হাসান মামুন
আমার একটা ধারণা ছিল, আগের দুটি নির্বাচন যেনতেনভাবে করে ফেললেও ২০২৪ সালেরটি সরকার ইচ্ছামতো করে ফেলতে পারবে না; বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক তৎপরতা দেখে এমনটা মনে হচ্ছিল। লেখালেখিও করেছি সে ধারায়। এটা কারও পক্ষ বা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া তো নয়। এটা ন্যায্যতার প্রশ্ন। একের পর এক খারাপ নির্বাচন একটা দেশকে কোনো ভালো গন্তব্যে নিয়ে যায় না। আর এটা বুঝতে পণ্ডিত হতে হয় না। তবে ২০২৪-এর নির্বাচনটি প্রত্যাশামতো হলো না কেন, সেটা বুঝতে পণ্ডিতদের সহায়তা প্রয়োজন। তাঁরা ইতিমধ্যে ব্যাখ্যা করেছেন, কেন এ নির্বাচনও সরকারের ইচ্ছামতোই হয়ে গেল।
তখন থেকে আবার মনে হচ্ছিল, নির্বাচন সেরে ফেলতে পারলেও দেশ চালিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে কঠিন। এর একটা কারণ তৈরি হচ্ছে ভেতরে-ভেতরে; অনেক দিন ধরে। সেটা হলো, রাজনৈতিক অধিকার হরণসহ সরকারপক্ষীয়দের গা-জোয়ারি ভাব মানুষ কত দিন সহ্য করবে? আরেকটি কারণ মনে হচ্ছিল, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তো খারাপ। অর্থনীতির ছাত্র বলে; এর ইস্যুগুলো পর্যবেক্ষণ করি বলেও লক্ষ করছিলাম, এ ক্ষেত্রে সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠছে।
কিছু সংকট আছে, যা দ্রুতই সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করে। তেমন সংকট কিন্তু মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। যেমন টানা মূল্যস্ফীতি। সেটা মোকাবিলা করতে গিয়ে সরকার আবার উল্টোপাল্টা পদক্ষেপ নিচ্ছিল। তাতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটছিল আরও। সেটা ঢাকতে আবার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছিল তথ্য জালিয়াতির! কেবলই মনে হচ্ছিল, ভুক্তভোগী মানুষ এসব ‘বদমায়েশি’ কত দিন মেনে নেবে? তারা কি কোনো একটা ইস্যুতে রাস্তায় নেমে এসে সরকারকে বিপাকে ফেলবে না?
আমার মনে হচ্ছিল, অবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পর্যুদস্ত মানুষ অচিরেই রাস্তায় নামবে। ‘বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে না’ বলে যতই চিৎকার করুন ওবায়দুল কাদের—তাঁরা তো দেশকে শ্রীলঙ্কার চেয়েও খারাপ অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছিলেন। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ খেয়ে দিচ্ছিলেন তাঁরা। পরিপূর্ণ রাজনৈতিক নিয়োগ লাভকারী গভর্নররাও সেটা সামাল দিচ্ছিলেন না। ব্যাংক খাতের একটা অংশও খেয়ে দেওয়া হচ্ছিল ক্রমে। এক দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ীকে নামিয়ে ব্যাংক দখল করে স্রেফ লুট করা হচ্ছিল। সঙ্গে বাড়ছিল অর্থ পাচার।
লুটের অর্থ দেশে বিনিয়োজিত হলেও কথা ছিল। গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতেও চলছিল লুটের আয়োজন। এরও প্রভাব পড়ছিল জ্বালানির বেড়ে চলা দামে। এ ধরনের সরকার সবখানেই কিছু মেগা প্রকল্প নিয়ে মানুষকে চমকে দিতে চায়। তারও আড়ালে চলে দুর্নীতির আয়োজন।
অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে জাতীয় বাজেট। চলে দুই হাতে ঋণ নিয়ে সরকার আর উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা। এসবের পক্ষে নগ্ন প্রচারণা চালাতে আবার গড়ে তোলা হয় স্তাবকগোষ্ঠী। তাদের ‘দেখভালের’ ব্যবস্থাও হয়। এ জায়গাটায় হাসিনা সরকার তো ছাড়িয়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কাকে। আরেকটা বড় তফাত ছিল। শ্রীলঙ্কায় কিন্তু ছিল নির্বাচিত সরকার। অনুমোদিত শাসনের একটা জোর কিন্তু থাকে। হাসিনা সরকারের সেটাও ছিল না।
মধ্য জুলাই থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশে যা ঘটে গেল, তাতে কোটা সংস্কারের দাবি উপরিভাগে থাকলেও গভীরে কিন্তু ছিল মানুষের দীর্ঘ রাজনৈতিক অধিকারহীনতা। সঙ্গে যোগ হয়েছিল, বিশেষত করোনার পর সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির কশাঘাত। এটা ঠিক, কোটা সংস্কারের দাবি ঠিকমতো নিষ্পত্তি করতে পারলে এটা ঘিরে যা যা হয়েছে, তার কিছুই হতো না। তবে কী হলে কী হতো, সেটা তো নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। যা ঘটে গেছে—আমরা কেবল পারি তার কার্যকারণ খতিয়ে দেখতে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কেন দ্রুতই সরকারবিরোধী হয়ে উঠল, সেটা বুঝতেও ব্যর্থ ছিল হাসিনা সরকার। তাঁরা এর মধ্যে কেবলই ‘তৃতীয় শক্তির অনুপ্রবেশ’ দেখতে পাচ্ছিলেন।
সেটা অভিন্নকণ্ঠে প্রচার করতে কিছু মানুষকে নামিয়েও দেওয়া হয়েছিল। হ্যাঁ, ‘তৃতীয় শক্তি’ অবশ্যই ছিল। কিন্তু তারা ঠিক ‘বিএনপি-জামায়াত’ নয়। তারা মূলত উন্নয়নের সুফলবঞ্চিত জনগোষ্ঠী। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দ্রুত একাত্ম হয়ে নেমে এরা প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে। সেদিন রাতেই, যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আন্দোলনরতদের উচ্ছেদ করা হয় শক্তি প্রয়োগ করে। শক্তির এই প্রয়োগ সরকার শুরু করেছিল ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীদের নামিয়ে। যাত্রাবাড়ীর প্রতিরোধ ছিল তারও প্রতিক্রিয়া। এরই মধ্যে রংপুরে আবু সাঈদের অসাধারণ আত্মদানের ঘটনা বেদনাবিদ্ধ করে সর্বস্তরের বিবেকবান মানুষকে।
ফিরে তাকালেই আমরা দেখব, যাত্রাবাড়ীতে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল—কারফিউ জারি করে, সেনাবাহিনী নামিয়েও তা দমানো যায়নি। সরকার পতনের দিনও যাত্রাবাড়ী থেকে চানখাঁরপুল পর্যন্ত ভয়াবহ সংঘাত চলেছে পুলিশের সঙ্গে। তত দিনে এটা হয়ে উঠেছে পরিপূর্ণভাবে ছাত্র-জনতার আন্দোলন। ঘটনার দিক থেকে এটা ছাড়িয়ে যায় সব আন্দোলনকে। রাজধানীর অন্যান্য এলাকায়; যেমন রামপুরা-বাড্ডা, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরে যে অসাধারণ আন্দোলন হয়েছে; তাতেও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে ক্রমে।
মিরপুর ডিওএইচএসে একপর্যায়ে সপরিবারে নেমে আসেন সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা। দুই সাবেক সেনাপ্রধানসহ তাঁদের সহকর্মীরা সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। সরকার উপলব্ধিতে ব্যর্থ হলেও তাঁরা কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারছিলেন, আন্দোলন কোথায় চলে গেছে! এতে অবশ্যই ঢুকেছিল ‘বিএনপি-জামায়াত’। কেন ঢুকবে না?
হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকেরাও ব্যাপকভাবে শামিল হয়েছিল। তাদের প্রত্যেকেরই দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল সরকারের ওপর।বারবার আন্দোলন রচনায় ব্যর্থ হওয়ার কারণেও তারা এতে যোগ দিয়েছিল একটা পর্যায়ে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলেও কি চুপচাপ বসে থাকত?
‘বিদেশি শক্তি’, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র এই আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। ভূমিকা তো রাখারই কথা। বিগত নির্বাচনকে একটা ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা দিতেও তাদের কথা কি রাখা হয়েছিল? উল্টো আজেবাজে কথা বলে অপমান করা হয়েছে। ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতকে প্রকাশ্যে ব্যবহার করেও তাদের পিছু হটতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেটা আবার ঘটা করে বলাও হয়েছে। ভারতীয় পক্ষ থেকেও একই সুরে বলা হয়েছে নানা কথা; যার মধ্যে কূটনৈতিক শিষ্টাচারও ছিল না। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র যদি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে থাকে, তাতে অবাক হওয়া যাবে না। অভিযোগ করেও লাভ নেই। কিন্তু সবকিছুর পর এটা তো চিন্তা করে দেখতে হবে, কেন শিক্ষার্থীরা এত বিক্ষুব্ধ ছিল!
কেন তারা নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে সার্কাজম করে স্লোগান তুলে ঐতিহ্যবাহী একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা বদলে দিল? এর তাৎপর্য উপলব্ধিতেও ব্যর্থ হলো ৭৫ বছরের পুরোনো রাজনৈতিক দলটির সরকার। অবশ্য তত দিনে এটা হয়ে উঠেছিল প্রশাসন আর কিছু ‘অলিগার্ক ব্যবসায়ী’র সরকার। হয়ে পড়েছিল নতুন প্রজন্ম শুধু নয়; জনগণের সিংহভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন। সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতিশূন্য। এ ধরনের সরকারকে কোনো শক্তিশালী ও কুশলী বিদেশি শক্তি তো সহজেই বিপাকে ফেলতে পারে। কিন্তু সেটা দিয়েই পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চাওয়া এক ভয়ানক ভুল। শেখ হাসিনা ও তাঁর অনুগামীরা এখনো এর মধ্যে ডুবে আছেন কি না, কে জানে!
আন্দোলনে কারা হতাহত হয়েছে, সেদিকে তাকালেও কিন্তু বোঝা যায় নিম্ন আয়ের মানুষের কী ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল এতে! শিক্ষার্থীরা যেহেতু ছিল এর অগ্রভাগে, তাই তাদের মৃত্যুর ঘটনাগুলো স্বভাবতই বেশি আলোড়িত করেছে আমাদের। বেশি আলোড়িত করেছে শিশু-কিশোরদের করুণ মৃত্যুর ঘটনাগুলো। মাঝে ইউনিসেফ এটাকে আলাদা করে তুলে ধরায় সরকার আবার প্রতিবাদ জানায় ‘সংখ্যা’ নিয়ে!
টানা কয়েক দিন আন্দোলন দমনের নামে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারটাও আড়াল করা হচ্ছিল তখন। ইন্টারনেট সংযোগ করা হচ্ছিল বিচ্ছিন্ন, যাতে বিশেষত বহির্বিশ্ব এসব জানতে না পারে। কিন্তু নির্বিচারে মেরেধরেও আন্দোলন দমানো যাচ্ছিল না; কেননা এটা ছিল দেশের গভীর থেকে উৎসারিত। কোটার তোয়াক্কা না করা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা নেমেছিল কেন?
তারা নেমেছিল স্রেফ প্রতিবাদ জানাতে। তারাও আবু সাঈদ স্টাইলে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ায় রামপুরা, উত্তরা, মিরপুরে। স্কুলের কিশোরেরা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মতো করে চিঠি লিখে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে গুলি খায়। শেষে অভিভাবকদেরও নামতে হয় তাদের সঙ্গে। কারণ ওদের ঘরে রাখা যাচ্ছিল না। আত্মাহুতির একটা উৎসবই যেন শুরু হয়ে গিয়েছিল দেশে। সংবাদপত্রে দেখলাম, নরসিংদীর এক দিনমজুর ভাই কীভাবে দুই হাত তুলে পেছনে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে চাইছে। সেও কিন্তু অকাতরে জীবন দিয়েছে পুলিশের গুলিতে।
এমন একটা পরিস্থিতির দিকেই দেশকে নিয়ে গিয়েছিল হাসিনা সরকার! আমরা অবশ্যই চাইব না, এ পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি আর কখনো হোক। সেটাকে ন্যূনতম লক্ষ্য ধরেই এখন এগোতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
আমার একটা ধারণা ছিল, আগের দুটি নির্বাচন যেনতেনভাবে করে ফেললেও ২০২৪ সালেরটি সরকার ইচ্ছামতো করে ফেলতে পারবে না; বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক তৎপরতা দেখে এমনটা মনে হচ্ছিল। লেখালেখিও করেছি সে ধারায়। এটা কারও পক্ষ বা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া তো নয়। এটা ন্যায্যতার প্রশ্ন। একের পর এক খারাপ নির্বাচন একটা দেশকে কোনো ভালো গন্তব্যে নিয়ে যায় না। আর এটা বুঝতে পণ্ডিত হতে হয় না। তবে ২০২৪-এর নির্বাচনটি প্রত্যাশামতো হলো না কেন, সেটা বুঝতে পণ্ডিতদের সহায়তা প্রয়োজন। তাঁরা ইতিমধ্যে ব্যাখ্যা করেছেন, কেন এ নির্বাচনও সরকারের ইচ্ছামতোই হয়ে গেল।
তখন থেকে আবার মনে হচ্ছিল, নির্বাচন সেরে ফেলতে পারলেও দেশ চালিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে কঠিন। এর একটা কারণ তৈরি হচ্ছে ভেতরে-ভেতরে; অনেক দিন ধরে। সেটা হলো, রাজনৈতিক অধিকার হরণসহ সরকারপক্ষীয়দের গা-জোয়ারি ভাব মানুষ কত দিন সহ্য করবে? আরেকটি কারণ মনে হচ্ছিল, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তো খারাপ। অর্থনীতির ছাত্র বলে; এর ইস্যুগুলো পর্যবেক্ষণ করি বলেও লক্ষ করছিলাম, এ ক্ষেত্রে সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠছে।
কিছু সংকট আছে, যা দ্রুতই সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করে। তেমন সংকট কিন্তু মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। যেমন টানা মূল্যস্ফীতি। সেটা মোকাবিলা করতে গিয়ে সরকার আবার উল্টোপাল্টা পদক্ষেপ নিচ্ছিল। তাতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটছিল আরও। সেটা ঢাকতে আবার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছিল তথ্য জালিয়াতির! কেবলই মনে হচ্ছিল, ভুক্তভোগী মানুষ এসব ‘বদমায়েশি’ কত দিন মেনে নেবে? তারা কি কোনো একটা ইস্যুতে রাস্তায় নেমে এসে সরকারকে বিপাকে ফেলবে না?
আমার মনে হচ্ছিল, অবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পর্যুদস্ত মানুষ অচিরেই রাস্তায় নামবে। ‘বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে না’ বলে যতই চিৎকার করুন ওবায়দুল কাদের—তাঁরা তো দেশকে শ্রীলঙ্কার চেয়েও খারাপ অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছিলেন। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ খেয়ে দিচ্ছিলেন তাঁরা। পরিপূর্ণ রাজনৈতিক নিয়োগ লাভকারী গভর্নররাও সেটা সামাল দিচ্ছিলেন না। ব্যাংক খাতের একটা অংশও খেয়ে দেওয়া হচ্ছিল ক্রমে। এক দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ীকে নামিয়ে ব্যাংক দখল করে স্রেফ লুট করা হচ্ছিল। সঙ্গে বাড়ছিল অর্থ পাচার।
লুটের অর্থ দেশে বিনিয়োজিত হলেও কথা ছিল। গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতেও চলছিল লুটের আয়োজন। এরও প্রভাব পড়ছিল জ্বালানির বেড়ে চলা দামে। এ ধরনের সরকার সবখানেই কিছু মেগা প্রকল্প নিয়ে মানুষকে চমকে দিতে চায়। তারও আড়ালে চলে দুর্নীতির আয়োজন।
অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে জাতীয় বাজেট। চলে দুই হাতে ঋণ নিয়ে সরকার আর উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা। এসবের পক্ষে নগ্ন প্রচারণা চালাতে আবার গড়ে তোলা হয় স্তাবকগোষ্ঠী। তাদের ‘দেখভালের’ ব্যবস্থাও হয়। এ জায়গাটায় হাসিনা সরকার তো ছাড়িয়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কাকে। আরেকটা বড় তফাত ছিল। শ্রীলঙ্কায় কিন্তু ছিল নির্বাচিত সরকার। অনুমোদিত শাসনের একটা জোর কিন্তু থাকে। হাসিনা সরকারের সেটাও ছিল না।
মধ্য জুলাই থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশে যা ঘটে গেল, তাতে কোটা সংস্কারের দাবি উপরিভাগে থাকলেও গভীরে কিন্তু ছিল মানুষের দীর্ঘ রাজনৈতিক অধিকারহীনতা। সঙ্গে যোগ হয়েছিল, বিশেষত করোনার পর সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির কশাঘাত। এটা ঠিক, কোটা সংস্কারের দাবি ঠিকমতো নিষ্পত্তি করতে পারলে এটা ঘিরে যা যা হয়েছে, তার কিছুই হতো না। তবে কী হলে কী হতো, সেটা তো নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। যা ঘটে গেছে—আমরা কেবল পারি তার কার্যকারণ খতিয়ে দেখতে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কেন দ্রুতই সরকারবিরোধী হয়ে উঠল, সেটা বুঝতেও ব্যর্থ ছিল হাসিনা সরকার। তাঁরা এর মধ্যে কেবলই ‘তৃতীয় শক্তির অনুপ্রবেশ’ দেখতে পাচ্ছিলেন।
সেটা অভিন্নকণ্ঠে প্রচার করতে কিছু মানুষকে নামিয়েও দেওয়া হয়েছিল। হ্যাঁ, ‘তৃতীয় শক্তি’ অবশ্যই ছিল। কিন্তু তারা ঠিক ‘বিএনপি-জামায়াত’ নয়। তারা মূলত উন্নয়নের সুফলবঞ্চিত জনগোষ্ঠী। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দ্রুত একাত্ম হয়ে নেমে এরা প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে। সেদিন রাতেই, যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আন্দোলনরতদের উচ্ছেদ করা হয় শক্তি প্রয়োগ করে। শক্তির এই প্রয়োগ সরকার শুরু করেছিল ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীদের নামিয়ে। যাত্রাবাড়ীর প্রতিরোধ ছিল তারও প্রতিক্রিয়া। এরই মধ্যে রংপুরে আবু সাঈদের অসাধারণ আত্মদানের ঘটনা বেদনাবিদ্ধ করে সর্বস্তরের বিবেকবান মানুষকে।
ফিরে তাকালেই আমরা দেখব, যাত্রাবাড়ীতে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল—কারফিউ জারি করে, সেনাবাহিনী নামিয়েও তা দমানো যায়নি। সরকার পতনের দিনও যাত্রাবাড়ী থেকে চানখাঁরপুল পর্যন্ত ভয়াবহ সংঘাত চলেছে পুলিশের সঙ্গে। তত দিনে এটা হয়ে উঠেছে পরিপূর্ণভাবে ছাত্র-জনতার আন্দোলন। ঘটনার দিক থেকে এটা ছাড়িয়ে যায় সব আন্দোলনকে। রাজধানীর অন্যান্য এলাকায়; যেমন রামপুরা-বাড্ডা, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরে যে অসাধারণ আন্দোলন হয়েছে; তাতেও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে ক্রমে।
মিরপুর ডিওএইচএসে একপর্যায়ে সপরিবারে নেমে আসেন সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা। দুই সাবেক সেনাপ্রধানসহ তাঁদের সহকর্মীরা সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। সরকার উপলব্ধিতে ব্যর্থ হলেও তাঁরা কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারছিলেন, আন্দোলন কোথায় চলে গেছে! এতে অবশ্যই ঢুকেছিল ‘বিএনপি-জামায়াত’। কেন ঢুকবে না?
হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকেরাও ব্যাপকভাবে শামিল হয়েছিল। তাদের প্রত্যেকেরই দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল সরকারের ওপর।বারবার আন্দোলন রচনায় ব্যর্থ হওয়ার কারণেও তারা এতে যোগ দিয়েছিল একটা পর্যায়ে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলেও কি চুপচাপ বসে থাকত?
‘বিদেশি শক্তি’, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র এই আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। ভূমিকা তো রাখারই কথা। বিগত নির্বাচনকে একটা ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা দিতেও তাদের কথা কি রাখা হয়েছিল? উল্টো আজেবাজে কথা বলে অপমান করা হয়েছে। ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতকে প্রকাশ্যে ব্যবহার করেও তাদের পিছু হটতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেটা আবার ঘটা করে বলাও হয়েছে। ভারতীয় পক্ষ থেকেও একই সুরে বলা হয়েছে নানা কথা; যার মধ্যে কূটনৈতিক শিষ্টাচারও ছিল না। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র যদি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে থাকে, তাতে অবাক হওয়া যাবে না। অভিযোগ করেও লাভ নেই। কিন্তু সবকিছুর পর এটা তো চিন্তা করে দেখতে হবে, কেন শিক্ষার্থীরা এত বিক্ষুব্ধ ছিল!
কেন তারা নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে সার্কাজম করে স্লোগান তুলে ঐতিহ্যবাহী একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা বদলে দিল? এর তাৎপর্য উপলব্ধিতেও ব্যর্থ হলো ৭৫ বছরের পুরোনো রাজনৈতিক দলটির সরকার। অবশ্য তত দিনে এটা হয়ে উঠেছিল প্রশাসন আর কিছু ‘অলিগার্ক ব্যবসায়ী’র সরকার। হয়ে পড়েছিল নতুন প্রজন্ম শুধু নয়; জনগণের সিংহভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন। সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতিশূন্য। এ ধরনের সরকারকে কোনো শক্তিশালী ও কুশলী বিদেশি শক্তি তো সহজেই বিপাকে ফেলতে পারে। কিন্তু সেটা দিয়েই পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চাওয়া এক ভয়ানক ভুল। শেখ হাসিনা ও তাঁর অনুগামীরা এখনো এর মধ্যে ডুবে আছেন কি না, কে জানে!
আন্দোলনে কারা হতাহত হয়েছে, সেদিকে তাকালেও কিন্তু বোঝা যায় নিম্ন আয়ের মানুষের কী ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল এতে! শিক্ষার্থীরা যেহেতু ছিল এর অগ্রভাগে, তাই তাদের মৃত্যুর ঘটনাগুলো স্বভাবতই বেশি আলোড়িত করেছে আমাদের। বেশি আলোড়িত করেছে শিশু-কিশোরদের করুণ মৃত্যুর ঘটনাগুলো। মাঝে ইউনিসেফ এটাকে আলাদা করে তুলে ধরায় সরকার আবার প্রতিবাদ জানায় ‘সংখ্যা’ নিয়ে!
টানা কয়েক দিন আন্দোলন দমনের নামে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারটাও আড়াল করা হচ্ছিল তখন। ইন্টারনেট সংযোগ করা হচ্ছিল বিচ্ছিন্ন, যাতে বিশেষত বহির্বিশ্ব এসব জানতে না পারে। কিন্তু নির্বিচারে মেরেধরেও আন্দোলন দমানো যাচ্ছিল না; কেননা এটা ছিল দেশের গভীর থেকে উৎসারিত। কোটার তোয়াক্কা না করা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা নেমেছিল কেন?
তারা নেমেছিল স্রেফ প্রতিবাদ জানাতে। তারাও আবু সাঈদ স্টাইলে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ায় রামপুরা, উত্তরা, মিরপুরে। স্কুলের কিশোরেরা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মতো করে চিঠি লিখে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে গুলি খায়। শেষে অভিভাবকদেরও নামতে হয় তাদের সঙ্গে। কারণ ওদের ঘরে রাখা যাচ্ছিল না। আত্মাহুতির একটা উৎসবই যেন শুরু হয়ে গিয়েছিল দেশে। সংবাদপত্রে দেখলাম, নরসিংদীর এক দিনমজুর ভাই কীভাবে দুই হাত তুলে পেছনে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে চাইছে। সেও কিন্তু অকাতরে জীবন দিয়েছে পুলিশের গুলিতে।
এমন একটা পরিস্থিতির দিকেই দেশকে নিয়ে গিয়েছিল হাসিনা সরকার! আমরা অবশ্যই চাইব না, এ পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি আর কখনো হোক। সেটাকে ন্যূনতম লক্ষ্য ধরেই এখন এগোতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৬ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৬ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৬ দিন আগে