হাজার কোটি ডলার ছুঁতে যাচ্ছে এশিয়ার টেস্টটিউব বেবি শিল্প, মা–বাবা হতে সর্বস্ব বাজি ধরছে মানুষ

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৪, ০০: ০৮

একটি সন্তানের আশায় ১১ বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন জেনজিরা (ছদ্মনাম)। মাতৃত্বের সাধ পূরণের আকাঙ্ক্ষা তাঁকে বারবার নিয়ে গেছে ব্যাংককের সেরা প্রজনন স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোতে। ৪৫ বছর বয়সী এই নারীর মা হওয়ার আশা ক্রমেই ফ্যাকাশে হয়ে আসছে। তাঁর হিমায়িত ডিম্বাণুর সংখ্যা নেমেছে দুই–এ, দ্রুত ফুরিয়ে আসছে অর্থকড়িও। নয়বারের চেষ্টার পর জেনজিরা ও তাঁর স্বামীর মাঝে ভয় চেপে বসেছে— হয়তো কখনো সন্তানের মুখ দেখা হবে না!

জেনজিরা বলেন, ‘আমি চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং কালো জাদু—দুটোই চেষ্টা করেছি। তবে সম্ভবত এটাই আমার ভাগ্য, আমি মা হতে পারব না। আমি এখনো মা হতে চাই। কিন্তু যতবারই আমরা ব্যর্থ হই ততবারই দুঃখ ও হতাশা ঘিরে ধরে। পুরো পৃথিবী যেন মাথার ওপর ভেঙে পড়ে!’

মা হওয়ার চেষ্টায় এখন পর্যন্ত ব্যয় করেছেন প্রায় ১ লাখ ৩৬ হাজার ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় দেড় কোটি টাকা। তবে কয়েকশ কোটি ডলারের প্রজনন ব্যবসায় জেনজিরার এই খরচ মহাসমুদ্রে এক ফোঁটা পানি!

প্রজনন স্বাস্থ্যের এই বাণিজ্য শুরু হয়েছে চার দশকেরও বেশি আগে। ১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই জন্ম নেয় বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব বেবি লুইস ব্রাউন। জন্মের মতো মানবজীবনের এক মৌলিক বিষয় নিয়ে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে খেলায় মত্ত হয়েছে মানুষ—এ ধরনের নৈতিক বিতর্কও জন্ম নিয়েছিল টেস্টটিউব বেবি নিয়ে। তবে যে সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লব রাতারাতি লাখ লাখ নিঃসন্তান দম্পতিকে বাবা–মা হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে, টিকে গেছে সেই শিল্প। আর বেড়েছে বাণিজ্যের পরিধি।

এরপর প্রজনন চিকিৎসার কল্যাণে এ পর্যন্ত আনুমানিক ১ কোটি ২০ লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে। এশিয়ার প্রথম আইভিএফ শিশু হলেন স্যামুয়েল লি। তিনি ১৯৮৩ সালে সিঙ্গাপুরে জন্ম নেন।

এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জন্মহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলে অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকটিভ টেকনোলজি (এআরটি) বা সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তির চাহিদা বাড়ছে। অ্যালায়েড মার্কেট রিসার্চ পূর্বাভাস দিয়েছে যে, ২০২৮ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিষেবার বাজার পৌঁছাবে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারে—যা ২০২০ সালের দ্বিগুণ।

প্রজনন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট এই চিকিৎসার দ্বারস্থ হওয়ার প্রবণতার পেছনে অনেক কারণই জড়িত। অনেক ক্ষেত্রেই দম্পতিরা স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অনেক বেশি দেরি করে ফেলেন। ফলে বিশ্বব্যাপী পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যেই বন্ধ্যত্বের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার নিঃসন্তান থাকতে চাওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যাও বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দেশে জন্মহার দ্রুত কমছে। দেশগুলোতে জন্মহারের এই পরিবর্তনকে আপাতদৃষ্টিতে দুর্নিবার বলেও সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে প্রজনন স্বাস্থ্যে এআরটি প্রযুক্তি আসায় নিঃসন্তান দম্পতিরা সন্তান লাভের আশায় ততদিন চেষ্টা করে যান, যত দিন আর্থিক সামর্থ্য থাকে। বেশ বড় অঙ্কের খরচ সত্ত্বেও আইভিএফ ক্লিনিকের চাহিদা বাড়ছে—যা মানুষের অগ্রাধিকার, অর্থনীতি এবং লিঙ্গ সমতা সংক্রান্ত বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে।

এআরটির পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা আইভিএফ। এর খরচ অঞ্চল ভেদে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। সিঙ্গাপুরে এর খরচ সর্বোচ্চ। দেশটির বেসরকারি হাসপাতালে প্রতি চক্রের জন্য খরচ হয় গড়ে প্রায় ১০ হাজার ২০০ ডলার। তবে ভারতে আইভিএফের খরচ তুলনামূলক কম। সেখানে আইভিএফের প্রতি চক্রের খরচ প্রায় ২ হাজার ৭০০ ডলার। ডিম্বাণু উৎপাদনে সহায়তা করার জন্য নারীদের সাধারণত ন্যূনতম তিনটি আইভিএফ চক্র সম্পন্ন করা প্রয়োজন হয়।

মালয়েশিয়া ভিত্তিক আলফা আইভিএফ গ্রুপের সিইও ডা. কলিন লি বলেন, ‘গর্ভধারণের চিকিৎসা সস্তা হবে না। পুরো আইভিএফ প্রক্রিয়াটিই বেশ জটিল।’

প্রজনন চিকিৎসার জন্য সরকারি সহায়তা একেক দেশে একেক রকম। উদাহরণস্বরূপ—অস্ট্রেলিয়া এবং সিঙ্গাপুরে সরকারিভাবে প্রতি বছর হাজার হাজার এআরটি চক্রকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। থাইল্যান্ডে মেডিকেল টুরিজমের বাজার বিকশিত হচ্ছে। চীনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ দেশটিতে যায় চিকিৎসার জন্য।

গত বছর নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি ১৮টি শিশুর মধ্যে একটির জন্ম আইভিএফে। মোনাশ আইভিএফের মেডিকেল ডিরেক্টর এবং মেলবোর্নের মোনাশ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লুক রমবাউটস বলেন, বেশির ভাগ রোগী এখন আইভিএফের শরণাপন্ন হতে পারছে বলে সরকারকে ধন্যবাদ।

একইভাবে সিঙ্গাপুরে সরকারিভাবে প্রজনন চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তা করা হয়। প্রতি বছর হাজার হাজার এআরটি চক্রের আংশিক খরচ সরকার থেকে দেওয়া হয়। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে ১০ হাজার ৮০০টি এআরটি চক্রে তহবিল দিয়েছে সিঙ্গাপুর।

এআরটিতে অগ্রগতি সত্ত্বেও চিকিৎসাধীন দম্পতিদের মানসিক এবং আর্থিক ক্ষতিসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে। সিঙ্গাপুরে ফার্টিলিটি সাপোর্ট এসজির মতো সহায়তা গোষ্ঠীগুলো প্রজনন চিকিৎসার জটিলতাগুলো চিহ্নিত করে দম্পতিদের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা এবং মানসিক সহায়তা দেয়।

সাশ্রয়ী মূল্যের এবং নাগালের মধ্যে প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ খাতে সরকারি ভর্তুকি বাড়ানোর দাবি জোরালো হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে থাইল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশও রয়েছে, যেখানে জন্মহার বেশ কমে গেছে। কিছু দেশে আইভিএফে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে, এআরটির চাহিদা বৃদ্ধি শুধু চিকিৎসা শিল্পই নয় বরং, এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জন্মহার হ্রাসের গভীর সামাজিক প্রভাবকেও তুলে ধরে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের নিবন্ধ থেকে অনূদিত

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত