অরুণ কর্মকার
পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে তা হবে পানি নিয়ে। কথাটা প্রথম বলেছিলেন সম্ভবত বিশ্বব্যাংকের কোনো একজন প্রেসিডেন্ট। তারপর পৃথিবীময় অনেক বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজন বিভিন্ন সময় কথাটার পুনরাবৃত্তি করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীতে পানির ক্রমবর্ধমান সংকট সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করা। এ বছর বিশ্ব পানি দিবসের (২২ মার্চ) অনুষ্ঠানাদিতে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ঢাকা পর্যন্ত সর্বত্র ওই সংকটের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
গত ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত বিশ্ব পানি সম্মেলনে জাতিসংঘের উপস্থাপনায় বলা হয়েছে, পৃথিবীর ৫০০ কোটি মানুষ সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। ওই সম্মেলনেই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পৃথিবীর সেই সব বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সমস্যা নিরসনের জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘোষণা করেছে।
কিন্তু যে গ্রহটির মোট আয়তনের চার ভাগের তিন ভাগই পানি, সেখানে পানির সংকট হবে কেন! প্রথম কারণ হলো, পৃথিবীতে অঢেল পানি থাকলেও ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ খুবই কম। সেই যে কবি স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ তাঁর ‘দ্য রাইম অব দ্য এন্সিয়েন্ট মেরিনার’-এ বলেছেন, ‘...ওয়াটার, ওয়াটার এভরিহোয়্যার, নর এনি ড্রপ টু ড্রিংক’, অনেকটা সে রকম। অথচ আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ এখনো কোনো কিছুর নগণ্য দাম বোঝাতে ‘পানির দাম’ কথাটা ব্যবহার করে। যদিও সবাই এ কথাও জানে যে পানির অপর নাম জীবন। আর জীবন হচ্ছে অমূল্য। পানি ছাড়া কোনো জীবের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব।
বিজ্ঞানীরা হিসাব-নিকাশ করে দেখেছেন, পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগজুড়ে থাকা পানির মোট পরিমাণ ১৩৫ কোটি (১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন) ঘন কিলোমিটার। এটা যে কী বিপুল পরিমাণ পানি, তা আমাদের অনেকের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। তবে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু তথ্য থেকে আমরা অন্য রকম ধারণা পেতে পারি। যেমন ওই ১৩৫ কোটি ঘন কিলোমিটার পানির শতকরা ৯৭ ভাগ হচ্ছে লবণাক্ত পানি। পান করা, কৃষিকাজ কিংবা শিল্পে ব্যবহারের জন্য এই পানি উপযুক্ত নয়।
অবশিষ্ট ৩ শতাংশ হচ্ছে, ব্যবহার উপযোগী মিঠাপানি (ফ্রেশ ওয়াটার)। তবে এই ৩ শতাংশ পানিই পৃথিবীর বর্তমান চাহিদা মেটানোর জন্য যা প্রয়োজন, তার চেয়েও অনেক বেশি। কিন্তু কথা এখানেই শেষ নয়। ওই ৩ শতাংশের বেশির ভাগ পানিই থাকে পৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চল আচ্ছাদিত বরফ ও হিমবাহ আকারে এবং ভূগর্ভের অনেক গভীর জলাধারে (ডিপ ওয়াটার অ্যাকুইফার)। মেঘ হয়েও ভেসে বেড়ায় কিছু পানি। এরপর পৃথিবীর মোট পানির মাত্র দশমিক ৩ ভাগ মিঠাপানি থাকে নিত্যনৈমিত্তিক কাজে ব্যবহারের জন্য। নদী, খাল-বিল, হ্রদ ও অগভীর ভূগর্ভে থাকা এই পানির পরিমাণ এক লাখ ঘন কিলোমিটার।
বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে পৃথিবীতে মানবজাতির সব কাজে পানি ব্যবহার হয় ৫ হাজার ঘন কিলোমিটারের কম। এই হিসাবে মিঠাপানির প্রাপ্যতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু সমস্যা হলো পৃথিবীর সব মহাদেশে ও সব অঞ্চলে এই মিঠাপানি সমপরিমাণে পাওয়া যায় না। বছরের সব মৌসুমেও সর্বত্র সমপরিমাণ মিঠাপানি মেলে না। বর্ষায় প্রচুর অব্যবহৃত পানি সমুদ্রে চলে যায়। ব্যবহারের সুযোগই থাকে না। আবার শুকনো মৌসুমে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির প্রবাহ থাকে না। পৃথিবীর অন্যান্য মহাদেশ ও অঞ্চলের মতো আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায়ও এই সমস্যা প্রকট। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এই সমস্যাকে বিশ্বব্যাপী প্রকটতর করে তুলেছে।
পৃথিবীর প্রধান প্রধান নদীধারা একাধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত; অর্থাৎ আন্তর্জাতিক নদী। এসব নদীর পানি বণ্টন ও ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক আইনকানুন রয়েছে। কিন্তু পানির উৎস ও প্রাপ্যতায় যে ব্যাপক মৌসুমি ব্যবধান থাকে, সে কারণে পানিবণ্টন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনকানুন ছাপিয়ে প্রধান নির্ধারক হয়ে ওঠে রাজনীতি। যাকে আসলে পানির রাজনীতি বলা যায়। এই রাজনীতিতে উজানের দেশগুলোই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। তারা নিজের দেশের কৃষি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটাতে একতরফাভাবে অনেক বেশি পানি ব্যবহারের সুযোগ নেয়। হিমালয় থেকে উৎসারিত এবং ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা আমাদের দেশের প্রধান নদীগুলোর ক্ষেত্রেও আমরা এই প্রবণতা দেখি। আর তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে রাজনীতির কোনো কিছুই তো এখন আর অন্তরালে নেই।
আমাদের অভিন্ন নদীগুলোতে শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ কম থাকায় বঙ্গোপসাগর থেকে লবণাক্ত পানি দেশের অভ্যন্তরে অনেক দূর পর্যন্ত ঢুকে পড়ছে। একসময়ের শস্যভান্ডার বরিশাল অঞ্চল এখন খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতি এলাকা। কারণ, ছড়িয়ে পড়েছে লবণাক্ততা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলেও লবণাক্ততার আধিক্য পরিবেশ-প্রতিবেশের নিদারুণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানকার মানুষ প্রায় সারা বছর সুপেয় পানির কষ্টে কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। শুকনো মৌসুমে দেশের উত্তরাঞ্চলের কোনো কোনো এলাকায় মরুকরণের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শেরপুরের নিজের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরে একজন সাংবাদিক বন্ধু জানান, তাঁদের এলাকায় কয়েক বছর ধরে শুকনো মৌসুমের শুরুতেই কোনো কোনো খাল-নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ছে।
তবে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও হিস্যা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে সমস্যা, এটাই আমাদের দেশে মিঠা বা সুপেয় পানির প্রাপ্যতা কিংবা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার একমাত্র সমস্যা নয়। আমরা আমাদের নদ-নদী, খাল-বিল, হ্রদ-জলাশয়, পুকুর-ডোবাগুলো নিজেরাই বিপন্ন করে ফেলছি। দখলে-দূষণে আমাদের নিজস্ব পানির এই উৎসগুলোর এখন ত্রাহি অবস্থা। এগুলো রক্ষার জন্য যথেষ্ট আইনকানুন আমাদের দেশে আছে। এসব আইনকানুন প্রয়োগের কর্তৃপক্ষও রয়েছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। সবলের প্রতাপ ও প্রভাবে এসব আইনকানুন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। ঠিক যেমন অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের আন্তর্জাতিক আইনকানুন উজানের বড় এবং শক্তিধর দেশগুলোর কাছে কার্যকরভাবে ঘেঁষতে পারছে না।
আমরা শহর-নগরের খাল-নদী, পুকুর-ডোবা সব দখল ও ভরাট করে ফেলছি আইনের তোয়াক্কা না করে। আমাদের শহর-নগরগুলোতে পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা অপ্রতুল। কোথাও কোথাও তা একেবারেই নেই। আমরা ওই সব জলাশয়ে পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন করে পানিদূষণ করছি। আর শহর-নগরে ব্যবহারের জন্য গভীর নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে যাচ্ছি। ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
আমরা বাধাহীনভাবে শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলি। শহর-নগরের পয়োবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্যে আমরা নদীর পানি এতই দূষিত করে ফেলি যে তা পরিশোধন করেও ব্যবহারের উপযোগী কর যায় না। আমরা এই উৎসগুলোকে দূষণমুক্ত রাখতে পারলে ভূগর্ভের পানি ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো। প্রতিকারহীনভাবে দেশের সর্বত্র চলছে নদী-জলাশয় দখল। আসলে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বলতে আমাদের কিছুই নেই। পয়োনিষ্কাশনেরও একই অবস্থা।
এ বছর বিশ্ব পানি দিবস পালনের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, ‘পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে ত্বরান্বিত পরিবর্তন’। অর্থাৎ এই সংকট সমাধানের পদক্ষেপগুলো দ্রুত কার্যকর করা হবে। কিন্তু বাস্তবে বহুকাল থেকেই আমরা দেখে আসছি, এসব সংকট সমাধানের পরিবর্তে বিপরীত ধারায় চলছে। দ্রুততার সঙ্গে উল্টোমুখী পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে সরকারিভাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রকাশিত তথ্য হচ্ছে, দেশের ৪১ শতাংশ (প্রায় ৮ কোটি) মানুষ নিরাপদ পানি পায় না। আর স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন সুবিধাবঞ্চিত মানুষ দেশে ৬১ শতাংশ (প্রায় ১২ কোটি)। অথচ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষের কাছে নিরাপদ পানি পৌঁছাতে হবে।
আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মধ্যে একটি হচ্ছে নদী রক্ষা কমিশন (নরক)। এই কমিশনকে যথেষ্ট আইনি ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে; বিশেষ করে নদী দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে। কিন্তু দেশের কোথাও কোনো নদী দখলের প্রতিকার তারা করতে পেরেছেন এমন নজির নেই।
আসলে পানি নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার যে আশঙ্কার কথা শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে, পৃথিবীর দেশে দেশে সেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শুরুটা হয়েছে দেশগুলোর অভ্যন্তরে, তৃণমূল পর্যায় থেকে। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতির ভূমিকা এ ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। এই যুদ্ধই পর্যায়ক্রমে দেশগুলোর জাতীয় পর্যায়ে এবং সংকট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ার ধারণা করা মোটেই অযৌক্তিক নয়।
অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে তা হবে পানি নিয়ে। কথাটা প্রথম বলেছিলেন সম্ভবত বিশ্বব্যাংকের কোনো একজন প্রেসিডেন্ট। তারপর পৃথিবীময় অনেক বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজন বিভিন্ন সময় কথাটার পুনরাবৃত্তি করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীতে পানির ক্রমবর্ধমান সংকট সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করা। এ বছর বিশ্ব পানি দিবসের (২২ মার্চ) অনুষ্ঠানাদিতে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ঢাকা পর্যন্ত সর্বত্র ওই সংকটের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
গত ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত বিশ্ব পানি সম্মেলনে জাতিসংঘের উপস্থাপনায় বলা হয়েছে, পৃথিবীর ৫০০ কোটি মানুষ সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। ওই সম্মেলনেই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পৃথিবীর সেই সব বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সমস্যা নিরসনের জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘোষণা করেছে।
কিন্তু যে গ্রহটির মোট আয়তনের চার ভাগের তিন ভাগই পানি, সেখানে পানির সংকট হবে কেন! প্রথম কারণ হলো, পৃথিবীতে অঢেল পানি থাকলেও ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ খুবই কম। সেই যে কবি স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ তাঁর ‘দ্য রাইম অব দ্য এন্সিয়েন্ট মেরিনার’-এ বলেছেন, ‘...ওয়াটার, ওয়াটার এভরিহোয়্যার, নর এনি ড্রপ টু ড্রিংক’, অনেকটা সে রকম। অথচ আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ এখনো কোনো কিছুর নগণ্য দাম বোঝাতে ‘পানির দাম’ কথাটা ব্যবহার করে। যদিও সবাই এ কথাও জানে যে পানির অপর নাম জীবন। আর জীবন হচ্ছে অমূল্য। পানি ছাড়া কোনো জীবের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব।
বিজ্ঞানীরা হিসাব-নিকাশ করে দেখেছেন, পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগজুড়ে থাকা পানির মোট পরিমাণ ১৩৫ কোটি (১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন) ঘন কিলোমিটার। এটা যে কী বিপুল পরিমাণ পানি, তা আমাদের অনেকের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। তবে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু তথ্য থেকে আমরা অন্য রকম ধারণা পেতে পারি। যেমন ওই ১৩৫ কোটি ঘন কিলোমিটার পানির শতকরা ৯৭ ভাগ হচ্ছে লবণাক্ত পানি। পান করা, কৃষিকাজ কিংবা শিল্পে ব্যবহারের জন্য এই পানি উপযুক্ত নয়।
অবশিষ্ট ৩ শতাংশ হচ্ছে, ব্যবহার উপযোগী মিঠাপানি (ফ্রেশ ওয়াটার)। তবে এই ৩ শতাংশ পানিই পৃথিবীর বর্তমান চাহিদা মেটানোর জন্য যা প্রয়োজন, তার চেয়েও অনেক বেশি। কিন্তু কথা এখানেই শেষ নয়। ওই ৩ শতাংশের বেশির ভাগ পানিই থাকে পৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চল আচ্ছাদিত বরফ ও হিমবাহ আকারে এবং ভূগর্ভের অনেক গভীর জলাধারে (ডিপ ওয়াটার অ্যাকুইফার)। মেঘ হয়েও ভেসে বেড়ায় কিছু পানি। এরপর পৃথিবীর মোট পানির মাত্র দশমিক ৩ ভাগ মিঠাপানি থাকে নিত্যনৈমিত্তিক কাজে ব্যবহারের জন্য। নদী, খাল-বিল, হ্রদ ও অগভীর ভূগর্ভে থাকা এই পানির পরিমাণ এক লাখ ঘন কিলোমিটার।
বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে পৃথিবীতে মানবজাতির সব কাজে পানি ব্যবহার হয় ৫ হাজার ঘন কিলোমিটারের কম। এই হিসাবে মিঠাপানির প্রাপ্যতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু সমস্যা হলো পৃথিবীর সব মহাদেশে ও সব অঞ্চলে এই মিঠাপানি সমপরিমাণে পাওয়া যায় না। বছরের সব মৌসুমেও সর্বত্র সমপরিমাণ মিঠাপানি মেলে না। বর্ষায় প্রচুর অব্যবহৃত পানি সমুদ্রে চলে যায়। ব্যবহারের সুযোগই থাকে না। আবার শুকনো মৌসুমে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির প্রবাহ থাকে না। পৃথিবীর অন্যান্য মহাদেশ ও অঞ্চলের মতো আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায়ও এই সমস্যা প্রকট। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এই সমস্যাকে বিশ্বব্যাপী প্রকটতর করে তুলেছে।
পৃথিবীর প্রধান প্রধান নদীধারা একাধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত; অর্থাৎ আন্তর্জাতিক নদী। এসব নদীর পানি বণ্টন ও ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক আইনকানুন রয়েছে। কিন্তু পানির উৎস ও প্রাপ্যতায় যে ব্যাপক মৌসুমি ব্যবধান থাকে, সে কারণে পানিবণ্টন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনকানুন ছাপিয়ে প্রধান নির্ধারক হয়ে ওঠে রাজনীতি। যাকে আসলে পানির রাজনীতি বলা যায়। এই রাজনীতিতে উজানের দেশগুলোই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। তারা নিজের দেশের কৃষি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটাতে একতরফাভাবে অনেক বেশি পানি ব্যবহারের সুযোগ নেয়। হিমালয় থেকে উৎসারিত এবং ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা আমাদের দেশের প্রধান নদীগুলোর ক্ষেত্রেও আমরা এই প্রবণতা দেখি। আর তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে রাজনীতির কোনো কিছুই তো এখন আর অন্তরালে নেই।
আমাদের অভিন্ন নদীগুলোতে শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ কম থাকায় বঙ্গোপসাগর থেকে লবণাক্ত পানি দেশের অভ্যন্তরে অনেক দূর পর্যন্ত ঢুকে পড়ছে। একসময়ের শস্যভান্ডার বরিশাল অঞ্চল এখন খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতি এলাকা। কারণ, ছড়িয়ে পড়েছে লবণাক্ততা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলেও লবণাক্ততার আধিক্য পরিবেশ-প্রতিবেশের নিদারুণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানকার মানুষ প্রায় সারা বছর সুপেয় পানির কষ্টে কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। শুকনো মৌসুমে দেশের উত্তরাঞ্চলের কোনো কোনো এলাকায় মরুকরণের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শেরপুরের নিজের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরে একজন সাংবাদিক বন্ধু জানান, তাঁদের এলাকায় কয়েক বছর ধরে শুকনো মৌসুমের শুরুতেই কোনো কোনো খাল-নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ছে।
তবে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও হিস্যা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে সমস্যা, এটাই আমাদের দেশে মিঠা বা সুপেয় পানির প্রাপ্যতা কিংবা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার একমাত্র সমস্যা নয়। আমরা আমাদের নদ-নদী, খাল-বিল, হ্রদ-জলাশয়, পুকুর-ডোবাগুলো নিজেরাই বিপন্ন করে ফেলছি। দখলে-দূষণে আমাদের নিজস্ব পানির এই উৎসগুলোর এখন ত্রাহি অবস্থা। এগুলো রক্ষার জন্য যথেষ্ট আইনকানুন আমাদের দেশে আছে। এসব আইনকানুন প্রয়োগের কর্তৃপক্ষও রয়েছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। সবলের প্রতাপ ও প্রভাবে এসব আইনকানুন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। ঠিক যেমন অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের আন্তর্জাতিক আইনকানুন উজানের বড় এবং শক্তিধর দেশগুলোর কাছে কার্যকরভাবে ঘেঁষতে পারছে না।
আমরা শহর-নগরের খাল-নদী, পুকুর-ডোবা সব দখল ও ভরাট করে ফেলছি আইনের তোয়াক্কা না করে। আমাদের শহর-নগরগুলোতে পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা অপ্রতুল। কোথাও কোথাও তা একেবারেই নেই। আমরা ওই সব জলাশয়ে পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন করে পানিদূষণ করছি। আর শহর-নগরে ব্যবহারের জন্য গভীর নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে যাচ্ছি। ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
আমরা বাধাহীনভাবে শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলি। শহর-নগরের পয়োবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্যে আমরা নদীর পানি এতই দূষিত করে ফেলি যে তা পরিশোধন করেও ব্যবহারের উপযোগী কর যায় না। আমরা এই উৎসগুলোকে দূষণমুক্ত রাখতে পারলে ভূগর্ভের পানি ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো। প্রতিকারহীনভাবে দেশের সর্বত্র চলছে নদী-জলাশয় দখল। আসলে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বলতে আমাদের কিছুই নেই। পয়োনিষ্কাশনেরও একই অবস্থা।
এ বছর বিশ্ব পানি দিবস পালনের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, ‘পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে ত্বরান্বিত পরিবর্তন’। অর্থাৎ এই সংকট সমাধানের পদক্ষেপগুলো দ্রুত কার্যকর করা হবে। কিন্তু বাস্তবে বহুকাল থেকেই আমরা দেখে আসছি, এসব সংকট সমাধানের পরিবর্তে বিপরীত ধারায় চলছে। দ্রুততার সঙ্গে উল্টোমুখী পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে সরকারিভাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রকাশিত তথ্য হচ্ছে, দেশের ৪১ শতাংশ (প্রায় ৮ কোটি) মানুষ নিরাপদ পানি পায় না। আর স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন সুবিধাবঞ্চিত মানুষ দেশে ৬১ শতাংশ (প্রায় ১২ কোটি)। অথচ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষের কাছে নিরাপদ পানি পৌঁছাতে হবে।
আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মধ্যে একটি হচ্ছে নদী রক্ষা কমিশন (নরক)। এই কমিশনকে যথেষ্ট আইনি ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে; বিশেষ করে নদী দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে। কিন্তু দেশের কোথাও কোনো নদী দখলের প্রতিকার তারা করতে পেরেছেন এমন নজির নেই।
আসলে পানি নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার যে আশঙ্কার কথা শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে, পৃথিবীর দেশে দেশে সেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শুরুটা হয়েছে দেশগুলোর অভ্যন্তরে, তৃণমূল পর্যায় থেকে। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতির ভূমিকা এ ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। এই যুদ্ধই পর্যায়ক্রমে দেশগুলোর জাতীয় পর্যায়ে এবং সংকট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ার ধারণা করা মোটেই অযৌক্তিক নয়।
অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
৯ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগে