অরুণ কর্মকার
শেষ পর্যন্ত ভোলায় প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রমাণিত মজুতভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হলো। ২৬ বছর আগে আবিষ্কৃত শাহবাজপুরের পর ভোলা নর্থ এবং সবশেষে ইলিশা তো স্বতন্ত্র একটি গ্যাসক্ষেত্র হিসেবেই স্বীকৃতি পেল। সব মিলে সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ভোলায় এখন আবিষ্কৃত গ্যাসের মজুত ২ দশমিক ৩৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। নিঃসন্দেহে দেশের জন্য এটি খুব ভালো একটি খবর।
এমন একসময় এ সুখবরটি এসেছে, যখন দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে চলছে একধরনের অস্থিরতা। দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন ক্রমেই কমছে। কমতে কমতে দৈনিক ২ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে ২ হাজার ১৫০ মিলিয়নেরও নিচে নেমে এসেছে। এই কমার প্রবণতার মধ্যেও দেশে মাঝেমধ্যে নতুন কোনো কূপে কিংবা পুরোনো কূপ সংস্কার করে কিছু গ্যাস পাওয়া গেছে। তা সত্ত্বেও উৎপাদন কমার ধারা ঠেকানো যায়নি। ফলে দেশে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি বেড়ে চলেছে।
তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করেও এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হবেও না। কারণ সীমিত অবকাঠামোর কারণে শিগগিরই এলএনজির আমদানি বাড়ানো সম্ভব নয়। বর্তমানে দৈনিক সর্বোচ্চ ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি করাই সম্ভব। তার বেশি নয়। এলএনজি আমদানির সক্ষমতা বাড়াতে হলে আরও ভাসমান ও স্থলভিত্তিক টার্মিনাল স্থাপন করতে হবে। সেটা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। এলএনজি আমদানিও ব্যয়বহুল। কারণ দাম বেশি। তা ছাড়া ডলার-সংকট তো এই সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সংকট কত দিন চলবে, কেউ বলতে পারে না। কারণ এর সঙ্গে বৈশ্বিক পরিস্থিতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে, পেট্রোবাংলা অর্থসংকটে আছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) স্বাভাবিক গতিতে জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারছে না। তারও কারণ ডলার-সংকট। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে সময়মতো দাম পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এরও কারণ ডলার-সংকট ও ডলারের উচ্চমূল্য। ফলে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের জ্বালানি তেল আমদানির সক্ষমতা সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
গ্যাস-তেল-কয়লানির্বিশেষে জ্বালানি-সংকটের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে ২ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয়েছে। আগামী মাসে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আরও একবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে ভোলায় নতুন গ্যাসের সন্ধান এবং স্বতন্ত্র একটি গ্যাসক্ষেত্র (ইলিশা) ঘোষণা বিশেষ কোনো তাৎপর্য বহন করে কি না, চলমান জ্বালানি-সংকট নিরসনে ভোলার এই গ্যাস কতটা কাজে লাগবে, ভোলায় আরও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না, এসব বিষয় পর্যালোচনা করে দেখা দরকার।
ইলিশা স্বতন্ত্র গ্যাসক্ষেত্র হওয়ার কারণ এ ক্ষেত্রটির গ্যাসের কাঠামো (স্ট্রাকচার) ভোলার শাহবাজপুর কিংবা ভোলা নর্থ ক্ষেত্রটির সঙ্গে যুক্ত নয়। মজুত মাত্র ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। এটি দেশের ২৯তম গ্যাসক্ষেত্র। অবশ্য পেট্রোবাংলার প্রডাকশন অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের দৈনিক প্রতিবেদনে ‘প্রোডিউসিং ফিল্ড’ হিসেবে ২২টির নাম উল্লেখ আছে। এর মধ্যেও রূপগঞ্জ ক্ষেত্রটি পুরোপুরি বন্ধ এবং মেঘনা, সালদা, সেমুতাং, সুন্দলপুর ক্ষেত্রগুলোর উৎপাদনের পরিমাণ নগণ্য।
ইলিশা-১ কূপে গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার পর এখন ভোলায় গ্যাসকূপের সংখ্যা দাঁড়াল ৯। এবার তিনটি কূপ খনন করেছে রাশিয়ার কোম্পানি গ্যাজপ্রম। এর আগে ছয়টি কূপ খনন করেছে বাপেক্স নিজে। বাপেক্সের হিসাব অনুযায়ী, ভোলায় এখন গ্যাসের প্রমাণিত মজুত ২ দশমিক ৩৮ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)। দেশে এখন প্রতিবছর গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় এক টিসিএফ।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ভোলার দক্ষিণে মনপুরাসহ বিচ্ছিন্ন দ্বীপাঞ্চল এবং মেঘনা নদীবক্ষেও বিপুল গ্যাসের মজুত রয়েছে। সেই সব এলাকায় নিবিড় অনুসন্ধান চালানো দরকার। তাঁরা মনে করেন, দেশে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে তার চেয়ে বেশি অনাবিষ্কৃত রয়েছে। এই অনাবিষ্কৃত গ্যাসের বৃহদাংশই রয়েছে ভোলাসহ বেঙ্গল বেসিনে। নিবিড় অনুসন্ধানের মাধ্যমে এই গ্যাস আবিষ্কারের অপেক্ষায় আছি আমরা দেশবাসী।
ভোলার গ্যাস দেশের চলমান জ্বালানি-সংকট নিরসনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। কারণ ওই গ্যাস দেশের মূল ভূখণ্ডে সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পর ভোলায় যে ছয়টি কূপ খনন করা হয়েছে, সেগুলোর দৈনিক মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ১২০ মিলিয়ন (১২ কোটি) ঘনফুট। কিন্তু বিদ্যমান দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বর্তমানে ভোলায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা সর্বোচ্চ ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট, যা তিনটি কূপ থেকেই সরবরাহ করা যায়। ফলে অবশিষ্ট তিনটি কূপ অলস পড়ে আছে। এর পাশাপাশি এখন আরও তিনটি নতুন কূপ খনন সম্পন্ন হয়েছে। ফলে দৈনিক গ্যাস উত্তোলন সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু ব্যবহার সীমিত।
সরকার অবশ্য ভোলার কিছু গ্যাস সিএনজি আকারে সিলিন্ডারে করে ঢাকা এবং এর আশপাশের সংকটাপন্ন এলাকার শিল্পকারখানায় সরবরাহের জন্য বেসরকারি কোম্পানি ইন্ট্রাকোর সঙ্গে চুক্তি করেছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী, আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ দৈনিক মাত্র ৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সিএনজি আকারে বিশেষ সিলিন্ডারে করে বিশেষায়িত পরিবহন যানে করে তিতাস গ্যাসের সংকটপূর্ণ এলাকায়
শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হবে। যে শিল্প যত পিএসআই চাপে গ্যাস ব্যবহার করে, সেই শিল্পে সেই চাপে গ্যাস সরবরাহের জন্যও করতে হবে বিশেষ ব্যবস্থা। এরপর আগামী বছর ফেব্রুয়ারি নাগাদ আরও ২০ (মোট ২৫) মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস একই এলাকার শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হবে। কিন্তু তাতে চলমান গ্যাস-সংকট সমাধানে যেমন উল্লেখযোগ্য কিছু হবে না, তেমনি ভোলার গ্যাসেরও ব্যবহার খুব একটা বাড়বে না। তিতাসের এলাকায় গ্যাসের দৈনিক সরবরাহ ঘাটতি এখন প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
তবে ভোলার গ্যাস নিয়ে সরকারের বড় পরিকল্পনাও রয়েছে। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য পাইপলাইনে ভোলার গ্যাস দেশের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসা। ভোলা থেকে বরিশাল হয়ে খুলনা পর্যন্ত একটি এবং পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্ত পর্যন্ত আরেকটি পাইপলাইন করা এই পরিকল্পনার অংশবিশেষ। এ রকম একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ভোলা অঞ্চলে কী পরিমাণ গ্যাস মজুত থাকতে পারে তা নির্ধারণ করা।
দীর্ঘ পাইপলাইন করে সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২০-২৫ বছর সরবরাহের জন্য বর্তমানে আবিষ্কৃত ২ দশমিক ৩৮ টিসিএফ গ্যাস যথেষ্ট নয়।
অবশ্য ভোলা অঞ্চলে গ্যাসের বিপুল মজুত সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা যে উচ্চ আশা পোষণ করেন তা আগেই উল্লেখ করেছি।
আমাদের দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দুটি ভূতাত্ত্বিক কাঠামো সম্ভাবনাময়। এর একটি সুরমা বেসিন। অন্যটি বেঙ্গল বেসিন। বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদীসহ যেসব এলাকায় বিদ্যমান সব গ্যাসক্ষেত্রগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে এর সবই সুরমা বেসিনের অন্তর্ভুক্ত। মূলত ওই অঞ্চলেই অনুসন্ধান, আবিষ্কার ও উত্তোলন করে আসা হয়েছে।
সেই তুলনায় বেঙ্গল বেসিনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান অবহেলিত বা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। ফলে একমাত্র ভোলা ছাড়া বেঙ্গল বেসিনে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো আবিষ্কার হয়নি। অথচ ভূতাত্ত্বিক, ভূপদার্থবিদ, বিশেষজ্ঞ গবেষক ও প্রকৌশলীরা বেঙ্গল বেসিনকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় মনে করেন। শুধু প্রয়োজন অনুসন্ধান করে তা আবিষ্কার করা।
তবে এই বিশাল কর্মকাণ্ড একা বাপেক্সের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার গ্যাজপ্রমের মতো কোনো অংশীদারের সহযোগিতা। সেই সহযোগিতার সম্ভাবনার কথাও আমরা অনেক শুনেছি। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন কিছু। ফলে দেশ ক্রমাগতভাবে জ্বালানি আমদানির বিপজ্জনক নির্ভরশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। দেশের জ্বালানি সম্পদের উন্নয়ন না করা হলে আমদানির এই ঝোঁক আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে—তা বলা খুব মুশকিল।
সম্প্রতি ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত জ্বালানি খাতবিষয়ক একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, গ্যাস অনুসন্ধান ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে প্রচুর সময় ও বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন হলেও অনুসন্ধান কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই।
দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিশেষজ্ঞ-পেশাজীবীরা এ কথাটিই বলে এসেছেন। আগেই এ কাজটি শুরু করা হলে দেশে বর্তমান জ্বালানি-সংকটের এত জটিল রূপ দেখতে হতো না। তবু যদি সরকার এখনো কাজটি শুরু করে এবং অব্যাহতভাবে চালিয়ে যায়, বিলম্বে হলেও তাও সুফল বয়ে আনবে। কথায় আছে না ‘বেটার লেট দ্যান নেভার!’
অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
শেষ পর্যন্ত ভোলায় প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রমাণিত মজুতভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হলো। ২৬ বছর আগে আবিষ্কৃত শাহবাজপুরের পর ভোলা নর্থ এবং সবশেষে ইলিশা তো স্বতন্ত্র একটি গ্যাসক্ষেত্র হিসেবেই স্বীকৃতি পেল। সব মিলে সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ভোলায় এখন আবিষ্কৃত গ্যাসের মজুত ২ দশমিক ৩৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। নিঃসন্দেহে দেশের জন্য এটি খুব ভালো একটি খবর।
এমন একসময় এ সুখবরটি এসেছে, যখন দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে চলছে একধরনের অস্থিরতা। দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন ক্রমেই কমছে। কমতে কমতে দৈনিক ২ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে ২ হাজার ১৫০ মিলিয়নেরও নিচে নেমে এসেছে। এই কমার প্রবণতার মধ্যেও দেশে মাঝেমধ্যে নতুন কোনো কূপে কিংবা পুরোনো কূপ সংস্কার করে কিছু গ্যাস পাওয়া গেছে। তা সত্ত্বেও উৎপাদন কমার ধারা ঠেকানো যায়নি। ফলে দেশে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি বেড়ে চলেছে।
তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করেও এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হবেও না। কারণ সীমিত অবকাঠামোর কারণে শিগগিরই এলএনজির আমদানি বাড়ানো সম্ভব নয়। বর্তমানে দৈনিক সর্বোচ্চ ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি করাই সম্ভব। তার বেশি নয়। এলএনজি আমদানির সক্ষমতা বাড়াতে হলে আরও ভাসমান ও স্থলভিত্তিক টার্মিনাল স্থাপন করতে হবে। সেটা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। এলএনজি আমদানিও ব্যয়বহুল। কারণ দাম বেশি। তা ছাড়া ডলার-সংকট তো এই সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সংকট কত দিন চলবে, কেউ বলতে পারে না। কারণ এর সঙ্গে বৈশ্বিক পরিস্থিতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে, পেট্রোবাংলা অর্থসংকটে আছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) স্বাভাবিক গতিতে জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারছে না। তারও কারণ ডলার-সংকট। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে সময়মতো দাম পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এরও কারণ ডলার-সংকট ও ডলারের উচ্চমূল্য। ফলে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের জ্বালানি তেল আমদানির সক্ষমতা সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
গ্যাস-তেল-কয়লানির্বিশেষে জ্বালানি-সংকটের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে ২ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয়েছে। আগামী মাসে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আরও একবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে ভোলায় নতুন গ্যাসের সন্ধান এবং স্বতন্ত্র একটি গ্যাসক্ষেত্র (ইলিশা) ঘোষণা বিশেষ কোনো তাৎপর্য বহন করে কি না, চলমান জ্বালানি-সংকট নিরসনে ভোলার এই গ্যাস কতটা কাজে লাগবে, ভোলায় আরও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না, এসব বিষয় পর্যালোচনা করে দেখা দরকার।
ইলিশা স্বতন্ত্র গ্যাসক্ষেত্র হওয়ার কারণ এ ক্ষেত্রটির গ্যাসের কাঠামো (স্ট্রাকচার) ভোলার শাহবাজপুর কিংবা ভোলা নর্থ ক্ষেত্রটির সঙ্গে যুক্ত নয়। মজুত মাত্র ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। এটি দেশের ২৯তম গ্যাসক্ষেত্র। অবশ্য পেট্রোবাংলার প্রডাকশন অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের দৈনিক প্রতিবেদনে ‘প্রোডিউসিং ফিল্ড’ হিসেবে ২২টির নাম উল্লেখ আছে। এর মধ্যেও রূপগঞ্জ ক্ষেত্রটি পুরোপুরি বন্ধ এবং মেঘনা, সালদা, সেমুতাং, সুন্দলপুর ক্ষেত্রগুলোর উৎপাদনের পরিমাণ নগণ্য।
ইলিশা-১ কূপে গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার পর এখন ভোলায় গ্যাসকূপের সংখ্যা দাঁড়াল ৯। এবার তিনটি কূপ খনন করেছে রাশিয়ার কোম্পানি গ্যাজপ্রম। এর আগে ছয়টি কূপ খনন করেছে বাপেক্স নিজে। বাপেক্সের হিসাব অনুযায়ী, ভোলায় এখন গ্যাসের প্রমাণিত মজুত ২ দশমিক ৩৮ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)। দেশে এখন প্রতিবছর গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় এক টিসিএফ।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ভোলার দক্ষিণে মনপুরাসহ বিচ্ছিন্ন দ্বীপাঞ্চল এবং মেঘনা নদীবক্ষেও বিপুল গ্যাসের মজুত রয়েছে। সেই সব এলাকায় নিবিড় অনুসন্ধান চালানো দরকার। তাঁরা মনে করেন, দেশে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে তার চেয়ে বেশি অনাবিষ্কৃত রয়েছে। এই অনাবিষ্কৃত গ্যাসের বৃহদাংশই রয়েছে ভোলাসহ বেঙ্গল বেসিনে। নিবিড় অনুসন্ধানের মাধ্যমে এই গ্যাস আবিষ্কারের অপেক্ষায় আছি আমরা দেশবাসী।
ভোলার গ্যাস দেশের চলমান জ্বালানি-সংকট নিরসনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। কারণ ওই গ্যাস দেশের মূল ভূখণ্ডে সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পর ভোলায় যে ছয়টি কূপ খনন করা হয়েছে, সেগুলোর দৈনিক মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ১২০ মিলিয়ন (১২ কোটি) ঘনফুট। কিন্তু বিদ্যমান দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বর্তমানে ভোলায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা সর্বোচ্চ ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট, যা তিনটি কূপ থেকেই সরবরাহ করা যায়। ফলে অবশিষ্ট তিনটি কূপ অলস পড়ে আছে। এর পাশাপাশি এখন আরও তিনটি নতুন কূপ খনন সম্পন্ন হয়েছে। ফলে দৈনিক গ্যাস উত্তোলন সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু ব্যবহার সীমিত।
সরকার অবশ্য ভোলার কিছু গ্যাস সিএনজি আকারে সিলিন্ডারে করে ঢাকা এবং এর আশপাশের সংকটাপন্ন এলাকার শিল্পকারখানায় সরবরাহের জন্য বেসরকারি কোম্পানি ইন্ট্রাকোর সঙ্গে চুক্তি করেছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী, আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ দৈনিক মাত্র ৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সিএনজি আকারে বিশেষ সিলিন্ডারে করে বিশেষায়িত পরিবহন যানে করে তিতাস গ্যাসের সংকটপূর্ণ এলাকায়
শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হবে। যে শিল্প যত পিএসআই চাপে গ্যাস ব্যবহার করে, সেই শিল্পে সেই চাপে গ্যাস সরবরাহের জন্যও করতে হবে বিশেষ ব্যবস্থা। এরপর আগামী বছর ফেব্রুয়ারি নাগাদ আরও ২০ (মোট ২৫) মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস একই এলাকার শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হবে। কিন্তু তাতে চলমান গ্যাস-সংকট সমাধানে যেমন উল্লেখযোগ্য কিছু হবে না, তেমনি ভোলার গ্যাসেরও ব্যবহার খুব একটা বাড়বে না। তিতাসের এলাকায় গ্যাসের দৈনিক সরবরাহ ঘাটতি এখন প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
তবে ভোলার গ্যাস নিয়ে সরকারের বড় পরিকল্পনাও রয়েছে। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য পাইপলাইনে ভোলার গ্যাস দেশের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসা। ভোলা থেকে বরিশাল হয়ে খুলনা পর্যন্ত একটি এবং পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্ত পর্যন্ত আরেকটি পাইপলাইন করা এই পরিকল্পনার অংশবিশেষ। এ রকম একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ভোলা অঞ্চলে কী পরিমাণ গ্যাস মজুত থাকতে পারে তা নির্ধারণ করা।
দীর্ঘ পাইপলাইন করে সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২০-২৫ বছর সরবরাহের জন্য বর্তমানে আবিষ্কৃত ২ দশমিক ৩৮ টিসিএফ গ্যাস যথেষ্ট নয়।
অবশ্য ভোলা অঞ্চলে গ্যাসের বিপুল মজুত সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা যে উচ্চ আশা পোষণ করেন তা আগেই উল্লেখ করেছি।
আমাদের দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দুটি ভূতাত্ত্বিক কাঠামো সম্ভাবনাময়। এর একটি সুরমা বেসিন। অন্যটি বেঙ্গল বেসিন। বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদীসহ যেসব এলাকায় বিদ্যমান সব গ্যাসক্ষেত্রগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে এর সবই সুরমা বেসিনের অন্তর্ভুক্ত। মূলত ওই অঞ্চলেই অনুসন্ধান, আবিষ্কার ও উত্তোলন করে আসা হয়েছে।
সেই তুলনায় বেঙ্গল বেসিনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান অবহেলিত বা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। ফলে একমাত্র ভোলা ছাড়া বেঙ্গল বেসিনে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো আবিষ্কার হয়নি। অথচ ভূতাত্ত্বিক, ভূপদার্থবিদ, বিশেষজ্ঞ গবেষক ও প্রকৌশলীরা বেঙ্গল বেসিনকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় মনে করেন। শুধু প্রয়োজন অনুসন্ধান করে তা আবিষ্কার করা।
তবে এই বিশাল কর্মকাণ্ড একা বাপেক্সের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার গ্যাজপ্রমের মতো কোনো অংশীদারের সহযোগিতা। সেই সহযোগিতার সম্ভাবনার কথাও আমরা অনেক শুনেছি। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন কিছু। ফলে দেশ ক্রমাগতভাবে জ্বালানি আমদানির বিপজ্জনক নির্ভরশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। দেশের জ্বালানি সম্পদের উন্নয়ন না করা হলে আমদানির এই ঝোঁক আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে—তা বলা খুব মুশকিল।
সম্প্রতি ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত জ্বালানি খাতবিষয়ক একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, গ্যাস অনুসন্ধান ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে প্রচুর সময় ও বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন হলেও অনুসন্ধান কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই।
দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিশেষজ্ঞ-পেশাজীবীরা এ কথাটিই বলে এসেছেন। আগেই এ কাজটি শুরু করা হলে দেশে বর্তমান জ্বালানি-সংকটের এত জটিল রূপ দেখতে হতো না। তবু যদি সরকার এখনো কাজটি শুরু করে এবং অব্যাহতভাবে চালিয়ে যায়, বিলম্বে হলেও তাও সুফল বয়ে আনবে। কথায় আছে না ‘বেটার লেট দ্যান নেভার!’
অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে