খাবার নেই, ঘুম নেই, কোনো আশা নেই যেখানে

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯: ৫৮
Thumbnail image
ছবি: আল-জাজিরা

গাজার মানুষকে সাহায্য এবং কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার জন্য যাঁরা সেখানে কাজ করছেন, তাঁরাও এখন ডুবে যাচ্ছেন হতাশার গভীরে। যেমন ওলগা শেরেভকো। জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয় অফিসের একজন কর্মী হিসেবে গাজায় এখন পর্যন্ত তিনি চার বছর কাটিয়েছেন। এর মধ্যে তাঁর সর্বশেষ ছয় মাসই কেটেছে চলমান যুদ্ধের মধ্যে।

আল-জাজিরার এক নিবন্ধে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধে গাজায় নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন ওলগা। তাঁর মতে, গাজায় সর্বশেষ ছয় মাসের মতো এত অসহায় তিনি আর কখনোই বোধ করেননি। অবিরাম যুদ্ধ যন্ত্র, যার কাছে গোলাবারুদের কোনো সীমা নেই, প্রতিটি গুলি ছোড়ার পরপরই লোড করা হচ্ছে নতুন গুলি।

গত সেপ্টেম্বরে খান ইউনিসে একটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনাকারী এক নারীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন ওলগা। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, শান্তি নিয়ে তিনি কতটা আশাবাদী।

সেই নারী একটি ছোট্ট মেয়ের দিকে ইশারা করে বললেন, ‘এই মেয়ের বাবা পাঁচ দিন আগে তাঁদের বাড়িতে বোমা হামলার সময় মারা গেছেন। তাঁর মরদেহ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা। সেই জায়গায় ক্রমাগত গুলি চলছে। তবে কিসের এত আশা?’

যুদ্ধের মধ্যে গাজার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে ঘুম। ওলগা জানান, গত বছরের জানুয়ারিতেও গাজার দেইর আল-বালাহর এলাকায় ছিলেন ওলগা। সেই সময়েও বড় কোনো বিস্ফোরণের পর জানালার কাছে ছুটে গিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখতেন তিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে এগুলো এত সাধারণ হয়ে গেছে যে কেউ তা দেখতে আর ছুটে যায় না।

প্রতি রাতে মানুষ যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়, তখনই শুরু হয় বোমা হামলা। একের পর এক মিসাইলের শিস শোনা যায়। তারপরই প্রবল বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দেয় জানালাগুলোকে। চিৎকার করে ওঠে কুকুর, গাধা, শিশু—সবাই। একের পর এক হামলা চলে, তারপরই গুলির শব্দ। শেষরাতে কিছুক্ষণের জন্য অবশ্য শান্তি নেমে আসে। কিন্তু ফজরের আজানের সময় আবার নতুন করে আক্রমণ শুরু হয়।

ওলগা জানান, টেলিভিশনে গাজার যেসব দৃশ্য দেখা যায়, বাস্তবে সেগুলো আরও অনেক বেশি ভয়ংকর। ক্যামেরা কখনোই এই ধ্বংসের প্রকৃত চিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারে না। শব্দের ভয়াবহতা তো আছেই।

তীব্র খাদ্যসংকটের মধ্যে বেকারিগুলোতে রুটি নেওয়ার জন্য মানুষের লড়াই আর চিৎকার একটি নিত্য ঘটনা। এক সপ্তাহ আগেই একটি বেকারির সামনে রুটির জন্য ধাক্কাধাক্কিতে এক নারী ও দুই মেয়ে পিষে মারা গেছেন।

ওলগার বন্ধু খালেদ গাজার কমিউনিটি কিচেনগুলো পরিচালনা করেন। তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন এই ভেবে যে খুব শিগগির খাবার ফুরিয়ে যাবে। তাঁকে কোনো সান্ত্বনা দিতে পারেননি ওলগা; বরং উল্টো ওই বন্ধুই ওলগাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, ‘কাঁদবেন না, ওলগা। আমাদের মতো শক্ত থাকুন।’

গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি গাজার উত্তরাঞ্চলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেই পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হয়েছে। সাহায্য পরিবহনের ব্যাগ থেকে পড়ে যাওয়া ময়লা ময়দা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নেওয়া মানুষের দৃশ্য চোখে পড়েছে।

ওলগা জানান, গাজায় সবচেয়ে দুর্বলদের সাহায্য করার চেষ্টা করতে গিয়ে কার আগে সাহায্য প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। প্রায় ২৩ লাখ মানুষের মধ্যে ১০০ ভাগই সাহায্যের অপেক্ষায় রয়েছে।

ওলগা লিখেছেন, ‘গর্ভবতী নারী, গৃহ সহিংসতার শিকার কেউ, কিংবা গৃহহীন ও শারীরিক প্রতিবন্ধী—কাকে আগে সাহায্য করবেন? এই সিদ্ধান্তের যন্ত্রণা আমাদের অনেক রাত ঘুমাতে দেবে না।’

তাঁর ভাষায়, ‘আমরা রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহ তুলেছি। কোনোটি তখনো উষ্ণ, রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আবার কোনোটি ঠান্ডা হয়ে গেছে, কুকুরে খেয়ে ফেলেছে। অনেকে ছিল শিশু। তারা আঘাতের শিকার হয়ে একা, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণে মারা গেছে। তাদের মায়েরা হয়তো কেন তাঁদের সন্তান রাতে বাড়ি ফিরে আসেনি ভেবে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।

বাকি পৃথিবীর কাছে এই শিশুরা শুধু গাজার পরিসংখ্যানে যোগ হওয়া আরও একটি সংখ্যা। এখন পর্যন্ত সেখানে ৪৫ হাজার ৫০০ মানুষ মারা গেছে।

বিধ্বস্ত গাজায় কখনো কোনো শান্ত মুহূর্তে ওলগা নিজেকেই শুধু প্রশ্ন করেন—এই ধ্বংসের মাঝে কোথাও কি আশা আছে?

উত্তরটি কেবলই নীরবতা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত