জ্ঞান ও প্রশান্তির জন্য পর্যটন

ড. মো. গোলাম রহমান
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৪, ০৮: ১৩
আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০২৪, ০৮: ১৪

নির্মল আনন্দ ও মানসিক প্রশান্তির জন্য আমরা ভ্রমণ করি। তার সঙ্গে যোগ হয় জ্ঞান বিকাশের অফুরন্ত উপকরণ।

একটা সময় ছিল অল্পসংখ্যক বাঙালি চাকরিবাকরির সুবাদে বাড়ি ছেড়ে দেশান্তরি হতেন। সেই প্রবণতা এখনো যে নেই তা নয়, তবে বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিকতা আমাদের এগিয়ে দিয়েছে অনেক।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, যাঁরা প্রায়ই ভ্রমণ করেন, তাঁরা ভ্রমণ না করা মানুষদের চেয়ে বেশি সুখী হন। যাঁরা নিয়মিত বাড়ি থেকে অন্তত ৭৫ মাইল দূরে ভ্রমণ করেন, তাঁরা প্রায় ৭ শতাংশ বেশি সুখী। গতানুগতিক জীবন থেকে একটু পরিবর্তন মানুষের জীবনকে যথেষ্ট উদ্দীপনা দেয় বলে ধারণা করা হয়। ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির হসপিটালিটি বিজনেস ম্যানেজমেন্টের একজন গবেষক দেখিয়েছেন, যাঁরা ভ্রমণ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন এবং ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা করেন, তাঁরা অন্যদের চেয়ে সুখী। এই গবেষক ৫০০ জনের ওপর এক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন, অর্ধেকের বেশি মানুষ চারটির বেশি ভ্রমণপরিকল্পনা করেছিলেন বলে জানা যায়।

সারা বিশ্বে পর্যটনের গতি-প্রকৃতি পাল্টে যাচ্ছে। গতানুগতিক পর্যটনব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে স্থানীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, খাবারদাবার এবং জনগণের চালচলনে নতুনত্ব যোগ হচ্ছে। পর্যটনের স্থানগুলোর স্থানীয় সংস্কৃতি যথেষ্ট আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে পর্যটকদের মধ্যে। স্থানীয় সংস্কৃতি জানা এবং উপলব্ধি করার কৌতূহল পর্যটকদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে ভ্রমণ আয়োজনকারী সংস্থাগুলো নতুনভাবে পর্যটকদের চাহিদা পূরণে সচেষ্ট হচ্ছে। 

বিশ্বে পর্যটনের বিকাশ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভিয়েতনামে এ বছর এক গবেষণায় দেখা যায় যে পর্যটন খাতে তাদের আয় ২০১৯ সালের তুলনায় ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে, যা নাকি দেশটির সামগ্রিক অর্থনীতির ৭ শতাংশের বেশি। তারা আরও বলছে, দেশটিতে ভ্রমণ ও পর্যটনসংক্রান্ত চাকরি বৃদ্ধি পাবে ৬ শতাংশ।

যথেষ্ট আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রিক দেশ থাইল্যান্ড এবার পর্যটকের চাপে বিপাকে পড়েছে। সংখ্যাতিরিক্ত পর্যটকের চাপে থাইল্যান্ড নানা  পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্বের উল্লেখযোগ্য আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র ব্যাংকক, পাতায়া, ফুকেতে দেখেছি পর্যটকের ভিড়! কিছু কিছু জায়গায় চলচ্চিত্রের শুটিং হওয়ায় সেই সব পর্যটনকেন্দ্রে অনেক বেশি মানুষের আনাগোনা হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পর্যটক আকর্ষণের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চীন, থাইল্যান্ড, জাপান, মালয়েশিয়া, হংকং, ম্যাকাও, ভিয়েতনাম, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া। প্রায় সাড়ে ছয় কোটি পর্যটক প্রতিবছর চীন ভ্রমণ করেন। থাইল্যান্ডে প্রায় চার কোটি এবং জাপানে তিন কোটির বেশি পর্যটক ভ্রমণ করে থাকেন। হংকং, ম্যাকাও এবং ভিয়েতনাম—এই তিন দেশের প্রতিটিতে প্রায় দুই কোটি পর্যটক বেড়াতে আসেন প্রতিবছর। ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়ও প্রতিবছর বেড়াতে আসেন দেড় কোটির বেশি পর্যটক। 

ভারতের অনেক স্থান রয়েছে পর্যটকদের অন্যতম স্পট হিসেবে। ভারতের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত কাশ্মীর, শিমলা, নৈনিতাল, আগ্রা, মথুরা এবং এসব স্থানসংলগ্ন বেশ কিছু পর্যটক  আকর্ষণ স্থান; যেমন কাশ্মীরের জম্মু, শ্রীনগর আমাদের দেশের পর্যটকদের কাছে যেমনি প্রিয়, তেমনি কাশ্মীরের মানসবল লেক, গুলমার্গ, শোনামার্গ, চশমাশাহি, মোগল গার্ডেন, শালিমার গার্ডেন, ডাল লেক রেকর্ডসংখ্যক পর্যটকের পছন্দের জায়গা। বলা হয়ে থাকে ভূস্বর্গ কাশ্মীর! কাশ্মীর আমার স্বপ্নের। কাশ্মীর প্রথম দেখেছিলাম ১৯৭৫ সালে। পরে আরও কয়েকবার গিয়েছি, দেখেও বারবার দেখার আগ্রহ জাগে। আগ্রা, জয়পুর, উদয়পুরের মতো বহুল আলোচিত স্থানগুলোর আকর্ষণ যেকোনো সাধারণ পর্যটকের কাছে রয়েছে। দিল্লি, আগ্রা, জয়পুর, উদয়পুর—এসব স্থানে মোগল এবং রাজপুতদের ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থাপনায় পর্যটকদের ভিড় লক্ষ করেছি কম-বেশি সব ঋতুতে। দক্ষিণ ভারতের মহীশূর, বেঙ্গালুরু; কেরালার কোচিন, কইএম্বাতুর এবং তামিলনাড়ুর চেন্নাই (পুরোনো নাম মাদ্রাজ), উটকামন্ডু (পুরোনো নাম উটি) উল্লেখ করার মতো আকর্ষণীয় স্পট। মহীশূরে শ্রীরঙ্গপাটনা, শ্রাবণভেলেগুলার সুউচ্চ চন্দ্রগিরি পাহাড়ের চূড়ায় প্রায় ৭০০ সিঁড়ি বেয়ে উঠে দেখেছি গোমেটেশ্বরা জৈন মূর্তি, ৫৭ ফুট দৈর্ঘ্য, যা নাকি একটি পাথরখণ্ড থেকে তৈরি করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ যায় অর্ঘ্য দিতে কিংবা দেখতে।

পর্যটকদের কাছে ভারতের পূর্বাঞ্চলে দেখার মতো স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম দার্জিলিং। টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখার জন্য শীতের মধ্যে শেষ রাত থেকে পর্যটকেরা প্রস্তুতি নিয়ে জিপে করে হাজির হন সেখানে। তবে সবার ভাগ্যে সেই সূর্যোদয় দেখা হয়ে ওঠে না, প্রায়ই মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকে সূর্যি মামা। 

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন ফ্রান্সে, প্রায় নয় কোটি; স্পেনে আট কোটির ওপরে এবং যুক্তরাষ্ট্রে আট কোটির কাছাকাছি। চীন ও ইতালিতে প্রায় ছয় কোটি করে। মেক্সিকো ও যুক্তরাজ্যে প্রায় চার কোটি করে পর্যটক ভ্রমণ করে থাকেন। তুরস্ক ও জার্মানিতে প্রায় চার কোটি করে পর্যটক ভ্রমণ করেন আর থাইল্যান্ডে ভ্রমণ করেন প্রায় সমানসংখ্যক লোক, যা আগেই বলেছি।

এসব দেশে ছড়িয়ে আছে অফুরন্ত পর্যটনকেন্দ্র আর অসংখ্য বিনোদনের জায়গা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য কম-বেশি সব পর্যটনকেন্দ্রই লোকজনের বেড়ানোর প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে সাগরের জল যেমন হাত বাড়িয়ে ডাকে, তেমনি কারও কারও কাছে পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা বরফও উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় হেসে ওঠে! কোথাও পাহাড়ের গায়ে মেঘের খেলা আকুল করে মন; কোথাও আবার গভীর জঙ্গলে দেখা পাওয়া যায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা হরিণের পাল। কোনো কোনো জলাশয়ে ভেসে বেড়ায় নানা বর্ণের পাখপাখালি; কখনো বর্ষায় পেখম মেলে নাচে ময়ূর-ময়ূরী। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে সিলেট অঞ্চলের জাফলং, সাদা পাথর, রাতারগুল, তুরুংছড়া, লালাখান ও রাংপানি। ঢাকার অদূরে পানাম নগর, বড় সরদারবাড়ি, বাংলার তাজমহল। 

পানাম নগর ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলার প্রাচীনতম এই শহর বিশ্বের ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ডের তালিকাভুক্ত। এখানকার পুরোনো দুই ও তিনতলা ৫২টি ভবন, যার স্থাপত্যে ইউরোপীয় শিল্পরীতির সঙ্গে মোগল আমলের শিল্পরীতির মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

হ্রদ-পাহাড়ের ছোট্ট শহর রাঙামাটি–যেখানে স্বচ্ছ জলের রুপালি হ্রদ আর শ্যামল প্রকৃতির নীলাভ পাহাড়। কাপ্তাই হ্রদের তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট। প্রকৃতির আরেক আকর্ষণ সাজেক। মেঘের ভেলা উড়ে বেড়ানো দেখতে চাওয়ার মুগ্ধ করা এক পর্যটনকেন্দ্র। সাজেক দেখে অনেকে পার্শ্ববর্তী দেশের পাহাড় বেড়ানোর বিকল্প তৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফিরতে পারেন।

কুষ্টিয়ায় লালন শাহের মাজার, মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা এবং প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত পটুয়াখালীর কুয়াকাটা। কুষ্টিয়া শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার যেতে হবে কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ গ্রামে, সেখানে দেখেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত লাল রঙের কুঠিবাড়ি। রবীন্দ্রনাথের ব্যবহার্য কিছু জিনিসপত্র সংরক্ষিত আছে সেখানে। আর লালন শাহের মাজার কুষ্টিয়া শহর থেকে খুব দূরে নয়, অল্প সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। আমাদের দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার জন্য যথার্থ পরিকল্পনা প্রয়োজন।

পর্যটকবান্ধব কেন্দ্র হিসেবে এগুলোকে প্রমোট করার জন্য অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে টিম গঠন করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও যোগাযোগব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নয়ন করা প্রয়োজন। দেশের পর্যটকদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কথা বিবেচনা করে আধুনিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন আধুনিক সুবিধার সঙ্গে আধুনিক মানসিকতা এবং সংস্কৃতির সমন্বয়।

লেখক: ড. মো. গোলাম রহমান
সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত