বাংলাদেশের বিজয়ে ভারতের ভূমিকা

আবদুল মান্নান
প্রকাশ : ১৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০৭: ৩৭
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯: ৫৮

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের এটা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, এই অঞ্চলে শান্তির একমাত্র পথ হচ্ছে শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এই প্রস্তাব মানবে কেন?

এই বছর, ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পঞ্চাশ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চ, যার সমাপ্তি হয় নয় মাস পর একই বছর ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে যুদ্ধরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রায় ৯৩ হাজার সেনাসদস্যসহ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পড়ন্ত বিকেলে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় যৌথ বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে লিখিতভাবে আত্মসমর্পণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন একটি ঘটনা এই প্রথম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমনভাবে প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণ করেছিল।

কেমন ছিল ওই ১৬ ডিসেম্বরের পূর্ববর্তী নয় মাস, তা বর্তমান প্রজন্মকে বোঝানো সহজ নয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেক তাঁর গ্রন্থ ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাতে ‘পূর্ব পাকিস্তানের সেনা গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান, সেনা কমান্ডার আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, ঢাকা সেনানিবাসের প্রধান জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ঢাকার শেরেবাংলা নগরে নির্মাণাধীন সংসদ ভবন এলাকার বাইরে চেয়ার-টেবিল এবং হুইস্কির বোতল ও কফির ফ্লাস্ক নিয়ে বসে ছিলেন গণহত্যার শুরুটা দেখতে। ওই রাতের গণহত্যা শুরুর সাংকেতিক নামটা ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। এই অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব। তাঁকে হুকুম দেওয়া হয়েছিল শহরের ওপর আক্রমণটা এমন হওয়া চাই যেন সকালে শেরেবাংলা নগর থেকে দূরের সদরঘাট দেখা যায়। বুঝতে হবে মাঝখানে ঢাকা শহর। তখনো ঢাকা শহরে জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। সত্তরের নির্বাচনের পর এ দেশের রাজনীতি যে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির দিকে গড়াচ্ছে, তা সারা বিশ্ব; বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত ও দেশটির সরকার আঁচ করতে পেরেছিল। কারণ যে দেশটিকে জন্মের পর থেকে নানাভাবে পাকিস্তানের সেনা-বেসামরিক আমলাতন্ত্র শাসন করতে অভ্যস্ত, তারা কেন এত সহজে দেশটির শাসনভার বাঙালি তথা শেখ মুজিবের কাছে হস্তান্তর করবে? শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্য যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, সে সম্পর্কে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর সরকার বুঝতে পেরেছিল।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করলে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীকে (বিএসএফ) সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকেই নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশের মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যাওয়া শুরু করে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে এবং মানবিক কারণে তাতে সহায়তা করে বিএসএফ এবং সীমান্তে বসবাসরত ভারতীয়রা। তখন কে মুসলমান আর কে হিন্দু, তা বিবেচ্য বিষয় ছিল না। বিবেচ্য ছিল বিপন্ন মানুষকে বাঁচাতে হবে। মানবতা সর্বাগ্রে। জুন মাস নাগাদ কয়েক লাখ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন রাজ্যগুলোয় আশ্রয় নেয়। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। তাজউদ্দীনকে পরামর্শ দেওয়া হয় তিনি যেন নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করেন, যা আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য হবে। কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। কারণ, কারা সরকার গঠন করবে তা নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে কিছুটা হলেও মতদ্বৈধতা ছিল। একটি অংশ মনে করত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের নিয়ে সরকার গঠন করা হোক। অন্যদিকে কিছুসংখ্যক সেনাসদস্য চান সেনাসদস্যদের নিয়ে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করা হোক। বিচক্ষণ তাজউদ্দীন ঠিকই বুঝেছিলেন আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য হতে হলে সরকার গঠন করতে হবে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে। বৈধ সরকার গঠন করার ম্যান্ডেট আর কারও নেই। ১০ এপ্রিল তিস্তা নদীর উজানে বাগডোগড়া নামক স্থানে তাঁবু খাটিয়ে হারিকেন জ্বালিয়ে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। শেখ মুজিবকে করা হয় রাষ্ট্রপতি আর তাজউদ্দীন হন প্রধানমন্ত্রী। যেহেতু শেখ মুজিব পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী, সেহেতু অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। জুলাই-আগস্ট মাস নাগাদ বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় লাভ করে। ত্রিপুরা রাজ্যের স্থানীয় জনসংখ্যার চেয়ে শরণার্থীর সংখ্যা হয়ে ওঠে বেশি। ত্রিপুরা রাজার প্রাসাদেও অনেক শরণার্থীর ঠাঁই হয়। সে এক অভূতপূর্ব সময়। কলকাতার সল্ট লেকে গড়ে ওঠে বিশাল শরণার্থীশিবির। বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে, ভারতের মানুষ তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের। এমনও হয়েছে তাঁরা নিজেদের অন্নও ভাগ করে খেয়েছেন। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে চিকিৎসক শরণার্থীশিবিরে এসেছেন চিকিৎসাসেবা দিতে। এমনও হয়েছে খোলা আকাশের নিচে কাপড় দিয়ে ঘেরাও করে তার মধ্যে বাচ্চা প্রসব করিয়েছেন এই সব চিকিৎসক।

এর পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করার জন্য গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী, যার সদস্য ছিলেন বাঙালি পুলিশ, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী ইপিআর, বাঙালি সেনাবাহিনীর সদস্য, ছাত্র, কৃষক ও সাধারণ মানুষ। পুরুষ-নারীনির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ অস্ত্র তুলে নেয় দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য। অনেক স্থানে দেখা যায়, অপ্রাপ্তবয়স্কদের হাতেও অস্ত্র। বেশির ভাগ অস্ত্রের জোগান এসেছিল ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী থেকে। বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারাও প্রচুর অস্ত্র নিজেরা শত্রু বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন। বাঙালি সেনাসদস্য, পুলিশ ও ইপিআর নিজেরা নিজেদের কাছে থাকা অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হয় ভারতের নাগাল্যান্ডে। চট্টগ্রাম বন্দরে আগস্ট মাসে অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনা করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় পলাশীতে। যুদ্ধের ফ্রন্টে যখন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধরত, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বনেতাদের বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করতে বিভিন্ন দেশে সফর শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতেও দ্বিধা করেননি। ইন্দিরা গান্ধী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের এটা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, এই অঞ্চলে শান্তির একমাত্র পথ হচ্ছে শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এই প্রস্তাব মানবে কেন?

অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এটি পরিষ্কার হয়ে গেল যে পাকিস্তান কোনো অবস্থাতেই বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এদিকে মুক্তিবাহিনীর কাছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হওয়া শুরু হলো। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ভারতের পশ্চিমে সে দেশের একাধিক বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করে। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। পূর্বাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ; যে যুদ্ধে ভারতীয় আধা সামরিক ও নিয়মিত বাহিনী সহায়তা করেছে। পৃথিবীর যেসব দেশে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে অন্য একাধিক দেশ রাজনৈতিক ও আদর্শগত কারণে যুদ্ধরত দেশটিকে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, ভারতের একশ্রেণির মিডিয়া ও রাজনীতিবিদ একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে দেখেন আর বলেন, ভারত যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করে দিয়েছে। কথাটি সত্যের অপলাপ। যুদ্ধটা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, যা বাঙালিরাই করেছে; তাতে ভারত সহায়তা করেছে মাত্র। বাংলাদেশের মানুষ সব সময় তার জন্য ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা আর ভারতীয় সেনাবাহিনী একাত্তরে পাশাপাশি যুদ্ধ করে যে রক্ত ঝরিয়েছে, সেই রক্তের ঋণ তো কখনো শোধ হওয়ার নয়। আমি ভারতের বেশ কজন সিনিয়র সেনা অফিসারের (যেমন জেনারেল জ্যাকব) সঙ্গে বিভিন্ন সময় কথা বলেছি। তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা সঙ্গে না থাকলে এই যুদ্ধ এত সহজে শেষ হতো না। একাত্তরে ভারতের সাধারণ মানুষ, সশস্ত্র বাহিনী আর সর্বোপরি সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যে সমর্থন জুগিয়েছে, তা এ দেশের মানুষ চিরদিন মনে রাখবে।
বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকুক। সব অসত্যের অবসান হোক। জয় বাংলা।

আবদুল মান্নান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত