অর্থনীতিতে সংকট-অস্থিরতায় বছর পার

ফারুক মেহেদী, ঢাকা
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮: ৩৪
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২২, ১০: ৫৬

সময়ের পাতা উল্টিয়ে শেষ হচ্ছে অর্থনীতিতে ঝড়ের বছর। সব আশা, উচ্চাভিলাষ, পরিকল্পনা আর নীতি-কৌশলকে ওলট-পালট করে দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির ঝড়ের তাণ্ডব চলে বাংলাদেশেও। সেই ঝড় এখনো থামেনি। তাণ্ডব চালানো দামের ঝড়ে তছনছ নিত্যপণ্যের বাজার। এতে চরম ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ। আঘাত লেগেছে আয়ে আর কর্মসংস্থানে। আর জ্বালানির উত্তপ্ত পারদ এখনো গলেনি; উল্টো ডলারের সংকট পুরো উৎপাদন-সেবা খাতসহ সার্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা জিইয়ে রেখেছে।

রপ্তানি-রেমিট্যান্স-রাজস্বের দুর্বল গতি যেমন বছরজুড়ে দেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষী জিডিপি প্রবৃদ্ধির চাকায় পেরেক ঠুকে রেখেছে। ফলে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল আর টানেলের মতো মেগা প্রকল্পগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন করেও স্বস্তিতে নেই সরকার। বরং বিদ্যমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা ভয় ধরাচ্ছে নতুন বছরেও। এমন এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যেই শেষ হচ্ছে বছরটি। তবে এ বছরে অর্থনীতির নানা সূচকে যে ক্ষতের দাগ পড়েছে, সামনের বছরেই তা সেরে যাবে—এমন বার্তাও দিতে পারছেন না অর্থনীতিবিদ-বিশ্লেষকেরা।

অর্থবছরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, এটা ঠিক যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট বাংলাদেশেও নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছে। তবে এখানে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তারপরও অর্থনীতি কেন এতটা অস্থির হলো? বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের পরও কেন ডলারের সংকট কাটছে না? রেমিট্যান্স কেন আগের ধারায় ফিরছে না? রপ্তানি সত্যিকার অর্থে বাড়ল কি না? এসব প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। এখন দেখতে হবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা সঠিক ছিল কি না। এর মূল্যায়ন করে সামনে কার্যকর কিছু কৌশল নিতে হবে।

পোশাক রপ্তানিকারক ও বিকেএমইএয়ের সাবেক সভাপতি ফজলুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, অর্থনীতি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে চলতি বছরে। সামনের বছরে এসব চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন হতে পারে। কারণ বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানোর কথা শোনা যাচ্ছে। বিদ্যমান সমস্যাগুলোর মধ্যে যদি নতুন করে খরচ বাড়ানো হয়, তবে রপ্তানির কী হবে তা বলা মুশকিল।

চলতি বছরের শুরুর দিকে কোভিড-১৯ যখন সহনীয় হওয়ার পথে, তখনই বাধে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। পণ্য ও সেবার চাহিদা বাড়ে দেশে দেশে। চাপ পড়ে পণ্য পরিবহনে। এতে জাহাজভাড়া দ্বিগুণ-তিন গুণ পর্যন্ত হয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জেরে ভাগ হয়ে যায় পুরো বিশ্ব। এতে বড় আঘাতটা লাগে অর্থনীতিতে। পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বের এদিক থেকে ওদিকে সীমিত হয়ে যায় পণ্য আসা-যাওয়া। খাদ্য, জ্বালানি, শিল্পের যন্ত্রপাতি-কাঁচামালে সংকট তীব্র হয়।

দুষ্প্রাপ্যতায় বাড়ে দাম। ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে আমদানিনির্ভর বাংলাদেশ। দিন দিন তীব্র হয় ক্ষতি আর সংকটের মাত্রা। সামনে থেকে অর্থনীতিকে উলট-পালট করে দেয় ডলারের সংকট। এ থেকে উদ্ভূত হয় হাজারটা সমস্যা। বছরের শুরুতে নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম দিয়ে শুরু হওয়া অর্থনীতির অশান্তি পরে বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, রেমিট্যান্স আর রপ্তানি কমে যাওয়া, রাজস্ব ঘাটতির মতো মোটাদাগে অর্থনীতির মূল সূচকগুলোকে নড়বড়ে করে দেয়। 

ডলারের সংকট কীভাবে ভোগাচ্ছে অর্থনীতিকে? 
অর্থনৈতিক সূচকগুলো পর্যালোচনা করে জানা যায়, ডলারের সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একপ্রকার দৌড়ের ওপর রেখেছে। চাহিদা ও সরবরাহের ওপর ছেড়ে না দিয়ে কৃত্রিমভাবে দীর্ঘদিন ধরে ৮৬ টাকায় ডলারের দাম ধরে রাখার ফল কতটা বিপজ্জনক হয়, সেটা দেখা গেল যখন বাজারে এর দাম একপর্যায়ে ১২০ টাকায় গিয়ে ঠেকে। পরে দাম এদিক-সেদিক করে বিভিন্ন হার নির্ধারণ করে দিয়েও কার্যত ফল আসেনি। যে হার ঠিক করা হয়, সেটিও রক্ষণশীল। ডলারের দাম যৌক্তিক না করায় বিদেশ থেকে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডির আশ্রয় নেন। আর বৈশ্বিক মন্দার ধাক্কায় রপ্তানিও কমে যায়। অর্থাৎ একদিকে, বেশি ডলার খরচ হয়ে যায়, অন্যদিকে ডলার আসার প্রবাহ কমে যায়। সব মিলিয়ে ডলারের সংকট তীব্র হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি অসাধু চক্র ডলারের অবৈধ কারবারও করে। অনেক ব্যাংকও বাড়তি মুনাফা লুটে নেয়। ডলার কমে যাওয়ায় রেকর্ড রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে আসে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে। এটিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে আইএমএফ। পরে দেখা যায়, আসলে খরচ করার মতো ডলার আছে ২৬-২৭ বিলিয়ন ডলার। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ঋণ পাওয়ার জন্য সরকার ভেতরে-ভেতরে এটাকে মেনে নিয়ে আর বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে কি না এ আতঙ্কে ডলার খরচে অতিমাত্রায় সতর্ক হয়ে যায়। আমদানি কড়াকড়ি করে। ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি কমিয়ে দেয়। এতে অনেক ব্যাংক ডলারের সংকটে ভোগে। তারা চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ঋণপত্র খুলতে চায় না। সংকট এতটাই তীব্র হয় যে এখনো অনেক ব্যাংক শুধু বিলাসী পণ্য নয়, শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি বা যন্ত্রাংশ বা খাদ্যপণ্য আমদানি ঋণপত্রও খুলছে না।

রেমিট্যান্স আর রপ্তানিতে ধীরগতি কেন? 
ডলারের দাম থেকেই মূলত প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার সূত্রপাত বলে অনেকে মনে করেন। প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার পাঠালে যে হার পান, তারচেয়ে বেশি দেয় হুন্ডিওয়ালারা। আর তারল্য সংকটে ব্যাংকে টাকা পাঠালে টাকা দিতে পারবে না ব্যাংক–এ রকম একটি গুজবও প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে একটা সমস্যা তৈরি করেছে বলে জানা যায়। এদিকে, বছরজুড়েই রপ্তানি আয়েও উত্থান-পতন ছিল। উদ্যোক্তারা জানান, বছরের শুরুর দিকে বৈশ্বিক চাহিদা বাড়ায় বিপুল অর্ডার এলেও শেষের কয়েক মাস আবারও কমে যায়। এ সময়ে এলএনজি আমদানি বন্ধ করা, লোডশেডিং করায় উৎপাদনে প্রভাব পড়ে। এখনও শিল্পকারখানায় ২০-২৫ শতাংশ উৎপাদন কম হচ্ছে। এর সঙ্গে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের বাড়তি দামও ভোগাচ্ছে উৎপাদকদের। আর নতুন করে ঋণপত্র খুলতে সমস্যা হওয়ায় সামনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় তারা এখন ভীত।

এলএনজি আমদানি বন্ধ ও জ্বালানির দাম কি প্রভাব ফেলে?
ডলার বাঁচাতে সরকার বেশি দামে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয়। এতে ধুঁকছে শিল্প। বিদ্যুতের সংকটে লোডশেডিং একপর্যায়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে। উৎপাদন চালিয়ে রাখতে অনেক কারখানার মালিক খরচ বাড়িয়েও ডিজেলে জেনারেটরে ভরসা করেন। উদ্যোক্তারা সরকারকে বেশি দাম দিয়ে হলেও এলএনজি আমদানির পরামর্শ দেন। তাতে এখনো সাড়া দেয়নি সরকার। আর ডিজেলের দাম এক ধাক্কায় প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানোর ফলে পুরো অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। রাতারাতি সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীও দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামেন। এতে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন। মূল্যস্ফীতি মাত্রা ছাড়িয়ে ১০ শতাংশের ঘরে গিয়ে ঠেকে। সরকারি হিসাবে তা কমছে বলা হলেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন।

রাজস্ব আয়ে খরা চলছেই
ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যেই তাঁদের ব্যবসা খারাপ বলে বার্তা দিতে শুরু করেছেন। এর অর্থ হলো–রাজস্ব আয়ও কম হবে। বাস্তবেও তা দেখা যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে গত কয়েক মাসেই ঘাটতি পড়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। সামনে ঘাটতির এ মাত্রা কমবে বলে মনে করছেন না এ খাতের বিশ্লেষকেরা। কারণ অর্থনীতির অন্য সূচকগুলো খারাপ থাকলে রাজস্ব আয় ভালো হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুরবস্থা 
একদিকে অর্থনীতিতে নানা সংকট। সরকার একটা সামাল দিতে না-দিতেই আরেকটা সংকট পুরো ব্যবস্থাপনাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে; অন্যদিকে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে প্রভাবশালীরা অনেক ব্যাংককে খাদের কিনারে নিয়ে যান। নজরদারি, সুশাসনের বুলির মধ্যেই খেলাপি ঋণ কমা দূরের কথা, বরং বাড়তে বাড়তে তা ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। প্রভাবশালীরা নামে-বেনামে ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের প্রকৃত উদ্যোক্তারা ঠিকমতো ঋণ পাচ্ছেন না। এতে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রবৃদ্ধির কী হবে? 
সরকার গত প্রায় দেড় যুগ ধরেই উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিয়ে এগিয়ে গেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। করোনার ধাক্কা আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ প্রবৃদ্ধি এখন হুমকিতে। চলতি বছরে সরকার সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। যদিও সম্প্রতি অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তা সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে সামনের দিনে অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলে ওঠাই যে সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে, এ আভাসই দিচ্ছেন বিশ্লেষকেরা।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত