জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজও কাঁদছেন ছাব্বিরের মা

চিতলমারী (বাগেরহাট) প্রতিনিধি 
আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩: ৩৯
Thumbnail image
কলেজছাত্র ছাব্বির ইসলাম শাকিবের ছবি হাতে মা কাকলী বেগম। ছবি: আজকের পত্রিকা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের নামের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গেজেট প্রকাশের তারিখ বুধবার (১৫ জানুয়ারি) লেখা হলেও এটি প্রকাশ্যে এসেছে বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি)। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হরিদাস ঠাকুর স্বাক্ষরিত গেজেটটিতে শহীদদের মেডিকেল কেস আইডি, নাম, বাবার নাম, বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

শহীদদের এই তালিকায় উঠে এসেছে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার হিজলা গ্রামের কলেজছাত্র ছাব্বির ইসলাম শাকিবের (২১) নাম। ছাব্বির ওই গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য মো. শহিদুল্লাহ মল্লিক ও গৃহিণী কাকলী বেগমের একমাত্র পুত্র। আর একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজও চোখের পানি ঝরছে সাব্বিরের মা কাকলী বেগমের। ছাবিরের গেজেট নম্বর ১০৫। মেডিকেল কেস আইডি ৯৬৬৩।

আজ শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) দুপুরে ছাব্বির সম্পর্কে তাঁর বড় বোন শারমিন আক্তার বলেন, ‘ছাব্বির চিতলমারী শেরেবাংলা ডিগ্রি কলেজের ছাত্র ছিল। ছাত্রজীবন থেকেই সে মনেপ্রাণে বিএনপি করত। ছাব্বির ছিল শেরেবাংলা কলেজ ছাত্রদলের সক্রিয় সদস্য। শত বাধা পেরিয়ে সে বিএনপির ডাকা উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের প্রতিটি মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করত। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনী ও তাঁর লোকজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ওই সময় ছাব্বিরের এইচএসসি পরীক্ষা চলছিল।’

শারমিন আক্তার বলেন, ‘১৪ জুলাই পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা দিয়ে বিকেলে সে বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। রাতে আমার (শারমিনের) বাসায় টঙ্গীতে ওঠে। পরদিন আন্দোলনে যোগ দিতে চেষ্টা করলে আমরা তাকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করি। কিন্তু সব চাপ উপেক্ষা করে ১৯ জুলাই (শুক্রবার) সকাল ১০টায় ভাগনে-ভাগনিদের জন্য পাশের দোকান থেকে মোজো ও চিপস কিনে আনার কথা বলে সরাসরি উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনে চলে যায়। ওখানে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে দিনভর বিক্ষোভে অংশ নেয়। বিক্ষোভকালীন সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে পুলিশের ৫টি গুলি ছাব্বিরকে ঝাঁজরা করে।’

শারমিন আরও বলেন, ‘সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমার বাবার ফোনে জানতে পারি, ভাই ছাব্বির গুলিতে মারা গেছে। পাগলের মতো ছুটে যাই ভাইয়ের খোঁজে। সেখানে গিয়ে দেখি, গুলিতে ঝাঁজরা ভাইয়ের রক্তমাখা নিথর দেহ পড়ে আছে। ডাক্তার বলেন, আপনার ভাই মারা গেছে, দ্রুত লাশ নিয়ে যান।’

ছাব্বির ইসলাম শাকিবের কবরস্থান। ছবি: আজকের পত্রিকা
ছাব্বির ইসলাম শাকিবের কবরস্থান। ছবি: আজকের পত্রিকা

শারমিন আরও জানান, তাঁরা যখন গাড়িতে করে লাশ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন, তখন পথে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের লোকেরা লাশবাহী গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে লাশ অন্য একটা গাড়িতে উঠিয়ে রাত সাড়ে ৩টায় গ্রামের বাড়িতে আসেন। তিনি বলেন, ‘লাশ আনার পর আমাদের পরিবারসহ গ্রামবাসীকেও একনজর দেখার সুযোগ দেওয়া হয়নি। লাশ দাফনের জন্য মাত্র ৪০ মিনিট সময় বেঁধে দিয়েছিল। আমরা এ হত্যার বিচার চাই।’

গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ছাব্বিরের মা বলেন, ‘যার সন্তান হারায়নি, সে সন্তান হারানোর যন্ত্রণা বুঝবে না। এখনো শুনতে পাই, ছাব্বির আমাকে মা মা বলে ডাকছে। কিন্তু আমার বাবা তো চলে গেছে অনেক দূরে।’

সরকারি এই গেজেট অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন ৮৩৪ জন। প্রত্যেকের নামের পাশে মেডিকেল কেস আইডি অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা করা হয়েছে।

এদিকে শহীদ ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে শিগগির ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর’ করতে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

৮৩৪ জন নিহতের পাশাপাশি এই অভ্যুত্থানে আহত হয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার ছাত্র-জনতা। মূলত এই গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতি রক্ষা করতে এবং আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে কাজ করবে নতুন অধিদপ্তর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত