ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান
মহান মে দিবস। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের স্মারক হিসেবে ১ মে সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ পালিত হয়। উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত শ্রমিকদের ছিল না কোনো ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা, ছিল না কাজের নির্দিষ্ট সময়ের সীমা। মালিকেরা তাঁদের খেয়ালখুশিমতো শ্রমিকদের দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটাতেন। ১৮৭৭ সালে ন্যায্য মজুরি, ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস ও অন্যান্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শ্রমিকেরা ব্যাপক ধর্মঘট পালন করেছিলেন। এই ন্যায্য আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হয়। গুলিতে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত ৩০০ শ্রমিক আহত হয়েছেন। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অনেক শ্রমজীবী মানুষ নিপীড়নের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন দুর্বার আন্দোলন। সেই দিন যুক্তরাষ্ট্রের ১১ হাজার ৫৬২টি শিল্পকারখানাসহ সব শিল্পাঞ্চলে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন শ্রমিকেরা।
শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটের শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ও রক্তস্নাত প্রতিরোধযুদ্ধে এবং আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় ৮ ঘণ্টা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিজয় হয়। ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে ‘শ্রমিক দিবস’ ঘোষণা দেওয়া হয়।
শ্রমিকদের রক্তরাঙা পতাকা হাতে নিয়ে ১৩৭ বছর ধরে দুনিয়াব্যাপী শ্রমিকেরা ন্যায্য অধিকার আদায় ও শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই-সংগ্রাম করে আসছেন। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিবিপ্লব ও অন্যান্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধার উৎকর্ষের ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় অনেক উন্নয়ন ঘটলেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি আমাদের দেশের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে এখনো শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, কর্মঘণ্টা ও নিরাপদ কর্মস্থলের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক—কোনো ক্ষেত্রেই শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
মুক্তবাজার অর্থনীতি ও নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যের কারণে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বেশির ভাগ শ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা নেই। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করা হয় না। তাঁদের ছুটি দেওয়া হয় না। একজন শ্রমিক হিসেবে নারী শ্রমিক শ্রম আইন অনুযায়ী সব অধিকারের সমান অংশীদার হলেও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। নারী শ্রমিক-অধ্যুষিত গার্মেন্টস, অন্যান্য ক্ষুদ্র শিল্প ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে স্বল্প মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিম্ন পদমর্যাদা, খণ্ডকালীন নিয়োগ, যখন-তখন ছাঁটাই এবং কর্মঘণ্টার অধিক কাজ করানো হয়। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র থেকে সাপ্তাহিক ছুটি, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। এ ছাড়া অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, সুপেয় পানির অভাব, যৌন হয়রানিসহ অনেক সমস্যা তাঁদের প্রতিনিয়ত ভোগ করতে হয়। সমকাজে সমমজুরি ও নারী-পুরুষের মজুরিবৈষম্য তো রয়েছেই। কৃষি ও গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও তাঁদের কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। গৃহকর্মে নিয়োজিত নারীরা সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। ভাত-কাপড়, মাথা গোঁজার ঠাঁই, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষের বিশাল অংশ এখনো এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রয়োজনীয় ক্যালরি ও পুষ্টির অভাবে ন্যূনতম মানসম্মত খাবার খেতে না পারায় শ্রমিক, কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। তাঁরা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু স্বপ্ন পূরণের কোনো পথ খুঁজে পান না। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। শ্রমিকেরা কাজ করতে গিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে পারবেন কি না, তার নিশ্চয়তা নেই।
আমাদের দেশের সিংহভাগ শ্রমিক নির্মাণ, গার্মেন্টস, পরিবহন, চাতাল, ওয়েল্ডিং, শিপ ব্রেকিংসহ অসংগঠিত সেক্টরে কাজ করেন। এসব কারখানা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের যে মজুরি দেওয়া হয় তা দিয়ে কোনোভাবেই পরিবার-পরিজনসহ জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব সেক্টরে মজুরিবৈষম্য বিরাজমান।
দেশের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষসহ নিম্ন আয়ের সাধারণ জনগণ এক সংকটময় অবস্থায় দিন যাপন করছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির দাপট এবং মুনাফাখোর ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারসাজিতে কয়েক বছর ধরে দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি বর্তমানে এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে শ্রমিক, তা কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। একদিকে শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি বাড়েনি, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ জীবনধারণ ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ। এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রকৃত মজুরি কমে গিয়ে তাঁদের এক অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আগে আমাদের দেশে রেশন প্রথা ও মহার্ঘ ভাতা প্রথা চালু ছিল। এমতাবস্থায় শ্রমিক-কর্মচারী তথা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য, বিশেষ করে গার্মেন্টস, নির্মাণ, পরিবহন, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, চা-শ্রমিক, রিকশাশ্রমিক, হকার, চাতাল, ওয়েল্ডিং ও গৃহশ্রমিকদের জন্য রেশন প্রথার মাধ্যমে সস্তা ও সুলভ মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন চাল, ডাল, তেল, চিনি সরবরাহ করতে হবে। একই সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই মোতাবেক শ্রমিক-কর্মচারীরা মজুরি না পাওয়ায় তাঁদের প্রকৃত মজুরি ও ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এই সংকট নিরসনের জন্য বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে মহার্ঘ ভাতা প্রদান করা আজ অত্যন্ত জরুরি, যেটা আগে একসময় চালু ছিল। শ্রমিক-কর্মচারীদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কারখানা ও শিল্পাঞ্চলভিত্তিক আবাসন, হাসপাতাল ও বিদ্যালয় স্থাপন করে সেখানে স্বল্পমূল্যে অথবা বিনা মূল্যে বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারঘোষিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বন্ধ থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল, চিনিকল, সুতা, বস্ত্রকলসহ বৃহৎ শিল্পকারখানাগুলো আধুনিকায়ন করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চালু করতে হবে। কর্মস্থলে সব ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতা রোধে আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুস্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
বর্তমানে রোবটিকস, আইওটি, ন্যানো প্রযুক্তি, ডেটা সায়েন্স ইত্যাদি প্রযুক্তির ফলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সামনে চলে এসেছে। বাংলাদেশে এর প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়বে। তবে সবচেয়ে বেশি পড়বে শ্রমবাজারে। অটোমেশন প্রযুক্তির ফলে শিল্পকারখানা হয়ে পড়বে ক্রমেই যন্ত্রনির্ভর। ফলে বিপুল পরিমাণ মানুষের চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। প্রযুক্তিভিত্তিক এই শিল্পবিপ্লবে প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে নানাবিধ কর্মক্ষেত্রে। চতুর্থ বিপ্লব মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাফল্য পেতে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। শুধু দেশেই নয়, যারা বিদেশে কাজ করছেন, তাঁদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। তাই শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে এই চতুর্থ বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে।
কিন্তু শ্রমিকশ্রেণি যে শুধু উৎপাদনব্যবস্থারই অংশ নন, দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনেরও অন্যতম কারিগর—এটা আমাদের দেশের মালিকশ্রেণি মানতে চায় না। আমাদের দেশে এখনো মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক বিরাজ করে, যা কোনোভাবেই শিল্প বিকাশের জন্য অনুকূল বা সহায়ক পরিবেশ হতে পারে না। শ্রমজীবী মানুষের অবদানের জন্যই শিল্প ও কৃষিবিপ্লব হয়েছে। আমাদের দেশের শ্রমিকেরা দক্ষ ও মেধাবী, এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। তাই শ্রমিকদের আস্থায় নিয়ে তাঁদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে সারা বিশ্বে যেভাবে শিল্প বিকশিত হয়েছে, আমাদের দেশেও সেভাবে শিল্পের বিকাশ সম্ভব। দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের ওপর মানুষের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে সুখী ও সমৃদ্ধ একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে মে দিবসের তাৎপর্য এ দেশে বিকশিত হবে, গড়ে উঠবে সোনার বাংলাদেশ। জয় হোক মেহনতি মানুষের।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র
মহান মে দিবস। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের স্মারক হিসেবে ১ মে সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ পালিত হয়। উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত শ্রমিকদের ছিল না কোনো ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা, ছিল না কাজের নির্দিষ্ট সময়ের সীমা। মালিকেরা তাঁদের খেয়ালখুশিমতো শ্রমিকদের দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটাতেন। ১৮৭৭ সালে ন্যায্য মজুরি, ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস ও অন্যান্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শ্রমিকেরা ব্যাপক ধর্মঘট পালন করেছিলেন। এই ন্যায্য আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হয়। গুলিতে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত ৩০০ শ্রমিক আহত হয়েছেন। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অনেক শ্রমজীবী মানুষ নিপীড়নের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন দুর্বার আন্দোলন। সেই দিন যুক্তরাষ্ট্রের ১১ হাজার ৫৬২টি শিল্পকারখানাসহ সব শিল্পাঞ্চলে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন শ্রমিকেরা।
শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটের শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ও রক্তস্নাত প্রতিরোধযুদ্ধে এবং আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় ৮ ঘণ্টা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিজয় হয়। ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে ‘শ্রমিক দিবস’ ঘোষণা দেওয়া হয়।
শ্রমিকদের রক্তরাঙা পতাকা হাতে নিয়ে ১৩৭ বছর ধরে দুনিয়াব্যাপী শ্রমিকেরা ন্যায্য অধিকার আদায় ও শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই-সংগ্রাম করে আসছেন। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিবিপ্লব ও অন্যান্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধার উৎকর্ষের ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় অনেক উন্নয়ন ঘটলেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি আমাদের দেশের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে এখনো শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, কর্মঘণ্টা ও নিরাপদ কর্মস্থলের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক—কোনো ক্ষেত্রেই শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
মুক্তবাজার অর্থনীতি ও নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যের কারণে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বেশির ভাগ শ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা নেই। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করা হয় না। তাঁদের ছুটি দেওয়া হয় না। একজন শ্রমিক হিসেবে নারী শ্রমিক শ্রম আইন অনুযায়ী সব অধিকারের সমান অংশীদার হলেও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। নারী শ্রমিক-অধ্যুষিত গার্মেন্টস, অন্যান্য ক্ষুদ্র শিল্প ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে স্বল্প মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিম্ন পদমর্যাদা, খণ্ডকালীন নিয়োগ, যখন-তখন ছাঁটাই এবং কর্মঘণ্টার অধিক কাজ করানো হয়। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র থেকে সাপ্তাহিক ছুটি, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। এ ছাড়া অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, সুপেয় পানির অভাব, যৌন হয়রানিসহ অনেক সমস্যা তাঁদের প্রতিনিয়ত ভোগ করতে হয়। সমকাজে সমমজুরি ও নারী-পুরুষের মজুরিবৈষম্য তো রয়েছেই। কৃষি ও গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও তাঁদের কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। গৃহকর্মে নিয়োজিত নারীরা সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। ভাত-কাপড়, মাথা গোঁজার ঠাঁই, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষের বিশাল অংশ এখনো এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রয়োজনীয় ক্যালরি ও পুষ্টির অভাবে ন্যূনতম মানসম্মত খাবার খেতে না পারায় শ্রমিক, কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। তাঁরা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু স্বপ্ন পূরণের কোনো পথ খুঁজে পান না। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। শ্রমিকেরা কাজ করতে গিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে পারবেন কি না, তার নিশ্চয়তা নেই।
আমাদের দেশের সিংহভাগ শ্রমিক নির্মাণ, গার্মেন্টস, পরিবহন, চাতাল, ওয়েল্ডিং, শিপ ব্রেকিংসহ অসংগঠিত সেক্টরে কাজ করেন। এসব কারখানা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের যে মজুরি দেওয়া হয় তা দিয়ে কোনোভাবেই পরিবার-পরিজনসহ জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব সেক্টরে মজুরিবৈষম্য বিরাজমান।
দেশের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষসহ নিম্ন আয়ের সাধারণ জনগণ এক সংকটময় অবস্থায় দিন যাপন করছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির দাপট এবং মুনাফাখোর ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারসাজিতে কয়েক বছর ধরে দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি বর্তমানে এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে শ্রমিক, তা কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। একদিকে শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি বাড়েনি, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ জীবনধারণ ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ। এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রকৃত মজুরি কমে গিয়ে তাঁদের এক অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আগে আমাদের দেশে রেশন প্রথা ও মহার্ঘ ভাতা প্রথা চালু ছিল। এমতাবস্থায় শ্রমিক-কর্মচারী তথা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য, বিশেষ করে গার্মেন্টস, নির্মাণ, পরিবহন, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, চা-শ্রমিক, রিকশাশ্রমিক, হকার, চাতাল, ওয়েল্ডিং ও গৃহশ্রমিকদের জন্য রেশন প্রথার মাধ্যমে সস্তা ও সুলভ মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন চাল, ডাল, তেল, চিনি সরবরাহ করতে হবে। একই সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই মোতাবেক শ্রমিক-কর্মচারীরা মজুরি না পাওয়ায় তাঁদের প্রকৃত মজুরি ও ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এই সংকট নিরসনের জন্য বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে মহার্ঘ ভাতা প্রদান করা আজ অত্যন্ত জরুরি, যেটা আগে একসময় চালু ছিল। শ্রমিক-কর্মচারীদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কারখানা ও শিল্পাঞ্চলভিত্তিক আবাসন, হাসপাতাল ও বিদ্যালয় স্থাপন করে সেখানে স্বল্পমূল্যে অথবা বিনা মূল্যে বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারঘোষিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বন্ধ থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল, চিনিকল, সুতা, বস্ত্রকলসহ বৃহৎ শিল্পকারখানাগুলো আধুনিকায়ন করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চালু করতে হবে। কর্মস্থলে সব ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতা রোধে আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুস্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
বর্তমানে রোবটিকস, আইওটি, ন্যানো প্রযুক্তি, ডেটা সায়েন্স ইত্যাদি প্রযুক্তির ফলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সামনে চলে এসেছে। বাংলাদেশে এর প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়বে। তবে সবচেয়ে বেশি পড়বে শ্রমবাজারে। অটোমেশন প্রযুক্তির ফলে শিল্পকারখানা হয়ে পড়বে ক্রমেই যন্ত্রনির্ভর। ফলে বিপুল পরিমাণ মানুষের চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। প্রযুক্তিভিত্তিক এই শিল্পবিপ্লবে প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে নানাবিধ কর্মক্ষেত্রে। চতুর্থ বিপ্লব মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাফল্য পেতে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। শুধু দেশেই নয়, যারা বিদেশে কাজ করছেন, তাঁদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। তাই শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে এই চতুর্থ বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে।
কিন্তু শ্রমিকশ্রেণি যে শুধু উৎপাদনব্যবস্থারই অংশ নন, দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনেরও অন্যতম কারিগর—এটা আমাদের দেশের মালিকশ্রেণি মানতে চায় না। আমাদের দেশে এখনো মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক বিরাজ করে, যা কোনোভাবেই শিল্প বিকাশের জন্য অনুকূল বা সহায়ক পরিবেশ হতে পারে না। শ্রমজীবী মানুষের অবদানের জন্যই শিল্প ও কৃষিবিপ্লব হয়েছে। আমাদের দেশের শ্রমিকেরা দক্ষ ও মেধাবী, এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। তাই শ্রমিকদের আস্থায় নিয়ে তাঁদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে সারা বিশ্বে যেভাবে শিল্প বিকশিত হয়েছে, আমাদের দেশেও সেভাবে শিল্পের বিকাশ সম্ভব। দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের ওপর মানুষের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে সুখী ও সমৃদ্ধ একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে মে দিবসের তাৎপর্য এ দেশে বিকশিত হবে, গড়ে উঠবে সোনার বাংলাদেশ। জয় হোক মেহনতি মানুষের।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে