Ajker Patrika

পুলিশি নিপীড়নের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ

আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭: ১৫
পুলিশি নিপীড়নের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ

পুলিশের নিপীড়নের মধ্যেই গাজায় ইসরায়েলের বর্বর হামলার প্রতিবাদে এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তাল রয়েছে। সপ্তাহজুড়েই শিক্ষার্থীদের দমন করার জন্য বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুলিশের আশ্রয় নিয়েছে; গ্রেপ্তার হয়েছেন শত শত শিক্ষার্থী। বিক্ষোভকারীরা ইসরায়েলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্যাম্পাসের অর্থায়ন বিচ্ছিন্ন করার দাবি জানিয়েছে। 

এর মধ্যে জর্জিয়ার আটালান্টায় অবস্থিত এমোরি ইউনিভার্সিটিতে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হয়েছে। এমনকি নারী এক অধ্যাপককে গায়ের জোরে মাটিতে ঠেসে ধরে হাতকড়া পরায়। সিএনএনের এক ভিডিওতে দেখা গেছে, এমোরি ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক ক্যারোলাইন ফোলিন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কথা বলতে গেলে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর ওপর চড়াও হন এবং চোখের পলকেই তাঁকে মাটিতে শুইয়ে ফেলেন। 

ইউনিভার্সিটির আটালান্টা ক্যাম্পাসে গত বৃহস্পতিবার তাঁবু গেঁড়ে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীসহ অন্যরা। এ সময় পুলিশ সেখানে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়। বিক্ষোভকারীদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর সবাই মিলে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। 

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুসারে, উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় ৩৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়। 

বিক্ষোভের লাগাম টেনে ধরতে কলেজ প্রশাসকদের ওপর চাপ বাড়িয়ে চলছেন আইনপ্রণেতারা। বিক্ষোভের কেন্দ্রস্থল কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে তদন্তের বিষয়ে গতকাল শুক্রবার রাতে সিনেটে প্রস্তাব পাস হয়েছে। বিক্ষোভের উত্তেজনা এরই মধ্যে ইয়েল, এমআইটি ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়েছে। 

২০২৪ সালের ২৬ এপ্রিল লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসের (ইউসিএলএ) ক্যাম্পাসের একটি সমাবেশে ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি: গতকাল শুক্রবার অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ‘অননুমোদিত শিবির স্থাপনে’ জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মুখপাত্র। 

বার্নার্ড কলেজ: স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছে, কলাম্বিয়ার ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেওয়ায় ‘প্রায় সব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন বরখাস্ত করার’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়: বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণবাদী বিভাজন জোটের এক ছাত্র মুখপাত্রকে নিষিদ্ধ করেছে। শিক্ষার্থীটি গত জানুয়ারিতে বলেছিল, ‘জায়নিস্টরা বেঁচে থাকার যোগ্য নয়।’ পরে অবশ্য ক্ষমা চেয়েছেন তিনি। 

ডেনভার ক্যাম্পাস: ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো ডেনভার, কমিউনিটি কলেজ অব ডেনভার এবং মেট্রোপলিটন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব ডেনভারের যৌথ ক্যাম্পাস থেকে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজনকারী প্রায় ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৪০ জনকেই  গতকাল শুক্রবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

২০২৪ সালের ২৬ এপ্রিল লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসের (ইউসিএলএ) ক্যাম্পাসের একটি সমাবেশে ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। ইমোরি ইউনিভার্সিটি: গত বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসে সংঘটিত সহিংস গ্রেপ্তারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টিরা ক্যাম্পাসে জড়ো হয়েছেন। অধ্যাপকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট গ্রেগরি ফেনভেসকে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য রাজ্য ও স্থানীয় পুলিশকে ডেকে আনার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। 

জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি: গত শক্রবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বর্তমান শিক্ষার্থী যদি ক্যাম্পাসে অবস্থান করেন, তবে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে এবং প্রশাসনিকভাবে ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করা হবে। 

ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি: ছত্রভঙ্গ করার আদেশ প্রত্যাখ্যান করায় গত বৃহস্পতিবার রাতে মোট ৩৬ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

২০২৪ সালের ২৬ এপ্রিল শিকাগোর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীরা জড়ো হন। চ্যাপেল হিলের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা: ইসরায়েল ও এর সামরিক অভিযানে বিনিয়োগ করা করপোরেশনগুলো থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বিচ্ছিন্ন করার দাবিতে গতকাল শুক্রবার ৭৫ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী স্কুলে জড়ো হয়। 

ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া: স্কুলের প্রেসিডেন্ট ক্যারল এল ফোল্ট এক বিবৃতিতে বলেন, ক্যাম্পাসটি অনিরাপদ হয়ে উঠেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় একটি তদন্ত শুরু করবে এবং সমস্ত ইউএসসি শিক্ষার্থী, ফ্যাকাল্টি ও কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য পদক্ষেপ নেবে। 

অস্টিনের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস: স্কুলটি প্যালেস্টাইন সলিডারিটি কমিটির ওপর ‘অন্তর্বর্তীকালীন বরখাস্তের’ আদেশ দিয়েছে। এই দলই গত বুধবার বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে, যেখানে ৫০ জনেরও অধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

 ২০২৪ সালের ২৬ এপ্রিল শিকাগোর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীরা জড়ো হন। কর্তৃপক্ষের ধৈর্য ফুরিয়ে আসায় এবং পুলিশ জোরপূর্বক পিছু হটতে বাধ্য করায় ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রের আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে। ভার্জিনিয়া টেক: গতকাল শুক্রবার স্কুল কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে একটি বিক্ষোভ সমাবেশ সম্পর্কে এক বিবৃতি জারি করে বলে, তারা বিক্ষোভকারীদের বলেছে, এই আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি মেনে চলে না। 

ইয়েল ইউনিভার্সিটি: ফ্যাকাল্টি ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন সংগঠন থেকে দেওয়া এক চিঠিতে চলতি সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তারের সমালোচনা করা হয়। তারা আরও বলে, তারা ইয়েলের সমাবর্তন অনুষ্ঠান বয়কট করতে প্রস্তুত। আরও একটি চিঠিতে ইয়েলের প্রশাসনকে ইয়েলের ইহুদি শিক্ষার্থী, কর্মী ও ফ্যাকাল্টিকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালনে তাদের ব্যর্থতার জন্য নিন্দা করা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ট্রাম্পকে তরুণদের ‘রোল মডেল’ বললেন এক সময়ের ঘোর বিরোধী নিকি মিনাজ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
‘আমেরিকাফেস্ট’ সম্মেলনের মঞ্চে নিকি মিনাজ। ছবি: সংগৃহীত
‘আমেরিকাফেস্ট’ সম্মেলনের মঞ্চে নিকি মিনাজ। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় রক্ষণশীল সংগঠন টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএ আয়োজিত ‘আমেরিকাফেস্ট’ সম্মেলনে হঠাৎ উপস্থিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের প্রশংসা করেছেন মার্কিন র‍্যাপ তারকা নিকি মিনাজ। রোববার (২১ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে তিনি তরুণ পুরুষদের জন্য ট্রাম্প ও ভ্যান্সকে ‘রোল মডেল’ হিসেবে উল্লেখ করেন। মিনাজের এই মন্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ চমক সৃষ্টি করেছে।

সোমবার (২২ ডিসেম্বর) ‘ফরচুন’ জানিয়েছে, এই সম্মেলনটি প্রয়াত রক্ষণশীল কর্মী চার্লি কার্কের স্মরণে আয়োজন করা হয়। মঞ্চে নিকি মিনাজের সাক্ষাৎকার নেন চার্লি কার্কের স্ত্রী ও বর্তমানে টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএ-এর নেতৃত্বে থাকা অ্যারিকা কার্ক। আলোচনায় ট্রাম্পের প্রতি নতুন সমর্থনের কথা জানান মিনাজ—যদিও অতীতে তিনি ট্রাম্পের কঠোর সমালোচক ছিলেন। পাশাপাশি তিনি নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতারও নিন্দা জানান।

মিনাজ ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাট গভর্নর গ্যাভিন নিউসমকে কটাক্ষ করে ট্রাম্পের দেওয়া ‘নিউ-স্কাম’ নামটি ব্যবহার করেন। বর্তমান প্রশাসনের প্রশংসা করে তিনি বলেন—বর্তমান প্রশাসনে হৃদয় ও আত্মা আছে এবং ট্রাম্প ও ভ্যান্স দুজনই এমন নেতা, যাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ সহজে নিজেদের মিল খুঁজে পায়।

এদিকে মঞ্চে এক অস্বস্তিকর মুহূর্ত তৈরি হয়, যখন ভ্যান্সের রাজনৈতিক দক্ষতার প্রশংসা করতে গিয়ে মিনাজ তাঁকে ‘অ্যাসাসিন’ বলে ফেলেন। কথাটি বলার পরই তিনি থেমে যান এবং পরিস্থিতি কিছুটা বিব্রতকর হয়ে ওঠে। চার্লি কার্ক হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় শব্দটি উপস্থিত অনেকের মনে আঘাত দেয়।

সম্প্রতি মিনাজ ট্রাম্পের ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ দেওয়া নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টান নির্যাতন সংক্রান্ত একটি পোস্ট শেয়ার করেছিলেন, যেখানে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়। এ নিয়ে তিনি জাতিসংঘে মার্কিন মিশনে আয়োজিত এক প্যানেল আলোচনাতেও অংশ নেন।

নিজের পরিবর্তিত অবস্থান নিয়ে মিনাজ বলেন, ‘মত বদলানো দোষের নয়—মনের কথা বলাই এখন সবচেয়ে বড় অপরাধ হয়ে গেছে।’ বিনোদন জগৎ থেকে সমালোচনার প্রসঙ্গে জানান, তিনি এসব নিয়ে ভাবেন না। একসময় ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির তীব্র বিরোধিতা করা এই শিল্পী এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, তাঁর মত বদলানো ঠিকই আছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

যুদ্ধের মধ্যেই গাজায় দুবার সন্তান প্রসবের ভয়াবহ স্মৃতি হাদিলের

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
হাদিল আল ঘেরবাওয়ির কোলে ছেলে জাওয়াদ। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
হাদিল আল ঘেরবাওয়ির কোলে ছেলে জাওয়াদ। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

‘এই বিভীষিকা আমি কখনো ভুলতে পারব না’—বলছিলেন হাদিল আল ঘেরবাওয়ি। ২৬ বছর বয়সী এই ফিলিস্তিনি নারী গাজা যুদ্ধে চরম ক্ষুধা, ভয় আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই দুটি গর্ভধারণ ও দুবার সন্তান জন্ম দিয়েছেন।

সোমবার (২২ ডিসেম্বর) যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান-ভিত্তিক ইনডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর সময় হাদিল সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ হওয়ায় তিনি নিয়মিত ডাক্তার দেখাতেন, আলট্রাসাউন্ড করাতেন এবং ভিটামিন নিতেন। গাজা সিটির পূর্বাংশে ইসরায়েল সীমান্তের কাছে বসবাস করায় যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিনই তিনি গাজার পশ্চিম অংশে বসবাস করা বাবা-মায়ের বাড়িতে চলে যান। হাদিল ভেবেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি আবার স্বামীর বাড়িতে ফিরে যাবেন। কিন্তু এরপর পরিবারটি অন্তত ১৩ বার বাস্তুচ্যুত হয় এবং স্বামীর বাড়িটিও একদিন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসেই গাজা সিটিতে একটি আবাসিক ভবনে বড় ধরনের হামলার কাছাকাছি অবস্থানে ছিলেন হাদিল। তাঁর কাছে এটিকে একটি ভূমিকম্প মনে হয়েছিল। পরে আশ্রয় নেন আল-শিফা হাসপাতালে। সেখানে অন্যান্য আশ্রয়প্রার্থীর ভিড় এত বেশি ছিল যে, বাথরুম ব্যবহার করাও প্রায় অসম্ভব ছিল। সেদিনের দৃশ্য আজও তাড়া করে ফেরে হাদিলকে। স্তূপ করে রাখা লাশ, ড্রামে রাখা খণ্ড-বিখণ্ড অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর তীব্র গন্ধ। তিনি বলেন, ‘আমি গর্ভবতী ছিলাম, সহ্য করতে পারিনি।’

অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে—নিরাপত্তার আশায় এবার তিনি ও তাঁর স্বামী খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে যান এবং চিকিৎসকদের কাছে আগেভাগেই সন্তান প্রসবের অনুরোধ করেন। হাদিল যখন সন্তান প্রসব করছিলেন, তখন হাসপাতালটির পাশের ভবনেই হামলা হয় এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশৃঙ্খল এই পরিস্থিতিতে সন্তান বদলে যাওয়ার আতঙ্কও গ্রাস করেছিল হাদিলকে। তবে আতঙ্কের মধ্যেই শেষ পর্যন্ত তিনি ছেলে জাওয়াদের জন্ম দেন।

নবজাতক নিয়ে হাদিলকে ৩০ জনের সঙ্গে একটি কক্ষে গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছিল। সেই সময়টিতে সেলাইয়ের তীব্র ব্যথার মধ্যেও তিনি কোনো ওষুধ পাননি; রাতের পর রাত চুপচাপ এই ব্যথা সহ্য করেছেন। তাঁর ধারণা, প্রসবের পর তিনি বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।

কয়েক মাস পর তাঁরা একটি তাঁবুতে ওঠেন। বালু, পোকামাকড় আর প্রচণ্ড ঠান্ডায় একের পর এক নবজাতকের মৃত্যুর খবরে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন হাদিল। রাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বারবার জেগে উঠতেন। জাওয়াদের বয়স ৯ মাস হলে আবারও গর্ভবতী হন তিনি। হাদিল বলেন, ‘তাঁবুতে থেকে আরেকটি সন্তান—ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিলাম।’

চলতি বছরের জানুয়ারিতে সাময়িক যুদ্ধবিরতির খবর কিছুটা আশা জাগিয়েছিল তাঁদের। সেই আশা থেকেই ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে যান। কিন্তু ছয় সপ্তাহ পরই ভেঙে যায় যুদ্ধবিরতি। পেটে সন্তান নিয়ে আবারও পালাতে হয় হাদিলকে। পালানোর পর তাঁদের বাড়িটিও ধ্বংস হয়ে যায়। যুদ্ধের মধ্যে দ্বিতীয় গর্ভধারণ হাদিলের জন্য ছিল সবচেয়ে কঠিন। এই সন্তান পেটে রাখার ৯ মাসই তাঁর যুদ্ধের মধ্যে কেটেছে। এমনও দিন গেছে, সারা দিন শুধু একটি শসা খেয়ে কাটিয়েছেন। আর কোথাও এক মুঠো খাবার পেলে নিজের ভাগটুকু তিনি ছেলে জাওয়াদকে দিতেন।

দ্বিতীয়বার প্রসবের সময়ও তিনি বাবা-মায়ের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। কারণ ওই বাড়ি থেকে কাছাকাছি একটি হাসপাতালে নবজাতক সুরক্ষার জন্য ইনকিউবেটর ছিল। এক রাতে প্রসবব্যথা শুরু হলে, লিফট না থাকায় পাঁচ তলা থেকে হেঁটেই নামতে হয় হাদিলকে। পরে তিনি অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেন এবং ওই হাসপাতালে দ্বিতীয় ছেলে ফারেসের জন্ম দেন। জন্মের সময় ফারেসের ওজন ছিল মাত্র ২ কেজি।

এবারে অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই সেলাই দেওয়া হয় হাদিলকে। আর অন্যকে সুযোগ করে দিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিছানা খালি করে তাঁকে চেয়ারে বসে থাকতে হয়। ফারেসের জন্মের পাঁচ ঘণ্টা পর, চরম ক্লান্তি ও ব্যথা নিয়ে তিনি আবার পাঁচ তলা সিঁড়ি বেয়ে বাবা-মায়ের ঘরে ফেরেন। এই যুদ্ধ, তাঁর শরীর ও মনে রেখে গেছে এমন ক্ষত—যা ভুলবার নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আসাদের খালি হয়ে যাওয়া কুখ্যাত কারাগারগুলো ভরে উঠছে আবার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
বাশার আল-আসাদের পতনের পর খালি হয়ে গিয়েছিল হোমসের এই কারাগারটি। ছবি: রয়টার্স
বাশার আল-আসাদের পতনের পর খালি হয়ে গিয়েছিল হোমসের এই কারাগারটি। ছবি: রয়টার্স

বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার মানুষ ভেবেছিল—দেশটির কুখ্যাত কারাগার অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে। বিদ্রোহীরা জেলখানার দরজা ভেঙে বন্দীদের মুক্ত করেছিল, পরিবারের লোকেরা ছুটে গিয়েছিল নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে। কিন্তু এক বছর না পেরোতেই সেই কারাগারগুলো আবার ভরে উঠছে। এবার নতুন সরকারের অধীনেই সিরিয়ায় আবারও ফিরে এসেছে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও চাঁদাবাজির অভিযোগ।

রয়টার্সের এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গত এক বছরে অন্তত ৮২৯ জন নিরাপত্তাজনিত কারণে আটক হয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আটক ব্যক্তিদের বড় অংশই কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ বা আদালতের আদেশ ছাড়াই বন্দী রয়েছেন।

সোমবার (২২ ডিসেম্বর) প্রকাশিত রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় প্রথম দফার গ্রেপ্তার শুরু হয়েছিল বিদ্রোহীদের বিজয়ের পরপরই। সে সময় মূলত আসাদের আমলের সেনা সদস্য ও কর্মকর্তাদের আটক করা হয়েছিল। পরে শীতের শেষ দিকে উপকূলীয় অঞ্চলে সহিংসতার জের ধরে আলাউইত সম্প্রদায়ের শত শত মানুষ গ্রেপ্তার হন। বসন্ত ও গ্রীষ্মে দ্রুজ অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলেও ব্যাপক ধরপাকড় চলে। একই সঙ্গে সুন্নি, খ্রিষ্টান ও শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনও ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’ বা আসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অস্পষ্ট অভিযোগে আটক হন।

রয়টার্স জানিয়েছে, আসাদ আমলের অন্তত ২৮টি কারাগার ও আটক কেন্দ্র আবার সক্রিয় হয়েছে। এগুলোর অনেকগুলোই অতীতে নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত ছিল। যদিও বর্তমান সরকার বলছে, অপরাধীদের বিচারের প্রয়োজনে এসব কেন্দ্র ব্যবহার করা হচ্ছে এবং অনেক বন্দীকে ইতিমধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তবে কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান তারা প্রকাশ করেনি।

সাক্ষাৎকারে সাবেক বন্দী ও স্বজনেরা জানিয়েছেন, আটক কেন্দ্রগুলোতে ভয়াবহ মানবেতর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গাদাগাদি করে বন্দী রাখা, খাবার ও চিকিৎসার অভাব, ত্বকের রোগ এবং নিয়মিত মারধরের অভিযোগ রয়েছে। অন্তত ১১ জন বন্দী কারা হেফাজতে মারা গেছেন বলে নথিভুক্ত করেছে রয়টার্স। এদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পরিবার জানতই না—দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর তারা বিষয়টি জানতে পারে।

চাঁদাবাজিও নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ১৪টি পরিবার জানিয়েছে, স্বজনকে মুক্তির বিনিময়ে ৫০০ থেকে ১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত দাবি করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এই অঙ্ক ৯০ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থ পরিশোধের পরও অনেকেই মুক্তি পাননি।

এদিকে সরকার স্বীকার করেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনের সময় কিছু ‘ফাঁকফোকর’ তৈরি হয়েছে এবং কিছু নিরাপত্তা সদস্য নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে। তাদের দাবি, চাঁদাবাজি ও সহিংসতার ঘটনায় অন্তত ১৫৯ জন নিরাপত্তা সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ব্যাপক আটক ও গুমের অভিযোগ নতুন সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরও আসাদের পতনের পর ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্বিচার আটক’-এর তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে।

আসাদের শাসনামলের মতো নির্মম নির্যাতন না হলেও, পুরোনো কারাগার ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন সিরিয়ার নতুন ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করছে। মানবাধিকারকর্মীদের ভাষায়, ‘শাসক বদলেছে, কিন্তু কারাগারের ছায়া এখনো কাটেনি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

মস্কোতে গাড়িবোমা হামলায় রুশ জেনারেল সারভারভ নিহত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
জেনারেল সারভারভের গাড়ির নিচে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক ডিভাইস পেতে রাখা হয়েছিল। ছবি: রয়টার্সের সৌজন্যে
জেনারেল সারভারভের গাড়ির নিচে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক ডিভাইস পেতে রাখা হয়েছিল। ছবি: রয়টার্সের সৌজন্যে

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে এক ভয়াবহ গাড়িবোমা হামলায় দেশটির শীর্ষস্থানীয় এক জেনারেল নিহত হয়েছেন। আজ সোমবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে এ ঘটনা ঘটে বলে রুশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি রাশিয়ার ইনভেস্টিগেটিভ কমিটির বরাতে জানিয়েছে, নিহত ব্যক্তির নাম লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফানিল সারভারভ (৫৬)। তিনি রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর অপারেশনাল ট্রেনিং বিভাগের প্রধান ছিলেন।

তদন্ত কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আজ স্থানীয় সময় সকালে মস্কোর দক্ষিণাঞ্চলের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের পার্কিং লটে এই বিস্ফোরণ ঘটে। জেনারেল সারভারভের গাড়ির নিচে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক ডিভাইস পেতে রাখা হয়েছিল। গাড়িটি চালু করার পরপরই সেটির বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে গুরুতর আহত অবস্থায় সারভারভকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।

ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা গেছে, একটি সাদা রঙের গাড়ি বিস্ফোরণে দুমড়েমুচড়ে গেছে এবং সেটির যন্ত্রাংশ উড়ে গিয়ে পাশে থাকা অন্য যানবাহনের ওপর পড়েছে।

রুশ ইনভেস্টিগেটিভ কমিটি এ ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে অভিহিত করে তদন্ত শুরু করেছে। প্রাথমিক তদন্তে রুশ কর্মকর্তাদের ধারণা, এই হামলার নেপথ্যে ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাত থাকতে পারে। তবে ইউক্রেন এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, জেনারেল সারভারভের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরপরই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে তা জানানো হয়েছে।

৫৬ বছর বয়সী ফানিল সারভারভ রুশ সামরিক বাহিনীর অত্যন্ত অভিজ্ঞ কর্মকর্তা ছিলেন। রুশ গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ফানিল সারভারভ নব্বইয়ের দশক এবং ২০০০ সালের শুরুতে তিনি ওসেটিয়ান-ইঙ্গুশ সংঘাত ও চেচেন যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৫-১৬ সালে সিরিয়ায় রুশ সামরিক অভিযানেও তিনি নেতৃত্ব দেন।

২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান শুরু করার পর থেকে মস্কোতে হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের ওপর বেশ কয়েকটি বড় হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র আলেকজান্ডার দুগিনের কন্যা দারিয়া দুগিনা গাড়িবোমা হামলায় নিহত হন।

চলতি বছরের এপ্রিলে জেনারেল ইয়ারোস্লাভ মোসকালিক ও ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল ইগর কিরিলভও একই ধরনের হামলায় প্রাণ হারান।

নীতিগত কারণে ইউক্রেন সাধারণত এ ধরনের হামলার দায় স্বীকার করে না। তবে গত বছর জেনারেল কিরিলভ নিহতের ঘটনায় ইউক্রেনীয় নিরাপত্তা সংস্থার জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিল বিবিসির একটি সূত্র।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত