ইউক্রেনে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হচ্ছে ভারতীয়দের

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২০: ২৯

‘সেনা নিরাপত্তা সহকারীর’ কথা বলে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে জোর করে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে অন্তত তিন ভারতীয়কে। এই তিনজনের এক ভুক্তভোগী ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে বলেন, এক এজেন্ট তাঁদের প্রতারিত করে নিয়ে যায়। 

 ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে প্রায় ১৮ জন ভারতীয়কে রাশিয়া–ইউক্রেন সীমান্তবর্তী মারিওপোল, খারকিভ, দোনেৎস্ক, রোস্তোভ–অন–দনে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধে একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানান এক এজেন্ট। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে এ যুদ্ধ চলছে। 

 ২০২২ সালে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক বাহিনীতে কয়েকজন ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিলেও যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে ভারতীয়দের উপস্থিতি এই প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে এল। 

এক ভুক্তভোগীর পরিবার তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজনৈতিক দল সর্বভারতীয় মজলিশ–ই–ইত্তেহাদুল মুসলেমিনের সংসদ সদস্য আসাদুদ্দিন ওয়েইসির কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। তিনি ভারতের হায়দরাবাদের বাসিন্দা। গত ২৫ জানুয়ারি ওয়েইসি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর ও মস্কোতে ভারতের দূতাবাসে এ বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি লিখেছেন। 

ভুক্তভোগীরা ভারতের উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, পাঞ্জাব ও জম্মু–কাশ্মীরের বাসিন্দা। দ্য হিন্দু ভুক্তভোগীদের নাম গোপন রেখেছে। 

উত্তর প্রদেশের এক ভুক্তভোগী জানান, তাঁদের তিনজনকে ‘রুশ সেনাবাহিনী’ অস্ত্র ও গোলাবারুদ পরিচালনার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয় এবং গত জানুয়ারিতে রাশিয়া–ইউক্রেন সীমান্তে রোস্তভ–অন–দনে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁরা লড়াই করতে বাধ্য হন। 

তিনি বলেন, ‘আমরা ২০২৩ সালের নভেম্বরে এখানে পৌঁছাই। এখানে আমাদের চুক্তি সই করানো হয়। চুক্তিতে বলা হয়, আমাদের সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আমাদের স্পষ্টভাবে বলা হয় যে, আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হবে না এবং প্রতি মাসে ১ লাখ ৯৫ হাজার রুপি বেতন ও ৫০ হাজার রুপি অতিরিক্ত বোনাস দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। দুই মাস বোনাসের ৫০ হাজার রুপি ছাড়া আমি আর কোনো বেতন পাইনি।’ 

তিনি বলেন, তিনি এক এজেন্টের মাধ্যমে রাশিয়া যান। এজেন্ট ফয়সাল খান বাবা ভ্লগ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল চালান। গত ১২ নভেম্বর রাশিয়ায় খানের সহযোগী ভারতীয় দুই এজেন্ট উত্তর প্রদেশের এ বাসিন্দাকে গ্রহণ করেন। 

ভুক্তভোগী বলেন, ‘গত ১৩ নভেম্বর, আমাদের একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মস্কো থেকে আড়াই ঘণ্টা দূরের এক নির্জন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা ভারতীয় ওই এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা জানায়, আমাদের নিরাপত্তা সহকারী হিসেবেই নিয়োগ দেওয়া হবে। আমাদের তাঁবুতে থাকতে দেওয়া হয় এবং অস্ত্রচালনা শেখানো হয়। গত ১৪ জানুয়ারি আমাদের যুদ্ধ করার জন্য দোনেৎস্কে পাঠানো হয়।’ 

লড়াই করতে বাধ্য করার কয়েক দিন পরই পালানোর সুযোগ পান তিনি এবং অস্ত্র ফেলে দেন। ভুক্তভোগী বলেন, ‘কিন্তু আমি ধরা পড়ে যাই এবং আমাকে বন্দুকের নলের মুখে হুমকি দেওয়া হয়। তারা আমাকে এক ভবন থেকে অন্য ভবনে পণ্য সরবরাহের কাজ করতে বলে। কমান্ডার আমাদের পাঁচ মিটারের দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটতে বলে যেন আমরা সহজ লক্ষ্য না হই। স্বল্প এই দূরত্ব অতিক্রম করতেই আমরা ৭–৮ বার বুলেটের মুখে পড়ি। আমার সঙ্গে থাকা এক স্থানীয় এতে নিহত হয়। গত ২২ জানুয়ারি আমি পালাতে সক্ষম হই এবং অত্যন্ত ঠান্ডার কারণে শরীরে ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই।’ 

তিনি বলেন, অনেক দিন পর্যন্ত তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেননি। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর পরই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘মস্কোর ভারতীয় দূতাবাসের কাছে বারবার অনুরোধ করা হলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছে। আমাকে বেশ কয়েকবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার কাছে যথাযথ কাগজপত্র নেই এবং কোনো অর্থ নেই। সরকার আমাদের সাহায্য করছে না।’ 

রাশিয়ায় ভুক্তভোগীদের গ্রহণকারী এক এজেন্ট দ্য হিন্দুকে বলেন, এই ব্যক্তিরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছেন এবং সরকার ব্যবস্থা না নিলে জীবনের মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। 

এজেন্ট বলেন, ‘তাঁদের সেনাবাহিনীর সহকারী হিসেবে কাজে নেওয়া হয়েছিল। চুক্তি অনুসারে তাঁদের তিন মাসের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, এর পরে একটি মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়ন এবং অন্যান্য পরীক্ষা করা হবে। তাঁরা রান্নাঘরের সহকারী বা অন্য কোনো কাজ চালিয়ে যেতে চান কি না তা নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু এক মাস পর তাঁদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয় এবং তাঁরা রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য হন। অন্য দেশের নাগরিকেরাও এখানে আটকা পড়ে আছে।’ 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাশিয়ায় ভারতীয়দের এই বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সূত্র অনুসারে, ভারতীয় দূতাবাস তাদের কাছে আসা সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখছে। 

তবে সূত্র বলছে, যারা দাবি করেন যে তাঁদের সীমান্তে শ্রম দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, তাঁদের অনেকেই দেশ ছাড়তে চান না। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে কাজের সুযোগ পাওয়ার জন্য নিয়োগকর্তাদের মোটা অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করেছেন। ভারতে তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরে আসার আগে কিছু অর্থ উপার্জন ছাড়া তাঁরা ফিরে আসতে চান না। তাই কর্মকর্তারা বলছেন, এ ক্ষেত্রে তাঁদের হাত বাঁধা। এরপরও যেকোনো প্রয়োজনে ভারতীয় নাগরিকদের সাহায্য করতে প্রস্তুত।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত