থ) ঘটনা দেড় হাজারের বেশি, তা-ও ১১ মাসে। পুরো বছরের পরিসংখ্যানে তা আরও বাড়বে বৈ কমবে না। 

সহস্রাধিক ধর্ষণের ঘটনা এবারই কিন্তু প্রথম নয়। গত বছরও দেশে ধর্ষণের ঘটনা এমনই ছিল। অথচ ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা থাকলেও প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে আসছে, কখনো কখনো জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হচ্ছে। আর তখনই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কুৎসিত রূপ নিজ মহিমায় নখদন্ত নিয়ে হাজির হয়। এবং বুঝিয়ে দেয়, কেন এ সমাজে ধর্ষণ বন্ধ হয় না। কারণ, সমাজে অনেকেই আছেন, যাঁদের মন্তব্য শুনলে মনে হয়, সুযোগের অভাবেই তাঁরা ধর্ষক নন! 

প্রশ্ন তোলাই যায় যে, কই দেখলেন এত সম্ভাব্য ধর্ষক? উত্তর জানতে স্রেফ একটি কাজ করুন। আপনার পরিবারের মা-বোন-স্ত্রী ও অন্য নারী সদস্যদের শুধু একটিবার জিজ্ঞেস করুন, তাঁরা রাস্তাঘাটে কত ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হন? কী সংখ্যক কটু মন্তব্য শোনেন? কতবার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পথচারী পুরুষেরা শরীরে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেন? বিশ্বাস করুন, এসবের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। এ দেশের নারীরা সেগুলো মুখ ফুটে বলেন না। তবে প্রত্যেক নারীর মনে এসব তিক্ত ও অপমানজনক অভিজ্ঞতা ঘাপটি মেরে থাকে। এ ধরনের হয়রানির কোনো ‘কারণ’ আপনি খুঁজে পাবেন না, যেগুলোকে আশ্রয় করে পুরুষের দোষ লঘু করে দেখাতে পারবেন। সেসব শোনার পরও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বা বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় ভিকটিমের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে পারেন কি না, পরীক্ষা করে দেখবেন। বুঝে যাবেন, সম্ভাব্য ধর্ষকের সংখ্যা আসলে কত! 

সম্প্রতি ওঠা কক্সবাজারে পর্যটক ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়টিও একটু ভেবে দেখুন। সেখানে অভিযোগ করা নারীর ‘চরিত্র’ নিয়ে আঙুল তোলা হয়েছে। পুলিশ যেমন কিছু বক্তব্য দিয়েছে, তেমনি কিছু সংবাদমাধ্যম তা নিয়ে সংবাদও প্রচার করেছে। তা করা যেতেই পারে। তবে সেসবের উপস্থাপন ছিল অনেকটাই অভিযোগবিরোধী। কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ একেবারে খারিজ করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। অপরাধের নানান মাত্রা থাকতেই পারে, অভিযোগ মিথ্যাও হতে পারে। কিন্তু কক্সবাজারের ঘটনায় একপর্যায়ে অভিযুক্ত বিভিন্ন সময় অপরাধ করেছেন, তা স্বীকার করেই অভিযোগকারীর দিকে আঙুল তোলার চেষ্টা দেখা গেছে এবং তাঁর অভিযোগের ফাঁকফোকর ফলাও করে প্রচারের কাজ করা হয়েছে। অন্তত যে সমাজে বছরে সহস্রাধিক ধর্ষণের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসে, সেই সমাজে ধর্ষণের অভিযোগ করার ক্ষেত্রে এটি ভবিষ্যতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, তখন অভিযোগ করার আগেই একজন ভিকটিম মনে করতে পারেন, তাতে তো ঝামেলাই বেশি। ফলে অনেক ঘটনায় ন্যায়বিচার চাওয়ার আবেদন কমে আসতে পারে। এতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর প্রতি সাধারণ নাগরিকের আস্থাহীনতা তৈরি হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। 

এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে যে, নারী নির্যাতনের সাফাই গাওয়া আমাদের অস্বস্তিকর সামাজিক প্রবণতা জাতীয় জীবনেও প্রবেশ করছে কি না। যদি তা-ই হয়, তবে হয়তো সামনের বছরের শেষেও সহস্রাধিক ধর্ষণের পরিসংখ্যান নিয়ে সালতামামি লিখে যেতে হবে। সংখ্যা তখন ধর্ষণের পরিমাণ জানাবে ঠিকই, কিন্তু আপনাকে-আমাকে আর বদলাতে পারবে না; বরং সবাই ধীরে ধীরে হয়ে উঠবে সুযোগের অভাবে ‘ভালো মানুষ’। আর ধর্ষণের ঘটনা সামনে এলে শুধু দেখা যাবে হাততালির উৎসব! 

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত