বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
হাতিরপুলের একটি চায়নিজ রেস্তোরাঁয় অনুষ্ঠান। এক সাংবাদিক বন্ধুর মেয়ের জন্মদিন। অতিথিদের বেশির ভাগই সাংবাদিক, বিশেষ করে অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদক।
কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাও আছেন, সঙ্গে অতিরিক্ত আইজিপি আবদুর রহিম খান। খাওয়া-দাওয়া চলছে। হঠাৎ ১০-১২ জন লোক হুড়োহুড়ি করে ঢুকে পড়লেন রেস্তোরাঁর ভেতরে। তাঁদের একজন উচ্চ স্বরে আমার সেই বন্ধুর নাম ধরে ডাকলেন, `…দেখেন ভাই, মিলন ভাই এসেছে।’ একটু পরে আমাদের সামনে হাজির হলেন সেই ‘মিলন ভাই’—হুমায়ুন কবির মিলন, যাকে সবাই চিনত ‘মুরগি মিলন’ নামে।
অতিথিরা কিছুটা বিরক্ত, এ রকম একটা অনুষ্ঠানে সন্ত্রাসী কেন? ঘটনা পরিষ্কার করলেন মিলন নিজেই। বললেন, তাঁকে কেউ দাওয়াত দেয়নি। অনুষ্ঠানের কথা শুনে নিজেই দলবল নিয়ে হাজির হয়েছেন। এলাকার লোক হিসেবে তাঁর তো একটা দায়িত্ব আছে।
‘দায়িত্ববান’ এই লোকটি একসময় নিজ দায়িত্বে ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়াতেন। চলতেন দলেবলে গাড়ি হাঁকিয়ে, আগে-পিছে অস্ত্রসমেত পাহারা নিয়ে। বছরে দু-তিনবার গ্রেপ্তার হয়ে সংবাদপত্রের শিরোনামও হতেন। বিমানবন্দর থেকে সূত্রাপুর–সবই ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে। আর ছিল একটা রাজনৈতিক পরিচয়, কিন্তু তাতে কোনো সামাজিক স্বীকৃতির মোড়ক ছিল না।
ইস্কাটন থেকে বাংলামোটরের দিকে যেতে হাতের বাঁয়ে হেলেনা সেন্টার। সেখানে এখন মোটর পার্টসের বড় বড় দোকান। সেই মার্কেটের পেছনে একটি ঘর ছিল সন্ত্রাসী লিয়াকতের ব্যক্তিগত কার্যালয়। প্রতিদিন বিকেলে মিলনও সেখানে আসতেন। তার চলাফেরায় কোনো রাখঢাক ছিল না। অপরাধ বিটের প্রায় সব রিপোর্টারকে তিনি চিনতেন, ডাকতেন বেশ সম্মান করে।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যেসব সন্ত্রাসী ঢাকা শহর কাঁপাতেন, তাঁদের অনেকেই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নিজেদের যুবলীগ-ছাত্রলীগ বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। বাহিনী তৈরি করে তাঁরাও রীতিমতো এলাকা দখলে মেতে ওঠেন। বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত সন্ত্রাসীরাও তখন দলবদল করে ফেলেন। এই সময়ে যেসব সন্ত্রাসীর উত্থান হয়, তাঁদেরই একজন হলেন মুরগি মিলন।
স্বাধীনতার পর মুরগি মিলন প্রভাবশালী নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টু ও হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গের ঘনিষ্ঠ হন। ১৯৭৮ সালের দিকে এলিফ্যান্ট রোডে জুতার দোকান দেন। পরে তিনি মার্কেট ও তৈরি পোশাকের প্রতিষ্ঠান করেন। একবার মুরগি মিলন আমাকে বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ২৩ এপ্রিল চোরাচালানের মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল।
মুরগি মিলনের জন্ম মুন্সিগঞ্জে হলেও থাকতেন রাজধানীর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। দুই ভাই। বাবা তাজুল ইসলাম হাতিরপুলে মুরগির ব্যবসা করতেন। ১৮ বছর পর্যন্ত মিলন সেই ব্যবসা দেখাশোনা করেন। সে কারণে বড় হয়েও তাঁর নামের সঙ্গে ‘মুরগি’ শব্দটি লেপ্টে যায়।
মুরগি মিলনের স্ত্রী নাসরিন কবির ডলির বাবা ছিলেন সাবেক জেলা জজ। তো জজ সাহেব তাঁর মেয়েকে এমন ‘সুপাত্রে’র হাতে তুলে দেবেন না। তিনি মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করলেন। খবর পেয়ে মুরগি মিলন ডলিকে বাড়ি থেকে তুলে এনে বিয়ে করেন।
মুরগি মিলন মোট কতবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তা মনে নেই, তবে প্রতি বছর তিনি দু-তিনবার গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যেতেন। এরপর জামিনে বেরিয়ে এসে ঘুরে বেড়াতেন। তবে কখনো একা চলাফেরা করতেন না। তাঁর বিরুদ্ধে সে সময় ১৬-১৭টি মামলা ছিল, যার প্রায় সবই চোরাচালানের। পুলিশ কর্মকর্তারা বলতেন, তিনি ছিলেন স্বর্ণ চোরাচালানের রিং লিডার। তাঁর প্রধান কাজ ছিল বিমানবন্দরে আসা সোনার চালান নিরাপদে ছাড়িয়ে এনে সীমান্ত পার করে দেওয়া। এই সোনায় লগ্নি করতেন ভারতের কয়েকজন ব্যবসায়ী। ভারত থেকে গরুর যে চালান আসত, তার সঙ্গে সোনার দামের সমন্বয় করা হতো। অর্থাৎ, সোনার বদলে গরু আসত ওপার থেকে।
সোনা পাচারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিমানবন্দর এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখা। তবে পাচার হয়ে সোনা যেহেতু প্রথমে তাঁতীবাজারে আসত, সে কারণে তাঁতীবাজারের নিয়ন্ত্রণও বড় ব্যাপার ছিল। এই নিয়ন্ত্রণ নিয়েই মুরগি মিলনের সঙ্গে বিরোধ বাধে কালা জাহাঙ্গীর ও টোকাই সাগরের। একপর্যায়ে কালা জাহাঙ্গীর তাঁতীবাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে চান, আর টোকাই সাগর চাইলেন বিমানবন্দরের। দুজনের স্বার্থ মিলে গেলে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ান মুরগি মিলন। এরপর তাঁরা মুরগি মিলনকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সেটাও সহজ ছিল না। মুরগি মিলন সব সময় পাহারায় চলতেন। তাঁকে কিছু করতে হলে বিশাল আয়োজন দরকার। ২০০০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, ক্যান্টনমেন্ট থানার একটি চোরাচালান মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে যান মুরগি মিলন। তারপর আর বেঁচে ফেরা হয়নি তাঁর।
মুরগি মিলনের লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে আনার পর আওরঙ্গ ও লিয়াকতের শত শত অনুসারী ছুটে আসেন। মিলনের স্ত্রী টোকাই সাগরকে প্রধান আসামি করে মামলা করেন, কিন্তু পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি। এ ঘটনার পর সপরিবারে আমেরিকায় পাড়ি জমান টোকাই সাগর। এখন তিনি সেখানেই আছেন।
মুরগি মিলনের পরিবার অবশ্য ঢাকাতেই ছিল। মৃত্যুর সময় তিনি বিপুল সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য রেখে গেলেও কোনো উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেননি। নাসরিন কবিরের সঙ্গে তাঁর ১৬ বছেরর সংসারে কোনো সন্তান ছিল না। মুরগি মিলন নিহত হলে তাঁর বিপুল সম্পত্তি চলে যায় স্ত্রী নাসরিনের নিয়ন্ত্রণে। মিলনের তিন ভাই ও এক বোন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন।
মিলন নিহত হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে থাকা ১৭টি মামলা ও ৩৩টি জিডির তদন্ত নথিভুক্ত (বিচার স্থগিত) হয়ে যায়। পুলিশও ঝেড়ে-মুছে ফাইল গুটিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পর আদালতে দায়ের করা একটি নালিশি মামলা নিয়ে হঠাৎ সবাই নড়েচড়ে বসেন। মামলাটি করেন মিলনের স্ত্রী নাসরিন কবির ওরফে ডলির মা ছালেহা খানম। মামলাটি হয় ২০১৪ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। এতে বলা হয়, মুরগি মিলন নিহত হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী নাসরিন বিয়ে করেন মাহবুবুর রহমান সর্দার নামের এক ব্যক্তিকে। তাঁদের একটি ছেলেও রয়েছে। কিন্তু সম্পত্তির লোভে মাহবুবুর রহমান শরীরে বিষাক্ত ইনজেকশন প্রয়োগ করে হত্যা করেন নাসরিনকে।
নাসরিন মারা যাওয়ার ৩৪ দিনের মাথায় কাউকে কিছু না জানিয়ে আদালতের মাধ্যমে সব সম্পত্তি নাবালক সন্তানের নামে হস্তান্তর করিয়ে নেন মাহবুব। এরপর তিনি সেই নাবালকের অভিভাবক হয়ে সব সম্পত্তি ভোগ করতে থাকেন। ওই সম্পদের মধ্যে উত্তরায় পাঁচ কাঠা জমি, পুরানা পল্টনে ফ্ল্যাট ও হাতিরপুলে ইস্টার্ন প্লাজার পাশে বেলভিউ নামে নয়তলা একটি বাণিজ্যিক ভবন আছে, যে ভবন থেকে মাসে ভাড়াই আসে আট লাখ টাকা।
আদালতে করা মামলায় ছালেহা খানম মাহবুবের ভাই খোকন সর্দার ও নাসরিন যে হাসপাতালে মারা যান, সেই হাসপাতালের চিকিৎসক সালেহ আহমদকেও আসামি করেন। এই মামলার তদন্ত নেমে পিবিআই অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু অনেক দিনের ঘটনা হওয়ায় বাদীর অভিযোগের সপক্ষে সব তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি তারা। সে কারণে বাদীর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে আদালতে প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। সেই মামলা এখনো হাইকোর্টে চলছে।
এই মামলা নিয়ে আমি একবার বাদী-বিবাদীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলতে চাননি। তবে দুই পক্ষের সবাই এ নিয়ে রহস্যময় নীরবতা পালন করলেও নির্মম বাস্তবতা হলো, ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে মিলন যে বিপুল সম্পত্তি করেছিলেন, তার কিছুই তিনি ভোগ করতে পারেননি। রেখে যেতে পারেননি উত্তরাধিকার। এখন সেই সম্পদ চলে গেছে অন্যের হাতে। তারাই ভোগ করছে মুরগি মিলনের শত কোটি টাকার সম্পদ। এরই নামই হয়তো বিধির বিধান।
আরও পড়ুন:
হাতিরপুলের একটি চায়নিজ রেস্তোরাঁয় অনুষ্ঠান। এক সাংবাদিক বন্ধুর মেয়ের জন্মদিন। অতিথিদের বেশির ভাগই সাংবাদিক, বিশেষ করে অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদক।
কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাও আছেন, সঙ্গে অতিরিক্ত আইজিপি আবদুর রহিম খান। খাওয়া-দাওয়া চলছে। হঠাৎ ১০-১২ জন লোক হুড়োহুড়ি করে ঢুকে পড়লেন রেস্তোরাঁর ভেতরে। তাঁদের একজন উচ্চ স্বরে আমার সেই বন্ধুর নাম ধরে ডাকলেন, `…দেখেন ভাই, মিলন ভাই এসেছে।’ একটু পরে আমাদের সামনে হাজির হলেন সেই ‘মিলন ভাই’—হুমায়ুন কবির মিলন, যাকে সবাই চিনত ‘মুরগি মিলন’ নামে।
অতিথিরা কিছুটা বিরক্ত, এ রকম একটা অনুষ্ঠানে সন্ত্রাসী কেন? ঘটনা পরিষ্কার করলেন মিলন নিজেই। বললেন, তাঁকে কেউ দাওয়াত দেয়নি। অনুষ্ঠানের কথা শুনে নিজেই দলবল নিয়ে হাজির হয়েছেন। এলাকার লোক হিসেবে তাঁর তো একটা দায়িত্ব আছে।
‘দায়িত্ববান’ এই লোকটি একসময় নিজ দায়িত্বে ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়াতেন। চলতেন দলেবলে গাড়ি হাঁকিয়ে, আগে-পিছে অস্ত্রসমেত পাহারা নিয়ে। বছরে দু-তিনবার গ্রেপ্তার হয়ে সংবাদপত্রের শিরোনামও হতেন। বিমানবন্দর থেকে সূত্রাপুর–সবই ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে। আর ছিল একটা রাজনৈতিক পরিচয়, কিন্তু তাতে কোনো সামাজিক স্বীকৃতির মোড়ক ছিল না।
ইস্কাটন থেকে বাংলামোটরের দিকে যেতে হাতের বাঁয়ে হেলেনা সেন্টার। সেখানে এখন মোটর পার্টসের বড় বড় দোকান। সেই মার্কেটের পেছনে একটি ঘর ছিল সন্ত্রাসী লিয়াকতের ব্যক্তিগত কার্যালয়। প্রতিদিন বিকেলে মিলনও সেখানে আসতেন। তার চলাফেরায় কোনো রাখঢাক ছিল না। অপরাধ বিটের প্রায় সব রিপোর্টারকে তিনি চিনতেন, ডাকতেন বেশ সম্মান করে।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যেসব সন্ত্রাসী ঢাকা শহর কাঁপাতেন, তাঁদের অনেকেই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নিজেদের যুবলীগ-ছাত্রলীগ বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। বাহিনী তৈরি করে তাঁরাও রীতিমতো এলাকা দখলে মেতে ওঠেন। বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত সন্ত্রাসীরাও তখন দলবদল করে ফেলেন। এই সময়ে যেসব সন্ত্রাসীর উত্থান হয়, তাঁদেরই একজন হলেন মুরগি মিলন।
স্বাধীনতার পর মুরগি মিলন প্রভাবশালী নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টু ও হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গের ঘনিষ্ঠ হন। ১৯৭৮ সালের দিকে এলিফ্যান্ট রোডে জুতার দোকান দেন। পরে তিনি মার্কেট ও তৈরি পোশাকের প্রতিষ্ঠান করেন। একবার মুরগি মিলন আমাকে বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ২৩ এপ্রিল চোরাচালানের মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল।
মুরগি মিলনের জন্ম মুন্সিগঞ্জে হলেও থাকতেন রাজধানীর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। দুই ভাই। বাবা তাজুল ইসলাম হাতিরপুলে মুরগির ব্যবসা করতেন। ১৮ বছর পর্যন্ত মিলন সেই ব্যবসা দেখাশোনা করেন। সে কারণে বড় হয়েও তাঁর নামের সঙ্গে ‘মুরগি’ শব্দটি লেপ্টে যায়।
মুরগি মিলনের স্ত্রী নাসরিন কবির ডলির বাবা ছিলেন সাবেক জেলা জজ। তো জজ সাহেব তাঁর মেয়েকে এমন ‘সুপাত্রে’র হাতে তুলে দেবেন না। তিনি মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করলেন। খবর পেয়ে মুরগি মিলন ডলিকে বাড়ি থেকে তুলে এনে বিয়ে করেন।
মুরগি মিলন মোট কতবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তা মনে নেই, তবে প্রতি বছর তিনি দু-তিনবার গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যেতেন। এরপর জামিনে বেরিয়ে এসে ঘুরে বেড়াতেন। তবে কখনো একা চলাফেরা করতেন না। তাঁর বিরুদ্ধে সে সময় ১৬-১৭টি মামলা ছিল, যার প্রায় সবই চোরাচালানের। পুলিশ কর্মকর্তারা বলতেন, তিনি ছিলেন স্বর্ণ চোরাচালানের রিং লিডার। তাঁর প্রধান কাজ ছিল বিমানবন্দরে আসা সোনার চালান নিরাপদে ছাড়িয়ে এনে সীমান্ত পার করে দেওয়া। এই সোনায় লগ্নি করতেন ভারতের কয়েকজন ব্যবসায়ী। ভারত থেকে গরুর যে চালান আসত, তার সঙ্গে সোনার দামের সমন্বয় করা হতো। অর্থাৎ, সোনার বদলে গরু আসত ওপার থেকে।
সোনা পাচারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিমানবন্দর এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখা। তবে পাচার হয়ে সোনা যেহেতু প্রথমে তাঁতীবাজারে আসত, সে কারণে তাঁতীবাজারের নিয়ন্ত্রণও বড় ব্যাপার ছিল। এই নিয়ন্ত্রণ নিয়েই মুরগি মিলনের সঙ্গে বিরোধ বাধে কালা জাহাঙ্গীর ও টোকাই সাগরের। একপর্যায়ে কালা জাহাঙ্গীর তাঁতীবাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে চান, আর টোকাই সাগর চাইলেন বিমানবন্দরের। দুজনের স্বার্থ মিলে গেলে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ান মুরগি মিলন। এরপর তাঁরা মুরগি মিলনকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সেটাও সহজ ছিল না। মুরগি মিলন সব সময় পাহারায় চলতেন। তাঁকে কিছু করতে হলে বিশাল আয়োজন দরকার। ২০০০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, ক্যান্টনমেন্ট থানার একটি চোরাচালান মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে যান মুরগি মিলন। তারপর আর বেঁচে ফেরা হয়নি তাঁর।
মুরগি মিলনের লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে আনার পর আওরঙ্গ ও লিয়াকতের শত শত অনুসারী ছুটে আসেন। মিলনের স্ত্রী টোকাই সাগরকে প্রধান আসামি করে মামলা করেন, কিন্তু পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি। এ ঘটনার পর সপরিবারে আমেরিকায় পাড়ি জমান টোকাই সাগর। এখন তিনি সেখানেই আছেন।
মুরগি মিলনের পরিবার অবশ্য ঢাকাতেই ছিল। মৃত্যুর সময় তিনি বিপুল সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য রেখে গেলেও কোনো উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেননি। নাসরিন কবিরের সঙ্গে তাঁর ১৬ বছেরর সংসারে কোনো সন্তান ছিল না। মুরগি মিলন নিহত হলে তাঁর বিপুল সম্পত্তি চলে যায় স্ত্রী নাসরিনের নিয়ন্ত্রণে। মিলনের তিন ভাই ও এক বোন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন।
মিলন নিহত হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে থাকা ১৭টি মামলা ও ৩৩টি জিডির তদন্ত নথিভুক্ত (বিচার স্থগিত) হয়ে যায়। পুলিশও ঝেড়ে-মুছে ফাইল গুটিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পর আদালতে দায়ের করা একটি নালিশি মামলা নিয়ে হঠাৎ সবাই নড়েচড়ে বসেন। মামলাটি করেন মিলনের স্ত্রী নাসরিন কবির ওরফে ডলির মা ছালেহা খানম। মামলাটি হয় ২০১৪ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। এতে বলা হয়, মুরগি মিলন নিহত হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী নাসরিন বিয়ে করেন মাহবুবুর রহমান সর্দার নামের এক ব্যক্তিকে। তাঁদের একটি ছেলেও রয়েছে। কিন্তু সম্পত্তির লোভে মাহবুবুর রহমান শরীরে বিষাক্ত ইনজেকশন প্রয়োগ করে হত্যা করেন নাসরিনকে।
নাসরিন মারা যাওয়ার ৩৪ দিনের মাথায় কাউকে কিছু না জানিয়ে আদালতের মাধ্যমে সব সম্পত্তি নাবালক সন্তানের নামে হস্তান্তর করিয়ে নেন মাহবুব। এরপর তিনি সেই নাবালকের অভিভাবক হয়ে সব সম্পত্তি ভোগ করতে থাকেন। ওই সম্পদের মধ্যে উত্তরায় পাঁচ কাঠা জমি, পুরানা পল্টনে ফ্ল্যাট ও হাতিরপুলে ইস্টার্ন প্লাজার পাশে বেলভিউ নামে নয়তলা একটি বাণিজ্যিক ভবন আছে, যে ভবন থেকে মাসে ভাড়াই আসে আট লাখ টাকা।
আদালতে করা মামলায় ছালেহা খানম মাহবুবের ভাই খোকন সর্দার ও নাসরিন যে হাসপাতালে মারা যান, সেই হাসপাতালের চিকিৎসক সালেহ আহমদকেও আসামি করেন। এই মামলার তদন্ত নেমে পিবিআই অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু অনেক দিনের ঘটনা হওয়ায় বাদীর অভিযোগের সপক্ষে সব তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি তারা। সে কারণে বাদীর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে আদালতে প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। সেই মামলা এখনো হাইকোর্টে চলছে।
এই মামলা নিয়ে আমি একবার বাদী-বিবাদীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলতে চাননি। তবে দুই পক্ষের সবাই এ নিয়ে রহস্যময় নীরবতা পালন করলেও নির্মম বাস্তবতা হলো, ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে মিলন যে বিপুল সম্পত্তি করেছিলেন, তার কিছুই তিনি ভোগ করতে পারেননি। রেখে যেতে পারেননি উত্তরাধিকার। এখন সেই সম্পদ চলে গেছে অন্যের হাতে। তারাই ভোগ করছে মুরগি মিলনের শত কোটি টাকার সম্পদ। এরই নামই হয়তো বিধির বিধান।
আরও পড়ুন:
রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
১৭ দিন আগেপরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
১৭ দিন আগেরাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় গত দুই মাসে দুই অটোরিকশা চালককে হত্যা করে রিকশা ছিনিয়ে নেওয়া ঘটনা ঘটেছে। পৃথক এই দুই ঘটনায় তদন্তে নেমে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
১৮ দিন আগেপাবনার পদ্মা নদী থেকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ১২ বছরের এক কিশোর এবং ২২ বছরের এক তরুণীর অর্ধগলিত দুইটি মরদেহ উদ্ধার করেছে নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি। উদ্ধারের দুইদিনেও কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। রোববার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাইদুর রহমান।
২১ দিন আগে