মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

ঝুলন্ত অঙ্গরাজ্যই ভাগ্যবিধাতা

জাহীদ রেজা নূর, নিউইয়র্ক থেকে
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১: ১০
ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

শুক্রবার সকাল থেকেই নিউইয়র্ক মহানগরের আকাশের মুখ ভার। আকাশজুড়ে মেঘের দৌরাত্ম্য। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে অবশ্য বলা হয়েছে, কখনো কখনো একটু সূর্যের মুখ দেখাও যেতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোন প্রার্থীর জীবনটাই আপাতত মেঘলা করে দেবে, আর কোন প্রার্থীর মুখে এনে দেবে ঝকঝকে রোদ্দুর, তা জানা যাবে আর কটা দিন পরই।

বরাবরের মতো এবারও দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোই ঠিক করে দেবে কে হবেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মাত্র কয়েকটি অঙ্গরাজ্যই পাল্টে দেয় সব হিসাব-নিকাশ। দেশটির বেশির ভাগ অঙ্গরাজ্যই আগে থেকে ঠিক করে নেয়, কার পক্ষে যাবে। এই যেমন নিউইয়র্ক হলো ডেমোক্র্যাটদের ঘাঁটি। এই অঙ্গরাজ্যের মানুষ এখন পর্যন্ত নীল ডেমোক্র্যাটদের ওপরই ভরসা রেখে চলেছে। তেমনি কানেটিকাট, ভারমন্ট, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নিউজার্সি, ক্যালিফোর্নিয়া, অরেগন, ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যও ডেমোক্র্যাটদের বিশ্বাস করে এসেছে সব সময়। অন্যদিকে লাল রিপাবলিকানদেরই ভালোবাসে অ্যালাবামা, আরকানসাস, ওয়াইওমিং, আলাস্কার মতো অঙ্গরাজ্যগুলো। এই অঙ্গরাজ্যগুলোয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা খুব বেশি চাপের মধ্যে থাকেন না। যারা নীল, তারা সব সময়ই নীল। যারা লাল, তারা সব সময়ই লাল। যে রাজ্যগুলোকে সহজেই লাল-নীলে ভাগ করা যায় না, সেখানেই যত জ্বালা আর স্নায়ুর চাপ। এ রকম অঙ্গরাজ্যগুলোর মানুষের মন ভজাতে কী কষ্টটাই না করতে হয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের! এবার কমলা হ্যারিস আর ডোনাল্ড ট্রাম্পও বুঝতে পারছেন, এই অঙ্গরাজ্যগুলোই তাঁদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে।

দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলো তাই সব রাজনীতিবিদ ও সংবাদমাধ্যমের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। এসব রাজ্যে যাঁরা এখনো স্থির করেননি কাকে ভোট দেবেন, তাঁদের নিজের দিকে টানতে প্রাণপাত করে থাকেন প্রার্থীরা।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সরাসরি ভোট হয় না। এখানে আছে ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ বা নির্বাচকমণ্ডলী নামের একটি ব্যবস্থা। কোনো অঙ্গরাজ্যের জনগণ যাঁকে বেশি ভোট দেয়, তাঁর ভাগ্যেই যায় রাজ্যটির সব ‘ইলেকটোরাল ভোট’। একেই বলে ‘উইনার টেক অল’ পদ্ধতি। যেমন জনবহুল নিউইয়র্কে ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ২৮, ক্যালিফোর্নিয়ায় আরও বেশি, ৫৪টি। আবার জনবিরল উত্তর ডাকোটায় মাত্র ৩টি। মোট ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে যে প্রার্থী ২৭০টি বা তার বেশি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাবেন, তিনিই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।

কোন রাজ্যগুলো দোদুল্যমান

সব সময় একই অঙ্গরাজ্য দোদুল্যমান থাকে, তা নয়। এটা নির্ভর করে জনসংখ্যা, সামাজিক ঘটনাবলি এবং চলতি অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর। অর্থনীতিকে তালিকার প্রথমেই রাখতে হয়। তবে এ বছর গর্ভপাত প্রসঙ্গটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নির্বাচনে। গত শতকের সত্তরের দশকে সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাতের পক্ষে যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিলেন, সে রায় ভঙ্গ করে কোনো অঙ্গরাজ্য গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা নিতে পারত না। কিন্তু ২০২২ সালে গর্ভপাতবিরোধী সুপ্রিম কোর্টের আরেকটি আলোচিত রায় অঙ্গরাজ্যগুলোকে ইচ্ছেমতো গর্ভপাতবিরোধী অবস্থানে যাওয়ার পথ খুলে দিয়েছে। এতে অনেক নারী ক্ষুব্ধ। কমলা হ্যারিস লড়ছেন নারীর গর্ভপাতের অধিকার ফিরে পেতে। ট্রাম্প সেটা চান না। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, এই নির্বাচনে গর্ভপাত একটি জোরালো ঘটনা, যার ওপর প্রেসিডেন্ট কে হবেন, তা-ও অনেকটা নির্ভর করছে।

আমরা এবার দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর দিকে দৃষ্টি দিই। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যই অর্থনীতি ও জাতীয় প্রশ্নের পাশাপাশি রাজ্যের নিজস্ব সংকট ও সমস্যাকেও ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখে।

আরিজোনা

আরিজোনার মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো অভিবাসন। আরিজোনার পাশেই মেক্সিকো। ফলে সীমান্ত গলে অভিবাসীরা বেআইনিভাবে ঢুকে পড়ছে এই রাজ্যে। জো বাইডেন তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে প্রতিবেশী এই দেশের সঙ্গে আমেরিকার সমস্যার ‘মূল কারণ’ মোকাবিলা করে সীমান্ত সংকট সমাধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু কমলা তাতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে অনেকেই মনে করেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প সে সুযোগটা নির্বাচনী প্রচারণায় কাজে লাগাচ্ছেন।

মেক্সিকো থেকে বিপুল জনস্রোত এসে মিশে যাচ্ছে আরিজোনায়, ফলে তা জনসংখ্যার দিক থেকে হয়ে উঠছে বর্ধিষ্ণু। এই রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ মানুষই লাতিন আমেরিকার বংশোদ্ভূত। লাতিনেরাই এখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বড় ভূমিকা রাখবে।

২০২০ সালে আরিজোনায় জিতেছিলেন জো বাইডেন। আরিজোনার জন্য রয়েছে ১১টি ইলেকটোরাল ভোট।

জর্জিয়া

১৯৯২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জর্জিয়ায় জয়ী হয়েছেন রিপাবলিকানরা। শুধু ২০২০ সালে এসে দেখা গেল লাল জর্জিয়া এবার নীল হয়েছে। তবে হয়েছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। ট্রাম্প পেয়েছিলেন মাত্র ০.২ শতাংশ কম ভোট। এই অঙ্গরাজ্যের ৩৩ শতাংশ মানুষ কৃষ্ণাঙ্গ। কমলা হ্যারিস তাদের কাছে অগ্রাধিকার পেতে পারেন।

জর্জিয়ার একটি গ্র্যান্ড জুরি ২০২০ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে উল্টে দিতে চেয়েছেন বলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেছিল। এখন মামলাটি স্থগিত রয়েছে এবং নির্বাচনের আগপর্যন্ত তা বিচারের দিকে গড়াবে না।

২০২০ সালে জর্জিয়ায় জয়ী হয়েছিলেন জো বাইডেন। এই রাজ্যে ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ১৬।

মিশিগান

গাড়িশিল্পের জন্য বিখ্যাত মিশিগান। ডেট্রয়েট শহরটির কথাই ধরুন, এটি ফোর্ড, জেনারেল মোটরস, ক্রাইসলার গাড়ির জন্মভূমি। এই রাজ্যের লোকজনের জন্য গাড়ি কারখানায় চাকরি পাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বাইডেনের শাসনামলেই চীন থেকে কম দামে গাড়ি আমদানি থামানো হয়েছে অতিমাত্রায় গাড়ির ওপর শুল্ক আরোপ করে।

কিন্তু মিশিগানে এবারও ডেমোক্র্যাটরা জিতবেন, নিশ্চিত হয়ে সে কথা বলা যাচ্ছে না। বাইডেনের রাজনীতির, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর নাখোশ মিশিগানবাসীরা। ইসরায়েলকে সমর্থন করে বাইডেন সরকার ফেঁসেছে এই রাজ্যে। মিশিগানে অনেক আরবের বাস। তাদের নিজের দিকে টানতে না পারলে কমলার পক্ষে এই অঙ্গরাজ্যের ভোট নিজের দিকে আনা সম্ভব হবে না।

২০২০ সালে বাইডেন জিতেছিলেন এই রাজ্যে। ১৫টি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে মিশিগানে।

নেভাদা

নেভাদার জন্যও অভিবাসন একটি মূল সমস্যা। রাজ্যটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তের কাছে অবস্থিত। রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লাতিন আমেরিকান। এখানকার শহুরে জনসংখ্যার অংশ দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।

নেভাদা পর্যটনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। জো বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এই অঙ্গরাজ্যের জিডিপি অন্য যেকোনো দোদুল্যমান রাজ্যের চেয়ে বেশি পরিমাণে বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে বেকারত্বের হার। যুক্তরাষ্ট্রে এই রাজ্যেই সবচেয়ে বেশি বেকারের বসবাস।

নেভাদায় ২০২০ সালের নির্বাচনে জিতেছিলেন বাইডেন।

এই রাজ্য থেকে নির্বাচকের সংখ্যা ৬।

উত্তর ক্যারোলাইনা

বাইডেন যখন নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন, তখনো উত্তর ক্যারোলাইনা যে ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকে পড়বে, তা জানান দিচ্ছিল। কিন্তু বাইডেন প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর এখানেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কমলা হ্যারিসকে শুরু করতে হচ্ছে একেবারে শূন্য থেকে। তবে মনে রাখতে হবে, শেষ ১১টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এখানে ডেমোক্র্যাটরা জিতেছেন মাত্র একবার।

উত্তর ক্যারোলাইনায় জনসংখ্যার ধরন বদলেছে। ১৯৯০ সালের দিকে এই রাজ্যের ৭৫ শতাংশই ছিল শেতাঙ্গ। এখন তা নেমে এসেছে ৬০ শতাংশে। তবে শেষ ৩০ বছরে জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য ঊর্ধ্বগতি দৃশ্যমান হয়েছে। পেনশনভোগী, অবসরপ্রাপ্ত সেনা এবং যুব সম্প্রদায় মিলেমিশে আছে এখানে।

২০২০ সালে এখানে জয়ী হয়েছিলেন ট্রাম্প। ইলেকটোরাল ভোট এই অঙ্গরাজ্যে ১৬টি।

পেনসিলভানিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের অন্য রাজ্যগুলোর তুলনায় এখানে দ্রব্যমূল্য বেশি হারে বাড়ছে। তবে হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং প্রযুক্তির ব্যবহার এই রাজ্যকে টেক্সাসের পরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাস উৎপাদনকারী অঙ্গরাজ্যে পরিণত করেছে। পেনসিলভানিয়াতেই গত ১০ সেপ্টেম্বর কমলা-ট্রাম্প একমাত্র বিতর্কটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই রাজ্যে ২০২০ সালে বাইডেন জয়ী হয়েছিলেন। এখানে ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ১৯।

উইসকনসিন

দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যের মধ্যে এই অঙ্গরাজ্যেই সবচেয়ে বেশি শ্বেতাঙ্গের বসবাস। গত দুই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেশের সর্বোচ্চ ভোটের হার ছিল এই অঙ্গরাজ্যে। ২০১৬ ও ২০২০ সালে, রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীরা উইসকনসিনে তাঁদের প্রতিপক্ষকে ২৫ হাজারের কম ভোটে পরাজিত করেছিলেন। এতেই বোঝা যায়, এই রাজ্যে একটি ভোটও কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ২০২০ সালে এই রাজ্যে জয়ী হয়েছিলেন জো বাইডেন। এখানে ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ১০।

দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলো জয় করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন নীল আর লালেরা। জয়ের আগপর্যন্ত প্রার্থীদের ভাগ্যের ধূসরতা বজায় থাকবে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টেকসই স্কুল জুতার নতুন মানদণ্ডে স্টেপ ফুটওয়্যার

গিফট কার্ড প্রতারণা মামলায় জয়ী হল গুগল

ইতিহাসের ‘সবচেয়ে বড় অভিবাসী নির্বাসন অভিযান’, কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন ট্রাম্প ও খরচ কত

রূপপুরে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক: কাজ ছাড়াই মেয়াদ শেষ, এখন ব্যয় বাড়ানোর আবদার

মিলানের কাছে ভরাডুবির পর মারাত্মক চিন্তায় রিয়াল

আরও
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত