সেকেন্ডে ৩ কিমি গতির রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ‘ওরেশনিক’ কতটা বিধ্বংসী

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২০: ০৭
বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার ওরেশনিক ইউক্রেনে রণক্ষেত্রে মস্কোকে বাড়তি সুবিধা এনে দেবে। ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেনের দিনিপ্রোতে গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার এক রুশ বিমান হামলা হয়। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা এই হামলাকে ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে আখ্যা দেন। এ হামলার পর ঘটনাস্থলে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় ধরে বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। এই হামলার এতটাই শক্তিশালী এক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছিল যে, এর পরপরই ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বলেছিলেন—এর বৈশিষ্ট্যগুলো আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের (আইসিবিএম) মতো।

তবে পশ্চিমা কর্মকর্তারা দ্রুতই এই দাবি অস্বীকার করেন। তারা বলেন, রাশিয়া যদি সত্যিই এমন কোনো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করত, তবে তা যুক্তরাষ্ট্রকে পারমাণবিক সতর্কতা জানিয়েই করা হতো। কিন্তু হামলার কয়েক ঘণ্টা পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে জানান, রাশিয়া ‘নতুন মাঝারি পাল্লার’ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে ‘ওরেশনিক’ নামে। রুশ ভাষায় এর অর্থ ‘হ্যাজেল গাছ’।

পুতিন বলেন, এই ক্ষেপণাস্ত্রের গতিবেগ ছিল মাক ১০ বা প্রতি সেকেন্ডে আড়াই থেকে ৩ কিলোমিটার (শব্দের গতির দশগুণ)। তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে এই অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার কোনো উপায় নেই।’ তিনি উল্লেখ করেন, দিনিপ্রোর একটি বড় সামরিক-শিল্প স্থাপনায় এই ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। তিনি এ হামলাকে পরীক্ষা হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘এটি সফল হয়েছে।’

এর পরদিন, রাশিয়ার শীর্ষ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় পুতিন জানান, ইউক্রেনের রণক্ষেত্রে এই ক্ষেপণাস্ত্রের আরও পরীক্ষা চালানো হবে। তবে পুতিনের দেওয়া বিবরণের পরও এই ক্ষেপণাস্ত্রটি আসলে কী, তা কতটা বিপজ্জনক—তা নিয়ে এখনো স্পষ্ট মতৈক্য নেই।

ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দারা দাবি করেন, এটি সিডার নামে পরিচিত এক নতুন ধরনের আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। তারা জানান, এটি মাক ১১ গতিতে চলছিল এবং রাশিয়ার আস্ত্রাখান অঞ্চল থেকে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা দিনিপ্রোতে পৌঁছাতে মাত্র ১৫ মিনিট সময় লেগেছিল। তারা আরও জানান, এই ক্ষেপণাস্ত্রটিতে ছয়টি ওয়ারহেড ছিল আসে এবং প্রতিটি ওয়ারহেডে ছিল অতিরিক্ত ছয়টি করে বিভিন্ন ধরনের গোলা-বারুদ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বিভিন্ন ফুটেজ পরীক্ষা করে।

কেন এই ক্ষেপণাস্ত্রের গতি গুরুত্বপূর্ণ

পুতিনের দাবি যদি সঠিক হয়, তবে ওরেশনিক ক্ষেপণাস্ত্রটি হাইপারসনিক (শব্দের গতির চেয়ে বেশি) শ্রেণির। সাধারণত, খুব কম ক্ষেপণাস্ত্রই এই স্তরে পৌঁছাতে পারে। একটি ক্ষেপণাস্ত্র যত দ্রুত চলবে, সেটি তত দ্রুত লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাবে। ক্ষেপণাস্ত্র যত দ্রুত লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাবে, প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনী প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য তত কম সময় পাবে। এ কারণেই, ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে গতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সাধারণত একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর জন্য প্রাথমিকভাবে বায়ুমণ্ডলের মধ্যে একটি বাঁকানো পথ অনুসরণ করে উপরে ওঠে এবং তারপরে একই ধরনের পথ ধরে নিচে নামে। কিন্তু এটি যখন নিচে নেমে আসে, তখন এটি গতি বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে এই গতিশক্তি বা কাইনেটিক এনার্জি বেড়ে যায়। এই অতিরিক্ত গতিশক্তি ক্ষেপণাস্ত্রটিকে আরও বেশি বিকল্প পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয়।

সাধারণত, এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার ঠিক আগে—কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। এ কারণে, বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা যেমন, ইউক্রেনে থাকা মার্কিন নির্মিত প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে এটিকে আটকানো বিশেষভাবে কঠিন হয়ে যায়।

এই কারণেই পুতিন সম্ভবত এই নতুন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়টি প্রকাশ্যে জানানো সময় এর গতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। রাশিয়া থেকে নিক্ষিপ্ত প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেন আটকে দিয়েছে। কিন্তু ব্যালিস্টিক মিসাইলের এই দ্রুত গতি সেই সফলতা কমিয়ে আনবে।

নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ওরেশনিকের পাল্লা কত

রুশ সামরিক বিশেষজ্ঞ ইলিয়া ক্রামনিক প্রোক্রেমলিন দেশটির সংবাদমাধ্যম ইজভেস্তিয়াকে বলেছেন, নতুন ক্ষেপণাস্ত্রটি সম্ভবত মাঝারি পাল্লার, তবে এই পাল্লার সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তিনি বলেন, ‘সম্ভাবনা আছে, আমরা একটি নতুন প্রজন্মের মাঝারি পাল্লার রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের (যার পরিসর আড়াই থেকে ৩ হাজার কিলোমিটার) বিষয়টি কথা বলছি। তবে আমাদের আলোচিত ক্ষেপণাস্ত্রটি সম্ভবত ৫ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত পাড়ি দিতে পারে।’

এর অর্থ হলো, এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়া ইউরোপের যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে পারবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার বাইরে থাকবে। ক্রামনিক বলেন, ‘এটি অবশ্যই একটি পৃথকযোগ্য ওয়ারহেড দ্বারা সজ্জিত এবং এর নিজস্ব গাইডেন্স ইউনিট আছে।’ অর্থাৎ, প্রয়োজন অনুসারে, এই ক্ষেপণাস্ত্রটি তার লক্ষ্যবস্তু এবং গতিপথ পরিবর্তন করতে সক্ষম।

ক্রামনিক ইঙ্গিত দেন, এটি ইয়ার্স-এম ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার একটি ছোট সংস্করণ হতে পারে। গত বছরই রাশিয়া এই ইয়ার্স-এম আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন সংস্করণ উৎপাদন শুরু করে। এটিকে যেকোনো জায়গা থেকে নিক্ষেপ করা যায় এবং এটিতে অনেকগুলো পৃথক ওয়ারহেড অন্তর্ভুক্ত।

আরেক সমর বিশেষজ্ঞ দিমিত্রি করনেভ ইজভেস্তিয়াকে বলেন, ওরেশনিক সম্ভবত স্বল্প পাল্লার ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্রের নকশার ওপর ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্রটি রাশিয়া ইউক্রেনে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে। তিনি জানান, ওরেশনিকে সম্ভবত রাশিয়া তাদের সর্বশেষ প্রজন্মের ইঞ্জিন যোগ করেছে। করনেভ বলেন, গত বসন্তে রাশিয়া কাপুস্তিন ইয়ার পরীক্ষাকেন্দ্রে একটি বড় ইঞ্জিনযুক্ত ইস্কান্দার ব্যবহার পরীক্ষা করেছে। সম্ভবত এটি ওরেশনিক ক্ষেপণাস্ত্রই ছিল।

কতটা বিধ্বংসী এই ওরেশনিক

সামরিক বিশ্লেষক ভ্লাদিস্লাভ শুরিগিন ইজভেস্তিয়াকে জানিয়েছেন, ওরেশনিক বিদ্যমান আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো অতিক্রম করতে সক্ষম। তিনি আরও বলেন, এটি পারমাণবিক ওয়ারহেড ব্যবহার না করেও গভীরতর স্তরে থাকা সুরক্ষিত বাঙ্কার ধ্বংস করতে পারে।

আরেক রুশ বিশ্লেষক ইগর কোরোতচেঙ্কো রুশ সংবাদ সংস্থা তাসকে বলেছেন, এই ক্ষেপণাস্ত্রটিতে স্বাধীনভাবে পরিচালনা করা যায় এমন একাধিক ওয়ারহেড আছে। তিনি আরও বলেছেন, ‘এই ওয়ারহেডগুলো লক্ষ্যবস্তুতে কার্যত একই সময়ে পৌঁছে যাওয়ায় এটি অত্যন্ত কার্যকরী হয়ে ওঠে।’

সামরিক ঝুঁকি বিশ্লেষক ও পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান সিবিলাইনের সিইও এবং প্রতিষ্ঠাতা জাস্টিন ক্রাম্প বিবিসিকে বলেছেন, এই ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে গুরুতরভাবে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা রাখে। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এই সংঘাতে ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী হুমকিগুলোর একটি। দ্রুত এবং আরও উন্নততর সিস্টেমগুলো সেই হুমকিকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলবে।’

বিবিসি থেকে সংক্ষেপিত

অনুবাদ: আব্দুর রহমান

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত