ডুবন্ত বেসিক ব্যাংক ভাসানোর শেষ চেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯: ৫৫

ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবতে বসা বেসিক ব্যাংক লিমিটেডকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা চলছে। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ বা কর্মপরিকল্পনা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদকে ডেকে দ্রুত এ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে তা জমা দিতে তাগাদা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আদায় করার এবং অনিয়মের মাধ্যমে বেরিয়ে যাওয়া অর্থ শনাক্ত করে তা ফেরত আনার কৌশল থাকতে হবে ওই পরিকল্পনায়। বেসিক ব্যাংক কর্মপরিকল্পনা জমা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে না পারলে বেসিক ব্যাংকে ‘লাল বাতি’ জ্বালানোর হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, ঋণ কেলেঙ্কারিতে বিপর্যস্ত ব্যাংকটিকে রক্ষা করতে একের পর এক বৈঠক করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভিন্ন সময়ে বেসিক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও তলব করা হয়। সেখানে ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ব্যাংকটির ওপর বাড়ানো হয় নজরদারি। একপর্যায়ে ব্যাংকটিতে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিয়ে গত ২১ ডিসেম্বর বৈঠক করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বৈঠকে চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা চাওয়ার পাশাপাশি বলা হয়েছে, সংকট দূর করতে না পারলে ব্যাংকটিকে প্রয়োজনে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় বা একীভূত করা হতে পারে।

বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের অতীতের ঋণ কেলেঙ্কারি অনেকের জানা। সেই জালিয়াতি ও কেলেঙ্কারির জন্য ব্যাংকটির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পূর্বে যারা অনিয়ম করেছে, অর্থ আত্মসাৎ করেছে, তাদের দায় বয়ে বেড়াচ্ছে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদও। ব্যাংকটির ভিত মজবুত করার লক্ষ্যে গত ২১ ডিসেম্বর তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে গভর্নর ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে একটি উদ্ধার রূপরেখা প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছেন।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কীভাবে আদায় করা হবে, ঋণে অনিয়মের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা অর্থ শনাক্ত করে তা ফেরত আনার কৌশলও থাকতে হবে কর্মপরিকল্পনায়। বেসিক ব্যাংক পরিকল্পনা জমা দেওয়ার পরে করণীয় ঠিক করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ২০০৯ সালের পরে মাত্র চার বছরে ব্যাংকটি ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়। এই ঋণের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকাই নিয়ম ভেঙে দেওয়া হয়। অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে ধরা পড়ে। এরপর নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ অবস্থায় বেসিক ব্যাংকে সমন্বয়ক নিয়োগের বিষয়টিও চূড়ান্ত বিবেচনায় আছে।

পূর্বের জালিয়াতি-অনিয়মের দায় 
বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল হাশেম ২২ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুকে নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক খবর প্রকাশ হয়েছে। পূর্বের জালিয়াতি ও অনিয়মের মাধ্যমে যা সংঘটিত হয়েছে তার দায় এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তবে ব্যাংকটির ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সব মহল থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সমস্যা সমাধানে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা চেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে আমরা ব্যাংকটিকে সামনে এগিয়ে নিতে কাজ করছি। পরিকল্পনা জমা দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনোভাব বুঝে ব্যাংকের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করা যাবে।’ এর বেশি জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে যোগাযোগ করতে তিনি পরামর্শ দেন।

এ বিষয়ে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুর রহমানের মন্তব্য জানতে গত ২২ ডিসেম্বর থেকে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। ২৬ ডিসেম্বর দুপুরে তাঁর হোয়াটস অ্যাপ নম্বরে মেসেজ পাঠিয়েও জবাব পাওয়া যায়নি। সেদিন তাঁর কার্যালয়ে গেলেও তিনি দেখা করতে রাজি হননি।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণের জোগান দিতে ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বেসিক ব্যাংক বা বাংলাদেশ স্মল ইন্ডাস্টিজ অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড।

আদালতের পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত বেসিক ব্যাংক ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকাই নিয়ম ভেঙে দেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে। ফলে ২০১৪ সালে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ করা হয়। সে বছরের ২৯ মে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছুদিন পর ৪ জুলাই শেখ আবদুল হাই বাচ্চু পদত্যাগপত্র জমা দেন।  

ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবতে বসা বেসিক ব্যাংকের ২০২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর দায়িত্বকালটা ‘অস্বস্তির’ ছিল। অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনিয়মের অভিযোগে দুদক ২০১৫ সালে ৫৬টি মামলা করে। তবে এত বছরে একটি মামলায়ও দুদক অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেনি। দুদকের এই ব্যর্থতায় গত ২৮ নভেম্বর হতাশা প্রকাশ করেছেন উচ্চ আদালত।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক মো. ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আদালত যৌক্তিকভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি ও দুর্নীতি হয়েছে। এখন দুদকের উচিত আদালতের পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে মামলাগুলোর দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া।’

বাচ্চুকে ধরলে টাকা উদ্ধার হবে
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে। খেলাপি ঋণের হার ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকেরই ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেসিক ব্যাংকের। ব্যাংকটি ২০১৮ সালে ৩৫৩ কোটি, ২০১৯ সালে ৩২৬ কোটি, ২০২০ সালে ৩৭১ কোটি এবং ২০২১ সালে ৩৯৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসিক ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি ঘটে এই ব্যাংকে। ব্যাংকটি অনেকটা লাইফ সাপোর্টে আছে। এর ভবিষ্যৎ ভালো মনে হচ্ছে না।’

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৪ সালে আবদুল হাই বাচ্চুর ব্যাংক হিসাবে জমা করা টাকা, সেই অর্থের উৎস ও এর বিবরণও দুদককে জানানো হয়েছিল। এরপরও বিশেষ খুঁটির জোরে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন। তাঁকে ধরতে পারলে টাকা উদ্ধার হবে এবং ব্যাংকটির প্রতি মানুষের আস্থাও ফিরবে। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের এখন যে অবস্থা, সরকার মূলধন জোগান দিয়ে বেশি দূর উদ্ধার করতে পারবে না। ব্যাংকটিকে এখন দীর্ঘমেয়াদি ঋণের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি বিতরণ করতে হবে। তবে ঋণ দেওয়ার আগে কোন প্রকল্পে, কাকে দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে ভালোভাবে খোঁজ নিতে হবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত