ভাবমূর্তির পাশাপাশি মানের সংকট, ভর্তিতে অনীহা

এম মেহেদী হাসিন, রংপুর
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৭: ৪৩
আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৯: ০৪

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ২০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর জন্য একজন করে শিক্ষক থাকার কথা; কিন্তু বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ৫৪ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন একজন শিক্ষক। প্রতিষ্ঠার এক দশকেরও বেশি সময় পার হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা নেই। কয়েকজন উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কোন্দল আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কর্মসূচিতে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেশির ভাগ সময় গণমাধ্যমের নেতিবাচক শিরোনামে থেকেছে রংপুরের এই বিদ্যায়তনটি।

এবার গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার প্রথম মেধাতালিকা থেকে বেরোবিতে ১৮ দশমিক ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ভাবমূর্তিসংকটে পড়ায় শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনীহা তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেছেন কেউ কেউ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও (ইউজিসি) মনে করছে, বিগত উপাচার্যের সময় বিশ্ববিদ্যালয়টি ভাবমূর্তিসংকটে পড়েছে। প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তিতে এর প্রভাব পড়তে পারে।

২০০৮ সালে রংপুর মহানগরীর পার্কের মোড় এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার প্রায় ১৪ বছর পরও কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। ‘ছোট’ বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা গায়ে লেগে থাকা এই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি কোনো দিকেই তেমন এগোতে পারেনি। কয়েকটি বিভাগে এখনো দীর্ঘদিনের সেশনজট রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগের থেকে পিছিয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

ইউজিসির তথ্যানুযায়ী, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ হাজার ৯৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক রয়েছেন ১৮৬ জন, এঁদের মধ্যে ১০ জন অধ্যাপক। ২১ জন শিক্ষক আবাসন সুবিধা পান। ২০২০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষকের প্রকাশনা ছিল না।

এবার সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার প্রথম মেধাতালিকা থেকে শিক্ষার্থী ভর্তিতে এই অনীহাকে অস্বাভাবিক বলছেন কেউ কেউ। কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী এ জন্য সমন্বিত ভর্তি পদ্ধতিকে দায়ী করেছেন। তবে শিক্ষাবিদেরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে পারেনি বলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

এর মধ্যে আবাসন সুবিধা না থাকাটা অন্যতম বলে মনে করেন একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাঁদের লক্ষ্য থাকে হলে থাকা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ হাজার ৯৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য তিনটি হল রয়েছে। এই তিন হলে ৪৯৫ জন ছাত্র এবং ৩৪২ জন ছাত্রী থাকছেন। আসনসংকট থাকায় হলে সিট পেতে অনেকের তিন বছর পর্যন্ত লেগে যায়।

এসব বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো যোগ হয়েছে উপাচার্যদের অনিয়ম-দুর্নীতি। গত ১৩ বছরে পাঁচজন উপাচার্য পেয়েছে বেরোবি। এঁদের মধ্যে দ্বিতীয় উপাচার্য আব্দুল জলিলের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে আলোচনায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। চতুর্থ উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর সময়ে শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, তাঁর অফিস না করা ছাড়াও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে বারবার গণমাধ্যমের শিরোনামে থেকেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

বেরোবির শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তাবিউর রহমান প্রধান বলছেন, ‘সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করা হলেও ভর্তির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব নিয়মে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েছে।’ সমন্বিত ভর্তিপ্রক্রিয়ায় পদ্ধতিগত ত্রুটি আছে রয়েছে বলে মনে করেন বেরোবির শিক্ষক উমর ফারুক। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, এটাকে সংস্কার করে শিক্ষার্থীবান্ধব ও শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণকর করা প্রয়োজন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর সভাপতি খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু মনে করছেন, যে স্বপ্ন নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা এখনো পূরণ হয়নি। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। মানসম্মত গবেষণার পরিবেশ তৈরি হয়নি। এ ছাড়া উপাচার্যদের দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের কারণে অভিভাবকদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এসব কারণে প্রতিষ্ঠানটি সংকটে পড়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী কে এম হিমেল আহমেদ বলেন, অবকাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি নানা নেতিবাচক কারণে বারবার সংবাদ হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম মেধাতালিকা থেকে ভর্তির সময় শেষে ৮২ শতাংশ আসন খালি থাকা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লজ্জার।’

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সি’ ইউনিটে ৮৩তম হয়েছিলেন রংপুরের বদরগঞ্জের শিক্ষার্থী আঁখি মনি। ভালো বিষয়ে ভর্তির সুযোগ থাকলেও তিনি অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে ভর্তি হয়েছেন। আঁখি জানান, বেরোবিতে অনেক পরে ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় তিনি সেখানে ভর্তি হননি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, বেরোবির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে ইউজিসি তদন্ত প্রতিবেদন দিলেও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যাতে শিক্ষার পরিবেশে ঠিক থাকে, সে বিষয়ে তাঁরা তদারকি করছেন। ইউজিসিও বিষয়গুলো দেখছে।

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও বেরোবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ কথা বলতে রাজি হননি। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য সরিফা সালোয়া ডিনা বলেন, প্রথম মেধাতালিকা থেকে ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও বেরোবি শিক্ষার্থী পাচ্ছে না—বিষয়টি এমন নয়। কারণ, আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা রয়েছে। তাই এখনই এ বিষয়ে উপসংহারে আসা ঠিক হবে না।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখভালের দায়িত্বে থাকা ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর আজকের পত্রিকাকে বলেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিসংকট রয়েছে, এটা ঠিক। আগের উপাচার্যের পুরো মেয়াদেই বিশ্ববিদ্যালয়টির নেতিবাচক ইমেজ ছিল। শিক্ষার্থী ভর্তিতে তার একটি প্রভাব থাকতে পারে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

ভারতের পাল্টা আক্রমণে দিশেহারা অস্ট্রেলিয়া

ঢাকা কলেজে সংঘর্ষকালে বোমা বিস্ফোরণের ছিটকে পড়েন সেনাসদস্য—ভাইরাল ভিডিওটির প্রকৃত ঘটনা

ঐশ্বরিয়ার বিচ্ছেদের খবরে মুখ খুললেন অমিতাভ

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত