স্বাধীনতার আড়াই শ বছরেও বর্ণবাদ থেকে মুক্তি মেলেনি

ইমরান খান
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২১, ১৮: ৩২
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২১, ১৯: ৫৫

এই করোনা মহামারির মধ্যেই আজ ৪ জুলাই উদ্‌যাপন করছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশটি যে পথচলা শুরু করেছিল, তা গত প্রায় আড়াই শ বছরে শুধু স্থিতিই পায়নি, গোটা বিশ্বের মোড়লের খ্যাতিও তাকে এনে দিয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে যে যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বকে আশার আলো দেখিয়েছিল, ঐক্যের ভবিষ্যতের, সেই যুক্তরাষ্ট্রের নামই ২৪৫ বছর পর আজ নানা কারণে উঠে আসে বিভাজনের উদ্গাতা হিসেবে। দেশে দেশে বৈরিতা বা দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখার কারিগর হিসেবে যেমন, তেমনি নিজ দেশেও বিভাজনের রেখাটি গত কয়েক বছরে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 

 ১৭৭৬ সালে প্রধান সেনাপতি জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী বিতাড়িত করার পর ওই বছরের ৪ জুলাই টমাস জেফারসন রচিত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ গৃহীত হয়। আর এর মধ্য দিয়ে ১৩টি আমেরিকান উপনিবেশ একসঙ্গে স্বাধীন হয়। সেই স্বাধীন উপনিবেশগুলোই আজকের ‘যুক্তরাষ্ট্র’। সেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রথম ভাগেই সুস্পষ্টভাবে প্রত্যেক মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা কেড়ে নেওয়া যায় না। এই অধিকারের তালিকায় কী কী আছে? আছে বেঁচে থাকার অধিকার, আছে সুখান্বেষণ ও স্বাধীনতার অধিকার। এই এক স্বাধীনতার প্রশ্নেই সর্বস্তরের মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় আড়াই শতাব্দী পরও এর অনেক কিছুই কাগুজে থেকে গেল। এত দিন এটি খোলসের নিচে চাপা ছিল। কিন্তু গত বছর করোনাকালে জর্জ ফ্লয়েড যখন পুলিশি নির্যাতনে নিহত হলেন, তখনই বোঝা গেল কত অসংগতি এখনো রয়ে গেছে সবাইকে আধুনিকতা, সমানাধিকার ও গণতন্ত্র শেখানো রাষ্ট্রটির ভেতরে। 

যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে এখনো নানা মোড়কে বর্ণবাদ, জাতি বিদ্বেষ, লিঙ্গবৈষম্যের নমুনা দেখা যায়। ১৯৬০–এর দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দেশটির বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্ট জাতিগত বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন। এ তালিকায় রিচার্ড নিক্সন যেমন আছেন, তেমনি আছেন সদ্য সাবেক হওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকি রোনাল্ড রিগানও মনে করতেন—দারিদ্র্য একটি আফ্রিকান–আমেরিকান সমস্যা। আর ট্রাম্পের কথা বলতে গেলে আঙুল ব্যথা (যেহেতু কালি ফুরোনোর কালও বিগত) হয়ে যাবে। এখানে বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়া এবং এই নিয়ে ‘গেল গেল’ রব ওঠার বিষয়টিও স্মরণ করা যেতে পারে। 

তারপরও দু–একটি উদাহরণ তুলে দিতেই হয়। প্রথমেই এ ক্ষেত্রে দগদগে ঘা হিসেবে জর্জ ফ্লয়েডের কথা আসতে হবে। ২০২০ সালের ২৫ মে আফ্রিকান-আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডের মর্মান্তিক মৃত্যু দেখেছে বিশ্ব। মিনিয়াপোলিস শহরে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শোভিনের হাঁটুর চাপে নিথর হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগে বারবার তিনি বলেছিলেন একটি কথা—‘আই কান্ট ব্রিদ’। এই তিনটি শব্দ সে সময় গোটা দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। গোটা দুনিয়া সে সময় আক্ষরিক অর্থেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে দেখছিল জর্জ ফ্লয়েডের মরে যাওয়া। দেখছিল মহাশক্তিধর ও ‘অগ্রসর’ একটি দেশের পাঁজরের গহিনে লুকিয়ে থাকা বর্ণবাদের মঞ্চায়ন। এই ঘটনায় বিশ্বব্যাপী ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। হ্যাঁ, শোভিনের বিচার হয়েছে। বিচারে তাঁকে সাড়ে ২২ বছর সাজা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শার্লোৎসভিল? 

হয়তো এত দিনে অনেকেই ভুলে গেছেন শার্লোৎসভিলের ঘটনা। সেখানে বর্ণবাদের অভিযোগ থাকা মার্কিন জাতীয় এক নেতার ভাস্কর্য অপসারণের জন্য আন্দোলন করছিলেন কিছু মানুষ। তাদের ওপর তখন হামলা করেছিল রণসাজে সেজে আসা শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরা। ঘটনা এখানে থামলে চলত। এই ঘটনায় শুরুতে পুরোপুরি নীরব থাকা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন মুখ খুললেন, তখন তিনি প্রকারান্তরে পক্ষ নিলেন উগ্র শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠীটিরই। 

এটা না হওয়ার কোনো কারণ নেই। ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো শপথ নিতেই পারতেন না, যদি মার্কিন সমাজের গহিনে এই বর্ণবাদ ও জাতিবিদ্বেষ লুকিয়ে না থাকত। ট্রাম্প সরাসরি বর্ণবাদী নানা মন্তব্য ও বিতর্কিত সব প্রতিশ্রুতি করেই ক্ষমতায় এসেছিলেন। ফলে তাঁর নির্বাচিত হওয়াটাই বলে দেয় মার্কিন সমাজে এখনো কী পরিমাণ বর্ণ ও জাতিবিদ্বেষ রয়েছে। 

কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষ ছাড়াও ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বিভিন্ন দেশের অভিবাসী জনগোষ্ঠী ও মুসলমানদের সম্পর্কে উসকানিমূলক বক্তব্য, অভিবাসন নিষিদ্ধকরণ, বাণিজ্য যুদ্ধ এবং বিতর্কিত নির্বাসন নীতি গ্রহণ করেন। মুসলমানদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন কঠিন করে তোলেন। ট্রাম্পের বর্ণবাদী নীতিগুলোর বেশির ভাগই তাঁর প্রাক্তন উপদেষ্টা বর্ণবাদে অভিযুক্ত রাজনীতিক স্টিফেন ব্যাননের পরিকল্পনা। 

ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা যায়, করোনা শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রে এশীয়দের বিরুদ্ধে জাতিগত বিদ্বেষ প্রায় দেড় শ শতাংশ বেড়েছে। এ সময় আটলান্টার তিনটি স্পা সেন্টারে হামলা করে আট নারীকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে ছয়জনই এশিয়ার। এই সময় পথে–ঘাটে এশীয় লোক দেখলে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা হেনস্তা করছে বলেও গণমাধ্যমে বহু খবর এসেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এশীয় মার্কিনরা বর্ণবিদ্বেষের মতো ভীতিকর অবস্থায় দিন কাটিয়েছেন। করোনাকাল ছাড়াও মধ্য এশীয়-আমেরিকানদের প্রায়ই জাতিগত বিদ্বেষ, সহিংসতা ও ঘৃণামূলক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। 

নাগরিক অধিকার নিয়ে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনের সঙ্গে বৈঠক শেষে বক্তব্য রাখছেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। ৩ ডিসেম্বর, ১৯৬৩এখন পর্যন্ত ৪৬ জন প্রেসিডেন্ট পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে কোনো নারী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেননি বা নির্বাচিতও হননি। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনে কয়েকজন অংশ নিলেও নির্বাচিত হতে পারেননি। গেল দুবার হিলারি ক্লিনটন ব্যর্থ হয়েছেন। সর্বশেষ নির্বাচনে কমলা হ্যারিস, এলিজাবেথ ওয়ারেনের মতো প্রার্থীরা ছিলেন। কিন্তু তাঁদের কেউই জায়গাটি নিতে পারেননি। হিলারি ছাড়া আর কেউ এমনকি দলীয় মনোনয়নই পাননি। এ ক্ষেত্রে ‘নারীকে ছোট করে দেখার’ অভিযোগটি বেশ জোরেশোরে উঠেছে। এই অভিযোগের ভিত্তিও বেশ শক্ত। যে কারণে নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বিভিন্ন পদে নারী কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি বেশ জোরের সঙ্গে ঘোষণা করতে দেখা যায়। শুধু প্রেসিডেন্ট কেন, একজন বাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসকে পেতে যুক্তরাষ্ট্রকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২৪৪ বছর। 

কথা হলো এত উন্নয়ন, এত প্রাযুক্তিক সামর্থ্য, বিজ্ঞান ও গবেষণায় এত অগ্রগতি সত্ত্বেও একটি দেশ কেন বর্ণবাদের মতো বিষ সযত্নে পুষে রাখে। একটু উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নানা সমস্যার পেছনে অভিবাসীদের দায়ী করার প্রবণতা বেশ পুরোনো। অথচ এই অভিবাসীরা প্রতি বছর বিরাট অঙ্কের অর্থ কর হিসেবে পরিশোধ করে। দেশটির উৎপাদন সক্ষমতা, উচ্চশিক্ষাসহ বহু ক্ষেত্রেই অভিবাসীরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে। এক সিলিকন ভ্যালির দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। তাহলে যেকোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক সংকটে অভিবাসীদের দিকে আঙুল তোলার প্রবণতাটি কেন? উত্তর সহজ, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে না চাপলে উদো দায়মুক্ত হবে কী করে? ঠিক, প্রশাসনই সুকৌশলে এই কাজটি করে। তারা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে বরাবরই একটি বলির পাঁঠা খুঁজে বের করে। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীরাই এই বলির পাঁঠা। 

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়ে গেছেন নোবেলজয়ী আফ্রিকান-আমেরিকান মানবাধিকার কর্মী মার্টিন লুথার কিং। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বক্তৃতা ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ তাঁকে অমর করে রেখেছে। মার্টিনের আন্দোলনের মূল কথাই ছিল বর্ণ, গোত্রের কারণে কেউ যেন বৈষম্যের শিকার না হন। সবাই যেন সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার পান। ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল মহান এই নেতাকেও প্রাণ দিতে হয়েছে শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থী আততায়ীর গুলিতে। প্রতি বছর কিংয়ের জন্য আলাদা একটি দিন রয়েছে। সেই দিনটিতে কিংকে স্মরণ করা হয়। নেতারা বক্তৃতা করেন। কিন্তু কিংয়ের যে স্বপ্ন, তা আজও অধরা থেকে গেছে। এমনকি এই করোনাকালে টিকা কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও উঠেছে বর্ণবাদের অভিযোগ। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। বহু বর্ণের মানুষের সম্মিলনে গড়ে ওঠা দেশটির হওয়ার কথা ছিল সত্যিকারের উদার এক দেশ। বাইডেন অনেক আশ্বাস দিচ্ছেন। তিনি সফল হোন—এটাই সবাই চায়। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত