চিররঞ্জন সরকার
সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় বিরোধী দলের গুরুত্ব অপরিসীম। এই ব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট বিরোধী দল সংসদের হৃৎপিণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ বিরোধী দল ছাড়া সংসদীয় পদ্ধতি কখনোই সফলভাবে কাজ করতে পারে না। বিরোধী দল ও সরকার সাইকেলের দুটি চাকার মতো। দুটি চাকা সচল হলে গণতন্ত্র সচল হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা বর্তমানে সার্কাসের সেই এক চাকার সাইকেলে পরিণত হয়েছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। বিএনপির বাইরে অন্যতম বৃহৎ দল জাতীয় পার্টি সরকারি দলের সঙ্গে আপসের ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। তাদের অবস্থান ‘না ঘরকা না ঘাটকা’! দ্বাদশ নির্বাচনে তারা মাত্র ১১টি আসন লাভ করেছে। তাদের চেয়ে অনেক বেশি আসনে জিতেছেন স্বতন্ত্র পরিচয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ৬২ জন। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২২টি আসন। এই পরিস্থিতিতে এবার সংসদে বিরোধী দল কে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মাত্র ১১টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না। এ সংখ্যা দিয়ে বিরোধী দল গঠন বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রচলিত নিয়মের বাইরে। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে বিরোধী দল হিসেবে অফিশিয়ালি স্বীকৃতি পেতে হলে দলের আসনসংখ্যা ন্যূনতম ২৫ হতে হবে, যা বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে নির্ধারিত হয়। এর কম হলে তারা বড়জোর পার্লামেন্টারি গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। কাজেই দ্বাদশ সংসদে আওয়ামী লীগ আবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও অপ্রতিহত ক্ষমতা নিয়ে সরকার গঠন করলেও সংসদীয় ব্যবস্থার সংকট থেকেই যাচ্ছে।
অবশ্য আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রবণতা অনুযায়ী, বিরোধিতা বা সমালোচনাকে সহ্য করা হয় না। আমরা চাই কেবল সমর্থন, প্রশংসা আর আনুগত্য। সমালোচনা যত গঠনমূলক হোক না কেন, সেটা আমরা মানতে বা সহ্য করতে পারি না। ফলে আমাদের দেশে ‘সমালোচক’ তৈরি হয় না, তৈরি হয় স্তাবক আর শত্রু বা বিদ্বেষকারী। এই মনোভাবের কারণে বিরোধী দল মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। অবশ্য বিরোধী দলও আমাদের দেশে কেন জানি গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে কেবলই হিংস্রতা প্রদর্শন, প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুঁড়িয়ে দেওয়া, ‘ধ্বংস হোক, নিপাত যাক’ টাইপের ধারণা পোষণ করে। ফলে আমাদের দেশে দুটি রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে পরিণত হয় ঘোরতর শত্রুতে।
কার্যকর বিরোধী দলমুক্ত একটা ‘অনুগত সংসদীয় ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের বিরাট অবদান আছে। বিরোধী দল বিকশিত হোক, সংসদে এসে কথা বলুক, এটা ক্ষমতাকাঙ্ক্ষীরা চায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনেও বাধা দেওয়া হয়। বিরোধীদের ঘায়েল করতে মিথ্যা মামলায় জর্জরিত করে রাখা হয়। এত সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বিরোধী দল তাই খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। অথচ গণতন্ত্রের চর্চায় বিরোধী দল থাকা অপরিহার্য। শুধু গণতন্ত্রের খাতিরেই নয়, যেকোনো বিবেচনাতেই বিরোধী দল বা সমালোচক প্রয়োজন। কেননা, একজন ব্যক্তি বা একটি দল সব সময় সব সিদ্ধান্ত সঠিক নিতে পারে না। তার সেই সিদ্ধান্ত ভুল না ঠিক, কোথায় গলদ, কোথায় সমস্যা—এগুলো আরেকজনের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। বাইরের কেউ যদি একটা উদ্যোগ বা সিদ্ধান্তের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়, ভিন্ন কোনো ভালো পথের সন্ধান দেয়, আখেরে সেটা সবার জন্যই লাভ। সে জন্যই ইংরেজিতে বলা হয় ‘ক্রিটিকস আর ইওর বেস্ট ফ্রেন্ডস’; অর্থাৎ সমালোচকেরা আপনার সবচেয়ে বড় বন্ধু।
কিন্তু আমরা সবাই ‘সবজান্তা শমশের’ হয়ে বসে আছি। আমরা নিজেরাই নিজেদের মত ও পথ সেরা বলে ধরে নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে অটুট থাকি। তাই সমালোচনা ও বিরোধিতাকে আমরা শত্রুতা হিসেবে ধরে নিই। সবার চোখ ও কণ্ঠ বন্ধ করে দিয়ে কেবল নিজেরটাকে শ্রেয় মনে করে পথ চলি। তাই আমাদের দেশে বিরোধী দল কখনো শক্তিশালী হয় না। বিরোধীদের কণ্ঠস্বর কখনো উচ্চকিত হতে পারে না।
আমাদের দেশে কয়েক দশকে যে যখন ক্ষমতায় আসীন হয়েছে, সেই বিরোধী দলের নাম-নিশানা ভুলিয়ে দেওয়ার মিশন নিয়েছে। প্রয়োজনমতো গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। নেতাদের হত্যা করা হয়েছে। বিরোধী দলমুক্ত দেশ গড়ার একটা অদৃশ্য অ্যাজেন্ডা ক্ষমতায় যাওয়া সব দলই বাস্তবায়ন করেছে। এই ব্যাধি রাজনীতিকদের মজ্জাগত।
বিরোধী মত বিকশিত হওয়া খুব, খুবই প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নিয়ে ১৯৮৯ সালে কলকাতার জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সুমন একটা গান লিখেছিলেন, ‘বিরোধীকে বলতে দাও’। বিরোধীর নিজের কথা নিজের মতো করে বলার স্বাধীনতা কতটা জরুরি, ইতিহাস সেটা বারবার প্রমাণ করেছে। নানা দেশে, নানা পরিস্থিতিতে। যেমন এই মুহূর্তে বাংলাদেশে। যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁদের স্বভাবে বিরোধী মত শোনার অভ্যাস কম, যেকোনো বিষয়ে বিপরীত কথা শুনলেই তাঁদের ক্রোধ জেগে ওঠে, ক্ষমতার অস্ত্র—অনেক সময় আক্ষরিক অর্থেই অস্ত্র—হাতে নিয়ে সেই ক্রোধ বিরুদ্ধ মতের অনুগামীদের দমন করতে তৎপর হয়। এই অসহিষ্ণুতা এক ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় অসুখ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
তাও মানা যেত যদি দেশটা ঠিকঠাকভাবে চলত। চুরিচামারি বন্ধ হতো। চাল-ডাল-তেল-লবণের দামটা নাগালে থাকত। দেশটা কি ভালো আছে? অর্থনীতি? পররাষ্ট্রনীতি? অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষার পরিবেশ, সব ভালো চলছে তো? কী বলছে পরিসংখ্যান? যত বড় সরকার-ভক্তই হোন না কেন, গত পাঁচ বছরে অর্থনীতি এগিয়েছে, সমৃদ্ধির বসন্ত শুরু হয়ে গেছে, এ কথা বলার মতো লোক মিলবে কি?
হ্যাঁ, দেশে কোটিপতির সংখ্যা, কোটিপতি ব্যাংক আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু তার চেয়ে বৈষম্য বেড়েছে অনেক বেশি। গরিব কৃষকে পরিণত হয়েছে অনেক মধ্যবিত্ত কৃষক। ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ছিন্নমূল, নদীভাঙা মানুষের শহরমুখী স্রোত গত কয়েক বছরে কতটা বেড়েছে, আয়বঞ্চনা ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে গরিব মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা কতটুকু পূরণ করতে পারছে, সে খবর কেউ রাখে? এগুলোর কোনো পরিসংখ্যানও নেই।
অর্থনীতিতে মহাদুর্যোগ চলছে। রিজার্ভ কমছে। জোড়াতালি দিয়ে চলছে রাষ্ট্রীয় লেনদেন। গত ৫০ বছরে এত বড় চ্যালেঞ্জ দেশের অর্থনীতির সামনে আসেনি। কিন্তু মন্ত্রী-আমলাদের কথায়-আচরণে তার কোনো প্রতিফলন নেই। অপব্যয়, দুর্নীতি কমানোর কোনো কঠোর অঙ্গীকার কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তাতে বড় ব্যবসায়ী আর সরকারি চাকুরে বাদে আর কজনের রোজগার আগের মতো থাকবে, তা বলা মুশকিল।
এদিকে দেশে বিরোধী দলের অস্তিত্ব যেন কোনো এক অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে গেছে। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল বিএনপি অযোগ্য নেতৃত্ব, ভুল নীতি আর কৌশলের কারণে দিন দিন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বিএনপিকে কিছু মিডিয়ায় ছাড়া এখন আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
হরতাল, অবরোধ, অসহযোগের মতো চরম কর্মসূচি দিয়ে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়ে দলটি লিফলেট বিতরণ, কালো পতাকা প্রদর্শনের মতো হাস্যকর কর্মসূচি দিচ্ছে। বিএনপির আন্দোলন নেতা-নেত্রীদের হুমকি-ধমকিতেই সীমাবদ্ধ। অহিংস আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দলটি শোচনীয় রকম ব্যর্থ। প্রতিবাদ, হিংসার পথ নিয়ে বিএনপির আন্দোলন বারবার দিকভ্রষ্ট হয়েছে। আসলে সাফল্যের কোনো শর্টকাট রুট নেই। সাফল্য আসে ধারাবাহিকতার হাত ধরে। ধারাবাহিক ও সংযত আন্দোলনেই পূরণ হয় উদ্দেশ্য। অবিরাম বৃষ্টিধারা একটার পর একটা স্তর ভেদ করে ধীরে ধীরে পৌঁছায় মাটির গভীরে। পুষ্ট করে ভূগর্ভস্থ জলাধার। সেই বিশুদ্ধ জলই মানুষের জীবন বাঁচায়। আন্দোলনও তেমনই। ধারাবাহিক আন্দোলন মানুষের মনের গভীরে জায়গা করে নেয়। সুরক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ভরসা জোগায়।
সেই কাজটি বিএনপি করতে পারছে না। ‘আন্দোলনের মাধ্যমে’ ক্ষমতাসীনদের ‘সব দাবি মানতে বাধ্য করার’ ঘোষণাকে বিএনপির নেতারা রীতিমতো প্রহসন বানিয়ে ফেলেছেন। গরম-গরম কথাই কেবল সার হচ্ছে। রাজনীতিতে গরম-গরম কথা, হিংসাত্মক আন্দোলন দেউলিয়াপনার লক্ষণ। বিরোধী দলই বা আর কত দিন নিজেদের মৌলিক মূর্খতার বৃত্তে ঘুরপাক খাবে? কবে তাদের সুমতি হবে?
আর একটা ‘অক্ষম বিরোধী দল’কে ছলে-বলে-কৌশলে দুর্বল বানিয়ে রাখার ‘সাফল্য’ ক্ষমতাসীনেরা আর কতকাল উপভোগ করবেন?
লেখক: চিররঞ্জন সরকার, গবেষক ও কলামিস্ট
সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় বিরোধী দলের গুরুত্ব অপরিসীম। এই ব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট বিরোধী দল সংসদের হৃৎপিণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ বিরোধী দল ছাড়া সংসদীয় পদ্ধতি কখনোই সফলভাবে কাজ করতে পারে না। বিরোধী দল ও সরকার সাইকেলের দুটি চাকার মতো। দুটি চাকা সচল হলে গণতন্ত্র সচল হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা বর্তমানে সার্কাসের সেই এক চাকার সাইকেলে পরিণত হয়েছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। বিএনপির বাইরে অন্যতম বৃহৎ দল জাতীয় পার্টি সরকারি দলের সঙ্গে আপসের ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। তাদের অবস্থান ‘না ঘরকা না ঘাটকা’! দ্বাদশ নির্বাচনে তারা মাত্র ১১টি আসন লাভ করেছে। তাদের চেয়ে অনেক বেশি আসনে জিতেছেন স্বতন্ত্র পরিচয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ৬২ জন। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২২টি আসন। এই পরিস্থিতিতে এবার সংসদে বিরোধী দল কে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মাত্র ১১টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না। এ সংখ্যা দিয়ে বিরোধী দল গঠন বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রচলিত নিয়মের বাইরে। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে বিরোধী দল হিসেবে অফিশিয়ালি স্বীকৃতি পেতে হলে দলের আসনসংখ্যা ন্যূনতম ২৫ হতে হবে, যা বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে নির্ধারিত হয়। এর কম হলে তারা বড়জোর পার্লামেন্টারি গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। কাজেই দ্বাদশ সংসদে আওয়ামী লীগ আবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও অপ্রতিহত ক্ষমতা নিয়ে সরকার গঠন করলেও সংসদীয় ব্যবস্থার সংকট থেকেই যাচ্ছে।
অবশ্য আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রবণতা অনুযায়ী, বিরোধিতা বা সমালোচনাকে সহ্য করা হয় না। আমরা চাই কেবল সমর্থন, প্রশংসা আর আনুগত্য। সমালোচনা যত গঠনমূলক হোক না কেন, সেটা আমরা মানতে বা সহ্য করতে পারি না। ফলে আমাদের দেশে ‘সমালোচক’ তৈরি হয় না, তৈরি হয় স্তাবক আর শত্রু বা বিদ্বেষকারী। এই মনোভাবের কারণে বিরোধী দল মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। অবশ্য বিরোধী দলও আমাদের দেশে কেন জানি গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে কেবলই হিংস্রতা প্রদর্শন, প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুঁড়িয়ে দেওয়া, ‘ধ্বংস হোক, নিপাত যাক’ টাইপের ধারণা পোষণ করে। ফলে আমাদের দেশে দুটি রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে পরিণত হয় ঘোরতর শত্রুতে।
কার্যকর বিরোধী দলমুক্ত একটা ‘অনুগত সংসদীয় ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের বিরাট অবদান আছে। বিরোধী দল বিকশিত হোক, সংসদে এসে কথা বলুক, এটা ক্ষমতাকাঙ্ক্ষীরা চায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনেও বাধা দেওয়া হয়। বিরোধীদের ঘায়েল করতে মিথ্যা মামলায় জর্জরিত করে রাখা হয়। এত সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বিরোধী দল তাই খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। অথচ গণতন্ত্রের চর্চায় বিরোধী দল থাকা অপরিহার্য। শুধু গণতন্ত্রের খাতিরেই নয়, যেকোনো বিবেচনাতেই বিরোধী দল বা সমালোচক প্রয়োজন। কেননা, একজন ব্যক্তি বা একটি দল সব সময় সব সিদ্ধান্ত সঠিক নিতে পারে না। তার সেই সিদ্ধান্ত ভুল না ঠিক, কোথায় গলদ, কোথায় সমস্যা—এগুলো আরেকজনের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। বাইরের কেউ যদি একটা উদ্যোগ বা সিদ্ধান্তের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়, ভিন্ন কোনো ভালো পথের সন্ধান দেয়, আখেরে সেটা সবার জন্যই লাভ। সে জন্যই ইংরেজিতে বলা হয় ‘ক্রিটিকস আর ইওর বেস্ট ফ্রেন্ডস’; অর্থাৎ সমালোচকেরা আপনার সবচেয়ে বড় বন্ধু।
কিন্তু আমরা সবাই ‘সবজান্তা শমশের’ হয়ে বসে আছি। আমরা নিজেরাই নিজেদের মত ও পথ সেরা বলে ধরে নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে অটুট থাকি। তাই সমালোচনা ও বিরোধিতাকে আমরা শত্রুতা হিসেবে ধরে নিই। সবার চোখ ও কণ্ঠ বন্ধ করে দিয়ে কেবল নিজেরটাকে শ্রেয় মনে করে পথ চলি। তাই আমাদের দেশে বিরোধী দল কখনো শক্তিশালী হয় না। বিরোধীদের কণ্ঠস্বর কখনো উচ্চকিত হতে পারে না।
আমাদের দেশে কয়েক দশকে যে যখন ক্ষমতায় আসীন হয়েছে, সেই বিরোধী দলের নাম-নিশানা ভুলিয়ে দেওয়ার মিশন নিয়েছে। প্রয়োজনমতো গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। নেতাদের হত্যা করা হয়েছে। বিরোধী দলমুক্ত দেশ গড়ার একটা অদৃশ্য অ্যাজেন্ডা ক্ষমতায় যাওয়া সব দলই বাস্তবায়ন করেছে। এই ব্যাধি রাজনীতিকদের মজ্জাগত।
বিরোধী মত বিকশিত হওয়া খুব, খুবই প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নিয়ে ১৯৮৯ সালে কলকাতার জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সুমন একটা গান লিখেছিলেন, ‘বিরোধীকে বলতে দাও’। বিরোধীর নিজের কথা নিজের মতো করে বলার স্বাধীনতা কতটা জরুরি, ইতিহাস সেটা বারবার প্রমাণ করেছে। নানা দেশে, নানা পরিস্থিতিতে। যেমন এই মুহূর্তে বাংলাদেশে। যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁদের স্বভাবে বিরোধী মত শোনার অভ্যাস কম, যেকোনো বিষয়ে বিপরীত কথা শুনলেই তাঁদের ক্রোধ জেগে ওঠে, ক্ষমতার অস্ত্র—অনেক সময় আক্ষরিক অর্থেই অস্ত্র—হাতে নিয়ে সেই ক্রোধ বিরুদ্ধ মতের অনুগামীদের দমন করতে তৎপর হয়। এই অসহিষ্ণুতা এক ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় অসুখ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
তাও মানা যেত যদি দেশটা ঠিকঠাকভাবে চলত। চুরিচামারি বন্ধ হতো। চাল-ডাল-তেল-লবণের দামটা নাগালে থাকত। দেশটা কি ভালো আছে? অর্থনীতি? পররাষ্ট্রনীতি? অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষার পরিবেশ, সব ভালো চলছে তো? কী বলছে পরিসংখ্যান? যত বড় সরকার-ভক্তই হোন না কেন, গত পাঁচ বছরে অর্থনীতি এগিয়েছে, সমৃদ্ধির বসন্ত শুরু হয়ে গেছে, এ কথা বলার মতো লোক মিলবে কি?
হ্যাঁ, দেশে কোটিপতির সংখ্যা, কোটিপতি ব্যাংক আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু তার চেয়ে বৈষম্য বেড়েছে অনেক বেশি। গরিব কৃষকে পরিণত হয়েছে অনেক মধ্যবিত্ত কৃষক। ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ছিন্নমূল, নদীভাঙা মানুষের শহরমুখী স্রোত গত কয়েক বছরে কতটা বেড়েছে, আয়বঞ্চনা ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে গরিব মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা কতটুকু পূরণ করতে পারছে, সে খবর কেউ রাখে? এগুলোর কোনো পরিসংখ্যানও নেই।
অর্থনীতিতে মহাদুর্যোগ চলছে। রিজার্ভ কমছে। জোড়াতালি দিয়ে চলছে রাষ্ট্রীয় লেনদেন। গত ৫০ বছরে এত বড় চ্যালেঞ্জ দেশের অর্থনীতির সামনে আসেনি। কিন্তু মন্ত্রী-আমলাদের কথায়-আচরণে তার কোনো প্রতিফলন নেই। অপব্যয়, দুর্নীতি কমানোর কোনো কঠোর অঙ্গীকার কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তাতে বড় ব্যবসায়ী আর সরকারি চাকুরে বাদে আর কজনের রোজগার আগের মতো থাকবে, তা বলা মুশকিল।
এদিকে দেশে বিরোধী দলের অস্তিত্ব যেন কোনো এক অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে গেছে। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল বিএনপি অযোগ্য নেতৃত্ব, ভুল নীতি আর কৌশলের কারণে দিন দিন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বিএনপিকে কিছু মিডিয়ায় ছাড়া এখন আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
হরতাল, অবরোধ, অসহযোগের মতো চরম কর্মসূচি দিয়ে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়ে দলটি লিফলেট বিতরণ, কালো পতাকা প্রদর্শনের মতো হাস্যকর কর্মসূচি দিচ্ছে। বিএনপির আন্দোলন নেতা-নেত্রীদের হুমকি-ধমকিতেই সীমাবদ্ধ। অহিংস আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দলটি শোচনীয় রকম ব্যর্থ। প্রতিবাদ, হিংসার পথ নিয়ে বিএনপির আন্দোলন বারবার দিকভ্রষ্ট হয়েছে। আসলে সাফল্যের কোনো শর্টকাট রুট নেই। সাফল্য আসে ধারাবাহিকতার হাত ধরে। ধারাবাহিক ও সংযত আন্দোলনেই পূরণ হয় উদ্দেশ্য। অবিরাম বৃষ্টিধারা একটার পর একটা স্তর ভেদ করে ধীরে ধীরে পৌঁছায় মাটির গভীরে। পুষ্ট করে ভূগর্ভস্থ জলাধার। সেই বিশুদ্ধ জলই মানুষের জীবন বাঁচায়। আন্দোলনও তেমনই। ধারাবাহিক আন্দোলন মানুষের মনের গভীরে জায়গা করে নেয়। সুরক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ভরসা জোগায়।
সেই কাজটি বিএনপি করতে পারছে না। ‘আন্দোলনের মাধ্যমে’ ক্ষমতাসীনদের ‘সব দাবি মানতে বাধ্য করার’ ঘোষণাকে বিএনপির নেতারা রীতিমতো প্রহসন বানিয়ে ফেলেছেন। গরম-গরম কথাই কেবল সার হচ্ছে। রাজনীতিতে গরম-গরম কথা, হিংসাত্মক আন্দোলন দেউলিয়াপনার লক্ষণ। বিরোধী দলই বা আর কত দিন নিজেদের মৌলিক মূর্খতার বৃত্তে ঘুরপাক খাবে? কবে তাদের সুমতি হবে?
আর একটা ‘অক্ষম বিরোধী দল’কে ছলে-বলে-কৌশলে দুর্বল বানিয়ে রাখার ‘সাফল্য’ ক্ষমতাসীনেরা আর কতকাল উপভোগ করবেন?
লেখক: চিররঞ্জন সরকার, গবেষক ও কলামিস্ট
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১৪ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে