ড. মইনুল ইসলাম
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি একতরফা নির্বাচন হয়ে গেল। ২০১৪ সালের নির্বাচনটিও একতরফা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশ ও প্রশাসনের মাধ্যমে দেশের অধিকাংশ স্থানে ব্যালটে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে সরকারি দল নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছিল। ফলে সংসদের তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসন ক্ষমতাসীন জোটের দখলে চলে যাওয়ার পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোর ৯৬ শতাংশ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
ক্ষমতাসীন দল কারচুপির মাধ্যমে প্রমাণ করেছিল যে ক্ষমতাসীন দলকে সরকারে রেখে এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। এবারের নির্বাচনটা আবারও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে হওয়ায় বিএনপিসহ দেশের অন্যান্য দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। এবারের নির্বাচনে ভোট সম্পন্ন হয়ে ২৯৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২২টি আসনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৪ জন ছাড়া ৫৮ জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। ফলে ২৮০টি আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়েছে বলা চলে। নির্বাচনের দিন বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছিল। যেটাকে তাদের বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না। তাই আবার ভোটের পর তারা বলেছে, নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। শেষের এক ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ বৈধ ভোট পড়ার বিষয়টি অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
১৯৯৬ সালে কেয়ারটেকার সরকার আইন পাস হওয়ার পর ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এই সরকারের অধীনে। কিন্তু ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত চারটি নির্বাচনেই বাংলাদেশের জনগণ ক্ষমতাসীন দল বা জোটকে প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনটি অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছিল বলে দেশে-বিদেশে বহুল-প্রশংসিত হলেও, পরাজয় মেনে নেয়নি বিএনপি। রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে ব্যবহার করে খালেদা জিয়া বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। যে ষড়যন্ত্রটি এ দেশে নিযুক্ত কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের সহায়তায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন।
২০০১ সালের নির্বাচন ঘনিয়ে আসার আগেই রাষ্ট্রপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টাবৃন্দ, সিভিল আমলাতন্ত্রের ডিসি, এডিসি, ম্যাজিস্ট্রেট, ডিআইজি, এসপি, ডিএসপি, এএসপি, ওসি—সবার নির্বাচনকালীন ভূমিকাকে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যবহারের ফন্দি-ফিকিরগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর আয়ত্তে চলে আসে। ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস আগে মার্চে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও পিছিয়ে দিয়েছিলেন। পত্র-পত্রিকায় কারণ উদ্ঘাটিত হলো, স্বাধীনচেতা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের চেয়ে তুলনামূলক নিরীহ প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানকে আওয়ামী লীগ অধিকতর নিরাপদ বিকল্প মনে করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ায় বিচারপতি লতিফুর রহমান যখন নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে তিনিই প্রধান উপদেষ্টা হতে যাচ্ছেন, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাসখানেক আগেই তিনি তাঁর ‘হোমওয়ার্ক’ শুরু করে দিলেন। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও তাঁর হোমওয়ার্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব লাভের আগেই।
একই সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কয়েকজন আমলাও গোপনে তাঁদের হোমওয়ার্ক শুরু করে দিয়েছিলেন সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের যে ছক আওয়ামী লীগ সাজিয়ে রেখেছিল, তা কীভাবে বিএনপি-জামায়াতপন্থী কর্মকর্তাদের গণ-ট্রান্সফারের মাধ্যমে তছনছ করে দেওয়া যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুইদ-মইনুল-শাহজাহান কমিটিকে ব্যবহার করে ওই বিএনপি-জামায়াতপন্থী কুশীলবেরা দুই মাসের কম সময়ে ১ হাজার ৫২৬ জন কর্মকর্তার ট্রান্সফার সুসম্পন্ন করার কাহিনি পরবর্তীকালে ওই কুশীলবদের কয়েকজনের পত্রপত্রিকায় প্রদত্ত জবানিতেই খোলাসা হয়ে গিয়েছিল। এরপর বিএনপি দাবি তুলল, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। সারা দেশে, নয়তো আওয়ামী লীগের মাস্তানরা নাকি ভোটকেন্দ্র দখল করে রাখবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের এ-সম্পর্কীয় সুপারিশ মেনে নিলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন। সেনাবাহিনী মাঠে গিয়ে ধাওয়া দিল মাস্তান-পাতি মাস্তান-ক্যাডারদের, পালিয়ে বাঁচল বীর-পুঙ্গবেরা। কিন্তু আওয়ামী ‘দুষ্টলোকদের’ খালি করা মাঠ যে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার ও মাস্তানরা দখল করে নিয়েছিল, এই সত্যটাও এত দিনে খোলাসা হয়ে গিয়েছিল।
২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসন এবং পুলিশ বাহিনী থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিল আওয়ামীপন্থী ও মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের। সাতজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জেনারেল মইন উ আহমেদকে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ করা হলো। বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারতের অপরাধে অপমানজনকভাবে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে পদত্যাগে বাধ্য করে রাষ্ট্রপতি করা হলো প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনকে। বিএনপির প্রাথমিক পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্পাদক বিচারপতি কে এম হাসানকে পুরস্কার হিসেবে হাইকোর্টে বিচারপতি করা হয়েছিল। তাঁকেই ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার অঙ্ক কষে বিএনপির ‘চাণক্য-প্রবররা’ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৬৭ বছরে নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ধুরন্ধরদের এই ‘অতি চালাকি’ জনগণের কাছে ধরা পড়ে গেল, শুরু হয়ে গেল হাসানবিরোধী প্রাণঘাতী আন্দোলন-সংগ্রাম। আন্দোলনের তীব্রতা উপলব্ধি করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দুপুরেই বিচারপতি হাসান রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ব্যাপারে তাঁর অসম্মতি জানিয়ে দিলেন।
সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বিধান অনুসারে বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার অনুরোধ না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কট্টর বিএনপি-প্রেমের প্রমাণ পেয়ে ৪ জন উপদেষ্টা পদত্যাগ করায় নতুন চার উপদেষ্টা নিয়োগ করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করতে এগিয়ে গেলেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার নির্দেশমতো সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে মেজর জেনারেল রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীকে নিয়োগের বন্দোবস্ত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন। কিন্তু ওই খবর আগেভাগে ফাঁস হওয়ায় জেনারেল মইন উ আহমেদ তাঁর কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এভাবেই ১/১১তে বাংলাদেশ আবারও ছদ্মবেশী সেনাশাসনের কবলে পড়েছিল। সেনা এস্টাবলিশমেন্টের ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ এবং দীর্ঘদিন শাসন করার খায়েশ ব্যর্থ হওয়ায় তারা ২০০৮ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল।
মূলকথা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘ম্যানিপুলেশনের’ শিকার হয়েছে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৬-০৮ সালে। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করেছিলেন, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক। কিন্তু প্রয়োজন মনে করলে আরও দুটি নির্বাচন ওই ব্যবস্থায় হতে পারে। সুযোগ বুঝে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই বাতিল করে দিলেন শেখ হাসিনা। আর তখন থেকেই দেশের বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনর্বহালকে আন্দোলন-সংগ্রামের মূল দাবিতে পরিণত করলেও, তাদের আন্দোলন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশিদের বিরোধিতাকে তোয়াক্কা
না করে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ আরেকটি একতরফা নির্বাচন করে ফেলল। বোঝা প্রয়োজন, সহজে কোনো ক্ষমতাসীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করবে না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি একতরফা নির্বাচন হয়ে গেল। ২০১৪ সালের নির্বাচনটিও একতরফা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশ ও প্রশাসনের মাধ্যমে দেশের অধিকাংশ স্থানে ব্যালটে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে সরকারি দল নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছিল। ফলে সংসদের তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসন ক্ষমতাসীন জোটের দখলে চলে যাওয়ার পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোর ৯৬ শতাংশ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
ক্ষমতাসীন দল কারচুপির মাধ্যমে প্রমাণ করেছিল যে ক্ষমতাসীন দলকে সরকারে রেখে এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। এবারের নির্বাচনটা আবারও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে হওয়ায় বিএনপিসহ দেশের অন্যান্য দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। এবারের নির্বাচনে ভোট সম্পন্ন হয়ে ২৯৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২২টি আসনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৪ জন ছাড়া ৫৮ জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। ফলে ২৮০টি আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়েছে বলা চলে। নির্বাচনের দিন বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছিল। যেটাকে তাদের বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না। তাই আবার ভোটের পর তারা বলেছে, নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। শেষের এক ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ বৈধ ভোট পড়ার বিষয়টি অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
১৯৯৬ সালে কেয়ারটেকার সরকার আইন পাস হওয়ার পর ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এই সরকারের অধীনে। কিন্তু ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত চারটি নির্বাচনেই বাংলাদেশের জনগণ ক্ষমতাসীন দল বা জোটকে প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনটি অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছিল বলে দেশে-বিদেশে বহুল-প্রশংসিত হলেও, পরাজয় মেনে নেয়নি বিএনপি। রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে ব্যবহার করে খালেদা জিয়া বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। যে ষড়যন্ত্রটি এ দেশে নিযুক্ত কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের সহায়তায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন।
২০০১ সালের নির্বাচন ঘনিয়ে আসার আগেই রাষ্ট্রপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টাবৃন্দ, সিভিল আমলাতন্ত্রের ডিসি, এডিসি, ম্যাজিস্ট্রেট, ডিআইজি, এসপি, ডিএসপি, এএসপি, ওসি—সবার নির্বাচনকালীন ভূমিকাকে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যবহারের ফন্দি-ফিকিরগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর আয়ত্তে চলে আসে। ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস আগে মার্চে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও পিছিয়ে দিয়েছিলেন। পত্র-পত্রিকায় কারণ উদ্ঘাটিত হলো, স্বাধীনচেতা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের চেয়ে তুলনামূলক নিরীহ প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানকে আওয়ামী লীগ অধিকতর নিরাপদ বিকল্প মনে করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ায় বিচারপতি লতিফুর রহমান যখন নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে তিনিই প্রধান উপদেষ্টা হতে যাচ্ছেন, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাসখানেক আগেই তিনি তাঁর ‘হোমওয়ার্ক’ শুরু করে দিলেন। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও তাঁর হোমওয়ার্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব লাভের আগেই।
একই সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কয়েকজন আমলাও গোপনে তাঁদের হোমওয়ার্ক শুরু করে দিয়েছিলেন সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের যে ছক আওয়ামী লীগ সাজিয়ে রেখেছিল, তা কীভাবে বিএনপি-জামায়াতপন্থী কর্মকর্তাদের গণ-ট্রান্সফারের মাধ্যমে তছনছ করে দেওয়া যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুইদ-মইনুল-শাহজাহান কমিটিকে ব্যবহার করে ওই বিএনপি-জামায়াতপন্থী কুশীলবেরা দুই মাসের কম সময়ে ১ হাজার ৫২৬ জন কর্মকর্তার ট্রান্সফার সুসম্পন্ন করার কাহিনি পরবর্তীকালে ওই কুশীলবদের কয়েকজনের পত্রপত্রিকায় প্রদত্ত জবানিতেই খোলাসা হয়ে গিয়েছিল। এরপর বিএনপি দাবি তুলল, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। সারা দেশে, নয়তো আওয়ামী লীগের মাস্তানরা নাকি ভোটকেন্দ্র দখল করে রাখবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের এ-সম্পর্কীয় সুপারিশ মেনে নিলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন। সেনাবাহিনী মাঠে গিয়ে ধাওয়া দিল মাস্তান-পাতি মাস্তান-ক্যাডারদের, পালিয়ে বাঁচল বীর-পুঙ্গবেরা। কিন্তু আওয়ামী ‘দুষ্টলোকদের’ খালি করা মাঠ যে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার ও মাস্তানরা দখল করে নিয়েছিল, এই সত্যটাও এত দিনে খোলাসা হয়ে গিয়েছিল।
২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসন এবং পুলিশ বাহিনী থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিল আওয়ামীপন্থী ও মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের। সাতজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জেনারেল মইন উ আহমেদকে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ করা হলো। বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারতের অপরাধে অপমানজনকভাবে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে পদত্যাগে বাধ্য করে রাষ্ট্রপতি করা হলো প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনকে। বিএনপির প্রাথমিক পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্পাদক বিচারপতি কে এম হাসানকে পুরস্কার হিসেবে হাইকোর্টে বিচারপতি করা হয়েছিল। তাঁকেই ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার অঙ্ক কষে বিএনপির ‘চাণক্য-প্রবররা’ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৬৭ বছরে নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ধুরন্ধরদের এই ‘অতি চালাকি’ জনগণের কাছে ধরা পড়ে গেল, শুরু হয়ে গেল হাসানবিরোধী প্রাণঘাতী আন্দোলন-সংগ্রাম। আন্দোলনের তীব্রতা উপলব্ধি করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দুপুরেই বিচারপতি হাসান রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ব্যাপারে তাঁর অসম্মতি জানিয়ে দিলেন।
সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বিধান অনুসারে বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার অনুরোধ না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কট্টর বিএনপি-প্রেমের প্রমাণ পেয়ে ৪ জন উপদেষ্টা পদত্যাগ করায় নতুন চার উপদেষ্টা নিয়োগ করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করতে এগিয়ে গেলেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার নির্দেশমতো সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে মেজর জেনারেল রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীকে নিয়োগের বন্দোবস্ত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন। কিন্তু ওই খবর আগেভাগে ফাঁস হওয়ায় জেনারেল মইন উ আহমেদ তাঁর কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এভাবেই ১/১১তে বাংলাদেশ আবারও ছদ্মবেশী সেনাশাসনের কবলে পড়েছিল। সেনা এস্টাবলিশমেন্টের ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ এবং দীর্ঘদিন শাসন করার খায়েশ ব্যর্থ হওয়ায় তারা ২০০৮ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল।
মূলকথা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘ম্যানিপুলেশনের’ শিকার হয়েছে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৬-০৮ সালে। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করেছিলেন, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক। কিন্তু প্রয়োজন মনে করলে আরও দুটি নির্বাচন ওই ব্যবস্থায় হতে পারে। সুযোগ বুঝে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই বাতিল করে দিলেন শেখ হাসিনা। আর তখন থেকেই দেশের বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনর্বহালকে আন্দোলন-সংগ্রামের মূল দাবিতে পরিণত করলেও, তাদের আন্দোলন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশিদের বিরোধিতাকে তোয়াক্কা
না করে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ আরেকটি একতরফা নির্বাচন করে ফেলল। বোঝা প্রয়োজন, সহজে কোনো ক্ষমতাসীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করবে না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে