ড. মইনুল ইসলাম
২২ থেকে ২৪ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী জোহানেসবার্গে ব্রিকসের ১৫তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যাতে আমন্ত্রিত হয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যোগ দেন। এবারের সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধ বাধানোর দায়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে যোগ দেননি। তাঁর জায়গায় রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। এতে সম্মেলনের গুরুত্ব কিছুটা খর্ব হয়েছে। বাংলাদেশ ব্রিকস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের’ শেয়ারহোল্ডার সদস্য। খোদ ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই আবেদন করেছে, কিন্তু এ ব্যাপারে ব্রিকসের পাঁচ সদস্যের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় বাংলাদেশকে আরও অপেক্ষা করতে হবে। সদস্য হওয়ার আবেদন করার জন্য আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। কারণ, ব্রিকস প্রতিষ্ঠার এই সিদ্ধান্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের তল্পিবাহী আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের দাদাগিরির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসী প্রয়াস হিসেবে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত হয়েছে।
ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য ২২ দেশ আবেদন করলেও ৬টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, বাকি দেশগুলোকে অপেক্ষায় থাকতে হবে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ভারত মনে করছে, সদস্যসংখ্যা বাড়লে ব্রিকসে চীনের আধিপত্য আরও বেড়ে যাবে। প্রধান দুই সদস্যদেশের মধ্যে এহেন বিশ্বাসের ঘাটতি ব্রিকসের জন্য বিপজ্জনক। এমনিতেই এই দুই দেশের ক্রমবর্ধমান বৈরিতা ব্রিকসের অগ্রগতিকে অনেকখানি থমকে দিয়েছে।
২০১৪ সালের ১৫ জুলাই ব্রাজিলের ফোর্টালেজা নগরীতে ব্রিকস দেশগুলো যখন তখনকার ‘ব্রিকস ব্যাংক’ বা বর্তমান ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল, তখন ওই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে আমি একটি জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখেছিলাম। ব্রিকস শব্দটি বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগ ও ব্যবসা-গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান-স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নিলের প্রবর্তিত একটি টার্ম, যা তিনি উদ্ভাবন করেছেন ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকা—বিশ্বের এই পাঁচটি দ্রত-উত্থানশীল অর্থনীতির ইংরেজি নামের আদ্যাক্ষরের সমন্বয়ে। এই পাঁচটি দেশ বিশ্বের আয়তনের প্রায় ২৫ শতাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত, এগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ এবং বিশ্বের মোট জিডিপির প্রায় ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ এই পাঁচটি দেশ উৎপাদন করছে। এগুলোর মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুটো দেশ ভারত ও চীন যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশ রাশিয়া। এই দেশগুলোর কোনোটাকেই মাথাপিছু জিডিপির বিবেচনায় উন্নত দেশ বলা যাবে না, যদিও চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি এবং এখানকার জনগণের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত দ্রুতবর্ধনশীল। ভারতের মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারের মতো, তাই ভারতকে এখনো একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ বলা যায়। মাথাপিছু জিডিপির বিচারে এই পাঁচটি দেশ ‘উন্নয়নশীল দেশ’ হলেও বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গত তিন দশকের ধারাবাহিকতায় ব্রিকস গঠনকারী দেশগুলো চমকপ্রদ সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার অবস্থানে চলে এসেছে।
ক্রয়ক্ষমতা সাম্যের (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটিস বা পিপিপি) ভিত্তিতে চীনের জিডিপি ২০১৪ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে এবং ভারতও ২০৩০ সালের মধ্যেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। তার মানে পিপিপি পদ্ধতিতে ব্রিকসের অবদান বিশ্বের জিডিপির ৪৫ শতাংশের বেশি হয়ে গেছে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে। তাই এই জোটটিকে বিশ্ব অর্থনীতির নব্য পরাশক্তি অভিহিত করলে অত্যুক্তি হবে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিকস দেশগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেওয়ার প্রয়াস চলছে এবং তৃতীয় বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশও তাদের নেতৃত্ব মেনে নিচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস শহরে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত অনুসারে নব্য সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন-নেতৃত্বাধীন উন্নত, শিল্পায়িত দেশগুলো যেভাবে উপনিবেশ-উত্তর উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং গ্যাট ও এর উত্তরসূরি ডব্লিউটিওর মাধ্যমে প্রচেষ্টা জোরদার করে চলেছে, ব্রিকসের নেতৃত্বে এখন তৃতীয় বিশ্ব তার বিরুদ্ধে প্রায়ই সফল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। এই নব্য সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করার জন্য ‘আধিপত্য-পরনির্ভরতা তাত্ত্বিক কাঠামোর’ অনুসারী অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির তত্ত্বগুলো পুঁজিবাদী কেন্দ্রগুলো কীভাবে তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তীয় দেশগুলো থেকে পুঁজি পাচারের নানা মেকানিজমকে ব্যবহার করে চলেছে, তার বিশ্লেষণ উপস্থাপন করছে। ফলে আফ্রো-এশীয় ও লাতিন আমেরিকার জনগণের মধ্যে গত পাঁচ দশকে এ বিষয়টি সম্পর্কে গভীর সচেতনতার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বিংশ শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকের প্রতিবিপ্লবের জোয়ারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক-দাবিদার রাষ্ট্রগুলোর পতন ঘটেছে, তবু প্রান্তীয় অবস্থানের উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী কেন্দ্রগুলোয় পুঁজির পাচার ঠেকাতে হলে নব্য সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আগ্রাসনকে রুখতেই হবে—এই চেতনাটুকু প্রবলভাবে সঞ্চারিত হয়েছে উন্নয়নশীল বিশ্বের জনমানসে। এই চেতনার কারণেই লাতিন আমেরিকার নয়টি দেশে বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে—ব্রাজিল, মেক্সিকো, পেরু, চিলি, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, উরুগুয়ে ও নিকারাগুয়ায় এখন বামপন্থী সরকার ক্ষমতাসীন। সমাজতান্ত্রিক কিউবায় ১৯৫৯ সাল থেকেই বামপন্থী সরকার টিকে আছে মার্কিন অবরোধ সত্ত্বেও।
অন্যদিকে, বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকেই ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ ছদ্মবেশধারী বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিশ্বে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগ্রাসী তৎপরতাকে জোরদার করার প্রয়াস সত্ত্বেও ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে চলমান অর্থনৈতিক সংকট কাটানো ক্রমেই কঠিন হয়ে চলেছে। ব্রিটেনের ‘থ্যাচারিজম’ এবং মার্কিন ‘রেগানোমিকস’কে ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ তৎপরতা বলা হয়। এই তৎপরতার অংশ হিসেবেই ১৯৭৯ সালে ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ প্রণীত হয়েছিল মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (অর্থ মন্ত্রণালয়), আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে। (১৯৮৯ সালে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ উইলিয়ামসন এই ত্রিপক্ষীয় সমঝোতাকে ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ নামে অভিহিত করেন)। এই ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমেই এগিয়ে চলেছে উন্নয়নশীল বিশ্বে মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রচলনের হাতিয়ার হিসেবে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংককে অপব্যবহারের সাম্রাজ্যবাদী খেলা। ১৯৭৯ সালেই বাংলাদেশ এই আগ্রাসনের জালে আটকা পড়েছিল। ওই সময়টাতে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসে প্রতিবছর মারাত্মক ঘাটতি হতো। এ দেশের রপ্তানি আয় দিয়ে ওই বছরগুলোতে আমদানি ব্যয়ের ৩০-৩২ শতাংশের বেশি মেটানো যেত না, ফলে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের ওপর অর্থনীতির নির্ভরশীলতা ছিল মারাত্মক, জিডিপির ১০-১২ শতাংশ। (১৯৮১-৮২ অর্থবছরে জিডিপির ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল ওই বৈদেশিক ঋণ ও খয়রাতনির্ভরতা)। তাই বাধ্য হয়ে জিয়াউর রহমানের সরকারকে আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি বা ইএফএফ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য। ১৯৮০ সালে ওই ঋণ অনুমোদন করা হলেও ঋণের সঙ্গে বিরাট একটা শর্তের তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে। ওই শর্তগুলো এতই কঠোর ছিল যে জিয়াউর রহমানের সরকার ওগুলো পূরণে ‘ধীরে চলো নীতি’ অবলম্বন করে। ফলে ঋণের প্রথম কিস্তির ২০ মিলিয়ন ডলার ছাড় করার পর আইএমএফ রুষ্ট হয়ে বাকি ৭৮০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিল করে দিয়েছিল। পরে ১৯৮২-৮৩ সালে এরশাদ সরকারের আমলে ওই সব শর্তের অনেকগুলো পূরণ করা হয়েছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই এই শর্তগুলোকে ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’ অভিহিত করে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণ পাওয়ার প্রায় অভিন্ন শর্তাবলিতে রূপান্তরিত করেছে। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো চার দশক ধরে এই দুটো সংস্থা থেকে যত ঋণ নিয়েছে তার সবগুলোতেই শর্তগুলো জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রাইভেটাইজেশন, ডিরেগুলেশন, লিবারালাইজেশন ও গ্লোবালাইজেশন—এই চারটি ডাইমেনশনে অর্থনীতির ওপর ব্যক্তি খাতের নিয়ন্ত্রণকে যথাসম্ভব নিরঙ্কুশ করা এবং রাষ্ট্রের ভূমিকাকে ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করার এই মতাদর্শিক জবরদস্তি তৃতীয় বিশ্বের সচেতন জনগণের মধ্যে ক্রমেই প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রীরা এখনো আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের অপমানজনক শর্তাধীন ঋণ পাওয়াকে তাঁদের বাহাদুরি হিসেবে জাহির করে চলেছেন। এখন বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা জিডিপির ১ শতাংশের নিচে নেমে গেলেও তাঁরা এই বদখাসলত ছাড়তে পারছেন না! বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের নিষ্ঠুর দাদাগিরির প্রত্যক্ষ শিকার হয়েছিল পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিলের নাটকটায়, নিজেদের অর্থায়নে ওই সেতু বানিয়ে আমরা তার জবাব দিয়েছি। অতএব, ব্রিকসের প্রতি আমাদের পক্ষপাতিত্ব থাকাই স্বাভাবিক।
২২ থেকে ২৪ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী জোহানেসবার্গে ব্রিকসের ১৫তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যাতে আমন্ত্রিত হয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যোগ দেন। এবারের সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধ বাধানোর দায়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে যোগ দেননি। তাঁর জায়গায় রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। এতে সম্মেলনের গুরুত্ব কিছুটা খর্ব হয়েছে। বাংলাদেশ ব্রিকস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের’ শেয়ারহোল্ডার সদস্য। খোদ ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই আবেদন করেছে, কিন্তু এ ব্যাপারে ব্রিকসের পাঁচ সদস্যের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় বাংলাদেশকে আরও অপেক্ষা করতে হবে। সদস্য হওয়ার আবেদন করার জন্য আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। কারণ, ব্রিকস প্রতিষ্ঠার এই সিদ্ধান্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের তল্পিবাহী আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের দাদাগিরির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসী প্রয়াস হিসেবে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত হয়েছে।
ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য ২২ দেশ আবেদন করলেও ৬টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, বাকি দেশগুলোকে অপেক্ষায় থাকতে হবে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ভারত মনে করছে, সদস্যসংখ্যা বাড়লে ব্রিকসে চীনের আধিপত্য আরও বেড়ে যাবে। প্রধান দুই সদস্যদেশের মধ্যে এহেন বিশ্বাসের ঘাটতি ব্রিকসের জন্য বিপজ্জনক। এমনিতেই এই দুই দেশের ক্রমবর্ধমান বৈরিতা ব্রিকসের অগ্রগতিকে অনেকখানি থমকে দিয়েছে।
২০১৪ সালের ১৫ জুলাই ব্রাজিলের ফোর্টালেজা নগরীতে ব্রিকস দেশগুলো যখন তখনকার ‘ব্রিকস ব্যাংক’ বা বর্তমান ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল, তখন ওই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে আমি একটি জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখেছিলাম। ব্রিকস শব্দটি বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগ ও ব্যবসা-গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান-স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নিলের প্রবর্তিত একটি টার্ম, যা তিনি উদ্ভাবন করেছেন ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকা—বিশ্বের এই পাঁচটি দ্রত-উত্থানশীল অর্থনীতির ইংরেজি নামের আদ্যাক্ষরের সমন্বয়ে। এই পাঁচটি দেশ বিশ্বের আয়তনের প্রায় ২৫ শতাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত, এগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ এবং বিশ্বের মোট জিডিপির প্রায় ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ এই পাঁচটি দেশ উৎপাদন করছে। এগুলোর মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুটো দেশ ভারত ও চীন যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশ রাশিয়া। এই দেশগুলোর কোনোটাকেই মাথাপিছু জিডিপির বিবেচনায় উন্নত দেশ বলা যাবে না, যদিও চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি এবং এখানকার জনগণের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত দ্রুতবর্ধনশীল। ভারতের মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারের মতো, তাই ভারতকে এখনো একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ বলা যায়। মাথাপিছু জিডিপির বিচারে এই পাঁচটি দেশ ‘উন্নয়নশীল দেশ’ হলেও বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গত তিন দশকের ধারাবাহিকতায় ব্রিকস গঠনকারী দেশগুলো চমকপ্রদ সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার অবস্থানে চলে এসেছে।
ক্রয়ক্ষমতা সাম্যের (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটিস বা পিপিপি) ভিত্তিতে চীনের জিডিপি ২০১৪ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে এবং ভারতও ২০৩০ সালের মধ্যেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। তার মানে পিপিপি পদ্ধতিতে ব্রিকসের অবদান বিশ্বের জিডিপির ৪৫ শতাংশের বেশি হয়ে গেছে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে। তাই এই জোটটিকে বিশ্ব অর্থনীতির নব্য পরাশক্তি অভিহিত করলে অত্যুক্তি হবে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিকস দেশগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেওয়ার প্রয়াস চলছে এবং তৃতীয় বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশও তাদের নেতৃত্ব মেনে নিচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস শহরে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত অনুসারে নব্য সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন-নেতৃত্বাধীন উন্নত, শিল্পায়িত দেশগুলো যেভাবে উপনিবেশ-উত্তর উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং গ্যাট ও এর উত্তরসূরি ডব্লিউটিওর মাধ্যমে প্রচেষ্টা জোরদার করে চলেছে, ব্রিকসের নেতৃত্বে এখন তৃতীয় বিশ্ব তার বিরুদ্ধে প্রায়ই সফল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। এই নব্য সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করার জন্য ‘আধিপত্য-পরনির্ভরতা তাত্ত্বিক কাঠামোর’ অনুসারী অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির তত্ত্বগুলো পুঁজিবাদী কেন্দ্রগুলো কীভাবে তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তীয় দেশগুলো থেকে পুঁজি পাচারের নানা মেকানিজমকে ব্যবহার করে চলেছে, তার বিশ্লেষণ উপস্থাপন করছে। ফলে আফ্রো-এশীয় ও লাতিন আমেরিকার জনগণের মধ্যে গত পাঁচ দশকে এ বিষয়টি সম্পর্কে গভীর সচেতনতার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বিংশ শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকের প্রতিবিপ্লবের জোয়ারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক-দাবিদার রাষ্ট্রগুলোর পতন ঘটেছে, তবু প্রান্তীয় অবস্থানের উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী কেন্দ্রগুলোয় পুঁজির পাচার ঠেকাতে হলে নব্য সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আগ্রাসনকে রুখতেই হবে—এই চেতনাটুকু প্রবলভাবে সঞ্চারিত হয়েছে উন্নয়নশীল বিশ্বের জনমানসে। এই চেতনার কারণেই লাতিন আমেরিকার নয়টি দেশে বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে—ব্রাজিল, মেক্সিকো, পেরু, চিলি, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, উরুগুয়ে ও নিকারাগুয়ায় এখন বামপন্থী সরকার ক্ষমতাসীন। সমাজতান্ত্রিক কিউবায় ১৯৫৯ সাল থেকেই বামপন্থী সরকার টিকে আছে মার্কিন অবরোধ সত্ত্বেও।
অন্যদিকে, বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকেই ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ ছদ্মবেশধারী বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিশ্বে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগ্রাসী তৎপরতাকে জোরদার করার প্রয়াস সত্ত্বেও ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে চলমান অর্থনৈতিক সংকট কাটানো ক্রমেই কঠিন হয়ে চলেছে। ব্রিটেনের ‘থ্যাচারিজম’ এবং মার্কিন ‘রেগানোমিকস’কে ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ তৎপরতা বলা হয়। এই তৎপরতার অংশ হিসেবেই ১৯৭৯ সালে ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ প্রণীত হয়েছিল মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (অর্থ মন্ত্রণালয়), আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে। (১৯৮৯ সালে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ উইলিয়ামসন এই ত্রিপক্ষীয় সমঝোতাকে ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ নামে অভিহিত করেন)। এই ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমেই এগিয়ে চলেছে উন্নয়নশীল বিশ্বে মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রচলনের হাতিয়ার হিসেবে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংককে অপব্যবহারের সাম্রাজ্যবাদী খেলা। ১৯৭৯ সালেই বাংলাদেশ এই আগ্রাসনের জালে আটকা পড়েছিল। ওই সময়টাতে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসে প্রতিবছর মারাত্মক ঘাটতি হতো। এ দেশের রপ্তানি আয় দিয়ে ওই বছরগুলোতে আমদানি ব্যয়ের ৩০-৩২ শতাংশের বেশি মেটানো যেত না, ফলে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের ওপর অর্থনীতির নির্ভরশীলতা ছিল মারাত্মক, জিডিপির ১০-১২ শতাংশ। (১৯৮১-৮২ অর্থবছরে জিডিপির ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল ওই বৈদেশিক ঋণ ও খয়রাতনির্ভরতা)। তাই বাধ্য হয়ে জিয়াউর রহমানের সরকারকে আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি বা ইএফএফ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য। ১৯৮০ সালে ওই ঋণ অনুমোদন করা হলেও ঋণের সঙ্গে বিরাট একটা শর্তের তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে। ওই শর্তগুলো এতই কঠোর ছিল যে জিয়াউর রহমানের সরকার ওগুলো পূরণে ‘ধীরে চলো নীতি’ অবলম্বন করে। ফলে ঋণের প্রথম কিস্তির ২০ মিলিয়ন ডলার ছাড় করার পর আইএমএফ রুষ্ট হয়ে বাকি ৭৮০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিল করে দিয়েছিল। পরে ১৯৮২-৮৩ সালে এরশাদ সরকারের আমলে ওই সব শর্তের অনেকগুলো পূরণ করা হয়েছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই এই শর্তগুলোকে ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’ অভিহিত করে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণ পাওয়ার প্রায় অভিন্ন শর্তাবলিতে রূপান্তরিত করেছে। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো চার দশক ধরে এই দুটো সংস্থা থেকে যত ঋণ নিয়েছে তার সবগুলোতেই শর্তগুলো জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রাইভেটাইজেশন, ডিরেগুলেশন, লিবারালাইজেশন ও গ্লোবালাইজেশন—এই চারটি ডাইমেনশনে অর্থনীতির ওপর ব্যক্তি খাতের নিয়ন্ত্রণকে যথাসম্ভব নিরঙ্কুশ করা এবং রাষ্ট্রের ভূমিকাকে ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করার এই মতাদর্শিক জবরদস্তি তৃতীয় বিশ্বের সচেতন জনগণের মধ্যে ক্রমেই প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রীরা এখনো আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের অপমানজনক শর্তাধীন ঋণ পাওয়াকে তাঁদের বাহাদুরি হিসেবে জাহির করে চলেছেন। এখন বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা জিডিপির ১ শতাংশের নিচে নেমে গেলেও তাঁরা এই বদখাসলত ছাড়তে পারছেন না! বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের নিষ্ঠুর দাদাগিরির প্রত্যক্ষ শিকার হয়েছিল পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিলের নাটকটায়, নিজেদের অর্থায়নে ওই সেতু বানিয়ে আমরা তার জবাব দিয়েছি। অতএব, ব্রিকসের প্রতি আমাদের পক্ষপাতিত্ব থাকাই স্বাভাবিক।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে