Ajker Patrika

কৃষি ও ই-কমার্স

শাইখ সিরাজ
কৃষি ও ই-কমার্স

২০১৯ সালের মার্চের শেষ দিকে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর একটি পর্বের আয়োজন করা হয়েছিল গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে। অনুষ্ঠানে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশেদ নামের এক শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘এ এলাকায় প্রচুর সুপারিগাছ আছে। সেখানে প্রচুর সুপারি পাতার খোল হয়। আমি অনলাইনে দেখেছি এই সুপারির খোল দিয়ে থালা-বাটি তৈরি করা যায়। আমিও এমন একটি উদ্যোগ নিতে চাই।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমি থালা-বাটিগুলো বিক্রি করব কোথায়?’ উত্তরে বলেছিলাম, ‘তুমি বিষয়টা সম্পর্কে জেনেছ অনলাইন থেকে, তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জেনেছ অনলাইন থেকে, বিক্রিও তো তুমি অনলাইনেই করতে পারো।’ অনলাইন মার্কেট বা ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের বাজারে প্রবেশ সহজ করে দিয়েছে। আগে নতুন একটা পণ্য নিয়ে বাজারে প্রবেশ করা ছিল খুব কঠিন ব্যাপার। কিন্তু সময় পাল্টেছে। অসংখ্য তরুণ মাথাভর্তি স্বপ্ন নিয়ে বসে আছেন। তাঁরা কিছু একটা করতে চান। শুধু একটু ধাক্কা দিয়ে পথটা ধরিয়ে দিলেই অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলতে পারেন তাঁরা।

যেহেতু আমি কৃষির মানুষ। কৃষিকে ঘিরেই আমার কাজকর্ম। আমি মনে করি প্রত্যেক কৃষক আসলে উদ্যোক্তা। তাঁদের হাত ধরেই তৈরি হচ্ছে আগামীর অর্থনীতি। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে দেশে ৭৮ লাখের বেশি এসএমই প্রতিষ্ঠান রয়েছে, জিডিপিতে যাদের অবদান ২৫ শতাংশ। এসএমই খাতের এ অবদান ২০২৪ সালের মধ্যে ৩২ শতাংশে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে ওলট-পালট করে দিলেও পৃথিবীজুড়েই ই-কমার্স খাতকে সমৃদ্ধ করেছে। করোনা-পরবর্তী সময়েও অনেক মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে অনলাইনে কেনাকাটা। বাংলাদেশে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় করোনার বছর অনলাইনে কেনাকাটা বেড়েছে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ, অনলাইনে বেচাকেনা হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা।

অনলাইনে বেচাকেনার কথায় ২০০৮ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ল। তখনো অনলাইনে পণ্য বেচাকেনা সেভাবে শুরু হয়নি। ঈশ্বরদী থেকে কৃষক ময়েজ আমাকে ফোন দিলেন। বললেন, ‘স্যার, আমার কাছে কয়েকটা গরু আছে। একেবারেই প্রাকৃতিক উপায়ে লালন-পালন করে বড় করা। কোরবানির জন্য কিনবেন?’
আমি বললাম, ‘গরু না দেখে কীভাবে কিনব?’

ময়েজ বললেন, ‘স্যার, কোনো ব্যাপার না। আপনার ই-মেইল নম্বরটা দেন (তখনো গ্রামের মানুষ তো দূরে থাক, আমরাও ই-মেইল আইডি বলতে শিখিনি)।’ ঘণ্টা চারেক পর ময়েজ আমাকে বললেন, ‘স্যার, আপনার ই-মেইল চেক করে দেখেন, সব পাঠিয়ে দিয়েছি।’ ই-মেইল খুলে দেখি, গরুর ছবি, ওজন, দামসহ সব তথ্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। বিস্মিত হলাম। ময়েজ জানতেনও না একদিন ই-কমার্স বা অনলাইন মার্কেটিং শুরু হবে, নিজের হাতের মোবাইলটিকে নিজের অজান্তেই ব্যবহার করে শুরু করেছিলেন অনলাইন মার্কেটিং। কেউ ময়েজকে শিখিয়ে দেয়নি, এটি তাঁর আনকোরা আইডিয়া। এভাবেই কৃষক তাঁর নিজের বুদ্ধি-বিবেচনায় উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন কৌশল নিজের মতো করে প্রয়োগ করছেন। এর আগে, ২০০৭ সাল হবে হয়তো, শহরের তিন শিক্ষিত তরুণ চাকরি না পেয়ে সরাসরি ই-কমার্সের একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিলেন। যার নাম ‘ক্লিক বিডি’। ওখানে পুরোনো মোবাইল ফোন বিক্রি করা যেত। এভাবেই যাত্রা শুরু হলো দেশে ই-কমার্সের।

এবারও ঈদুল আজহা সামনে রেখে অনলাইনে ও ডিজিটাল পশুর হাটগুলো বেশ জমে উঠেছিল। অনেকে অনলাইনকে ঘিরে তৈরি করছেন তাঁদের স্বপ্নের নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্যের খাত। আমের মৌসুমে অনলাইনেই বেশি আম বিক্রি হচ্ছে। আম বিক্রি করে অনেক তরুণ স্বাবলম্বী হয়েছেন।

সময়ের প্রয়োজনেই ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো পৌঁছে গেছে কৃষকের কাছে। কৃষক এখন খেত থেকেই ফসল অনলাইনে বিক্রি করে দিচ্ছেন। যে বিষয়গুলো আগে দেখে এসেছি উন্নত দেশে। মনে পড়ে, ২০১৭ সালে চীনের জংশানের শিনশিং কাউন্টির এক প্রত্যন্ত গ্রামের ড্রাগনবাগানের মালিক লিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার এত ড্রাগন কোথায় বিক্রি করেন?’ তিনি বলেছিলেন, তাঁদের উইচ্যাট গ্রুপে উৎপাদিত ফলের পরিমাণ ও দাম লিখে দেন। অনলাইনেই বিক্রি হয়ে যায় মুহূর্তে।

আমাদের দেশে ই-কমার্স পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়ার আগেই কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য ই-কমার্সের প্রতি মানুষের একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। একসময় যেমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল—চীনের প্রোডাক্ট, গ্যারান্টি নেই। তেমনি নতুন একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে, ‘অনলাইনে কেনা জিনিসের কোনো ভরসা নেই’। ছবিতে রাজহাঁস, হাতে আসে পাতিহাঁস-টাইপ বিষয়। ই-কমার্সের জন্য নেতিবাচক বিষয়গুলো হচ্ছে, সময়মতো পণ্য না পৌঁছানো, পণ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য না দিয়ে, ভুল তথ্য দেওয়া, নকল বা কপি পণ্য সরবরাহ, অনলাইন এমএলএম কার্যক্রম, এক পণ্য বহুজনের কাছে বিক্রির পর টাকা ফেরত না দিয়ে কাস্টমারকে অন্য পণ্য কিনতে বাধ্য করা ইত্যাদি। তবে মাস কয়েক হলো বাংলাদেশ ব্যাংক ও ই-কমার্স সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদ্যোগে ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ বেচাবিক্রির জন্য বাধ্য করছে।

আমাজন বা আলিবাবায় যেমন রেটিং সিস্টেম দেখে মানুষ সেলারের কোয়ালিটি বা পণ্যের কোয়ালিটি বুঝতে পারে, আমাদের দেশে ই-কমার্সের ক্ষেত্রে সে রকম রেটিং দেওয়ার চর্চাটা গড়ে ওঠেনি। তাই আমাদের পণ্যের মান নিশ্চিত করতে কোনো ট্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে, যা দেখে ট্যাগ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মানুষের আস্থা থাকবে।

ই-কমার্সে যে বিষয়টি সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তা হচ্ছে, মার্কেটপ্লেস। আমাজন, আলিবাবা কিংবা দারাজ যা-ই বলি না কেন, ওই সব মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগী যে চক্র আমরা ভেঙে ফেলতে চাই, সেটা কি সম্ভব হবে? কারণ আমি যদি বুস্ট না করি, আমার পণ্য মার্কেটপ্লেসের সামনের কাতারে আসবে না। ফলে আমার বেচাবিক্রি বাড়াতে প্রতিনিয়ত টাকা ঢালতে হবে। প্রতিটি উদ্যোক্তাই যেন ব্র্যান্ড হয়ে উঠতে পারে, তেমন একটা প্ল্যাটফর্মের কথা ভাবা যায় কি না, সেটা আমাদের দেখতে হবে। সরকার নানা উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণ উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে, স্টার্টআপ লোন, ইনোভেশন আইডিয়াকে বাস্তবায়নে সহায়তা দিচ্ছে। কৃষি ও কৃষকের জন্য একটা আন্তর্জাতিক অনলাইন বাজার তৈরির ক্ষেত্রেও সরকার যদি কাজ করত, তাহলে আমাদের তরুণ কৃষকেরা আরও বেশি উদ্যোগী হতেন।

২০২৪ সালনাগাদ কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের বিশ্ববাজার হবে ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের। সেখানে আমাদের বর্তমান উপস্থিতি মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলারের। ই-কমার্সের যে স্রোত বাংলাদেশে শুরু হয়েছে, সেই মূল স্রোতে সারা দেশে তৈরি হওয়া অগণিত কৃষি উদ্যোক্তাকে যুক্ত না করতে পারলে এই বিশাল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ কঠিন হয়ে উঠবে।

ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষিপণ্যের বাজার। যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোগ। তরুণ উদ্যোক্তারা নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছেন অনলাইন বাজার। বাজার মানেই প্রতিযোগিতা, আর প্রতিযোগিতাপূর্ণ স্থানে থাকে প্রতারণার আশঙ্কা। ফলে এ ক্ষেত্রে শুরু থেকেই প্রয়োজন সুপরিকল্পনা ও মনিটরিং। যাতে সহজ-সরল কৃষক প্রতারিত হয়ে সম্ভাবনাময় এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেন।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের বিপক্ষে সেমির আগেই ধাক্কা খেল অস্ট্রেলিয়া

পরমাণু শক্তিধর হতে চেয়েছিল তাইওয়ান, সিআইএ এজেন্টের বিশ্বাসঘাতকতায় স্বপ্নভঙ্গ

এলপি গ্যাস, তেল, আটাসহ বেশ কিছু পণ্যে ভ্যাট তুলে দিল এনবিআর

চ্যাম্পিয়নস ট্রফি: রিজার্ভ-ডেতেও সেমিফাইনাল না হলে হৃদয়বিদারক সমীকরণ

অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যা বললেন জামায়াতের আমির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত