মামুনুর রশীদ
স্মরণকালের এক ভয়াবহ বন্যা আঘাত হেনেছিল সুরমা উপত্যকায়। সিলেট অঞ্চলে এ বছরই আরও দুটি বন্যা হয়ে গেছে। তবে এবারের বন্যা মানুষ, প্রাণিজগৎ সবাইকে এমন বিপদগ্রস্ত করে তুলেছিল যে প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রীও পৌঁছানো যাচ্ছিল না। পাকিস্তান আমল থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিদেশি পরামর্শ পেয়ে নানা ধরনের প্রেসক্রিপশনে দেশের নদ-নদীকে বিপন্ন করে বন্যার পথ উন্মুক্ত করেছে। মোগল আমলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই উপমহাদেশে কোনো বন্যার ইতিহাস পাওয়া যায় না। খনার বচনেও বা তারও আগে বন্যার কোনো আভাস দেখা যায় না। মূলত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সময় রেললাইন প্রতিষ্ঠার পর বন্যা হতে শুরু করে। পরবর্তীকালে নদ-নদীকে নানা রকমভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বন্যা বাড়তে থাকে।
পাকিস্তান আমলে ওয়াপদা নামক এক বিশাল জলহস্তী বন্যা তো কমাতে পারেইনি; বরং তা এক রাক্ষসে রূপ নিয়েছিল। ওয়াপদা নামক প্রতিষ্ঠানটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার আগে সারা দেশে যেখানে নদীর উপস্থিতি আছে সেখানে সুদৃশ্য ও বিশাল রেস্টহাউসের বাংলো গড়ে তোলে। রীতিমতো তখন প্রকৌশলীদের অভাব দেখা দেয়। প্যারাসিটামলের মতো নানা ধরনের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থায় কোটি কোটি টাকার অর্থ অপচয় করে। এই সব প্রকৌশলী নেদারল্যান্ডসে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন কিন্তু সেই দেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাগুলোর কোনো প্রয়োগ নিজের দেশে করেন না।
নেদারল্যান্ডস বন্যার সঙ্গে সহাবস্থান করে এবং আমস্টারডাম শহরে অসংখ্য খাল, নালাকে রক্ষা করে বন্যাকে থামিয়ে দেয়। বাংলাদেশেও অসংখ্য নদ-নদী। এই নদ-নদীর সঙ্গে আমাদের কৃষিভিত্তিক উৎপাদনব্যবস্থার কোনো সংযোগ সৃষ্টি না করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। নদী নিরবধি আপন বেগে পাগলপারা। নদীর এই প্রবাহকে রুদ্ধ করতে গেলেই সে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। দুই কূল ভেঙে চুরমার করতে শুরু করে। ফলে লাখ লাখ পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করে, বিভিন্ন শহরে চিরদিনের জন্য আশ্রয় নেয় পরিবারগুলো। একেকটি বাড়িঘর চোখের পলকে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। যার মধ্যে আছে রেললাইন, হাট-বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। দেশে এখন একাধিক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে পানি উন্নয়নের জন্য বিভাগও আছে; যার মধ্যে ডক্টরেট করা অনেক শিক্ষকও আছেন। দীর্ঘস্থায়ী বন্যা প্রতিরোধের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো সমাধান বের করতে পারেননি।
আমাদের দেশের মতো চীনেও বন্যা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। চীন তার একটা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান করতে পেরেছে। আমাদের এই উপমহাদেশে পানি একটি রাজনৈতিক বিষয়। ভারতকে কাবু করতে পাকিস্তান পাঞ্জাবে বাঁধ দিয়ে ফেলে। আবার পাকিস্তানকে কাবু করতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ফারাক্কায় বাঁধ দিতে ভুল করেনি ভারত। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রতিও পানিভিত্তিক রাজনীতির অবসান হয়নি। তিস্তার পানি উত্তরবঙ্গের দুঃখ হয়ে চোখের জলের সঙ্গে যুক্ত হয়। আবার নির্বাচনের রাজনীতিতে পানি একটা ভূমিকা পালন করে। যেসব জেলায় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা থাকেন, সেখানে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণ করে পানির স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করা হয়। ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ না করেই রাস্তা হয়ে যায়। ফলে পানিকে এক মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে নয় মাইল জায়গা ঘুরে আসতে হয়। যার ফলে শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা। এমনি অনেক উদাহরণ আছে।
বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা দিন দিন গভীর সংকটের দিকে যাচ্ছে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে এই ঢাকা শহরে কোনো বন্যার আভাস পাওয়া যায় না। কারণ ঢাকা শহরে ছিল নানা ধরনের খাল এবং খালের পানি অবলীলায় বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ত। যোগাযোগের বড় মাধ্যম ছিল নৌকা। পাকিস্তান আমলে এই খালগুলো বন্ধ করে দেওয়ার একটা পাঁয়তারা শুরু করা হয়। আমরাই দেখেছি ধোলাইখালের পানিপ্রবাহ ঢাকা শহরের সব ময়লা-আবর্জনা বুড়িগঙ্গায় নিয়ে ফেলে দিচ্ছে। আর্মেনিয়ান অধিবাসীদের সৃষ্ট এ খালটি ঢাকা শহরের একটি মূল্যবান পানিপ্রবাহের ব্যবস্থায় নিয়োজিত ছিল। আবার বিদেশি পরামর্শকদের বুদ্ধিতে এবং আর্থিক সাহায্যে ধোলাইখাল বন্ধ করে দিয়ে ভূগর্ভে বড় বড় পাইপ দিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয় এবং বড় বড় পাম্প দিয়ে নারিন্দা থেকে তা বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করার ব্যবস্থা করা হয়। এই পাইপগুলো ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যায় এবং একসময় নারিন্দা পাম্পিং স্টেশনটিও অকেজো হয়ে যায়।
অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়নের জোয়ারে পানিপ্রবাহের কথা নগরের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত মিউনিসিপ্যালিটি এবং পরে সিটি করপোরেশন ভুলেই যায়। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ভুলে যাওয়ার ফলে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা এক কঠিন সংকটে পড়ে। স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের যে ব্যবস্থা এক শ বছর আগেও ছিল, তাকে রুদ্ধ করে দিয়ে ঢাকা শহর একটি জলাবদ্ধ শহরে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম শহর একটি উঁচু-নিচু পাহাড়ের শহর। পাশেই বঙ্গোপসাগর। শহরটাকে চারদিক থেকে আঁকড়ে ধরে আছে কর্ণফুলী নদী। বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের জন্য কিছু প্রাকৃতিক ব্যবস্থার উদ্ভাবন অত্যন্ত জরুরি। সেই ব্যবস্থায় না গিয়ে অদূরদর্শী পরিকল্পনার ফলে জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামে এক জটিল আকার ধারণ করেছে। গত বছরে পানিনিষ্কাশনের পথে মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। বন্যার সময় দক্ষিণবঙ্গের গ্রামগুলো থেকে ক্রমাগত একই কথা শোনা যায়, বাঁধ ভেঙে তাঁদের এই দুর্দশার কারণগুলো ঘটছে এবং বাঁধ নির্মাণে সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতি সহজেই ধরা পড়ছে।
এবারে অন্যান্য বারের চেয়েও অনেক বেশি প্রতাপ নিয়ে নদীভাঙন শুরু হয়েছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ কোনো কিছুই বাদ পড়ছে না। তিন-চারতলা ভবনও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পানির শক্তিকে বোঝার ক্ষমতা আমাদের নীতিনির্ধারকদের এখনো হয়নি। আগুন, পানি ও বাতাস তিনটি প্রাকৃতিক শক্তি। এই তিন প্রাকৃতিক শক্তি এখন বাংলাদেশের মানুষের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারেই উদাসীন। এটি যে একটি জনপদের এক বড় সমস্যা, তা তারা যেন আমলেই নিতে চায় না। অথচ বড় বড় শহরে দেখেছি রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মানুষগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। সূর্য ওঠার আগেই বর্জ্য যথাস্থানে চলে যায় এবং আধুনিক প্রযুক্তির রিসাইকেল প্রক্রিয়ায় এই বর্জ্যগুলো সম্পদে পরিণত হয়। একবার পলিথিন নিয়ন্ত্রণে সরকারকে খুব তৎপর দেখা গিয়েছিল। অপচনশীল এই বস্তুটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটা বড় অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে; অথচ বিষয়টি এখন এমন শিথিল যে সর্বত্রই প্লাস্টিকের জয়যাত্রা। বন্যা এলে আমরা খুব তৎপর হই, নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য হাত বাড়াই। কিন্তু বন্যা চলে গেলে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি।
কয়েক দিন ধরে সারা বিশ্বের প্রচারমাধ্যমে বন্যার নানা রকম ছবি ফলাও করে ছাপা হয়েছে। ফলে বিশ্বের একটি ধারণা হয় যে এ দেশটি অনুন্নত সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিক্ষা ও রাজনীতির দেশ। আমাদের এই গ্রহেই যে আরও কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান আছে, তা আর কেউ ভাবে না। একবার আমার একটি নাটক জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়ে জার্মানরা অভিনয় করছিলেন। বিশাল বিশাল পোস্টার দেওয়া হয়েছিল বার্লিনের রেলস্টেশন ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়। আমার পাশে দাঁড়িয়ে একজন জার্মান পোস্টারটি দেখছিলেন এবং আমার দিকে হঠাৎ তাকিয়ে তিনি হয়তো অনুভব করলেন আমি সেই দেশেরই মানুষ, কাছে এগিয়ে আসতেই আমি আমার পরিচয় দিলাম।
সেটি ১৯৮৯ সাল। জার্মান ভদ্রলোক বললেন, তোমার দেশে কোনো শিল্প-সাহিত্য আছে? আমরা তো জানি দেশটি বন্যা, প্লাবন, দুর্ভিক্ষ আর মিলিটারি ডিকটেটরদের দেশ। আমি তাঁকে ব্যাখ্যা করলাম এবং তিনি নাটক দেখতে এলেন। নাটক প্রদর্শনীর শেষে দেখলাম তাঁর হাতে জার্মান ভাষায় অনূদিত আমার নাটকের একটি বই। তিনি বললেন, আজকে আমি বুঝলাম তোমাদের দেশটিতে একটি উন্নত সংস্কৃতিও আছে। কিন্তু রাজনীতির অতল বঞ্চনায় তোমরা একটা অচলায়তনে বসবাস করছ। তখন দেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলছে। আমি সেই ছবিগুলো তাঁকে দেখালাম। সেই জার্মান ভদ্রলোক এত বছর পরেও যদি আমাদের বানভাসি মানুষের ছবিগুলো দেখেন তাহলে কি একই কথা বলবেন?
স্মরণকালের এক ভয়াবহ বন্যা আঘাত হেনেছিল সুরমা উপত্যকায়। সিলেট অঞ্চলে এ বছরই আরও দুটি বন্যা হয়ে গেছে। তবে এবারের বন্যা মানুষ, প্রাণিজগৎ সবাইকে এমন বিপদগ্রস্ত করে তুলেছিল যে প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রীও পৌঁছানো যাচ্ছিল না। পাকিস্তান আমল থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিদেশি পরামর্শ পেয়ে নানা ধরনের প্রেসক্রিপশনে দেশের নদ-নদীকে বিপন্ন করে বন্যার পথ উন্মুক্ত করেছে। মোগল আমলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই উপমহাদেশে কোনো বন্যার ইতিহাস পাওয়া যায় না। খনার বচনেও বা তারও আগে বন্যার কোনো আভাস দেখা যায় না। মূলত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সময় রেললাইন প্রতিষ্ঠার পর বন্যা হতে শুরু করে। পরবর্তীকালে নদ-নদীকে নানা রকমভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বন্যা বাড়তে থাকে।
পাকিস্তান আমলে ওয়াপদা নামক এক বিশাল জলহস্তী বন্যা তো কমাতে পারেইনি; বরং তা এক রাক্ষসে রূপ নিয়েছিল। ওয়াপদা নামক প্রতিষ্ঠানটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার আগে সারা দেশে যেখানে নদীর উপস্থিতি আছে সেখানে সুদৃশ্য ও বিশাল রেস্টহাউসের বাংলো গড়ে তোলে। রীতিমতো তখন প্রকৌশলীদের অভাব দেখা দেয়। প্যারাসিটামলের মতো নানা ধরনের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থায় কোটি কোটি টাকার অর্থ অপচয় করে। এই সব প্রকৌশলী নেদারল্যান্ডসে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন কিন্তু সেই দেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাগুলোর কোনো প্রয়োগ নিজের দেশে করেন না।
নেদারল্যান্ডস বন্যার সঙ্গে সহাবস্থান করে এবং আমস্টারডাম শহরে অসংখ্য খাল, নালাকে রক্ষা করে বন্যাকে থামিয়ে দেয়। বাংলাদেশেও অসংখ্য নদ-নদী। এই নদ-নদীর সঙ্গে আমাদের কৃষিভিত্তিক উৎপাদনব্যবস্থার কোনো সংযোগ সৃষ্টি না করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। নদী নিরবধি আপন বেগে পাগলপারা। নদীর এই প্রবাহকে রুদ্ধ করতে গেলেই সে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। দুই কূল ভেঙে চুরমার করতে শুরু করে। ফলে লাখ লাখ পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করে, বিভিন্ন শহরে চিরদিনের জন্য আশ্রয় নেয় পরিবারগুলো। একেকটি বাড়িঘর চোখের পলকে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। যার মধ্যে আছে রেললাইন, হাট-বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। দেশে এখন একাধিক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে পানি উন্নয়নের জন্য বিভাগও আছে; যার মধ্যে ডক্টরেট করা অনেক শিক্ষকও আছেন। দীর্ঘস্থায়ী বন্যা প্রতিরোধের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো সমাধান বের করতে পারেননি।
আমাদের দেশের মতো চীনেও বন্যা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। চীন তার একটা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান করতে পেরেছে। আমাদের এই উপমহাদেশে পানি একটি রাজনৈতিক বিষয়। ভারতকে কাবু করতে পাকিস্তান পাঞ্জাবে বাঁধ দিয়ে ফেলে। আবার পাকিস্তানকে কাবু করতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ফারাক্কায় বাঁধ দিতে ভুল করেনি ভারত। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রতিও পানিভিত্তিক রাজনীতির অবসান হয়নি। তিস্তার পানি উত্তরবঙ্গের দুঃখ হয়ে চোখের জলের সঙ্গে যুক্ত হয়। আবার নির্বাচনের রাজনীতিতে পানি একটা ভূমিকা পালন করে। যেসব জেলায় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা থাকেন, সেখানে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণ করে পানির স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করা হয়। ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ না করেই রাস্তা হয়ে যায়। ফলে পানিকে এক মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে নয় মাইল জায়গা ঘুরে আসতে হয়। যার ফলে শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা। এমনি অনেক উদাহরণ আছে।
বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা দিন দিন গভীর সংকটের দিকে যাচ্ছে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে এই ঢাকা শহরে কোনো বন্যার আভাস পাওয়া যায় না। কারণ ঢাকা শহরে ছিল নানা ধরনের খাল এবং খালের পানি অবলীলায় বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ত। যোগাযোগের বড় মাধ্যম ছিল নৌকা। পাকিস্তান আমলে এই খালগুলো বন্ধ করে দেওয়ার একটা পাঁয়তারা শুরু করা হয়। আমরাই দেখেছি ধোলাইখালের পানিপ্রবাহ ঢাকা শহরের সব ময়লা-আবর্জনা বুড়িগঙ্গায় নিয়ে ফেলে দিচ্ছে। আর্মেনিয়ান অধিবাসীদের সৃষ্ট এ খালটি ঢাকা শহরের একটি মূল্যবান পানিপ্রবাহের ব্যবস্থায় নিয়োজিত ছিল। আবার বিদেশি পরামর্শকদের বুদ্ধিতে এবং আর্থিক সাহায্যে ধোলাইখাল বন্ধ করে দিয়ে ভূগর্ভে বড় বড় পাইপ দিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয় এবং বড় বড় পাম্প দিয়ে নারিন্দা থেকে তা বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করার ব্যবস্থা করা হয়। এই পাইপগুলো ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যায় এবং একসময় নারিন্দা পাম্পিং স্টেশনটিও অকেজো হয়ে যায়।
অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়নের জোয়ারে পানিপ্রবাহের কথা নগরের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত মিউনিসিপ্যালিটি এবং পরে সিটি করপোরেশন ভুলেই যায়। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ভুলে যাওয়ার ফলে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা এক কঠিন সংকটে পড়ে। স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের যে ব্যবস্থা এক শ বছর আগেও ছিল, তাকে রুদ্ধ করে দিয়ে ঢাকা শহর একটি জলাবদ্ধ শহরে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম শহর একটি উঁচু-নিচু পাহাড়ের শহর। পাশেই বঙ্গোপসাগর। শহরটাকে চারদিক থেকে আঁকড়ে ধরে আছে কর্ণফুলী নদী। বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের জন্য কিছু প্রাকৃতিক ব্যবস্থার উদ্ভাবন অত্যন্ত জরুরি। সেই ব্যবস্থায় না গিয়ে অদূরদর্শী পরিকল্পনার ফলে জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামে এক জটিল আকার ধারণ করেছে। গত বছরে পানিনিষ্কাশনের পথে মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। বন্যার সময় দক্ষিণবঙ্গের গ্রামগুলো থেকে ক্রমাগত একই কথা শোনা যায়, বাঁধ ভেঙে তাঁদের এই দুর্দশার কারণগুলো ঘটছে এবং বাঁধ নির্মাণে সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতি সহজেই ধরা পড়ছে।
এবারে অন্যান্য বারের চেয়েও অনেক বেশি প্রতাপ নিয়ে নদীভাঙন শুরু হয়েছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ কোনো কিছুই বাদ পড়ছে না। তিন-চারতলা ভবনও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পানির শক্তিকে বোঝার ক্ষমতা আমাদের নীতিনির্ধারকদের এখনো হয়নি। আগুন, পানি ও বাতাস তিনটি প্রাকৃতিক শক্তি। এই তিন প্রাকৃতিক শক্তি এখন বাংলাদেশের মানুষের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারেই উদাসীন। এটি যে একটি জনপদের এক বড় সমস্যা, তা তারা যেন আমলেই নিতে চায় না। অথচ বড় বড় শহরে দেখেছি রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মানুষগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। সূর্য ওঠার আগেই বর্জ্য যথাস্থানে চলে যায় এবং আধুনিক প্রযুক্তির রিসাইকেল প্রক্রিয়ায় এই বর্জ্যগুলো সম্পদে পরিণত হয়। একবার পলিথিন নিয়ন্ত্রণে সরকারকে খুব তৎপর দেখা গিয়েছিল। অপচনশীল এই বস্তুটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটা বড় অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে; অথচ বিষয়টি এখন এমন শিথিল যে সর্বত্রই প্লাস্টিকের জয়যাত্রা। বন্যা এলে আমরা খুব তৎপর হই, নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য হাত বাড়াই। কিন্তু বন্যা চলে গেলে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি।
কয়েক দিন ধরে সারা বিশ্বের প্রচারমাধ্যমে বন্যার নানা রকম ছবি ফলাও করে ছাপা হয়েছে। ফলে বিশ্বের একটি ধারণা হয় যে এ দেশটি অনুন্নত সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিক্ষা ও রাজনীতির দেশ। আমাদের এই গ্রহেই যে আরও কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান আছে, তা আর কেউ ভাবে না। একবার আমার একটি নাটক জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়ে জার্মানরা অভিনয় করছিলেন। বিশাল বিশাল পোস্টার দেওয়া হয়েছিল বার্লিনের রেলস্টেশন ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়। আমার পাশে দাঁড়িয়ে একজন জার্মান পোস্টারটি দেখছিলেন এবং আমার দিকে হঠাৎ তাকিয়ে তিনি হয়তো অনুভব করলেন আমি সেই দেশেরই মানুষ, কাছে এগিয়ে আসতেই আমি আমার পরিচয় দিলাম।
সেটি ১৯৮৯ সাল। জার্মান ভদ্রলোক বললেন, তোমার দেশে কোনো শিল্প-সাহিত্য আছে? আমরা তো জানি দেশটি বন্যা, প্লাবন, দুর্ভিক্ষ আর মিলিটারি ডিকটেটরদের দেশ। আমি তাঁকে ব্যাখ্যা করলাম এবং তিনি নাটক দেখতে এলেন। নাটক প্রদর্শনীর শেষে দেখলাম তাঁর হাতে জার্মান ভাষায় অনূদিত আমার নাটকের একটি বই। তিনি বললেন, আজকে আমি বুঝলাম তোমাদের দেশটিতে একটি উন্নত সংস্কৃতিও আছে। কিন্তু রাজনীতির অতল বঞ্চনায় তোমরা একটা অচলায়তনে বসবাস করছ। তখন দেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলছে। আমি সেই ছবিগুলো তাঁকে দেখালাম। সেই জার্মান ভদ্রলোক এত বছর পরেও যদি আমাদের বানভাসি মানুষের ছবিগুলো দেখেন তাহলে কি একই কথা বলবেন?
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে