আ. লীগের নির্বাচনী ইশতেহার: শুধু অঙ্গীকারের ফানুস নয়

বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮: ০৩
আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ১০: ৪৩

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইশতেহারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জনগণের কাছে তাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা, অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে দলের ইশতেহার ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সরকারের কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির মাধ্যমে এবারের ইশতেহার প্রণয়ন করা হয়েছে। ইশতেহার প্রণয়নের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা ছিল। 

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। এবার আবারও তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনের আগে দলের ইশতেহার ঘোষণাকালে শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। বাঙালিদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি।’

এরপর মাথাপিছু আয়, জিডিপি ও বাজেটের আকার, বিদ্যুৎ, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা খাতে সরকারের অর্জনগুলো তুলে ধরে বলেন, ‘মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়, মাতৃভূমির স্বাধীনতা থেকে শুরু করে এ দেশের যা কিছু মহৎ অর্জন, তা এসেছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাত ধরেই ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চমধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে।’

ইশতেহারে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার শুধু অঙ্গীকারের ফানুস নয়; বরং তা দূরদর্শী, বাস্তবমুখী ও অর্জনযোগ্য। গত নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যেসব প্রতিশ্রুতি জাতির সামনে দিয়েছিল, এর বেশির ভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে; কিছু প্রতিশ্রুতি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। শেখ হাসিনা অবশ্য এটাও বলেছেন, ‘আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে সব সময়ই যে আমরা শতভাগ সফল হয়েছি, এমন দাবি করব না। তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কথামালার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। আমরা যা বলি, তা বাস্তবায়ন করি।’

১৫ বছরের ভুলত্রুটির কথাও উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিগত ১৫ বছরের সরকার পরিচালনার পথপরিক্রমায় যা কিছু ভুলত্রুটি, তার দায়ভার আমাদের। সাফল্যের কৃতিত্ব আপনাদের। আমাদের ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আমরা কথা দিচ্ছি, অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করব।’

আওয়ামী লীগের এবারের ইশতেহারের স্লোগান ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’। স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক, জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিগত এবং উদ্ভাবনী। স্মার্ট বাংলাদেশের রয়েছে চারটি স্তম্ভ—স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ইশতেহারে দেওয়া হয়েছে।  ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘দিনবদলের সনদ’ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সেই ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ছিল দলটির।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। আর সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’।

এবার ইশতেহারে ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো:
. দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।  
২. কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। 
৩. আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
৪. লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষিব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি।
৫. দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো। 
৬.ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো। 
৭. নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা।
৮. সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা। 
৯. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। 
১০. সাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা। 
১১. সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কথামালার রাজনীতি নয়, তাঁর দল যে কথা বলে, সেই কথা বাস্তবায়ন করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা করে। তিনি এটাও বলেছেন, ‘নির্বাচন এলেই মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং উন্নয়নবিরোধী একটি চক্র ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে সক্রিয় হয়ে ওঠে। নির্বাচনে কূটকৌশল অবলম্বন বা কারচুপির মাধ্যমে কিংবা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে তারা আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে। সফল না হলে জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিশোধস্পৃহায়। অগ্নিসন্ত্রাস, যানবাহন পোড়ানো, বোমাবাজি, নাশকতা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে ভীতি-সন্ত্রস্ত করে ঘরবন্দী করতে চায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তার ওপর এবার তারা বিদেশ থেকেও কলকাঠি নাড়ছে। 

জনগণের ম্যান্ডেট পাবে না—এটা বুঝতে পেরে আগে থেকে এবার তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে। হরতাল-অবরোধের নামে যানবাহন পোড়ানো, মানুষ হত্যা, রেললাইন উপড়ে ফেলাসহ বিভিন্ন নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে। মা ও শিশুর অগ্নিদগ্ধ লাশ সবার বিবেককে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। এ ধরনের হীন কাজ আর সহ্য করা যায় না। জনগণের সাড়া না পেয়ে ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে এসব নাশকতা চালিয়ে জানমালের ক্ষতি করছে। সন্ত্রাস করে নির্বাচন বানচাল করার স্বপ্ন-সাধ কোনো দিনই তাদের পূরণ হতে দেবে না এ দেশের জনগণ।’ 

শেখ হাসিনা বলেন, ‘যত দিন আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখেন, সুস্থ রাখেন, তত দিন যা কর্তব্য হিসেবে আমি গ্রহণ করেছি, সেখান থেকে সরে আসব না। আপনাদের সেবক হিসেবে কাজ করার মধ্য দিয়েই আমি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। মা-বাবা, ভাই, আত্মীয়স্বজন—সবাইকে হারিয়ে আমি রাজনীতিতে এসেছি শুধু আমার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত কাজ শেষ করে এ দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। এ কাজ করতে গিয়ে আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবার। কিন্তু বাবার কথা ভেবে, আপনাদের কথা ভেবে আমি পিছপা হইনি।’ 

শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল পর্যবেক্ষণ করে এটা বলা যায় যে তিনি ভালোর পক্ষে চলতে সচেষ্ট, তবে পরিবেশ-পরিস্থিতি সব সময় অনুকূলে থাকে না। সব সময় সবকিছু ইচ্ছামতো করতে না পারলেও তিনি লক্ষ্যচ্যুত হন না। এটা ঠিক যে নিজেকে যোগ্যতম প্রমাণ করেই নৌকার কান্ডারি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এতে যাঁরা বিষাদ ভারাক্রান্ত হয়ে পীড়িত বোধ করেন তাঁরা শেখ হাসিনার মধ্যে ভালো কিছু দেখেন না। ফুলের সৌন্দর্য না দেখে তাঁরা পোকা খোঁজেন। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এটাই যে শেখ হাসিনার নিন্দা বা সমালোচনা করে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়ানো যাবে না। কারণ সক্ষমতার বিচারে তিনিই এখন বাংলাদেশ। তাঁর প্রতি যাঁরা ঈর্ষাকাতর, তাঁরা কেউ বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে সক্ষম হননি। 

শেখ হাসিনা দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘জনগণের অবিচল আস্থাই আওয়ামী লীগের শক্তি। এ দেশের জনগণের প্রতি আমাদের রয়েছে অগাধ বিশ্বাস। তাই আমরা নিজেদের অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মতো বিশাল অবকাঠামো গড়ে তোলার সাহস দেখাতে পেরেছি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেট্রোরেল, বর্ধিত বিমান ও নৌবন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী টানেল, গভীর সমুদ্রবন্দরসহ প্রতিশ্রুত মেগা প্রকল্পগুলো।’

আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের অবশ্যই অবকাঠামোগত দৃশ্যমান অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে। আবার মানুষের আয়-ব্যয়ের অসংগতি, দুর্নীতি, আয়বৈষম্য, সম্পদবৈষম্য ইত্যাদি বিষয়ও আছে। আছে রাজনৈতিক সংকট, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতা। মানুষের মধ্যে কোনো কোনো বিষয়ে যে অসন্তোষ আছে তা অস্বীকার না করে বরং তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আওয়ামী লীগ যে কথামালার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না, সেটাও মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে যে ১১টি বিষয়ে অগ্রাধিকারের কথা বলা হয়েছে, তা পালনে কোনো বিচ্যুতি বা শৈথিল্য দেখানো চলবে না।

বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত