Ajker Patrika

৯০% টিকা দিয়ে ধনী দেশগুলোকে লজ্জা দিল কিউবা

জাহাঙ্গীর আলম
আপডেট : ০৬ জানুয়ারি ২০২২, ১৯: ৩২
৯০% টিকা দিয়ে ধনী দেশগুলোকে লজ্জা দিল কিউবা

কোভিডের বিরুদ্ধে টিকাগুলোর বেশির ভাগই আগেভাগে কিনে গুদামজাত করে ফেলেছে ধনী রাষ্ট্রগুলো। তাদের কারণে ঝুঁকির মুখে পড়েছে দরিদ্ররা। অথচ তারাই এখনো আশানুরূপ টিকা দান নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের লাগামহীন সংক্রমণ ধনী দেশগুলোকে নতুন করে বিধিনিষেধের পথে হাঁটতে বাধ্য করছে। 

আর ওদিকে যে দ্বীপ দেশটি আলো জ্বালাতেই হিমশিম খায় তারা এরই মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি জনগণকে টিকা দিয়ে ফেলেছে। 

উনিশ শতকে স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম নায়ক জেনারেল ম্যাক্সিমো গোমেজ একসময় বলেছিলেন, ‘কিউবানরা হয় লক্ষ্য ছোঁয় না- নয়তো লক্ষ্যকে অতিক্রম করে চলে যায়!’ 

দেড় শতাব্দী পরে তাঁর সেই বাণীই সত্য হলো! দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতির দ্বীপটির হয়তো আলো জ্বালানোর সামর্থ্য নেই, কিন্তু তারাই এখন বিশ্বের যেকোনো বড় দেশের তুলনায় কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি সফলতা দেখিয়েছে। 

সরকারি তথ্য এবং পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি কিউবান অন্তত একটি ডোজ টিকা পেয়েছেন। আর ৮৩ শতাংশ জনগণ পেয়েছে পূর্ণ ডোজ। দেশে উদ্ভাবিত কোভিড টিকাই দিয়েছে কিউবা। ১০ লাখের বেশি জনসংখ্যার দেশগুলির মধ্যে একমাত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতেরই ব্যাপকভিত্তিক টিকা নিশ্চিত করার রেকর্ড রয়েছে। 

কানাডার ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির ল্যাটিন আমেরিকান স্টাডিজের ইমেরিটাস অধ্যাপক জন কার্ক বলেন, ‘কিউবা এক জাদু বাস্তবতার দেশ! মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যা এবং সীমিত আয় নিয়ে কিউবা একটি প্রাণপ্রযুক্তিতে শক্তিধর দেশ হতে পারে, এমন ধারণা ফাইজারে কর্মরত কারও পক্ষে বোধগম্য হবে না। কিন্তু কিউবার পক্ষেই এটি সম্ভব!’ 

বেশিরভাগ লাতিন আমেরিকার দেশের মতো, কিউবাও জানত যে টিকা কিনতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তে হবে। তাই ২০২০ সালের মার্চে, পর্যটন রাজস্ব হ্রাস এবং যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নতুন নিষেধাজ্ঞার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার বিপর্যয় সঙ্গী করে দ্বীপ রাষ্ট্রটির বিজ্ঞানীরা কোমর বেঁধে নেমেছিলেন। 

বলতে গেলে তাঁরা জুয়া খেলতে নেমেছিলেন: জিতেও গেছেন। ২০২১-এর বসন্তের মধ্যে কিউবা বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে সফলভাবে নিজস্ব কোভিড টিকা উদ্ভাবন ও উৎপাদন শুরু করে। এরপর থেকেই দক্ষ ও আন্তরিক স্বাস্থ্যকর্মী, সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবার বিপর্যয়ের ঝুঁকি কাঁধে নিয়ে দ্রুত টিকা দান কর্মসূচি শুরু করে। এমনকি শিশুদেরও টিকা দিয়েছে কিউবা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, এখানে জনগণ স্বেচ্ছায় টিকা নিয়েছে। যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোতে টিকা বিরোধিতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত বসন্তে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফল অনুসারে, কিউবার দুটি কোভিড টিকাই ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকর। সফল টিকাদান কর্মসূচিই দেশটিতে সংক্রমণের হার ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। যেখানে গত গ্রীষ্মে পশ্চিম গোলার্ধের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সংক্রমণের দেশগুলোর মধ্যে ছিল কিউবা। 

গত আগস্টে কিউবা প্রতি সপ্তাহেই কোভিডে শত শত মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। যেখানে গত সপ্তাহে মৃত্যু ছিল তিনজন। 

সর্বজনীন টিকা দানে কিউবার এই সাফল্য আলাদা করে উল্লেখ করার মতো ঘটনা, যখন অবরোধে জেরবার দেশটিতে স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য খাতের অবস্থা অত্যন্ত ভঙ্গুর। গত দুই বছরে অভ্যন্তরীণ মুদ্রা প্রবাহ অর্ধেকে নেমে গেছে, দেশটিতে অ্যান্টিবায়োটিক এখন এতটাই দুষ্প্রাপ্য যে অ্যামোক্সিসিলিনের ২০টি ট্যাবলেট কালোবাজার থেকে কিনতে এক মাসের ন্যূনতম সরকারি বেতনের সমান টাকা খরচ করতে হচ্ছে। 

ভাঙা হাড়ের চিকিৎসায় প্লাস্টার করতে কিছু প্রদেশের ডাক্তারেরা এখন ব্যবহৃত কার্ডবোর্ডের ওপর নির্ভর করছেন! 

হাভানা-ভিত্তিক আইনজীবী গ্রেগরি বিনিওস্কি ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘১৯৫৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে, কিউবানরা এই মহান ক্রুসেডগুলো শুরু করেছে। খুবই অবাস্তব, তবুও প্রায়ই সফল হই।’ 

উদাহরণ হিসেবে বিনিওস্কি বলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর প্রাণপ্রযুক্তিতে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের এক স্বপ্ন ফিদেল কাস্ত্রোর পরিকল্পনার পাইপলাইনে ছিল। ওই সময় যেকোনো যুক্তিবাদী পরামর্শকই বলতেন, যে প্রকল্পের ফল পেতে ২৫ বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে সেখানে সম্পদ বিনিয়োগ করার সময় এটি নয়। তবুও আমরা কিন্তু এখন এখানে… যেখানে প্রাণপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগের ফলই এখন জীবন বাঁচাচ্ছে।’ 

অবশ্য কাস্ত্রোর সব পরিকল্পনাই কাজ করেছে এমন নয়। বেশ কিছু উদ্যোগই নাটকীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন, ১৯৭০ সালে ১ কোটি টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যে আখ চাষ উৎসাহিত করার উদ্যোগের কথা বলা যায়। শ্রমিকদের নিয়মিত কাজ থেকে এনে আখ কাটতে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই পদক্ষেপ শিল্পকে পঙ্গু করে দেয়। ফলত অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ায়। 

গত বছর কিউবা ১৯৫৯ সালের তুলনায় সাত গুণ কম চিনি সংগ্রহ করেছে। 

কানাডার রয়্যাল মিলিটারি কলেজের ইতিহাস ও কৌশলের ইমেরিটাস অধ্যাপক হ্যাল ক্লেপাক বলেন, ‘একটি জাতি হিসেবে বড় জিনিসগুলোতে বেশি ভালো করার প্রবণতা থাকে। আর সাধারণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে উদাসীনতার কারণে ভয়ংকর ফল হয়। যেমন, এক দশকের কম সময়ের মধ্যে পুরো দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা, আড়াই বছরে নিরক্ষরতা দূর করা এবং চিকিৎসা আন্তর্জাতিকীকরণ- এগুলো সবই ছিল পাগলামি। কিন্তু তারা (কিউবা) এটা করেছে।’ 

আজ কিউবা হাজার হাজার চিকিৎসক এবং নার্স তৈরি করছে। তাঁরা বিদেশে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে মানবিক কাজ করছেন। কিন্তু দেশের জনগণের জন্য পর্যাপ্ত আলু উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছে কিউবা। এটা সত্যিই একটা ট্র্যাজেডি! 

এর জন্য দায়ী করা যেতে পারে কিউবার অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত এবং রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থাকেই। বিশ্বে এ ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বশেষ দৃষ্টান্তগুলো একটি হয়ে আছে কিউবা। উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের প্যারাডক্স (কূটাভাস) ব্যাখ্যা করার কিছু উপাদান হয়তো তারা রেখে যাচ্ছে। শীর্ষ পর্যায়ে যখন রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে তখন ইতিবাচক লক্ষ্যগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যখন সঠিক দিকনির্দেশের অভাব হয়, তখন দ্বীপ দেশটির কঠোর অনমনীয় সরকার ব্যবস্থার হাল ধরতে সামনে এসে হাজির হয় কাফকায়েস্ক আমলাতন্ত্র। যাদের প্রকৃত কোনো লক্ষ্য উদ্দেশ্য, দায় কিছুই না থাকার মতো এক ভয়ংকর কদর্য রূপ অনেক দেশে মাঝে মধ্যে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। 

এদিকে গত সপ্তাহজুড়ে প্রতিদিন একজন কোভিড রোগী শনাক্ত হচ্ছে কিউবায়। অত্যন্ত সংক্রামক ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণেই সংক্রমণের হার এখন বাড়ছে। কিউবার বিজ্ঞানীরা ওমিক্রনের বিরুদ্ধে তাঁদের টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে এখনো তথ্য প্রকাশ করেননি। টিকাটি হালনাগাদ করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। 

এরই মধ্যে, কিউবার জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু করেছে। চলতি জানুয়ারি মাসেই প্রায় শতভাগ বুস্টার ডোজ দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কিউবা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ট্রাম্পকে তরুণদের ‘রোল মডেল’ বললেন এক সময়ের ঘোর বিরোধী নিকি মিনাজ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
‘আমেরিকাফেস্ট’ সম্মেলনের মঞ্চে নিকি মিনাজ। ছবি: সংগৃহীত
‘আমেরিকাফেস্ট’ সম্মেলনের মঞ্চে নিকি মিনাজ। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় রক্ষণশীল সংগঠন টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএ আয়োজিত ‘আমেরিকাফেস্ট’ সম্মেলনে হঠাৎ উপস্থিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের প্রশংসা করেছেন মার্কিন র‍্যাপ তারকা নিকি মিনাজ। রোববার (২১ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে তিনি তরুণ পুরুষদের জন্য ট্রাম্প ও ভ্যান্সকে ‘রোল মডেল’ হিসেবে উল্লেখ করেন। মিনাজের এই মন্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ চমক সৃষ্টি করেছে।

সোমবার (২২ ডিসেম্বর) ‘ফরচুন’ জানিয়েছে, এই সম্মেলনটি প্রয়াত রক্ষণশীল কর্মী চার্লি কার্কের স্মরণে আয়োজন করা হয়। মঞ্চে নিকি মিনাজের সাক্ষাৎকার নেন চার্লি কার্কের স্ত্রী ও বর্তমানে টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএ-এর নেতৃত্বে থাকা অ্যারিকা কার্ক। আলোচনায় ট্রাম্পের প্রতি নতুন সমর্থনের কথা জানান মিনাজ—যদিও অতীতে তিনি ট্রাম্পের কঠোর সমালোচক ছিলেন। পাশাপাশি তিনি নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতারও নিন্দা জানান।

মিনাজ ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাট গভর্নর গ্যাভিন নিউসমকে কটাক্ষ করে ট্রাম্পের দেওয়া ‘নিউ-স্কাম’ নামটি ব্যবহার করেন। বর্তমান প্রশাসনের প্রশংসা করে তিনি বলেন—বর্তমান প্রশাসনে হৃদয় ও আত্মা আছে এবং ট্রাম্প ও ভ্যান্স দুজনই এমন নেতা, যাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ সহজে নিজেদের মিল খুঁজে পায়।

এদিকে মঞ্চে এক অস্বস্তিকর মুহূর্ত তৈরি হয়, যখন ভ্যান্সের রাজনৈতিক দক্ষতার প্রশংসা করতে গিয়ে মিনাজ তাঁকে ‘অ্যাসাসিন’ বলে ফেলেন। কথাটি বলার পরই তিনি থেমে যান এবং পরিস্থিতি কিছুটা বিব্রতকর হয়ে ওঠে। চার্লি কার্ক হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় শব্দটি উপস্থিত অনেকের মনে আঘাত দেয়।

সম্প্রতি মিনাজ ট্রাম্পের ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ দেওয়া নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টান নির্যাতন সংক্রান্ত একটি পোস্ট শেয়ার করেছিলেন, যেখানে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়। এ নিয়ে তিনি জাতিসংঘে মার্কিন মিশনে আয়োজিত এক প্যানেল আলোচনাতেও অংশ নেন।

নিজের পরিবর্তিত অবস্থান নিয়ে মিনাজ বলেন, ‘মত বদলানো দোষের নয়—মনের কথা বলাই এখন সবচেয়ে বড় অপরাধ হয়ে গেছে।’ বিনোদন জগৎ থেকে সমালোচনার প্রসঙ্গে জানান, তিনি এসব নিয়ে ভাবেন না। একসময় ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির তীব্র বিরোধিতা করা এই শিল্পী এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, তাঁর মত বদলানো ঠিকই আছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

যুদ্ধের মধ্যেই গাজায় দুবার সন্তান প্রসবের ভয়াবহ স্মৃতি হাদিলের

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
হাদিল আল ঘেরবাওয়ির কোলে ছেলে জাওয়াদ। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
হাদিল আল ঘেরবাওয়ির কোলে ছেলে জাওয়াদ। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

‘এই বিভীষিকা আমি কখনো ভুলতে পারব না’—বলছিলেন হাদিল আল ঘেরবাওয়ি। ২৬ বছর বয়সী এই ফিলিস্তিনি নারী গাজা যুদ্ধে চরম ক্ষুধা, ভয় আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই দুটি গর্ভধারণ ও দুবার সন্তান জন্ম দিয়েছেন।

সোমবার (২২ ডিসেম্বর) যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান-ভিত্তিক ইনডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর সময় হাদিল সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ হওয়ায় তিনি নিয়মিত ডাক্তার দেখাতেন, আলট্রাসাউন্ড করাতেন এবং ভিটামিন নিতেন। গাজা সিটির পূর্বাংশে ইসরায়েল সীমান্তের কাছে বসবাস করায় যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিনই তিনি গাজার পশ্চিম অংশে বসবাস করা বাবা-মায়ের বাড়িতে চলে যান। হাদিল ভেবেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি আবার স্বামীর বাড়িতে ফিরে যাবেন। কিন্তু এরপর পরিবারটি অন্তত ১৩ বার বাস্তুচ্যুত হয় এবং স্বামীর বাড়িটিও একদিন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসেই গাজা সিটিতে একটি আবাসিক ভবনে বড় ধরনের হামলার কাছাকাছি অবস্থানে ছিলেন হাদিল। তাঁর কাছে এটিকে একটি ভূমিকম্প মনে হয়েছিল। পরে আশ্রয় নেন আল-শিফা হাসপাতালে। সেখানে অন্যান্য আশ্রয়প্রার্থীর ভিড় এত বেশি ছিল যে, বাথরুম ব্যবহার করাও প্রায় অসম্ভব ছিল। সেদিনের দৃশ্য আজও তাড়া করে ফেরে হাদিলকে। স্তূপ করে রাখা লাশ, ড্রামে রাখা খণ্ড-বিখণ্ড অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর তীব্র গন্ধ। তিনি বলেন, ‘আমি গর্ভবতী ছিলাম, সহ্য করতে পারিনি।’

অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে—নিরাপত্তার আশায় এবার তিনি ও তাঁর স্বামী খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে যান এবং চিকিৎসকদের কাছে আগেভাগেই সন্তান প্রসবের অনুরোধ করেন। হাদিল যখন সন্তান প্রসব করছিলেন, তখন হাসপাতালটির পাশের ভবনেই হামলা হয় এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশৃঙ্খল এই পরিস্থিতিতে সন্তান বদলে যাওয়ার আতঙ্কও গ্রাস করেছিল হাদিলকে। তবে আতঙ্কের মধ্যেই শেষ পর্যন্ত তিনি ছেলে জাওয়াদের জন্ম দেন।

নবজাতক নিয়ে হাদিলকে ৩০ জনের সঙ্গে একটি কক্ষে গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছিল। সেই সময়টিতে সেলাইয়ের তীব্র ব্যথার মধ্যেও তিনি কোনো ওষুধ পাননি; রাতের পর রাত চুপচাপ এই ব্যথা সহ্য করেছেন। তাঁর ধারণা, প্রসবের পর তিনি বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।

কয়েক মাস পর তাঁরা একটি তাঁবুতে ওঠেন। বালু, পোকামাকড় আর প্রচণ্ড ঠান্ডায় একের পর এক নবজাতকের মৃত্যুর খবরে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন হাদিল। রাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বারবার জেগে উঠতেন। জাওয়াদের বয়স ৯ মাস হলে আবারও গর্ভবতী হন তিনি। হাদিল বলেন, ‘তাঁবুতে থেকে আরেকটি সন্তান—ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিলাম।’

চলতি বছরের জানুয়ারিতে সাময়িক যুদ্ধবিরতির খবর কিছুটা আশা জাগিয়েছিল তাঁদের। সেই আশা থেকেই ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে যান। কিন্তু ছয় সপ্তাহ পরই ভেঙে যায় যুদ্ধবিরতি। পেটে সন্তান নিয়ে আবারও পালাতে হয় হাদিলকে। পালানোর পর তাঁদের বাড়িটিও ধ্বংস হয়ে যায়। যুদ্ধের মধ্যে দ্বিতীয় গর্ভধারণ হাদিলের জন্য ছিল সবচেয়ে কঠিন। এই সন্তান পেটে রাখার ৯ মাসই তাঁর যুদ্ধের মধ্যে কেটেছে। এমনও দিন গেছে, সারা দিন শুধু একটি শসা খেয়ে কাটিয়েছেন। আর কোথাও এক মুঠো খাবার পেলে নিজের ভাগটুকু তিনি ছেলে জাওয়াদকে দিতেন।

দ্বিতীয়বার প্রসবের সময়ও তিনি বাবা-মায়ের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। কারণ ওই বাড়ি থেকে কাছাকাছি একটি হাসপাতালে নবজাতক সুরক্ষার জন্য ইনকিউবেটর ছিল। এক রাতে প্রসবব্যথা শুরু হলে, লিফট না থাকায় পাঁচ তলা থেকে হেঁটেই নামতে হয় হাদিলকে। পরে তিনি অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেন এবং ওই হাসপাতালে দ্বিতীয় ছেলে ফারেসের জন্ম দেন। জন্মের সময় ফারেসের ওজন ছিল মাত্র ২ কেজি।

এবারে অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই সেলাই দেওয়া হয় হাদিলকে। আর অন্যকে সুযোগ করে দিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিছানা খালি করে তাঁকে চেয়ারে বসে থাকতে হয়। ফারেসের জন্মের পাঁচ ঘণ্টা পর, চরম ক্লান্তি ও ব্যথা নিয়ে তিনি আবার পাঁচ তলা সিঁড়ি বেয়ে বাবা-মায়ের ঘরে ফেরেন। এই যুদ্ধ, তাঁর শরীর ও মনে রেখে গেছে এমন ক্ষত—যা ভুলবার নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আসাদের খালি হয়ে যাওয়া কুখ্যাত কারাগারগুলো ভরে উঠছে আবার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
বাশার আল-আসাদের পতনের পর খালি হয়ে গিয়েছিল হোমসের এই কারাগারটি। ছবি: রয়টার্স
বাশার আল-আসাদের পতনের পর খালি হয়ে গিয়েছিল হোমসের এই কারাগারটি। ছবি: রয়টার্স

বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার মানুষ ভেবেছিল—দেশটির কুখ্যাত কারাগার অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে। বিদ্রোহীরা জেলখানার দরজা ভেঙে বন্দীদের মুক্ত করেছিল, পরিবারের লোকেরা ছুটে গিয়েছিল নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে। কিন্তু এক বছর না পেরোতেই সেই কারাগারগুলো আবার ভরে উঠছে। এবার নতুন সরকারের অধীনেই সিরিয়ায় আবারও ফিরে এসেছে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও চাঁদাবাজির অভিযোগ।

রয়টার্সের এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গত এক বছরে অন্তত ৮২৯ জন নিরাপত্তাজনিত কারণে আটক হয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আটক ব্যক্তিদের বড় অংশই কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ বা আদালতের আদেশ ছাড়াই বন্দী রয়েছেন।

সোমবার (২২ ডিসেম্বর) প্রকাশিত রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় প্রথম দফার গ্রেপ্তার শুরু হয়েছিল বিদ্রোহীদের বিজয়ের পরপরই। সে সময় মূলত আসাদের আমলের সেনা সদস্য ও কর্মকর্তাদের আটক করা হয়েছিল। পরে শীতের শেষ দিকে উপকূলীয় অঞ্চলে সহিংসতার জের ধরে আলাউইত সম্প্রদায়ের শত শত মানুষ গ্রেপ্তার হন। বসন্ত ও গ্রীষ্মে দ্রুজ অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলেও ব্যাপক ধরপাকড় চলে। একই সঙ্গে সুন্নি, খ্রিষ্টান ও শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনও ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’ বা আসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অস্পষ্ট অভিযোগে আটক হন।

রয়টার্স জানিয়েছে, আসাদ আমলের অন্তত ২৮টি কারাগার ও আটক কেন্দ্র আবার সক্রিয় হয়েছে। এগুলোর অনেকগুলোই অতীতে নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত ছিল। যদিও বর্তমান সরকার বলছে, অপরাধীদের বিচারের প্রয়োজনে এসব কেন্দ্র ব্যবহার করা হচ্ছে এবং অনেক বন্দীকে ইতিমধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তবে কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান তারা প্রকাশ করেনি।

সাক্ষাৎকারে সাবেক বন্দী ও স্বজনেরা জানিয়েছেন, আটক কেন্দ্রগুলোতে ভয়াবহ মানবেতর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গাদাগাদি করে বন্দী রাখা, খাবার ও চিকিৎসার অভাব, ত্বকের রোগ এবং নিয়মিত মারধরের অভিযোগ রয়েছে। অন্তত ১১ জন বন্দী কারা হেফাজতে মারা গেছেন বলে নথিভুক্ত করেছে রয়টার্স। এদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পরিবার জানতই না—দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর তারা বিষয়টি জানতে পারে।

চাঁদাবাজিও নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ১৪টি পরিবার জানিয়েছে, স্বজনকে মুক্তির বিনিময়ে ৫০০ থেকে ১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত দাবি করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এই অঙ্ক ৯০ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থ পরিশোধের পরও অনেকেই মুক্তি পাননি।

এদিকে সরকার স্বীকার করেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনের সময় কিছু ‘ফাঁকফোকর’ তৈরি হয়েছে এবং কিছু নিরাপত্তা সদস্য নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে। তাদের দাবি, চাঁদাবাজি ও সহিংসতার ঘটনায় অন্তত ১৫৯ জন নিরাপত্তা সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ব্যাপক আটক ও গুমের অভিযোগ নতুন সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরও আসাদের পতনের পর ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্বিচার আটক’-এর তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে।

আসাদের শাসনামলের মতো নির্মম নির্যাতন না হলেও, পুরোনো কারাগার ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন সিরিয়ার নতুন ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করছে। মানবাধিকারকর্মীদের ভাষায়, ‘শাসক বদলেছে, কিন্তু কারাগারের ছায়া এখনো কাটেনি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

মস্কোতে গাড়িবোমা হামলায় রুশ জেনারেল সারভারভ নিহত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
জেনারেল সারভারভের গাড়ির নিচে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক ডিভাইস পেতে রাখা হয়েছিল। ছবি: রয়টার্সের সৌজন্যে
জেনারেল সারভারভের গাড়ির নিচে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক ডিভাইস পেতে রাখা হয়েছিল। ছবি: রয়টার্সের সৌজন্যে

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে এক ভয়াবহ গাড়িবোমা হামলায় দেশটির শীর্ষস্থানীয় এক জেনারেল নিহত হয়েছেন। আজ সোমবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে এ ঘটনা ঘটে বলে রুশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি রাশিয়ার ইনভেস্টিগেটিভ কমিটির বরাতে জানিয়েছে, নিহত ব্যক্তির নাম লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফানিল সারভারভ (৫৬)। তিনি রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর অপারেশনাল ট্রেনিং বিভাগের প্রধান ছিলেন।

তদন্ত কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আজ স্থানীয় সময় সকালে মস্কোর দক্ষিণাঞ্চলের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের পার্কিং লটে এই বিস্ফোরণ ঘটে। জেনারেল সারভারভের গাড়ির নিচে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক ডিভাইস পেতে রাখা হয়েছিল। গাড়িটি চালু করার পরপরই সেটির বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে গুরুতর আহত অবস্থায় সারভারভকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।

ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা গেছে, একটি সাদা রঙের গাড়ি বিস্ফোরণে দুমড়েমুচড়ে গেছে এবং সেটির যন্ত্রাংশ উড়ে গিয়ে পাশে থাকা অন্য যানবাহনের ওপর পড়েছে।

রুশ ইনভেস্টিগেটিভ কমিটি এ ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে অভিহিত করে তদন্ত শুরু করেছে। প্রাথমিক তদন্তে রুশ কর্মকর্তাদের ধারণা, এই হামলার নেপথ্যে ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাত থাকতে পারে। তবে ইউক্রেন এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, জেনারেল সারভারভের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরপরই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে তা জানানো হয়েছে।

৫৬ বছর বয়সী ফানিল সারভারভ রুশ সামরিক বাহিনীর অত্যন্ত অভিজ্ঞ কর্মকর্তা ছিলেন। রুশ গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ফানিল সারভারভ নব্বইয়ের দশক এবং ২০০০ সালের শুরুতে তিনি ওসেটিয়ান-ইঙ্গুশ সংঘাত ও চেচেন যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৫-১৬ সালে সিরিয়ায় রুশ সামরিক অভিযানেও তিনি নেতৃত্ব দেন।

২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান শুরু করার পর থেকে মস্কোতে হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের ওপর বেশ কয়েকটি বড় হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র আলেকজান্ডার দুগিনের কন্যা দারিয়া দুগিনা গাড়িবোমা হামলায় নিহত হন।

চলতি বছরের এপ্রিলে জেনারেল ইয়ারোস্লাভ মোসকালিক ও ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল ইগর কিরিলভও একই ধরনের হামলায় প্রাণ হারান।

নীতিগত কারণে ইউক্রেন সাধারণত এ ধরনের হামলার দায় স্বীকার করে না। তবে গত বছর জেনারেল কিরিলভ নিহতের ঘটনায় ইউক্রেনীয় নিরাপত্তা সংস্থার জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিল বিবিসির একটি সূত্র।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত