Ajker Patrika

গাজায় প্রকট হচ্ছে হামাসবিরোধী বিক্ষোভ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
হামাসের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা খুব কমই দেখা যায়, কারণ প্রতিবাদ করলে তা জোর করে থামিয়ে দেওয়া হয় এবং বিরোধীদের জেলে পাঠানো হয়, নির্যাতন করা হয়, এমনকি মেরে ফেলা হয়। এ প্রতিবাদটি ২৬ মার্চ গাজার উত্তরের বেইত লাহিয়ায় হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত
হামাসের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা খুব কমই দেখা যায়, কারণ প্রতিবাদ করলে তা জোর করে থামিয়ে দেওয়া হয় এবং বিরোধীদের জেলে পাঠানো হয়, নির্যাতন করা হয়, এমনকি মেরে ফেলা হয়। এ প্রতিবাদটি ২৬ মার্চ গাজার উত্তরের বেইত লাহিয়ায় হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত

চলে যাও! চলে যাও! চলে যাও! টেলিগ্রাম ভিডিওতে উচ্চকিত কণ্ঠে চলছে এ স্লোগান। কখনো বা সুরে সুরে। বার্তা খুবই স্পষ্ট। আর তা হচ্ছে, ‘হামাসের সবাই হটো।’

গাজার রাস্তায় রাস্তায় আগের চেয়েও অনেক বেশি ফিলিস্তিনি প্রকাশ্যেই ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, যে গোষ্ঠীটি প্রায় ২০ বছর শাসন করে আসছে গাজা।

ছোট্ট, দরিদ্র ভূখণ্ড গাজাকে ৭০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বাজে সংকটে ফেলে দেওয়ার জন্য অনেকেই হামাসকে দায়ী করছেন। গাজার ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাস্তায় আরেক দল বিক্ষোভকারী ‘হামাস জঞ্জাল’—এ বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার ডাক দিয়েছে।

উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায় যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে এবং হামাসবিরোধী স্লোগানে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স
উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায় যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে এবং হামাসবিরোধী স্লোগানে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

গাজায় হামাসের সমালোচক এক সাবেক রাজবন্দী ও আইনজীবী মোমেন আল-নাতুর বলেন, গাজার পরিস্থিতিতে বিশ্ব ধোঁকা খাচ্ছে। তাঁর কথায়, বিশ্ব মনে করছে গাজা মানেই হামাস, আর হামাস মানেই গাজা। আমরা হামাসকে বেছে নেইনি। অথচ হামাস এখন গাজা শাসন করতে বদ্ধপরিকর এবং তারা তাদের সঙ্গে আমাদের ভাগ্যও বেঁধে নিয়েছে। হামাসকে অবশ্যই সরে যেতে হবে।’

গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে কথা বলাও বিপজ্জনক। হামাস কখনোই ভিন্নমত সহ্য করেনি। এ পরিস্থিতির মধ্যে মোমেন আল-নাতুর ছিলেন নির্ভীক।

গত মার্চের শেষ দিকে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে একটি কলামে মোমেন আল-নাতুর লেখেন, হামাসকে সমর্থন দেওয়া মানে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা নয়; বরং ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুকেই সমর্থন করা।

বিবিসি জেরুজালেমের এক সাংবাদিক মোমেনকে জিজ্ঞেস করেন, এভাবে কথা বলা বিপজ্জনক নয় কি? এ প্রশ্নের জবাবে মোমেন নির্দ্বিধায় বলেন, ‘আমাদের ঝুঁকি নিয়েই কথা বলতে হয়।’

মোমেন জানান, এখন তাঁর বয়স ৩০। আর বয়স যখন ১১ ছিল তখন হামাস গাজার শাসনভার নিয়েছিল। কিন্তু তাঁর জীবনে কী হয়েছে? তাঁর জীবনটা কেবল যুদ্ধ আর বাড়তে থাকা সহিংসতার মধ্য দিয়েই নষ্ট হয়েছে। লাভের লাভ কিছুই হয়নি।

হামাস রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে সহিংস পন্থায় হটিয়ে ২০০৭ সালে গাজার শাসনক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে তিনটি বড় যুদ্ধ এবং দুটো ছোটখাটো সংঘাত হয়েছে।

মোমেন বলেন, ‘হামাসের দমনপীড়নের পরও তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আওয়াজ তোলাটা মানবতার দাবি।’

হামাস ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার মধ্যেও তাদের সমালোচকদের শাস্তি দিতে পিছপা হচ্ছে না। গত মার্চের শেষ দিকে হামাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে এই গোষ্ঠীটি উদয় আল-রুবাই নামের এক ফিলিস্তিনিকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

সশস্ত্র বন্দুকধারীরা রুবাইকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। পরে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। রুবাইয়ের পরিবার এই মৃত্যুর জন্য হামাসকে দায়ী করেছে এবং ন্যায়বিচার চেয়েছে।

হামাসের হাতে নিহত উদয় আল-রুবাই। ছবি: সংগৃহীত
হামাসের হাতে নিহত উদয় আল-রুবাই। ছবি: সংগৃহীত

রুবাইয়ের শেষকৃত্যে বেশ কিছু ফিলিস্তিনি এ হত্যাকাণ্ডের বদলা নেওয়া এবং হামাসকে গাজা থেকে সরে যাওয়ার দাবি তোলে। এর আগে, গত গ্রীষ্মে হামাসের বিরুদ্ধে কথা বলে রুবাইয়ের মতো প্রায় একই ভাগ্যবরণ করেছিলেন আমিন আবেদ নামের আরেক ফিলিস্তিনি।

মুখোশ পরা বন্দুকধারীরা তাঁকে পিটিয়ে অচেতন করে। শরীরের হাড় ভেঙে দেয়, এমনকি কিডনিও ক্ষতিগ্রস্ত করে। আবেদ কোনোভাবে প্রাণে বাঁচলেও তাঁকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল।

এখন আবেদ দুবাইয়ে থাকেন। এখনো তিনি হামাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাঁর বিশ্বাস, হামাসের কর্তৃত্ব খর্ব হয়ে গেছে। তাদের ক্ষমতা শেষ হয়ে আসছে।

আবেদ বলেন, হামাস মানুষজনকে আতঙ্কে রাখতে অধিকারকর্মী, নিরীহ মানুষদের পেটায়, হত্যা করে। তবে এখন আর আগের সে দিন নেই।

হামাসের দীর্ঘদিনের সমালোচক আমিন আবেদকে গত বছর গাজায় মুখোশধারী সশস্ত্র ব্যক্তিরা মারধর করেন। ছবি: সংগৃহীত
হামাসের দীর্ঘদিনের সমালোচক আমিন আবেদকে গত বছর গাজায় মুখোশধারী সশস্ত্র ব্যক্তিরা মারধর করেন। ছবি: সংগৃহীত

গত মাসে গাজায় যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ার পর থেকে ইসরায়েলের অবিরাম হামলায় হামাসের বন্দুকধারীরা এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে। আর গাজাবাসীরা আবার যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে পড়ে গেছে।

সম্প্রতি গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তা থেকে বোঝা যায় সেখানে ইসরায়েলের লাগাতার বোমা হামলায় কোণঠাসা হয়ে পড়া সাধারণ মানুষেরা এখন আর হামাসের ভয়ে ভীত নন।

গাজার উত্তরাঞ্চলের বেইত লাহিয়ায় ইদানীং হামাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরাল বিরোধিতা দেখা গেছে। সেখানে কয়েকটি ঘটনায় স্থানীয় মানুষেরা তাদের লোকালয়ের মধ্য থেকে হামাস যোদ্ধাদেরকে সামরিক অভিযান চালাতে দেয়নি।

এমনই একটি ঘটনার বর্ণনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৩ এপ্রিলে হামাসের এক যোদ্ধা বেইত লাহিয়ার এক বয়স্ক মানুষ জামান আল-মাজনানের বাড়িতে ঢুকে সেখান থেকে রকেট ছুড়তে চেয়েছিল; কিন্তু তা করতে দেননি সেই বৃদ্ধ।

আশপাশের আরও বাসিন্দারা তখন আল-মাজনানের পাশে এসে দাঁড়ান। এরপর বন্দুকধারীরা গুলি চালালে কয়েকজন আহত হন। তবে শেষ পর্যন্ত বন্দুকধারীদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

বন্দুকধারীদের বুলেটেও প্রতিবাদী মানুষেরা ভয় পাননি। বরং বন্দুকধারীদের সামনে এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, তাদের জিনিসপাতি নিয়ে চলে যেতে। প্রতিবাদকারীরা বলেছিলেন, ‘আমরা আপনাদেরকে (বন্দুকধারী) এখানে চাই না। আমরা আপনাদের অস্ত্র চাই না, যে অস্ত্র আমাদেরকে ধ্বংস, বিপর্যয় আর মৃত্যু এনে দিয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

যুদ্ধের মধ্যেই গাজায় দুবার সন্তান প্রসবের ভয়াবহ স্মৃতি হাদিলের

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
হাদিল আল ঘেরবাওয়ির কোলে ছেলে জাওয়াদ। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
হাদিল আল ঘেরবাওয়ির কোলে ছেলে জাওয়াদ। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

‘এই বিভীষিকা আমি কখনো ভুলতে পারব না’—বলছিলেন হাদিল আল ঘেরবাওয়ি। ২৬ বছর বয়সী এই ফিলিস্তিনি নারী গাজা যুদ্ধে চরম ক্ষুধা, ভয় আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই দুটি গর্ভধারণ ও দুবার সন্তান জন্ম দিয়েছেন।

সোমবার (২২ ডিসেম্বর) যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান-ভিত্তিক ইনডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর সময় হাদিল সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ হওয়ায় তিনি নিয়মিত ডাক্তার দেখাতেন, আলট্রাসাউন্ড করাতেন এবং ভিটামিন নিতেন। গাজা সিটির পূর্বাংশে ইসরায়েল সীমান্তের কাছে বসবাস করায় যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিনই তিনি গাজার পশ্চিম অংশে বসবাস করা বাবা-মায়ের বাড়িতে চলে যান। হাদিল ভেবেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি আবার স্বামীর বাড়িতে ফিরে যাবেন। কিন্তু এরপর পরিবারটি অন্তত ১৩ বার বাস্তুচ্যুত হয় এবং স্বামীর বাড়িটিও একদিন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসেই গাজা সিটিতে একটি আবাসিক ভবনে বড় ধরনের হামলার কাছাকাছি অবস্থানে ছিলেন হাদিল। তাঁর কাছে এটিকে একটি ভূমিকম্প মনে হয়েছিল। পরে আশ্রয় নেন আল-শিফা হাসপাতালে। সেখানে অন্যান্য আশ্রয়প্রার্থীর ভিড় এত বেশি ছিল যে, বাথরুম ব্যবহার করাও প্রায় অসম্ভব ছিল। সেদিনের দৃশ্য আজও তাড়া করে ফেরে হাদিলকে। স্তূপ করে রাখা লাশ, ড্রামে রাখা খণ্ড-বিখণ্ড অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর তীব্র গন্ধ। তিনি বলেন, ‘আমি গর্ভবতী ছিলাম, সহ্য করতে পারিনি।’

অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে—নিরাপত্তার আশায় এবার তিনি ও তাঁর স্বামী খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে যান এবং চিকিৎসকদের কাছে আগেভাগেই সন্তান প্রসবের অনুরোধ করেন। হাদিল যখন সন্তান প্রসব করছিলেন, তখন হাসপাতালটির পাশের ভবনেই হামলা হয় এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশৃঙ্খল এই পরিস্থিতিতে সন্তান বদলে যাওয়ার আতঙ্কও গ্রাস করেছিল হাদিলকে। তবে আতঙ্কের মধ্যেই শেষ পর্যন্ত তিনি ছেলে জাওয়াদের জন্ম দেন।

নবজাতক নিয়ে হাদিলকে ৩০ জনের সঙ্গে একটি কক্ষে গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছিল। সেই সময়টিতে সেলাইয়ের তীব্র ব্যথার মধ্যেও তিনি কোনো ওষুধ পাননি; রাতের পর রাত চুপচাপ এই ব্যথা সহ্য করেছেন। তাঁর ধারণা, প্রসবের পর তিনি বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।

কয়েক মাস পর তাঁরা একটি তাঁবুতে ওঠেন। বালু, পোকামাকড় আর প্রচণ্ড ঠান্ডায় একের পর এক নবজাতকের মৃত্যুর খবরে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন হাদিল। রাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বারবার জেগে উঠতেন। জাওয়াদের বয়স ৯ মাস হলে আবারও গর্ভবতী হন তিনি। হাদিল বলেন, ‘তাঁবুতে থেকে আরেকটি সন্তান—ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিলাম।’

চলতি বছরের জানুয়ারিতে সাময়িক যুদ্ধবিরতির খবর কিছুটা আশা জাগিয়েছিল তাঁদের। সেই আশা থেকেই ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে যান। কিন্তু ছয় সপ্তাহ পরই ভেঙে যায় যুদ্ধবিরতি। পেটে সন্তান নিয়ে আবারও পালাতে হয় হাদিলকে। পালানোর পর তাঁদের বাড়িটিও ধ্বংস হয়ে যায়। যুদ্ধের মধ্যে দ্বিতীয় গর্ভধারণ হাদিলের জন্য ছিল সবচেয়ে কঠিন। এই সন্তান পেটে রাখার ৯ মাসই তাঁর যুদ্ধের মধ্যে কেটেছে। এমনও দিন গেছে, সারা দিন শুধু একটি শসা খেয়ে কাটিয়েছেন। আর কোথাও এক মুঠো খাবার পেলে নিজের ভাগটুকু তিনি ছেলে জাওয়াদকে দিতেন।

দ্বিতীয়বার প্রসবের সময়ও তিনি বাবা-মায়ের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। কারণ ওই বাড়ি থেকে কাছাকাছি একটি হাসপাতালে নবজাতক সুরক্ষার জন্য ইনকিউবেটর ছিল। এক রাতে প্রসবব্যথা শুরু হলে, লিফট না থাকায় পাঁচ তলা থেকে হেঁটেই নামতে হয় হাদিলকে। পরে তিনি অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেন এবং ওই হাসপাতালে দ্বিতীয় ছেলে ফারেসের জন্ম দেন। জন্মের সময় ফারেসের ওজন ছিল মাত্র ২ কেজি।

এবারে অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই সেলাই দেওয়া হয় হাদিলকে। আর অন্যকে সুযোগ করে দিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিছানা খালি করে তাঁকে চেয়ারে বসে থাকতে হয়। ফারেসের জন্মের পাঁচ ঘণ্টা পর, চরম ক্লান্তি ও ব্যথা নিয়ে তিনি আবার পাঁচ তলা সিঁড়ি বেয়ে বাবা-মায়ের ঘরে ফেরেন। এই যুদ্ধ, তাঁর শরীর ও মনে রেখে গেছে এমন ক্ষত—যা ভুলবার নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আসাদের খালি হয়ে যাওয়া কুখ্যাত কারাগারগুলো ভরে উঠছে আবার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
বাশার আল-আসাদের পতনের পর খালি হয়ে গিয়েছিল হোমসের এই কারাগারটি। ছবি: রয়টার্স
বাশার আল-আসাদের পতনের পর খালি হয়ে গিয়েছিল হোমসের এই কারাগারটি। ছবি: রয়টার্স

বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার মানুষ ভেবেছিল—দেশটির কুখ্যাত কারাগার অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে। বিদ্রোহীরা জেলখানার দরজা ভেঙে বন্দীদের মুক্ত করেছিল, পরিবারের লোকেরা ছুটে গিয়েছিল নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে। কিন্তু এক বছর না পেরোতেই সেই কারাগারগুলো আবার ভরে উঠছে। এবার নতুন সরকারের অধীনেই সিরিয়ায় আবারও ফিরে এসেছে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও চাঁদাবাজির অভিযোগ।

রয়টার্সের এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গত এক বছরে অন্তত ৮২৯ জন নিরাপত্তাজনিত কারণে আটক হয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আটক ব্যক্তিদের বড় অংশই কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ বা আদালতের আদেশ ছাড়াই বন্দী রয়েছেন।

সোমবার (২২ ডিসেম্বর) প্রকাশিত রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় প্রথম দফার গ্রেপ্তার শুরু হয়েছিল বিদ্রোহীদের বিজয়ের পরপরই। সে সময় মূলত আসাদের আমলের সেনা সদস্য ও কর্মকর্তাদের আটক করা হয়েছিল। পরে শীতের শেষ দিকে উপকূলীয় অঞ্চলে সহিংসতার জের ধরে আলাউইত সম্প্রদায়ের শত শত মানুষ গ্রেপ্তার হন। বসন্ত ও গ্রীষ্মে দ্রুজ অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলেও ব্যাপক ধরপাকড় চলে। একই সঙ্গে সুন্নি, খ্রিষ্টান ও শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনও ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’ বা আসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অস্পষ্ট অভিযোগে আটক হন।

রয়টার্স জানিয়েছে, আসাদ আমলের অন্তত ২৮টি কারাগার ও আটক কেন্দ্র আবার সক্রিয় হয়েছে। এগুলোর অনেকগুলোই অতীতে নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত ছিল। যদিও বর্তমান সরকার বলছে, অপরাধীদের বিচারের প্রয়োজনে এসব কেন্দ্র ব্যবহার করা হচ্ছে এবং অনেক বন্দীকে ইতিমধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তবে কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান তারা প্রকাশ করেনি।

সাক্ষাৎকারে সাবেক বন্দী ও স্বজনেরা জানিয়েছেন, আটক কেন্দ্রগুলোতে ভয়াবহ মানবেতর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গাদাগাদি করে বন্দী রাখা, খাবার ও চিকিৎসার অভাব, ত্বকের রোগ এবং নিয়মিত মারধরের অভিযোগ রয়েছে। অন্তত ১১ জন বন্দী কারা হেফাজতে মারা গেছেন বলে নথিভুক্ত করেছে রয়টার্স। এদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পরিবার জানতই না—দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর তারা বিষয়টি জানতে পারে।

চাঁদাবাজিও নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ১৪টি পরিবার জানিয়েছে, স্বজনকে মুক্তির বিনিময়ে ৫০০ থেকে ১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত দাবি করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এই অঙ্ক ৯০ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থ পরিশোধের পরও অনেকেই মুক্তি পাননি।

এদিকে সরকার স্বীকার করেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনের সময় কিছু ‘ফাঁকফোকর’ তৈরি হয়েছে এবং কিছু নিরাপত্তা সদস্য নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে। তাদের দাবি, চাঁদাবাজি ও সহিংসতার ঘটনায় অন্তত ১৫৯ জন নিরাপত্তা সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ব্যাপক আটক ও গুমের অভিযোগ নতুন সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরও আসাদের পতনের পর ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্বিচার আটক’-এর তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে।

আসাদের শাসনামলের মতো নির্মম নির্যাতন না হলেও, পুরোনো কারাগার ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন সিরিয়ার নতুন ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করছে। মানবাধিকারকর্মীদের ভাষায়, ‘শাসক বদলেছে, কিন্তু কারাগারের ছায়া এখনো কাটেনি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

মস্কোতে গাড়িবোমা হামলায় রুশ জেনারেল সারভারভ নিহত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
জেনারেল সারভারভের গাড়ির নিচে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক ডিভাইস পেতে রাখা হয়েছিল। ছবি: রয়টার্সের সৌজন্যে
জেনারেল সারভারভের গাড়ির নিচে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক ডিভাইস পেতে রাখা হয়েছিল। ছবি: রয়টার্সের সৌজন্যে

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে এক ভয়াবহ গাড়িবোমা হামলায় দেশটির শীর্ষস্থানীয় এক জেনারেল নিহত হয়েছেন। আজ সোমবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে এ ঘটনা ঘটে বলে রুশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি রাশিয়ার ইনভেস্টিগেটিভ কমিটির বরাতে জানিয়েছে, নিহত ব্যক্তির নাম লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফানিল সারভারভ (৫৬)। তিনি রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর অপারেশনাল ট্রেনিং বিভাগের প্রধান ছিলেন।

তদন্ত কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আজ স্থানীয় সময় সকালে মস্কোর দক্ষিণাঞ্চলের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের পার্কিং লটে এই বিস্ফোরণ ঘটে। জেনারেল সারভারভের গাড়ির নিচে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক ডিভাইস পেতে রাখা হয়েছিল। গাড়িটি চালু করার পরপরই সেটির বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে গুরুতর আহত অবস্থায় সারভারভকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।

ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা গেছে, একটি সাদা রঙের গাড়ি বিস্ফোরণে দুমড়েমুচড়ে গেছে এবং সেটির যন্ত্রাংশ উড়ে গিয়ে পাশে থাকা অন্য যানবাহনের ওপর পড়েছে।

রুশ ইনভেস্টিগেটিভ কমিটি এ ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে অভিহিত করে তদন্ত শুরু করেছে। প্রাথমিক তদন্তে রুশ কর্মকর্তাদের ধারণা, এই হামলার নেপথ্যে ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাত থাকতে পারে। তবে ইউক্রেন এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, জেনারেল সারভারভের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরপরই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে তা জানানো হয়েছে।

৫৬ বছর বয়সী ফানিল সারভারভ রুশ সামরিক বাহিনীর অত্যন্ত অভিজ্ঞ কর্মকর্তা ছিলেন। রুশ গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ফানিল সারভারভ নব্বইয়ের দশক এবং ২০০০ সালের শুরুতে তিনি ওসেটিয়ান-ইঙ্গুশ সংঘাত ও চেচেন যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৫-১৬ সালে সিরিয়ায় রুশ সামরিক অভিযানেও তিনি নেতৃত্ব দেন।

২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান শুরু করার পর থেকে মস্কোতে হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের ওপর বেশ কয়েকটি বড় হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র আলেকজান্ডার দুগিনের কন্যা দারিয়া দুগিনা গাড়িবোমা হামলায় নিহত হন।

চলতি বছরের এপ্রিলে জেনারেল ইয়ারোস্লাভ মোসকালিক ও ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল ইগর কিরিলভও একই ধরনের হামলায় প্রাণ হারান।

নীতিগত কারণে ইউক্রেন সাধারণত এ ধরনের হামলার দায় স্বীকার করে না। তবে গত বছর জেনারেল কিরিলভ নিহতের ঘটনায় ইউক্রেনীয় নিরাপত্তা সংস্থার জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিল বিবিসির একটি সূত্র।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘হিন্দু রাষ্ট্র’ সংবিধানে থাকতে হবে না, এটি সূর্যোদয়ের মতোই সত্য: আরএসএস প্রধান

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
কলকাতায় আরএসএসের শতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে আয়োজিত ‘১০০ ব্যাখ্যান মালা’ অনুষ্ঠানে মোহন ভাগবত। ছবি: সংগৃহীত
কলকাতায় আরএসএসের শতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে আয়োজিত ‘১০০ ব্যাখ্যান মালা’ অনুষ্ঠানে মোহন ভাগবত। ছবি: সংগৃহীত

ভারত একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ এবং এর জন্য কোনো সাংবিধানিক অনুমোদনের প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত। তাঁর মতে, এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য এবং সূর্য পূর্বদিকে ওঠার মতোই ধ্রুব।

গতকাল রোববার (২১ ডিসেম্বর) কলকাতায় আরএসএসের শতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে আয়োজিত ‘১০০ ব্যাখ্যান মালা’ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

সংবিধানে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ শব্দ জোড়ানোর কোনো পরিকল্পনা বা দাবি সংঘের আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে মোহন ভাগবত বলেন, ‘সূর্য পূর্বদিকে ওঠে; আমরা জানি না কত দিন ধরে এটি ঘটছে। এর জন্য কি আমাদের সাংবিধানিক অনুমোদনের প্রয়োজন আছে? হিন্দুস্তান একটি হিন্দু রাষ্ট্র। যারা এই দেশকে মাতৃভূমি মনে করে এবং ভারতীয় সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করে, তারা সবাই এই দর্শনের অংশ।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংসদ যদি কখনো সংবিধান সংশোধন করে এই শব্দটি যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তা ভালো। কিন্তু তারা তা করুক বা না করুক—তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না। কারণ, সত্য এটাই যে আমাদের দেশ একটি হিন্দু রাষ্ট্র।’

জাতপাত নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে আরএসএস প্রধান স্পষ্ট করে বলেন, ‘জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথা বা জাতপাত হিন্দুত্বের বৈশিষ্ট্য নয়।’

আরএসএসকে প্রায়ই মুসলিমবিরোধী হিসেবে গণ্য করা হয়। এই প্রসঙ্গে মোহন ভাগবত মানুষকে সরাসরি সংঘের শাখা বা অফিসগুলো ঘুরে দেখার আমন্ত্রণ জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ অত্যন্ত স্বচ্ছ। আপনারা যেকোনো সময় এসে দেখে যান। যদি আমাদের কার্যক্রমে মুসলিমবিরোধী কিছু খুঁজে পান, তবে আপনাদের ধারণা বজায় রাখুন। কিন্তু যদি তা না দেখেন, তবে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করুন।’

তিনি দাবি করেন, মানুষ এখন বুঝতে পারছে যে আরএসএস হিন্দুদের সুরক্ষার কথা বলে এবং তারা কট্টর জাতীয়তাবাদী, কিন্তু তারা ‘মুসলিমবিরোধী’ নয়।

উল্লেখ্য, ভারতের সংবিধানের মূল প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ (Secular) শব্দটি ছিল না। ১৯৭৬ সালে জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধী সরকারের আনা ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে এটি যুক্ত করা হয়। অন্যদিকে, আরএসএস দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে, ভারতের সংস্কৃতি এবং জনতাত্ত্বিক কাঠামোর কারণেই এটি প্রাকৃতিকভাবে একটি হিন্দু রাষ্ট্র।

তথ্যসূত্র: এনডিটিভি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত