শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকিতে ৩০% স্কুলশিক্ষার্থী

কূটনৈতিক প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২১, ২০: ০২
আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০২১, ২০: ২৮

শিক্ষা খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে শিক্ষণ ঘাটতি ও মানসিক স্বাস্থ্যহানি এই দুই সমস্যাকে আমলে নেওয়া জরুরি। করোনা মহামারির কারণে দেশব্যাপী দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় দেশের গ্রাম ও শহরের বস্তি এলাকায় করা একটি জরিপে দেখা গেছে, কমপক্ষে ২২ শতাংশ প্রাথমিক এবং ৩০ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে। 

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। 

আজ সোমবার দুপুরে এক ওয়েবিনারে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন গবেষণার ফল প্রকাশ করেন। 

করোনার প্রভাব নিয়ে পিপিআরসি এবং বিআইজিডি ‘কোভিড-১৯ লাইভলিহুড অ্যান্ড রিকভারি প্যানেল সার্ভে’ নিয়ে কাজ করে আসছে। এরই অংশ হিসেবে এই জরিপ চালানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল ২০২১ সালের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত শিশুদের শিক্ষাজীবনে কী কী পরিবর্তন এসেছে তা জানা। এরপর একটি শিক্ষণ মডিউল তৈরি করা হয়। 

প্রথম জরিপটি করা হয় ২০২১ সালের মার্চে, পরেরটি একই বছরের আগস্টে। গবেষণার এই সময়কাল পুনরায় স্কুল খোলার যে বাস্তবতা, সে ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে বলে উল্লেখ করছেন গবেষণা সংশ্লিষ্টরা।

সোজা কথায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক যা বলেন বা করেন তা হলো শিক্ষণ, আর শিক্ষার্থীরা যা গ্রহণ করে তাকে বলে শিখন। অর্থাৎ, শিখন হলো একটি নির্দিষ্ট প্রসঙ্গের শিক্ষণের ফল। আর শিক্ষণ হলো শিক্ষার্থীদের শিখন সহায়তায় বৈজ্ঞানিক তথ্য ও কৌশলসমূহের সার্থক সমন্বয়ে ব্যক্ত শিক্ষকনির্ভর প্রক্রিয়া। 

গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার প্রভাবে গত ছয় মাসে শিক্ষাক্ষেত্রে আরও অবনতি হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী নিজে নিজেই পড়াশোনা করে, কেউ কেউ অনিয়মিতভাবে পড়াশোনা করে, অথবা একেবারেই পড়াশোনা করে না। গবেষকদের মতে, এমন শিক্ষার্থীরাই আছে শিক্ষণ ঘাটতি বা লার্নিং লসের ঝুঁকিতে। 

শিক্ষণ ঘাটতির এই সমস্যার পেছনে আর্থসামাজিক অসমতার একটি ভূমিকা রয়েছে বলে পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন গবেষকেরা। এর কারণ প্রথমত, একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষণ ঘাটতির সঙ্গে তার মায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার সম্পর্ক দেখা হয়। তাতে দেখা গেছে, যে মায়েরা কখনো স্কুলে যাননি, তাঁদের সন্তানেরা শিক্ষিত মায়ের সন্তানের তুলনায় বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, গৃহশিক্ষক কিংবা কোচিং সুবিধা করোনা মহামারির আগেও পেয়েছে এমন শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই মহামারি চলাকালীনও সেই সুযোগ পেয়েছে। তৃতীয়ত, গ্রামে ৪৪ শতাংশ পরিবারে এবং শহরের বস্তিতে ৩৬ শতাংশ পরিবারে অনলাইন শিক্ষা গ্রহণের জন্য যে উপকরণ দরকার, তার ব্যবস্থা নেই। চতুর্থত, ৮ শতাংশের বেশি স্কুলগামী শিক্ষার্থী উভয় সময়েই উপার্জনের জন্য কাজ করেছে। দেখা যাচ্ছে, মহামারি দেশের শিক্ষায় যে বৈষম্য তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। যদিও এ দেশে ব্যাপারটি আগে থেকেই একটি বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল। 

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, আগের মতো সবকিছু চালু হওয়ায় ও জীবিকার তাগিদে কাজে যোগ দেওয়ার কারণে মার্চের তুলনায় পরবর্তীতে শিক্ষা খাতে পরিবার থেকে সহায়তার হারও কমেছে। বিশেষত, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাই এর ভুক্তভোগী। অবশ্য আগস্টে সরাসরি যোগাযোগ করে বা, সরাসরি যোগাযোগ না করে-এই দুই পদ্ধতি মিলিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট করার ব্যাপারটি গ্রহণযোগ্যতা পায়। আগস্টে ১৮ শতাংশ প্রাথমিক এবং ৩৮ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এই সুবিধা পেয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের যোগাযোগ তেমন না থাকলেও অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার সময় যোগাযোগ হতো। 

মহামারি এবং এর ফলে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে ১৫ শতাংশেরও বেশি পরিবার জানিয়েছে, মহামারির শুরু থেকেই স্কুল এবং কলেজগামী শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপে ভুগছে। বাবা-মায়েরা জানিয়েছেন, স্কুল বন্ধ থাকাকালীন সন্তানদের আচরণ তুলনামূলক বেশি অসহনশীল, খিটমিটে এবং রাগান্বিত ছিল। এই হার মার্চে ৩৬ শতাংশ থাকলেও আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ শতাংশে। 

দূরশিক্ষণের মূল উপায় হলো টেলিভিশনে রেকর্ড করা ক্লাস এবং অনলাইন ও সরাসরি অনলাইন ক্লাস। তবে এসব ক্লাসে থাকার সুযোগ খুব কম শিক্ষার্থীরই হয়েছে। শিক্ষণ ঘাটতির এই প্রবণতা মাধ্যমিকে পড়ুয়া কিশোরদের মধ্যে বেশি দেখা গেছে। মার্চে তাদের মধ্যে এই ঝুঁকি ২৬ শতাংশে থাকলেও আগস্টে তা বেড়ে ৩৪ শতাংশে দাঁড়ায়। প্রাথমিকে পড়ুয়া ৫৬ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে পড়ুয়া ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মার্চে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া বা কোচিং করলেও আগস্টে সেই হার কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৮ শতাংশ এবং ৪৩ শতাংশ। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত