মামুনুর রশীদ
বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনী বইটি পড়ছিলাম। এই বইয়ে ১৯২০ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত ঢাকার বর্ণনা রয়েছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানের বর্ণনাসহ রয়েছে পুরানা পল্টন, রমনা, নবাবগঞ্জ, সদরঘাটের কথা। সেই সঙ্গে বিস্তারিতভাবেই আছে পুরানা পল্টনের কথা, যেখানে তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন। সিনেমা হলের কথা আছে, সেই পিকচার প্যালেসের কথাও। বিস্তারিত আছে তাঁর শিক্ষাজীবনের কথা, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি সেখানকার ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় সবে গড়ে উঠেছে একটা প্রায় গ্রামীণ পরিবেশে। তখন বিশ্ববিদ্যালয় মানেই কার্জন হল। তার চারপাশের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন বটে; কিন্তু আমতলা এবং মধুর ক্যানটিনের কথা আসেনি। বুদ্ধদেব বসুর আত্মজৈবনিক বইটিতে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন ও ঢাকার কথা বলেছেন। এরপর তিনি চলে যান কলকাতায়। এরপর দেশভাগের গল্প, দাঙ্গা—এসব তিনি ঢাকায় স্বভাবতই দেখেননি। এই ১৬-১৭ বছরের ঢাকায় তেমন কোনো পরিবর্তন হয়েছিল কি? হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনটি ছিল এখনকার ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমারজেন্সি বিভাগ। ওখানেই ছিল ঐতিহাসিক আমতলা এবং মধুর ক্যানটিন। আর শহীদ মিনারের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ। ১৯৪৮ সালে কার্জন হলে জিন্নাহ যখন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলেন, তখন কার্জন হলেই ছাত্ররা প্রচণ্ড গর্জে উঠেছিলেন। তারপর বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের কথা তো আমাদের সবারই জানা। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে বেরিয়ে আসার পর শহীদ মিনারের ওই জায়গাটিতেই গুলি হয়।
মিছিলে যুক্ত হয়েছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্ররাও। এখন যেখানে জগন্নাথ হল, সেখানেই ছিল পূর্ব বাংলার সংসদ। সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই এসে যুক্ত হয়েছিলেন এই ঘটনায়।
বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম কেন? বুদ্ধদেব বসু যে পূর্ব বালার চিত্রটি এঁকেছিলেন, তা ছিল সর্বতোভাবে অসাম্প্রদায়িক এক জনপদ। তাঁর সুদীর্ঘ স্মৃতিচারণে কোথাও কোনো মানুষকে অনিরাপদ মনে হয়নি।
কবিতাচর্চাও এখানে একটা মনোমুগ্ধকর পরিবেশে সম্ভব ছিল। কিন্তু তিরিশের দশক থেকে সাতচল্লিশ—এই ১৭ বছরে কী এমন সামাজিক পরিবর্তন ঘটল, যার ফলে দাঙ্গা হলো, বাংলা ভাষার মতো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানাতে হবে? ওই বছর গুলিতে পূর্ব বাংলা স্বাধীনতা আন্দোলনের বীরদের এক চারণভূমি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। সূর্য সেন, অনুশীলন, যুগান্তর দল তখন পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে আখড়া গেড়েছে। গ্রামবাংলায় তখন কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠতে শুরু করেছে। এই আন্দোলন পূর্ব বাংলার সামন্ত জমিদার ও ভূস্বামীদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই আতঙ্কগ্রস্ত এই শ্রেণির হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে সবাই একটা মুক্তির পথ খুঁজছিল। তাদের কাছে তখন দেশভাগটা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মুসলিম সামন্ত শ্রেণির তখন স্বপ্ন হয়ে দাঁড়াল, দেশভাগ হলে হিন্দুদের বিতাড়িত করে তাদের সম্পদ লুট করা যাবে। হিন্দু জমিদারেরা প্রথমে এটা বুঝতে পারেনি, কিন্তু যখন বুঝতে পারল তখন পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারত থেকে মুসলমানদের হটিয়ে একই কাজ করা যাবে বলে মনে করল। তাই কলকাতায় একটি রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ওদিকে পাঞ্জাবেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই লক্ষ করেছিল পূর্ব বাংলা একটা সুজলা-সুফলা দেশ। কলকারখানার কাঁচামাল শুধু নয়, বিপুল পরিমাণ রাজস্ব এখান থেকে সংগ্রহ করা যাবে। তাই প্রথম থেকেই পূর্ব বাংলাকে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত করে ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রাস করতে পারলে পাকিস্তানিদের নানা দিক থেকে সুবিধা হবে। তাই জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ভাষার বিরুদ্ধে চরম আঘাত হেনেছিলেন। বদরুদ্দীন উমরের ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইয়ে অনেক অনুসন্ধানমূলক গবেষণা আছে। তাতে দেখা যায়, পূর্ব বাংলার স্কুলশিক্ষকেরা বছরের পর বছর বেতন পাচ্ছেন না। ছাত্রদেরও বেতন দেওয়ার সামর্থ্য নেই। সরকার এসব বিষয়ে একেবারেই উদাসীন; অর্থাৎ এ সময় শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার একটা গভীর ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত ছিল। এ সময় নাচোলের সাঁওতাল এবং কৃষকদের আন্দোলনকে নৃশংসভাবে দমন করা হয়। সে সময় ইলা মিত্রের প্রতি পুলিশ বাহিনীর আচরণ সব সময়ের নৃশংসতাকে ছাড়িয়ে যায়। সেই সময় শুধু যে আক্রমণটা ভাষার ওপরে ছিল তা নয়, নানামুখী নিপীড়নেরই ফলাফল হিসেবে ভাষা আন্দোলন এগিয়ে চলে।
একদিকে ভাষার প্রশ্নে আন্দোলনের ওপর জেল-জুলুম, অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং বিশেষ করে কমিউনিস্ট কর্মীদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতনের ব্যবস্থা সত্ত্বেও তাদের দমিয়ে রাখা যায়নি। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃত্ব এই সব বেপরোয়া নিপীড়নের কাজ করলেও ভাষার প্রশ্নে তারা পিছু হটেছে। এই সময়ে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন কবি, গীতিকার, সুরকার, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী সবাই। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন দেশের ছোট-বড় শহর থেকে একেবারে গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। এত দ্রুত একুশের গান, একুশের কবিতা, একুশের ছবি আঁকা যে পরবর্তীকালের জন্য বাঙালিদের একটা বড় প্রেরণার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াবে, তা ছিল অভাবিত।
ইতিহাসে দেখা যায়, বাঙালি কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারেনি, কিন্তু বহুবার বিদ্রোহ করেছে। যে বিদ্রোহগুলোর ভাগ্যে কমই বিজয় এসেছে; কিন্তু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সম্ভবত প্রথম একটি সফল বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহই পরবর্তীকালে অনেক বিদ্রোহ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলাফলে বাঙালি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করে।
বুদ্ধদেব বসু কবি। অসাধারণ গদ্যে তিনি ঢাকা শহরকে এঁকেছেন এক বৃহৎ নান্দনিক গ্রাম হিসেবে। তখনকার শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যচর্চা পূর্ব বাংলার জন্য ছিল বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বাংলা অখণ্ড থাকলে হয়তো তিনি দুই বাংলার অখণ্ড সাহিত্যের ইতিহাস লিখতেন।
ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার পর তিনি ঢাকার সাহিত্য-সংস্কৃতি এমনকি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কেও কিছু লেখেননি। হয়তো তিনি ছিলেন জীবনসংগ্রামে গভীরভাবে নিমজ্জিত অথবা তিনি এই দেশান্তরকে মেনে নিয়েছিলেন। দেশভাগের পর এ দেশে আসেন বদরুদ্দীন উমর।
ছাত্রাবস্থায় তিনি পূর্ব বাংলার রাজনীতি ও ভাষা আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করেন। ষাটের দশকে বের হয় তাঁর বই ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি। দুই প্রতিভাবান মানুষই দেশান্তর মেনে নিয়েছেন।
আজকের তরুণ শিক্ষার্থীরা যে বার্তাটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা হলো, ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষা রক্ষার আন্দোলন ছিল না। মানুষের নিজেকে প্রকাশের মুখ্য বিষয় ভাষা, সেই ভাষা আবার সতত পরিবর্তনশীল। মাতৃভাষার শক্তিকে আবিষ্কার করে নিয়ত তার চর্চা প্রয়োজন।
ষাট, সত্তর ও আশির দশকে ভাষার চর্চা চলছে—কাব্যে, নাটক, গল্পে, উপন্যাসে, সর্বত্র।
কিন্তু সাম্প্রতিক কালে তা অনেকটাই শ্লথ। ফেসবুকে বাংলায় লিখে কি আমাদের সাহিত্যচর্চার প্রচেষ্টা শিথিল হয়ে পড়ছে? আমরা কি একুশের প্রথম প্রহরে অসাধারণ আর তাজা আনকোরা কবিতা, গল্প বা চিত্রসম্ভার নিয়ে উপস্থিত হব না? একুশের চেতনাকে সজীব রাখতে না পারলে আমাদের সংস্কৃতিও মুখ থুবড়ে পড়বে। বাঙালির যে রকম উদগ্র প্রবাসযাত্রা শুরু হয়েছে, তাতে আমাদের ভাষার প্রতি ভালোবাসা ক্রমেই শেষ হয়ে যায় কি না, তা-ই ভাববার বিষয়। কিন্তু এ কথাও সত্যি, বাংলা ভাষার শক্তি অসীম।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব
বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনী বইটি পড়ছিলাম। এই বইয়ে ১৯২০ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত ঢাকার বর্ণনা রয়েছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানের বর্ণনাসহ রয়েছে পুরানা পল্টন, রমনা, নবাবগঞ্জ, সদরঘাটের কথা। সেই সঙ্গে বিস্তারিতভাবেই আছে পুরানা পল্টনের কথা, যেখানে তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন। সিনেমা হলের কথা আছে, সেই পিকচার প্যালেসের কথাও। বিস্তারিত আছে তাঁর শিক্ষাজীবনের কথা, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি সেখানকার ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় সবে গড়ে উঠেছে একটা প্রায় গ্রামীণ পরিবেশে। তখন বিশ্ববিদ্যালয় মানেই কার্জন হল। তার চারপাশের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন বটে; কিন্তু আমতলা এবং মধুর ক্যানটিনের কথা আসেনি। বুদ্ধদেব বসুর আত্মজৈবনিক বইটিতে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন ও ঢাকার কথা বলেছেন। এরপর তিনি চলে যান কলকাতায়। এরপর দেশভাগের গল্প, দাঙ্গা—এসব তিনি ঢাকায় স্বভাবতই দেখেননি। এই ১৬-১৭ বছরের ঢাকায় তেমন কোনো পরিবর্তন হয়েছিল কি? হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনটি ছিল এখনকার ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমারজেন্সি বিভাগ। ওখানেই ছিল ঐতিহাসিক আমতলা এবং মধুর ক্যানটিন। আর শহীদ মিনারের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ। ১৯৪৮ সালে কার্জন হলে জিন্নাহ যখন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলেন, তখন কার্জন হলেই ছাত্ররা প্রচণ্ড গর্জে উঠেছিলেন। তারপর বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের কথা তো আমাদের সবারই জানা। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে বেরিয়ে আসার পর শহীদ মিনারের ওই জায়গাটিতেই গুলি হয়।
মিছিলে যুক্ত হয়েছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্ররাও। এখন যেখানে জগন্নাথ হল, সেখানেই ছিল পূর্ব বাংলার সংসদ। সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই এসে যুক্ত হয়েছিলেন এই ঘটনায়।
বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম কেন? বুদ্ধদেব বসু যে পূর্ব বালার চিত্রটি এঁকেছিলেন, তা ছিল সর্বতোভাবে অসাম্প্রদায়িক এক জনপদ। তাঁর সুদীর্ঘ স্মৃতিচারণে কোথাও কোনো মানুষকে অনিরাপদ মনে হয়নি।
কবিতাচর্চাও এখানে একটা মনোমুগ্ধকর পরিবেশে সম্ভব ছিল। কিন্তু তিরিশের দশক থেকে সাতচল্লিশ—এই ১৭ বছরে কী এমন সামাজিক পরিবর্তন ঘটল, যার ফলে দাঙ্গা হলো, বাংলা ভাষার মতো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানাতে হবে? ওই বছর গুলিতে পূর্ব বাংলা স্বাধীনতা আন্দোলনের বীরদের এক চারণভূমি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। সূর্য সেন, অনুশীলন, যুগান্তর দল তখন পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে আখড়া গেড়েছে। গ্রামবাংলায় তখন কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠতে শুরু করেছে। এই আন্দোলন পূর্ব বাংলার সামন্ত জমিদার ও ভূস্বামীদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই আতঙ্কগ্রস্ত এই শ্রেণির হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে সবাই একটা মুক্তির পথ খুঁজছিল। তাদের কাছে তখন দেশভাগটা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মুসলিম সামন্ত শ্রেণির তখন স্বপ্ন হয়ে দাঁড়াল, দেশভাগ হলে হিন্দুদের বিতাড়িত করে তাদের সম্পদ লুট করা যাবে। হিন্দু জমিদারেরা প্রথমে এটা বুঝতে পারেনি, কিন্তু যখন বুঝতে পারল তখন পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারত থেকে মুসলমানদের হটিয়ে একই কাজ করা যাবে বলে মনে করল। তাই কলকাতায় একটি রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ওদিকে পাঞ্জাবেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই লক্ষ করেছিল পূর্ব বাংলা একটা সুজলা-সুফলা দেশ। কলকারখানার কাঁচামাল শুধু নয়, বিপুল পরিমাণ রাজস্ব এখান থেকে সংগ্রহ করা যাবে। তাই প্রথম থেকেই পূর্ব বাংলাকে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত করে ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রাস করতে পারলে পাকিস্তানিদের নানা দিক থেকে সুবিধা হবে। তাই জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ভাষার বিরুদ্ধে চরম আঘাত হেনেছিলেন। বদরুদ্দীন উমরের ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইয়ে অনেক অনুসন্ধানমূলক গবেষণা আছে। তাতে দেখা যায়, পূর্ব বাংলার স্কুলশিক্ষকেরা বছরের পর বছর বেতন পাচ্ছেন না। ছাত্রদেরও বেতন দেওয়ার সামর্থ্য নেই। সরকার এসব বিষয়ে একেবারেই উদাসীন; অর্থাৎ এ সময় শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার একটা গভীর ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত ছিল। এ সময় নাচোলের সাঁওতাল এবং কৃষকদের আন্দোলনকে নৃশংসভাবে দমন করা হয়। সে সময় ইলা মিত্রের প্রতি পুলিশ বাহিনীর আচরণ সব সময়ের নৃশংসতাকে ছাড়িয়ে যায়। সেই সময় শুধু যে আক্রমণটা ভাষার ওপরে ছিল তা নয়, নানামুখী নিপীড়নেরই ফলাফল হিসেবে ভাষা আন্দোলন এগিয়ে চলে।
একদিকে ভাষার প্রশ্নে আন্দোলনের ওপর জেল-জুলুম, অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং বিশেষ করে কমিউনিস্ট কর্মীদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতনের ব্যবস্থা সত্ত্বেও তাদের দমিয়ে রাখা যায়নি। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃত্ব এই সব বেপরোয়া নিপীড়নের কাজ করলেও ভাষার প্রশ্নে তারা পিছু হটেছে। এই সময়ে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন কবি, গীতিকার, সুরকার, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী সবাই। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন দেশের ছোট-বড় শহর থেকে একেবারে গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। এত দ্রুত একুশের গান, একুশের কবিতা, একুশের ছবি আঁকা যে পরবর্তীকালের জন্য বাঙালিদের একটা বড় প্রেরণার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াবে, তা ছিল অভাবিত।
ইতিহাসে দেখা যায়, বাঙালি কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারেনি, কিন্তু বহুবার বিদ্রোহ করেছে। যে বিদ্রোহগুলোর ভাগ্যে কমই বিজয় এসেছে; কিন্তু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সম্ভবত প্রথম একটি সফল বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহই পরবর্তীকালে অনেক বিদ্রোহ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলাফলে বাঙালি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করে।
বুদ্ধদেব বসু কবি। অসাধারণ গদ্যে তিনি ঢাকা শহরকে এঁকেছেন এক বৃহৎ নান্দনিক গ্রাম হিসেবে। তখনকার শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যচর্চা পূর্ব বাংলার জন্য ছিল বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বাংলা অখণ্ড থাকলে হয়তো তিনি দুই বাংলার অখণ্ড সাহিত্যের ইতিহাস লিখতেন।
ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার পর তিনি ঢাকার সাহিত্য-সংস্কৃতি এমনকি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কেও কিছু লেখেননি। হয়তো তিনি ছিলেন জীবনসংগ্রামে গভীরভাবে নিমজ্জিত অথবা তিনি এই দেশান্তরকে মেনে নিয়েছিলেন। দেশভাগের পর এ দেশে আসেন বদরুদ্দীন উমর।
ছাত্রাবস্থায় তিনি পূর্ব বাংলার রাজনীতি ও ভাষা আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করেন। ষাটের দশকে বের হয় তাঁর বই ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি। দুই প্রতিভাবান মানুষই দেশান্তর মেনে নিয়েছেন।
আজকের তরুণ শিক্ষার্থীরা যে বার্তাটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা হলো, ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষা রক্ষার আন্দোলন ছিল না। মানুষের নিজেকে প্রকাশের মুখ্য বিষয় ভাষা, সেই ভাষা আবার সতত পরিবর্তনশীল। মাতৃভাষার শক্তিকে আবিষ্কার করে নিয়ত তার চর্চা প্রয়োজন।
ষাট, সত্তর ও আশির দশকে ভাষার চর্চা চলছে—কাব্যে, নাটক, গল্পে, উপন্যাসে, সর্বত্র।
কিন্তু সাম্প্রতিক কালে তা অনেকটাই শ্লথ। ফেসবুকে বাংলায় লিখে কি আমাদের সাহিত্যচর্চার প্রচেষ্টা শিথিল হয়ে পড়ছে? আমরা কি একুশের প্রথম প্রহরে অসাধারণ আর তাজা আনকোরা কবিতা, গল্প বা চিত্রসম্ভার নিয়ে উপস্থিত হব না? একুশের চেতনাকে সজীব রাখতে না পারলে আমাদের সংস্কৃতিও মুখ থুবড়ে পড়বে। বাঙালির যে রকম উদগ্র প্রবাসযাত্রা শুরু হয়েছে, তাতে আমাদের ভাষার প্রতি ভালোবাসা ক্রমেই শেষ হয়ে যায় কি না, তা-ই ভাববার বিষয়। কিন্তু এ কথাও সত্যি, বাংলা ভাষার শক্তি অসীম।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে