রক্ষা করতে হবে জাহাঙ্গীরনগরের উদ্ভিদ

মৃত্যুঞ্জয় রায়
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮: ৩৮

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের উদ্ভিদ গবেষক এম এ রহিম খবর দিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সুন্দর বনে’ ভুঁই ডালিমের ফুল ফুটেছে। ফোটা ফুল দেখতে হলে সকাল ৮টার মধ্যেই সেখানে যেতে হবে। না হলে সেগুলো ঝরে যাবে। বিপন্ন এই উদ্ভিদের দর্শন যেকোনো উদ্ভিদপ্রেমীর জন্য এক দুর্লভ সুযোগ। এই আমন্ত্রণ উপেক্ষা করা কঠিন। তাই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম সেই বিরল ও বিপন্ন গাছের ফুলগুলো দেখতে। চৈত্রসংক্রান্তির দিন। দুজন মিলে নেমে পড়লাম সেই ‘সুন্দর বন’ দর্শনে।

ঝাঁঝাঁ রোদে চারদিক চকচক করছে। বসন্তের নতুন কচি সবুজ পাতারা আড়মোড়া ভেঙে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সুন্দর বন’কে ষোড়শীর মতোই লাবণ্যময়ী করে তুলেছে। যেদিকে তাকাই, কেবল সবুজ আর সবুজ, শ্যামল সুন্দরে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। ছোট্ট একফালি শালবন, পাতা ঝরে তলাটা বাদামি হয়ে আছে। শুকনো পাতাগুলোর ওপর পা পড়তেই কী চমৎকার করে মচমচ আওয়াজ হচ্ছে, পাখি ডাকছে, দলে দলে প্রজাপতি উড়ছে। গাছের গা-ভরা কচি পাতাদের উল্লাস, কয়েক দিন পরই ডালের মাথায় মাথায় আসবে শাল ফুলেরা। এরই যেন প্রতীক্ষায় রয়েছে শালগাছগুলো। গাছেদের কী অদ্ভুত মমতা! একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ওপরে উঠে যাচ্ছে। এত যে জড়াজড়ি, একে অন্যের ওপর আশ্রয় করে বেড়ে ওঠা—কিছুতেই যেন গাছেরা এতে কিছু মনে করে না।

শালগাছের সহচর কিছু গাছ আছে, যেগুলো শুধু শালবনেই দেখা যায়। আহা, কী মমতায় বনরঙ্গনের গাছগুলো শালগাছের পায়ের কাছে লুটিয়ে আছে, কোনো কোনোটা শালগাছে হেলান দিয়ে দিব্যি থোকা থোকা ফুল ফোটাচ্ছে, সেই সব ফুলের মধুগন্ধে আমোদিত ‘সুন্দর বনের’ বাতাস! রহিম ভাই বললেন, আর কটা দিন আগে এলে বনরঙ্গনের বসন্তশোভাটা আরও ভালো করে দেখতে পারতেন, এখন ফুল তো শেষের পথে, শুকিয়ে গেছে অনেক ফুল। খুঁজে খুঁজে দেখালেন দুই রকমের বনরঙ্গন ফুল—একটার রং সাদা, ওগুলোর ঘ্রাণ বেশি। অন্যটা গোলাপি সাদা, সেগুলোর ঘ্রাণ কম। তার পরও পেলাম তার শোভা ও সৌরভ, আমার জন্য তা অপার্থিব আনন্দের। শালবনের সাথি এই গাছ বনে অনেকই দেখলাম, যেগুলো বহুদিন খুঁজেও টাঙ্গাইলের অনেক শালবনে পাইনি। এ সময় ফোটে বলে একে কেউ কেউ বলে বিজু ফুল। বিজু হলো চাকমাদের এক অন্যতম প্রধান আনন্দ উৎসব। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও পয়লা বৈশাখের দিন মিলে তারা এই উৎসব পালন করে, যার প্রধান উপকরণ ফুল। ভোরের আলো ফোটার আগেই চাকমা ছেলে-মেয়েরা ফুল সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়ে। বসন্ত ঋতু হওয়ায় মেলে অনেক ফুলের দেখা। সংগ্রহের পর সেসব ফুল তারা তিন ভাগ করে। এক ভাগ দিয়ে ভগবান বুদ্ধের পূজা করে, আরেক ভাগ জলে ভাসিয়ে দেয় এবং শেষ ভাগের ফুলগুলো দিয়ে ঘরবাড়ি সাজায়। বনের ভেতরে বিজু ফুলগুলো দেখে এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে আরেকটা বিপন্ন গাছের কাছে এসে পড়েছি বুঝতে পারিনি।

রহিম ভাই বাংলাদেশের লাল তালিকাভুক্ত, অর্থাৎ মহাবিপন্ন দুটো গাছ দেখালেন—একটা বনখেজুর, অন্যটা ওলানানা। যে গাছগুলো বাংলাদেশের উদ্ভিজ্জগৎ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে, সেই সব গাছের দেখা এখানে অপ্রত্যাশিতভাবে পাব তা কল্পনাও করিনি। শুধু তাই নয়, পাশাপাশি বনখেজুরের একটা পুরুষ ও আরেকটা স্ত্রী গাছের দেখাও পেলাম। বনখেজুরগাছের কাণ্ড বড়জোর ফুটখানেক লম্বা হবে, ওইটুকু লম্বা হতেই হয়তো তার ১০ থেকে ১২ বছর সময় লেগেছে। সৌভাগ্য যে, দুটো গাছে ফুল ফোটা দেখেই গাছ দুটোকে আলাদাভাবে চিনতে পারা গেল। না হলে এদের স্বতন্ত্রভাবে বোঝার কোনো উপায়ই ছিল না। সারা বনে শণ-উলু তৃণদের দাপট। এরই মধ্যে থোকা থোকা সবুজ ফুলের মঞ্জরি নিয়ে হেসে উঠেছে খুদি জাম আর পাইন্যাজামের গাছেরা, অসংখ্য গাছ। অথচ সচরাচর এসব গাছের দেখাই মেলে না। যে আনইগাছ খুঁজেছি হন্যে হয়ে টাঙ্গাইলের শালবনে, সেই আনইগাছকে উপেক্ষা করে সামনে যাওয়ার পথ খুঁজতে যেন হিমশিম খেলাম। বরইগাছের মতো পাতা, লতানো গাছের ডালপালা তীক্ষ্ণ কাঁটায় ভরা, প্রায় প্রতিটি ডালের আগায় থোকায় থোকায় ঝুলছে আনই বরই। কয়েক দিনের মধ্যে ওগুলো পেকে হলদেটে হবে, নরম আর মিষ্টি সেই শাঁস খাওয়ার মজাই আলাদা।

কখনো দাঁতরঙার পাকা ফল খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। দুধেল চায়ের মতো গৈরিক মাটির বুকজুড়ে ঝোপ ঝোপ দাঁতরঙা গাছ। বসন্ত শেষেও গাছে গাছে শোভা পাচ্ছে বেগুনি রঙের পাঁচ পাপড়ির ফুল, কচি ও পাকা ফল। বনে এসে বনফল খাব না, তা তো হতে পারে না! ফল পেকে খোসা ফেটে আলগা হয়ে আছে পাঁচ কোয়ার বীজসহ ফল। আহ্‌, কী সুস্বাদু আর মিষ্টি লাল রসে ভরা সেই ফল! যেন তুঁতফল বা স্ট্রবেরি খাচ্ছি! অজস্র গাছে ও ঝোপে ‘সুন্দর বন’ আসলেই সুন্দরী হয়ে আছে। তীক্ষ্ণ আর বড় বড় বড় কাঁটায় ভরা বাজনাগাছ, সেই গাছের ডালের মাথায় করাতের মতো খাঁজকাটা পাতাগুলো চমৎকারভাবে চারদিকে ছড়িয়ে আছে আল্পনার মতো, আর পাতাগুলোর মাঝখানে শোভা পাচ্ছে পুষ্পমঞ্জরি। একসময় গজারি বনের সহবাসী বাজনাগাছের পাকা ফল সেদ্ধ করে স্থানীয় মানুষ বাজনার তেল বা ঘি বানাত। এখন তা করে কি না, জানি না। কতশত যে গাছপালা! এদিকে তাকালে চোখে পড়ে গঙ্গাতারার শায়িত ঝোপ, ওদিকে তাকালে চোখে পড়ে বনবেলির বিক্ষিপ্ত ঝোপ, মনকাঁটা, মিনজিরি, মহুয়া, মুচকুন্দ, ধূপগাছ, তালমূলি, ভৃঙ্গরাজ, মণিরাজ, বনজাম, বনকুল, ছেঁচড়া কড়ই, খাড়াজোড়া, গন্ধিগজারি, পদ্মগুলঞ্চ, কুমারীলতা, লতাঢেঁকিয়া, ফলঝোলা গামারি আর সবুজাভ সাদা ফুলের সুগন্ধে মাতোয়ারা সুগন্ধি কড়ইগাছ।

তবে যে আকর্ষণে ছুটে গিয়েছিলাম ওখানে, সেটি না দেখে তো ফেরা যায় না। রহিম ভাই শেষে দুটো স্পটে নিয়ে গেলেন ভুঁই ডালিমের গাছ দেখাতে। ও মা! ভেবেছিলাম ওটা বুঝি কোনো গুল্ম বা বৃক্ষ হবে। গিয়ে দেখি গাছগুলো মৃত্তিকালগ্ন হয়ে আছে, পাতাগুলো অনেকটা তামাকপাতার মতো হলেও পাতার আগা কিছুটা ভোঁতা, নতুন পাতায় গাছগুলো ভরা। মাটির নিচের কাণ্ড থেকে একটি মঞ্জরিদণ্ডে ফুটেছে দু-তিনটে ফুল। বোঁটা খসে প্রায় সব ফুলই ঝরে গেছে। এর পরও একটা ফুলসহ গাছের ছবি তোলার সুযোগ পেয়ে মনটা ভরে গেল। একটা তৃপ্তি নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। পাশাপাশি আশঙ্কাও। শুনেছি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সুন্দর বনের খানিকটা কেটে সেখানে ভবন নির্মাণ করা হবে! তার মানে, এই ভুঁই ডালিম ও বনখেজুরের সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না! এ তো হতে পারে না। এই বন শুধু বিপন্ন উদ্ভিদের ঐশ্বর্যময় ভান্ডারই নয়, উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্রছাত্রীদের জন্য এক মূল্যবান পাঠশালাও। এই চত্বরে আছে ৯১৭ প্রজাতির উদ্ভিদ। তাই এসব মূল্যবান উদ্ভিদ রক্ষা করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য, বিপন্ন প্রজাতির সংরক্ষণও জরুরি।

লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত