খায়রুল বাসার নির্ঝর, ঢাকা
সজল তখন লঞ্চে। ঢাকায় ফিরছিলেন। বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলেন দাদাবাড়ি পটুয়াখালী। সন্ধ্যা তখন। বাবার সঙ্গে লঞ্চ ভ্রমণে মনটাও ভীষণ ভালো ছিল সজলের। রিং বাজতেই ফোন তুললেন। কথা বললেন মন খুলে। নতুন সিনেমায় অভিনয় করছেন আবদুন নূর সজল। নাম ‘সংযোগ’। আবু সাইয়ীদ বানাচ্ছেন। সিনেমাটি নিয়েই শুরু হলো আলাপ।
‘সংযোগ’ সিনেমায় আপনার সংযোগ কীভাবে হলো?
নির্মাতা আবু সাইয়ীদ ভাইয়ের সঙ্গে বেশ আগে থেকেই ‘সংযোগ’ সিনেমাটি নিয়ে কথা হচ্ছিল। বছর দশেক আগে তাঁর একটি ফিকশনে কাজ করেছিলাম। আমার করা যত ভালো ফিকশন আছে, তার মধ্যে ওই ফিকশন একটা। ১০ বছর আগেই যে কনটেন্টটি করেছিলাম, সেটি এখনো আধুনিক। সাইয়ীদ ভাইয়ের গল্প বলা, ডিরেকশন—সব সময়ই আমার খুব পছন্দের। তাঁর ‘সংযোগ’ সিনেমায় অভিনয়ের অফার পাওয়ার পর আমি শুধু গল্পটা শুনতে চেয়েছিলাম। গল্প আর চরিত্রটি শুনলাম। ভালো লাগল। এভাবেই কাজ শুরু।
কী ধরনের গল্প নিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘সংযোগ’। কিছুটা ধারণা দেওয়া যায়?
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির পাশাপাশি এই সময়ের সমাজ বাস্তবতা নিয়ে এই সিনেমার গল্প। আমি অভিনয় করছি একজন উদ্ভাবকের চরিত্রে। আমি আসলে লাকি যে এ রকম একটি গল্প, চরিত্র আমার কাছে এসেছে।
‘সংযোগ’ সিনেমাটি তৈরি হচ্ছে গণ-অর্থায়নে। বাংলাদেশে এ ধারণা অনেকটাই নতুন। স্বাধীন সিনেমার ক্ষেত্রে এদেশে গণ-অর্থায়নকে কতটা সম্ভাবনাময় মনে করেন?
হয়তো এ কনসেপ্টটা আমাদের জন্য নতুন। তবে গণ-অর্থায়ন বা ক্রাউন্ড ফান্ডিংয়ের সিনেমা কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সারাবিশ্বে তৃণমূল পর্যায় থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সিনেমা তৈরি হচ্ছে। সেগুলো বিশ্বজুড়ে প্রশংসাও পাচ্ছে। আমরা বাংলাদেশিরাও পিছিয়ে থাকব কেন! গণ-অর্থায়নে ‘সংযোগ’-এর মতো একটা সিনেমার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যে সিনেমাটি সামাজিকবার্তা বহন করছে, এটা তো নিশ্চয়ই সম্ভাবনার। আর আমি বরাবরই নতুন যেকোনো কিছুর সঙ্গে থাকি।
পরের প্রশ্নটা এ প্রসঙ্গেই। একসময় আপনি মূলত ‘রোমান্টিক হিরো’ ছিলেন। গত কয়েক বছর ধরে নানা ধরনের চরিত্রে নিজেকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছেন। এটি অভিনেতা হিসেবে আপনাকে কতখানি সমৃদ্ধ করছে?
আমার কাছে বরাবরই একটা জিনিস মনে হয়, যাঁরা অভিনয় ভালোবাসেন, এ শিল্পটাকে ভালোবাসেন, তাঁরা সবাই চান ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে কাজ করতে। আমার শুরু থেকে আগ্রহ ছিল ভিন্ন চরিত্রে কাজ করার। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত আমার কাছে অত বৈচিত্রময় চরিত্র আসত না। একইরকম চরিত্র পেতাম। যে কারণে মাঝে এক-দেড় বছর কোনো কাজ করিনি। তখন চাওয়া এটাই ছিল, যেন ভিন্ন চরিত্রে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়। ভালো কনটেন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ততা তৈরি হয়।
এখন সময়টাও ভালো। অনেক এক্সপেরিমেন্টাল কাজ হচ্ছে। মানুষের পছন্দের জায়গাও বদলেছে। অনেক রকমের প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। নতুন পুরোনো সবাই বিভিন্ন রকমের এক্সপেরিমেন্ট করছেন। তো সেই জায়গা থেকে আমি বলব আমরা যাঁরা অভিনেতা, তাঁদের জন্য এটা সুসংবাদই বটে।
সবচেয়ে ভালো বিষয়, একটা সময় যে নির্মাতারা খুব ভালো কাজ করতেন, তাঁরা আবারও কাজ শুরু করেছেন। এটা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য অনেক বড় সুসংবাদ। কারণ যত যা-ই বলি না কেন, আমরা যাঁরা অভিনয় করি, তাঁরা কিন্তু যে কোনো প্রজেক্টে একটা উপকরণের মতো। প্রজেক্টটা অবশ্যই একজন ডিরেক্টরের। ডিরেক্টর যখন কাজটি সুন্দর করে করেন, তখন আমাদের অভিনয় প্রশংসিত হয়।
গল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো আপনি সবার আগে গুরুত্ব দেন? গল্প, চরিত্র, সহ-অভিনেতা নাকি পরিচালক?
আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি পায় সামাজিকবার্তা। সেটার জন্য যে অনেক বড় পরিসরে কাজ করতে হবে, সেটাও আমি বলি না। একটা পরিবারে কিন্তু অনেক রকমের সমস্যা থাকে, একটা সম্পর্কেও সমস্যা থাকে। নাটক বা সিনেমায় সেই সমস্যাগুলোর যদি সমাধানের পথ দেখানো যায়। কিংবা যে দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে আমরা এসেছি, সেখান থেকেও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কোনো জায়গা যদি একটা ফিকশন বা একটা সিনেমার মধ্য দিয়েও বলা যায়; সেটা আমার কাছে মনে হয় অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। সেই সাথে যে গল্পে মাটির গন্ধ আছে, আমাদের নিজস্ব কালচারের প্রেজেন্টেশনস আছে, শ্রমজীবী মানুষের গল্প—এসব কাজ আমাকে টানে। আমাদের তো কৃষিপ্রধান দেশ। খেটে খাওয়া, শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাই এখানে বেশি। একজন রিকশাচালক থেকে শুরু করে একজন কৃষক, মুদি দোকানদার, মুচি, ফ্যাক্টরি শ্রমিক থেকে শুরু করে যাঁরা আছেন, এ রকম অনেক পেশা আছে। আমি পাঁচটা-সাতটা বললাম। তো এই মানুষগুলোর যে গল্প, তাঁদের যে ক্রাইসিস, সেই ক্রাইসিসের উত্তরণের যে পথ, এসব যে চিত্রনাট্যে পাই, সেগুলোতে কাজ করতে সব সময়ই ভালো লাগে।
প্রায় দুই যুগের অভিনয় ক্যারিয়ার আপনার। সিনেমার সংখ্যা এত কম কেন?
সিনেমার ক্ষেত্রে আমার যে গল্পগুলো ভালো লাগছে, আমি কিন্তু সেটাতেই সম্পৃক্ত হচ্ছি। আমার কোনো তাড়া নেই। এ বছর এটা করতে হবে, পরের বছর এটা করতে হবে— নট লাইক দ্যাট। আমি কিন্তু ওয়েট করতেই থাকি একটা ভালো কাজের জন্য। চরিত্রের ক্ষেত্রেও যেমন, নেগেটিভ চরিত্রেও আমি পিছপা হই না। সামনে হয়তো আমার একটা সিনেমাও আসবে নেগেটিভ চরিত্রের। একজন অভিনেতা হিসেবে চরিত্রের মতো হয়ে উঠতে পারাটাই আমার কাজ।
নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করলে কি ‘হিরো ইমেজ’ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না?
সব চরিত্র কি পজিটিভ হয়? আমাদের মানুষদের মধ্যে কি সবাই পজিটিভ? যাঁর মধ্যে ভালোর পরিমাণ বেশি, মন্দের পরিমাণ কম, তাঁকে আমরা ভালো বলি। যাঁর মধ্যে মন্দের পরিমাণ বেশি, ভালোর পরিমাণ কম, তাঁকে আমরা মন্দ বলি। কিন্তু একজন মন্দ মানুষের ভেতরেও যে ভালো গুণ থাকে না, তা কিন্তু নয়। পরিমাণটা হয়তো কম-বেশি থাকে। তো এই ধরনের চরিত্র কেন করব না? কারণ এটা তো খুব সহজ-স্বাভাবিক চরিত্র, যেগুলো আশপাশেই দেখা যায়।
ইন্ডাস্ট্রিতে আপনি সবার পছন্দের লোক। সবার সঙ্গেই আপনার ভালো সম্পর্ক। আপনাকে নিয়ে কোনো বিতর্ক-বিবাদ নেই। রহস্যটা বলবেন?
আমি এ ইন্ডাস্ট্রিতে ২০-২২ বছর কাজ করে ফেলেছি। এত বছর যে কাজ করতে পেরেছি, এটার কারণ— সবার সহযোগিতা। আমি অনেক মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ, সৃষ্টিকর্তা তো আছেনই, আমার পরিবার তো আছেই, তাছাড়াও ডিরেক্টর, প্রডাকশন বয়, মেকআপ আর্টিস্ট, ডিওপি, লাইটম্যান, সাংবাদিক— সবাই আমাকে এত সাপোর্ট করেন, আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। তা নাহলে আমি যে পরিমাণ আলাভোলা, এতদিন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে পারতাম না।
এটা সবাই বলেন, আপনার সঙ্গে কাজ করে আরাম পাওয়া যায়। আপনি কোনো পেইন দেন না, কোনো ট্যানট্রাম নেই। আপনি সেটে থাকলে রিলাক্সে থাকেন সবাই। এ বিষয়টি কি আপনি মেইনটেইন করেন?
দায়বদ্ধতা আসলে। একজন যদি তাঁর কাজের জন্য আমাকে সিলেক্ট করেন, তিনি তার বিনিময়ে আমাকে পারিশ্রমিক দিচ্ছেন, সেই জায়গা থেকে তো আসলে সৎ থেকে আমার কাজটা করা উচিত। এই সৎ কীভাবে হবে? আমি আমার কাজটিতে যতটুকু পারি মনোযোগি থাকব। যতটুকু পারি কো-অপারেটিভ থাকব। এটাই তো স্বাভাবিক। আমি কিন্তু আলাদা করে কিছু করি না।
মানে আলাদা করে কোনো মেইনটেইনের গল্প নেই। আপনার স্বভাবটাই এমন…
হ্যাঁ, সেটাই তো হওয়া উচিত।
আপনার বাসায় দেখেছি, বইয়ের ভালো কালেকশন আছে। ছোটখাটো লাইব্রেরি বলা যায়। এক সাক্ষাৎকারেও পড়েছি, বই পড়তে ভালোবাসতেন আপনি। এমনও হয়েছে, নীলক্ষেতে বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়েই অনেক বই শেষ করেছেন…
ছোটবেলা থেকেই আমার বই পড়ার অভ্যাস ছিল। সেটার কারণ ছিলেন একজন মামা, যিনি আমাকে ছোটবেলা থেকে পড়াতেন। নামটাও বলি—উনার নাম হচ্ছে ফিরোজ। দুটো জিনিসের প্র্যাকটিস উনি ছোটবেলা থেকেই করে দিয়েছিলেন। তারমধ্যে একটা— বই পড়ার অভ্যাস। পড়া শুরু হয়েছিল কমিকস দিয়ে। পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো হলে কমিকস পাব, এ রকম একটা বিষয় ছিল।
কিন্তু আসলে ক-টা বই-ই বা পাব! যখন বইয়ের দোকানে নিয়ে যেত, পুরো বছরের খাতা-বই একসঙ্গে কেনার জন্য, তখন হয়তো এক ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে, এই এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যে যত পারি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ফেলব। আর যেগুলো পড়া সম্ভব হচ্ছে না, সেগুলো কিনে নেব। এ-ই ছিল টার্গেট। তো ওখান থেকেই আসলে পড়ার অভ্যাস।
শুরুর দিকে পড়তাম রাকিব হাসান, সেবা প্রকাশনী। তারপর আনোয়ার হোসেন। সবচেয়ে বেশি বইয়ের পোকা আমি হইছিলাম হুমায়ূন আহমেদের কারণে। আমার কাছে মোটামুটি ভালো একটা হুমায়ূন আহমেদ সমগ্র আছে। তারপর জাফর ইকবাল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ— সবার বই-ই পড়া হইছে।
ফিরোজ মামার কথা বলছিলেন। উনি দুটি জিনিসের অভ্যাস করে দিয়েছিলেন। একটা বই পড়া। আরেকটা কী?
আরেকটা বিষয় ছিল, পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো হলে ওই যে মামার কথা বললাম, ফিরোজ মামা, উনি থিয়েটারের শো দেখাতে নিয়ে যেতেন। আমার এখনও মনে আছে, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’ নামে একটা নাটক ছিল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের। এই নাটকটা আমি ছোটবেলায় ২২ বার দেখছি। আমি কিন্তু একই চরিত্র অনেককে করতে দেখেছি। মাখন চরিত্রে হায়াত কাকুকেও (আবুল হায়াত) দেখেছি, যুবরাজ ভাইকেও (খালেদ খান) দেখেছি করতে। লাইলি চরিত্র, এটাতে আমি নিমা আপাকে (নিমা রহমান) দেখেছি, সারা আন্টিকে (সারা যাকের) দেখেছি, বিপাশা আপাকেও (বিপাশা হায়াত) করতে দেখেছি। তখন বিষয়টা ছিল, রেজাল্টটা ভালো করতে হবে, কারণ ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’ দেখতে হবে। এই নাটকটি এত ভালো লাগত যে, ওই সময় যতগুলো মঞ্চের নাটক হতো, সেই ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’, ‘কঞ্জুস’, ‘যৈবতী কন্যার মন’—মোটামুটি সব দেখছি।
এই যে বই পড়া কিংবা মঞ্চে নাটক দেখা—এগুলো অভিনয়ে কতটা হেল্প করেছে আপনাকে?
এটা আসলে ওইভাবে ডিফাইন করতে পারব না, বই পড়া কিংবা নাটক দেখা—এসবের কারণেই আমি অভিনয়ে এসেছি কিনা! বা ভালো অভিনয় করতে এগুলো কতটা কাজে লেগেছে, লেগেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু কতটা সাহায্য করেছে এভাবে ডিফাইন করা কঠিন। যেসব ডিরেক্টরদের সঙ্গে কাজ করেছি, তাঁরা প্রত্যেকে আমাকে শিখাইছেন। বিশেষভাবে আমি তিনজনের নাম মেনশন করতে চাই—আফজাল হোসেন, হুমায়ূন ফরীদি, আরেকজন হচ্ছেন আমাদের সেলিম আল দীন স্যার।
আমার মনে আছে, প্রথম যে সিরিয়ালটি করেছিলাম, তার নাম ‘হীরাফুল’। ওটা ছিল আফজাল হোসেনের ডিরেকশন, আর সেলিম আল দীন স্যারের লেখা। এমনিতে খুব কঠিন একটা লেখা আর খুব কঠিন একটা ডিরেকশনের মধ্যে কাজ করতে যাচ্ছি, তখন অ্যাকটিংয়ের তেমন কিছু বুঝিও না। আমার পেছনে আফজাল আঙ্কেল ভীষণ এফোর্ট দিতেন। নাটকটি যখন অনএয়ারে এল, আমাকে একদিন সেলিম আল দীন স্যার ফোন করেছিলেন। তিনি যদিও আমাদের ক্যাম্পাসেরই, কিন্তু আমার কাছে ফোনটা এসেছিল মাত্রার (আফজাল হোসেনের প্রতিষ্ঠান, মাত্রা) অফিস থেকে। মাত্রার অফিস থেকে ইউজুয়ালি আফজাল আঙ্কেলই ফোন করেন। আমি ভেবেছিলাম, তিনিই ফোন করেছেন। তাঁর সঙ্গে আমি এর আগে বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। আমি একটু দুষ্টুও ছিলাম, আফজাল আঙ্কেলকে জ্বালাইতাম ভীষণ। ফোন করে যখন বলছিলেন, হীরাফুল দেখলাম। ভালো করেছো। তুমি না তুই বলেছেন, মনে নেই। আমি বলছিলাম, আপনি যেমনটা বলছেন, তেমনভাবেই তো করছি। এখানে আমার তেমন কৃতিত্ব নেই। তখন তিনি বললেন, ‘আদনান চরিত্রটাকে আমি যেভাবে দেখতে চেয়েছিলাম, সেভাবেই পেয়েছি। বরং একটু বেটার পেয়েছি।’ এটা শুনে আমি কিছুক্ষণ কনফিউজড। প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা সজল তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ?’ আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘আফজাল আঙ্কেল’। তখন বললেন, ‘না, আমি সেলিম আল দীন বলছি।’ এটা শোনার পর আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেছি। উনি তো আমার ক্যাম্পাসের টিচার। উনি এবার কথাগুলো আবার বললেন। সাহস দিলেন, ‘এর পরের লটে যখন স্ক্রিপ্টটা আসবে, যদি কোনোকিছু বুঝতে না পারো, বা কোনো হেল্প লাগে, তুমি আমার কাছে এসো, আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেব।’
এটা তো আপনার জন্য বড় প্রাপ্তি তখন…
শুধু তা-ই নয়, ঠিক এই সময়ে এসে অভিনয়ের প্রতি আমার আগ্রহের জায়গা তৈরি হয়। এর আগে কিন্তু অভিনয় নিয়ে আমার তেমন কোনো প্ল্যান ছিল না। আমি যে এখানে কাজ করব রেগুলার, তেমনও বিষয় ছিল না। তখন আমি জাহাঙ্গীরনগরে পড়তাম, একটা ছোট জবও করতাম। আফজাল আঙ্কেল উনার বাসায় নিয়ে পর্যন্ত আমাকে ডায়লগ স্ক্যান করা শিখাইছেন। সংলাপে কোন জায়গায় গ্যাপ দিতে হবে, পজ দিতে হবে—এগুলো সব উনার শেখানো।
হুমায়ূন ফরীদির সঙ্গে অভিজ্ঞতা কেমন?
ফরিদী আঙ্কেলের সাথে সিন করতে গেলাম, সেটা আরেক অভিজ্ঞতা। এমনও হয়েছে ডায়লগের একটা জায়গায় লেখা আছে, উনি বলে দিলেন, একটা কাজ কর, তুই এখানে একটা গ্যাপ দে। গ্যাপ দিয়ে এরপর এই সংলাপটা বল। বললাম। দীপংকর দীপনের শুট। উনি কাট করলেন। তারপর বললেন, এভাবে না। একটা টেক গেল। সেকেন্ড টেক। উনি কিন্তু ওই দৃশ্যে নিজেও অ্যাকটিং করতেছেন। উনি বললেন, এভাবে না করে এখানে একটা ‘হু’ অ্যাড কর। বললাম। বলার পরে উনি আবার কাট করলেন। তিনবারের পর উনি আবার বললেন, শুরুর দিকে আরেকটা জিনিস অ্যাড কর। তারপর বল। উনাকেই কিন্তু অ্যাকটিং করতে হচ্ছে তিনবার করে।
উনার সঙ্গে আমার যতবার কথা হতো, উনার ডিরেকশনেও কাজ করতেছি। অনেক ছোট ছোট জিনিস, ওখানে ও রকম করিস না, এভাবে কর, এভাবে ওপর থেকে ডায়লগ বল। এ রকম বহু কিছু আছে। উনি আমাকে বকতেনই সারাক্ষণ। এমনও হতো, আমার একটা নাটক অনএয়ার হওয়ার পর, উনি ফোন করে বললেন, এ নাটকটা তুই কেন করছিস? এইটা তো কোনো অ্যাকটিং হইলো না। এ রকম কথা অনেক বলছেন উনি।
আমি জানতাম, ফরীদি আঙ্কেল ফোন করা মানে এখন বকা খাবো। একদিন চ্যানেল ওয়ানের একটা শোতে গেছিলাম। সেখানে যে সব ডিরেক্টর বা অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছি, তাঁদের বাইটস নিয়ে আসতো। আই নেভার এক্সপেক্ট যে, ওখানে ফরিদী আঙ্কেলের বাইটস আসবে। শো হোস্ট করছিলেন তানিয়া হোসেইন। তো এ রকম শোয়ের মাঝখানে হঠাৎ করে বলল, সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য, চলো আমরা স্ক্রিনে দেখি। হঠাৎ দেখি ফরিদী আঙ্কেল। তাঁকে দেখে তো আমার হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হলো। এখন তো আমি বকা খাব। ফরিদী আঙ্কেল বললেন, ‘শোন, তোকে কখনও বলা হয়নি। আমি তোর ফ্যান’। এই কথা শোনার পর তাঁকে থ্যাঙ্কু পর্যন্ত বলতে পারিনি। (এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম) বাকি পুরাটা শো আমি ‘হ্যাঁ, না, আচ্ছা’ ছাড়া আর কিছু বলেত পারিনি। আমি ওই কথা সারাজীবন ভুলতে পারিনি।
এজন্য আমি বলি, আমার পেছনে এ রকম অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা আসলে সত্যি একদমই আমাকে হাতে ধরে ধরে শিখাইছেন। আমি তো আসলে কিছু শিখে আসিনি।
এখন যারা আপনার সঙ্গে কাজ করেন, তাঁদের অভিজ্ঞতাও আপনার সঙ্গে নিশ্চয় এ রকমই। আপনি যথেষ্ট হেল্প করেন।
আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টা। আমার সঙ্গে নুতন যাঁরা কাজ করতে আসেন, আমি কিন্তু ওদের কাছ থেকেও শিখি। দেখা যায়, নতুন একজন এত সুন্দরভাবে ডায়লগ স্ক্যান করেন অনেক সময়। তখন মনে হয়, আচ্ছা, এভাবেও তো হতে পারে।
শেখার জায়গাটা আপনি ওপেন রাখছেন একেবারে…
আমার কাছে ওপেন। আমি সবসময়ই শিখি। আমি খুবই ডিরেক্টরস আটিস্ট। ডিরেক্টরদের সাথে যাদের যে প্রজেক্ট আমি করি, আমি চেষ্টা করি, তাঁরাও চেষ্টা করেন, যাতে কথা বলে বুঝে নিতে পারি আগে থেকে, যে চরিত্রটি করতে যাচ্ছি… যতরকমের গাইডলাইন থাকে আমি সব আগে থেকে তাঁদের কাছ থেকে নেওয়ার চেষ্টা করি। তারপর যতটুকু পারা যায়, এক্সিকিউট করি ক্যামেরার সামনে। কিন্তু আমার পেছনে ডিরেক্টরদের অবদান অনেক।
[কথা কি আর শেষ হয়! সে তো নদীর মতো। স্রোতের মতো। বয়ে চলে। সজলের সঙ্গে আরও অনেক বিষয়ে কথা হলো। রয়ে গেল আরও অনেক না বলা কথা…]
সজল তখন লঞ্চে। ঢাকায় ফিরছিলেন। বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলেন দাদাবাড়ি পটুয়াখালী। সন্ধ্যা তখন। বাবার সঙ্গে লঞ্চ ভ্রমণে মনটাও ভীষণ ভালো ছিল সজলের। রিং বাজতেই ফোন তুললেন। কথা বললেন মন খুলে। নতুন সিনেমায় অভিনয় করছেন আবদুন নূর সজল। নাম ‘সংযোগ’। আবু সাইয়ীদ বানাচ্ছেন। সিনেমাটি নিয়েই শুরু হলো আলাপ।
‘সংযোগ’ সিনেমায় আপনার সংযোগ কীভাবে হলো?
নির্মাতা আবু সাইয়ীদ ভাইয়ের সঙ্গে বেশ আগে থেকেই ‘সংযোগ’ সিনেমাটি নিয়ে কথা হচ্ছিল। বছর দশেক আগে তাঁর একটি ফিকশনে কাজ করেছিলাম। আমার করা যত ভালো ফিকশন আছে, তার মধ্যে ওই ফিকশন একটা। ১০ বছর আগেই যে কনটেন্টটি করেছিলাম, সেটি এখনো আধুনিক। সাইয়ীদ ভাইয়ের গল্প বলা, ডিরেকশন—সব সময়ই আমার খুব পছন্দের। তাঁর ‘সংযোগ’ সিনেমায় অভিনয়ের অফার পাওয়ার পর আমি শুধু গল্পটা শুনতে চেয়েছিলাম। গল্প আর চরিত্রটি শুনলাম। ভালো লাগল। এভাবেই কাজ শুরু।
কী ধরনের গল্প নিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘সংযোগ’। কিছুটা ধারণা দেওয়া যায়?
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির পাশাপাশি এই সময়ের সমাজ বাস্তবতা নিয়ে এই সিনেমার গল্প। আমি অভিনয় করছি একজন উদ্ভাবকের চরিত্রে। আমি আসলে লাকি যে এ রকম একটি গল্প, চরিত্র আমার কাছে এসেছে।
‘সংযোগ’ সিনেমাটি তৈরি হচ্ছে গণ-অর্থায়নে। বাংলাদেশে এ ধারণা অনেকটাই নতুন। স্বাধীন সিনেমার ক্ষেত্রে এদেশে গণ-অর্থায়নকে কতটা সম্ভাবনাময় মনে করেন?
হয়তো এ কনসেপ্টটা আমাদের জন্য নতুন। তবে গণ-অর্থায়ন বা ক্রাউন্ড ফান্ডিংয়ের সিনেমা কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সারাবিশ্বে তৃণমূল পর্যায় থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সিনেমা তৈরি হচ্ছে। সেগুলো বিশ্বজুড়ে প্রশংসাও পাচ্ছে। আমরা বাংলাদেশিরাও পিছিয়ে থাকব কেন! গণ-অর্থায়নে ‘সংযোগ’-এর মতো একটা সিনেমার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যে সিনেমাটি সামাজিকবার্তা বহন করছে, এটা তো নিশ্চয়ই সম্ভাবনার। আর আমি বরাবরই নতুন যেকোনো কিছুর সঙ্গে থাকি।
পরের প্রশ্নটা এ প্রসঙ্গেই। একসময় আপনি মূলত ‘রোমান্টিক হিরো’ ছিলেন। গত কয়েক বছর ধরে নানা ধরনের চরিত্রে নিজেকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছেন। এটি অভিনেতা হিসেবে আপনাকে কতখানি সমৃদ্ধ করছে?
আমার কাছে বরাবরই একটা জিনিস মনে হয়, যাঁরা অভিনয় ভালোবাসেন, এ শিল্পটাকে ভালোবাসেন, তাঁরা সবাই চান ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে কাজ করতে। আমার শুরু থেকে আগ্রহ ছিল ভিন্ন চরিত্রে কাজ করার। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত আমার কাছে অত বৈচিত্রময় চরিত্র আসত না। একইরকম চরিত্র পেতাম। যে কারণে মাঝে এক-দেড় বছর কোনো কাজ করিনি। তখন চাওয়া এটাই ছিল, যেন ভিন্ন চরিত্রে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়। ভালো কনটেন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ততা তৈরি হয়।
এখন সময়টাও ভালো। অনেক এক্সপেরিমেন্টাল কাজ হচ্ছে। মানুষের পছন্দের জায়গাও বদলেছে। অনেক রকমের প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। নতুন পুরোনো সবাই বিভিন্ন রকমের এক্সপেরিমেন্ট করছেন। তো সেই জায়গা থেকে আমি বলব আমরা যাঁরা অভিনেতা, তাঁদের জন্য এটা সুসংবাদই বটে।
সবচেয়ে ভালো বিষয়, একটা সময় যে নির্মাতারা খুব ভালো কাজ করতেন, তাঁরা আবারও কাজ শুরু করেছেন। এটা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য অনেক বড় সুসংবাদ। কারণ যত যা-ই বলি না কেন, আমরা যাঁরা অভিনয় করি, তাঁরা কিন্তু যে কোনো প্রজেক্টে একটা উপকরণের মতো। প্রজেক্টটা অবশ্যই একজন ডিরেক্টরের। ডিরেক্টর যখন কাজটি সুন্দর করে করেন, তখন আমাদের অভিনয় প্রশংসিত হয়।
গল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো আপনি সবার আগে গুরুত্ব দেন? গল্প, চরিত্র, সহ-অভিনেতা নাকি পরিচালক?
আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি পায় সামাজিকবার্তা। সেটার জন্য যে অনেক বড় পরিসরে কাজ করতে হবে, সেটাও আমি বলি না। একটা পরিবারে কিন্তু অনেক রকমের সমস্যা থাকে, একটা সম্পর্কেও সমস্যা থাকে। নাটক বা সিনেমায় সেই সমস্যাগুলোর যদি সমাধানের পথ দেখানো যায়। কিংবা যে দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে আমরা এসেছি, সেখান থেকেও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কোনো জায়গা যদি একটা ফিকশন বা একটা সিনেমার মধ্য দিয়েও বলা যায়; সেটা আমার কাছে মনে হয় অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। সেই সাথে যে গল্পে মাটির গন্ধ আছে, আমাদের নিজস্ব কালচারের প্রেজেন্টেশনস আছে, শ্রমজীবী মানুষের গল্প—এসব কাজ আমাকে টানে। আমাদের তো কৃষিপ্রধান দেশ। খেটে খাওয়া, শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাই এখানে বেশি। একজন রিকশাচালক থেকে শুরু করে একজন কৃষক, মুদি দোকানদার, মুচি, ফ্যাক্টরি শ্রমিক থেকে শুরু করে যাঁরা আছেন, এ রকম অনেক পেশা আছে। আমি পাঁচটা-সাতটা বললাম। তো এই মানুষগুলোর যে গল্প, তাঁদের যে ক্রাইসিস, সেই ক্রাইসিসের উত্তরণের যে পথ, এসব যে চিত্রনাট্যে পাই, সেগুলোতে কাজ করতে সব সময়ই ভালো লাগে।
প্রায় দুই যুগের অভিনয় ক্যারিয়ার আপনার। সিনেমার সংখ্যা এত কম কেন?
সিনেমার ক্ষেত্রে আমার যে গল্পগুলো ভালো লাগছে, আমি কিন্তু সেটাতেই সম্পৃক্ত হচ্ছি। আমার কোনো তাড়া নেই। এ বছর এটা করতে হবে, পরের বছর এটা করতে হবে— নট লাইক দ্যাট। আমি কিন্তু ওয়েট করতেই থাকি একটা ভালো কাজের জন্য। চরিত্রের ক্ষেত্রেও যেমন, নেগেটিভ চরিত্রেও আমি পিছপা হই না। সামনে হয়তো আমার একটা সিনেমাও আসবে নেগেটিভ চরিত্রের। একজন অভিনেতা হিসেবে চরিত্রের মতো হয়ে উঠতে পারাটাই আমার কাজ।
নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করলে কি ‘হিরো ইমেজ’ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না?
সব চরিত্র কি পজিটিভ হয়? আমাদের মানুষদের মধ্যে কি সবাই পজিটিভ? যাঁর মধ্যে ভালোর পরিমাণ বেশি, মন্দের পরিমাণ কম, তাঁকে আমরা ভালো বলি। যাঁর মধ্যে মন্দের পরিমাণ বেশি, ভালোর পরিমাণ কম, তাঁকে আমরা মন্দ বলি। কিন্তু একজন মন্দ মানুষের ভেতরেও যে ভালো গুণ থাকে না, তা কিন্তু নয়। পরিমাণটা হয়তো কম-বেশি থাকে। তো এই ধরনের চরিত্র কেন করব না? কারণ এটা তো খুব সহজ-স্বাভাবিক চরিত্র, যেগুলো আশপাশেই দেখা যায়।
ইন্ডাস্ট্রিতে আপনি সবার পছন্দের লোক। সবার সঙ্গেই আপনার ভালো সম্পর্ক। আপনাকে নিয়ে কোনো বিতর্ক-বিবাদ নেই। রহস্যটা বলবেন?
আমি এ ইন্ডাস্ট্রিতে ২০-২২ বছর কাজ করে ফেলেছি। এত বছর যে কাজ করতে পেরেছি, এটার কারণ— সবার সহযোগিতা। আমি অনেক মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ, সৃষ্টিকর্তা তো আছেনই, আমার পরিবার তো আছেই, তাছাড়াও ডিরেক্টর, প্রডাকশন বয়, মেকআপ আর্টিস্ট, ডিওপি, লাইটম্যান, সাংবাদিক— সবাই আমাকে এত সাপোর্ট করেন, আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। তা নাহলে আমি যে পরিমাণ আলাভোলা, এতদিন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে পারতাম না।
এটা সবাই বলেন, আপনার সঙ্গে কাজ করে আরাম পাওয়া যায়। আপনি কোনো পেইন দেন না, কোনো ট্যানট্রাম নেই। আপনি সেটে থাকলে রিলাক্সে থাকেন সবাই। এ বিষয়টি কি আপনি মেইনটেইন করেন?
দায়বদ্ধতা আসলে। একজন যদি তাঁর কাজের জন্য আমাকে সিলেক্ট করেন, তিনি তার বিনিময়ে আমাকে পারিশ্রমিক দিচ্ছেন, সেই জায়গা থেকে তো আসলে সৎ থেকে আমার কাজটা করা উচিত। এই সৎ কীভাবে হবে? আমি আমার কাজটিতে যতটুকু পারি মনোযোগি থাকব। যতটুকু পারি কো-অপারেটিভ থাকব। এটাই তো স্বাভাবিক। আমি কিন্তু আলাদা করে কিছু করি না।
মানে আলাদা করে কোনো মেইনটেইনের গল্প নেই। আপনার স্বভাবটাই এমন…
হ্যাঁ, সেটাই তো হওয়া উচিত।
আপনার বাসায় দেখেছি, বইয়ের ভালো কালেকশন আছে। ছোটখাটো লাইব্রেরি বলা যায়। এক সাক্ষাৎকারেও পড়েছি, বই পড়তে ভালোবাসতেন আপনি। এমনও হয়েছে, নীলক্ষেতে বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়েই অনেক বই শেষ করেছেন…
ছোটবেলা থেকেই আমার বই পড়ার অভ্যাস ছিল। সেটার কারণ ছিলেন একজন মামা, যিনি আমাকে ছোটবেলা থেকে পড়াতেন। নামটাও বলি—উনার নাম হচ্ছে ফিরোজ। দুটো জিনিসের প্র্যাকটিস উনি ছোটবেলা থেকেই করে দিয়েছিলেন। তারমধ্যে একটা— বই পড়ার অভ্যাস। পড়া শুরু হয়েছিল কমিকস দিয়ে। পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো হলে কমিকস পাব, এ রকম একটা বিষয় ছিল।
কিন্তু আসলে ক-টা বই-ই বা পাব! যখন বইয়ের দোকানে নিয়ে যেত, পুরো বছরের খাতা-বই একসঙ্গে কেনার জন্য, তখন হয়তো এক ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে, এই এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যে যত পারি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ফেলব। আর যেগুলো পড়া সম্ভব হচ্ছে না, সেগুলো কিনে নেব। এ-ই ছিল টার্গেট। তো ওখান থেকেই আসলে পড়ার অভ্যাস।
শুরুর দিকে পড়তাম রাকিব হাসান, সেবা প্রকাশনী। তারপর আনোয়ার হোসেন। সবচেয়ে বেশি বইয়ের পোকা আমি হইছিলাম হুমায়ূন আহমেদের কারণে। আমার কাছে মোটামুটি ভালো একটা হুমায়ূন আহমেদ সমগ্র আছে। তারপর জাফর ইকবাল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ— সবার বই-ই পড়া হইছে।
ফিরোজ মামার কথা বলছিলেন। উনি দুটি জিনিসের অভ্যাস করে দিয়েছিলেন। একটা বই পড়া। আরেকটা কী?
আরেকটা বিষয় ছিল, পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো হলে ওই যে মামার কথা বললাম, ফিরোজ মামা, উনি থিয়েটারের শো দেখাতে নিয়ে যেতেন। আমার এখনও মনে আছে, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’ নামে একটা নাটক ছিল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের। এই নাটকটা আমি ছোটবেলায় ২২ বার দেখছি। আমি কিন্তু একই চরিত্র অনেককে করতে দেখেছি। মাখন চরিত্রে হায়াত কাকুকেও (আবুল হায়াত) দেখেছি, যুবরাজ ভাইকেও (খালেদ খান) দেখেছি করতে। লাইলি চরিত্র, এটাতে আমি নিমা আপাকে (নিমা রহমান) দেখেছি, সারা আন্টিকে (সারা যাকের) দেখেছি, বিপাশা আপাকেও (বিপাশা হায়াত) করতে দেখেছি। তখন বিষয়টা ছিল, রেজাল্টটা ভালো করতে হবে, কারণ ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’ দেখতে হবে। এই নাটকটি এত ভালো লাগত যে, ওই সময় যতগুলো মঞ্চের নাটক হতো, সেই ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’, ‘কঞ্জুস’, ‘যৈবতী কন্যার মন’—মোটামুটি সব দেখছি।
এই যে বই পড়া কিংবা মঞ্চে নাটক দেখা—এগুলো অভিনয়ে কতটা হেল্প করেছে আপনাকে?
এটা আসলে ওইভাবে ডিফাইন করতে পারব না, বই পড়া কিংবা নাটক দেখা—এসবের কারণেই আমি অভিনয়ে এসেছি কিনা! বা ভালো অভিনয় করতে এগুলো কতটা কাজে লেগেছে, লেগেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু কতটা সাহায্য করেছে এভাবে ডিফাইন করা কঠিন। যেসব ডিরেক্টরদের সঙ্গে কাজ করেছি, তাঁরা প্রত্যেকে আমাকে শিখাইছেন। বিশেষভাবে আমি তিনজনের নাম মেনশন করতে চাই—আফজাল হোসেন, হুমায়ূন ফরীদি, আরেকজন হচ্ছেন আমাদের সেলিম আল দীন স্যার।
আমার মনে আছে, প্রথম যে সিরিয়ালটি করেছিলাম, তার নাম ‘হীরাফুল’। ওটা ছিল আফজাল হোসেনের ডিরেকশন, আর সেলিম আল দীন স্যারের লেখা। এমনিতে খুব কঠিন একটা লেখা আর খুব কঠিন একটা ডিরেকশনের মধ্যে কাজ করতে যাচ্ছি, তখন অ্যাকটিংয়ের তেমন কিছু বুঝিও না। আমার পেছনে আফজাল আঙ্কেল ভীষণ এফোর্ট দিতেন। নাটকটি যখন অনএয়ারে এল, আমাকে একদিন সেলিম আল দীন স্যার ফোন করেছিলেন। তিনি যদিও আমাদের ক্যাম্পাসেরই, কিন্তু আমার কাছে ফোনটা এসেছিল মাত্রার (আফজাল হোসেনের প্রতিষ্ঠান, মাত্রা) অফিস থেকে। মাত্রার অফিস থেকে ইউজুয়ালি আফজাল আঙ্কেলই ফোন করেন। আমি ভেবেছিলাম, তিনিই ফোন করেছেন। তাঁর সঙ্গে আমি এর আগে বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। আমি একটু দুষ্টুও ছিলাম, আফজাল আঙ্কেলকে জ্বালাইতাম ভীষণ। ফোন করে যখন বলছিলেন, হীরাফুল দেখলাম। ভালো করেছো। তুমি না তুই বলেছেন, মনে নেই। আমি বলছিলাম, আপনি যেমনটা বলছেন, তেমনভাবেই তো করছি। এখানে আমার তেমন কৃতিত্ব নেই। তখন তিনি বললেন, ‘আদনান চরিত্রটাকে আমি যেভাবে দেখতে চেয়েছিলাম, সেভাবেই পেয়েছি। বরং একটু বেটার পেয়েছি।’ এটা শুনে আমি কিছুক্ষণ কনফিউজড। প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা সজল তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ?’ আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘আফজাল আঙ্কেল’। তখন বললেন, ‘না, আমি সেলিম আল দীন বলছি।’ এটা শোনার পর আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেছি। উনি তো আমার ক্যাম্পাসের টিচার। উনি এবার কথাগুলো আবার বললেন। সাহস দিলেন, ‘এর পরের লটে যখন স্ক্রিপ্টটা আসবে, যদি কোনোকিছু বুঝতে না পারো, বা কোনো হেল্প লাগে, তুমি আমার কাছে এসো, আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেব।’
এটা তো আপনার জন্য বড় প্রাপ্তি তখন…
শুধু তা-ই নয়, ঠিক এই সময়ে এসে অভিনয়ের প্রতি আমার আগ্রহের জায়গা তৈরি হয়। এর আগে কিন্তু অভিনয় নিয়ে আমার তেমন কোনো প্ল্যান ছিল না। আমি যে এখানে কাজ করব রেগুলার, তেমনও বিষয় ছিল না। তখন আমি জাহাঙ্গীরনগরে পড়তাম, একটা ছোট জবও করতাম। আফজাল আঙ্কেল উনার বাসায় নিয়ে পর্যন্ত আমাকে ডায়লগ স্ক্যান করা শিখাইছেন। সংলাপে কোন জায়গায় গ্যাপ দিতে হবে, পজ দিতে হবে—এগুলো সব উনার শেখানো।
হুমায়ূন ফরীদির সঙ্গে অভিজ্ঞতা কেমন?
ফরিদী আঙ্কেলের সাথে সিন করতে গেলাম, সেটা আরেক অভিজ্ঞতা। এমনও হয়েছে ডায়লগের একটা জায়গায় লেখা আছে, উনি বলে দিলেন, একটা কাজ কর, তুই এখানে একটা গ্যাপ দে। গ্যাপ দিয়ে এরপর এই সংলাপটা বল। বললাম। দীপংকর দীপনের শুট। উনি কাট করলেন। তারপর বললেন, এভাবে না। একটা টেক গেল। সেকেন্ড টেক। উনি কিন্তু ওই দৃশ্যে নিজেও অ্যাকটিং করতেছেন। উনি বললেন, এভাবে না করে এখানে একটা ‘হু’ অ্যাড কর। বললাম। বলার পরে উনি আবার কাট করলেন। তিনবারের পর উনি আবার বললেন, শুরুর দিকে আরেকটা জিনিস অ্যাড কর। তারপর বল। উনাকেই কিন্তু অ্যাকটিং করতে হচ্ছে তিনবার করে।
উনার সঙ্গে আমার যতবার কথা হতো, উনার ডিরেকশনেও কাজ করতেছি। অনেক ছোট ছোট জিনিস, ওখানে ও রকম করিস না, এভাবে কর, এভাবে ওপর থেকে ডায়লগ বল। এ রকম বহু কিছু আছে। উনি আমাকে বকতেনই সারাক্ষণ। এমনও হতো, আমার একটা নাটক অনএয়ার হওয়ার পর, উনি ফোন করে বললেন, এ নাটকটা তুই কেন করছিস? এইটা তো কোনো অ্যাকটিং হইলো না। এ রকম কথা অনেক বলছেন উনি।
আমি জানতাম, ফরীদি আঙ্কেল ফোন করা মানে এখন বকা খাবো। একদিন চ্যানেল ওয়ানের একটা শোতে গেছিলাম। সেখানে যে সব ডিরেক্টর বা অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছি, তাঁদের বাইটস নিয়ে আসতো। আই নেভার এক্সপেক্ট যে, ওখানে ফরিদী আঙ্কেলের বাইটস আসবে। শো হোস্ট করছিলেন তানিয়া হোসেইন। তো এ রকম শোয়ের মাঝখানে হঠাৎ করে বলল, সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য, চলো আমরা স্ক্রিনে দেখি। হঠাৎ দেখি ফরিদী আঙ্কেল। তাঁকে দেখে তো আমার হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হলো। এখন তো আমি বকা খাব। ফরিদী আঙ্কেল বললেন, ‘শোন, তোকে কখনও বলা হয়নি। আমি তোর ফ্যান’। এই কথা শোনার পর তাঁকে থ্যাঙ্কু পর্যন্ত বলতে পারিনি। (এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম) বাকি পুরাটা শো আমি ‘হ্যাঁ, না, আচ্ছা’ ছাড়া আর কিছু বলেত পারিনি। আমি ওই কথা সারাজীবন ভুলতে পারিনি।
এজন্য আমি বলি, আমার পেছনে এ রকম অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা আসলে সত্যি একদমই আমাকে হাতে ধরে ধরে শিখাইছেন। আমি তো আসলে কিছু শিখে আসিনি।
এখন যারা আপনার সঙ্গে কাজ করেন, তাঁদের অভিজ্ঞতাও আপনার সঙ্গে নিশ্চয় এ রকমই। আপনি যথেষ্ট হেল্প করেন।
আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টা। আমার সঙ্গে নুতন যাঁরা কাজ করতে আসেন, আমি কিন্তু ওদের কাছ থেকেও শিখি। দেখা যায়, নতুন একজন এত সুন্দরভাবে ডায়লগ স্ক্যান করেন অনেক সময়। তখন মনে হয়, আচ্ছা, এভাবেও তো হতে পারে।
শেখার জায়গাটা আপনি ওপেন রাখছেন একেবারে…
আমার কাছে ওপেন। আমি সবসময়ই শিখি। আমি খুবই ডিরেক্টরস আটিস্ট। ডিরেক্টরদের সাথে যাদের যে প্রজেক্ট আমি করি, আমি চেষ্টা করি, তাঁরাও চেষ্টা করেন, যাতে কথা বলে বুঝে নিতে পারি আগে থেকে, যে চরিত্রটি করতে যাচ্ছি… যতরকমের গাইডলাইন থাকে আমি সব আগে থেকে তাঁদের কাছ থেকে নেওয়ার চেষ্টা করি। তারপর যতটুকু পারা যায়, এক্সিকিউট করি ক্যামেরার সামনে। কিন্তু আমার পেছনে ডিরেক্টরদের অবদান অনেক।
[কথা কি আর শেষ হয়! সে তো নদীর মতো। স্রোতের মতো। বয়ে চলে। সজলের সঙ্গে আরও অনেক বিষয়ে কথা হলো। রয়ে গেল আরও অনেক না বলা কথা…]
প্রতি সপ্তাহেই নতুন সিনেমা বা ওয়েব সিরিজের জন্য দর্শকের নজর থাকে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। সপ্তাহজুড়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাবে নানা দেশের, নানা ভাষার কনটেন্ট। বাছাই করা এমন কিছু কনটেন্টের খবর থাকছে এই প্রতিবেদনে।
৫ ঘণ্টা আগেবিচ্ছেদের পর একাই পালন করছেন মা-বাবার দায়িত্ব। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার ব্যবসায় নামছেন অভিনেত্রী। মা এবং নবজাতকের দরকারি পণ্যের ব্র্যান্ডশপ দিচ্ছেন পরীমনি।
৫ ঘণ্টা আগেপরদিনই কাকতালীয়ভাবে প্রকাশ্যে আসে বেজিস্ট মোহিনী দের বিবাহবিচ্ছেদের খবর। অনেকে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানো শুরু করেন। কেউ কেউ তো আগবাড়িয়ে এটাও বলে দিয়েছেন, মোহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণেই নাকি বিচ্ছেদ হয়েছে রাহমান-সায়রার!
৫ ঘণ্টা আগেআগামী ৪ ডিসেম্বর শুরু হবে ৩০তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এবারের উৎসবে অংশ নেবে বিভিন্ন দেশের ২০০টির বেশি সিনেমা। তবে রাখা হয়নি না বাংলাদেশের কোনো সিনেমা।
১০ ঘণ্টা আগে