Ajker Patrika

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি: উপমহাদেশে ইসলামি নবজাগরণের অগ্রদূত

মুফতি আবু আবদুল্লাহ আহমদ 
আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৫, ১৯: ০৭
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভির মাজার। ছবি: সংগৃহীত
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভির মাজার। ছবি: সংগৃহীত

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (১৭০৩–৬২ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামি চিন্তাবিদ, মুজাদ্দিদ, সমাজ সংস্কারক ও হাদিস বিশারদ। তিনি এমন এক যুগে জন্মগ্রহণ করেন, যখন মোগল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়েছিল এবং মুসলিম সমাজ বিভক্তির শিকার হচ্ছিল। তাঁর চিন্তাধারা, কোরআনের অনুবাদ ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের পুনর্জাগরণের পথ তৈরি করেছিলেন। তিনি ইসলামি দর্শন, তাফসির, হাদিস, ফিকহ এবং রাজনীতি নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন।

প্রাথমিক জীবন

শাহ ওয়ালিউল্লাহ ১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে (১১১৪ হিজরি) ভারতের দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শাহ আব্দুর রহিম ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলেম এবং দিল্লির বিখ্যাত মাদরাসা মাদরাসা-ই-রহিমিয়া-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছোটবেলা থেকেই অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন এবং মাত্র ১৫ বছর বয়সে ইসলামি শিক্ষার সব স্তর সম্পন্ন করেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ ১৭৩১ সালে হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় যান এবং সেখানে ইসলামি শিক্ষা ও গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি মক্কা ও মদিনার বিখ্যাত আলেমদের কাছ থেকে হাদিস, ফিকহ ও তাফসির অধ্যয়ন করেন। বিশেষত, তিনি শাইখ আবু তাহির কুরাইশি ও শাইখ ওয়াফদুল্লাহ আল-আলাভির মতো প্রখ্যাত ইসলামি পণ্ডিতদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দু বছর পর তিনি ভারত ফিরে আসেন এবং ইসলামি শিক্ষা, সমাজ সংস্কার ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রচার শুরু করেন।

অবদান

কোরআন: শাহ ওয়ালিউল্লাহ কোরআনের মূল শিক্ষা সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এর ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন, যা সে সময় একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ ছিল। আগে কোরআনের ব্যাখ্যা আরবি ভাষায় সীমাবদ্ধ ছিল, ফলে সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারত না। তাঁর অনুবাদ পরবর্তীকালে উর্দু, বাংলা ও অন্যান্য ভাষায় কোরআনের অনুবাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

হাদিস: তিনি হাদিস শাস্ত্রের ওপর গভীর গবেষণা করেন এবং ইসলামের মূল শিক্ষা প্রচারের জন্য হাদিসের বিভিন্ন সংকলন ও ব্যাখ্যা লিখেন। তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনা ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’, যেখানে তিনি ইসলামের মৌলিক নীতিগুলোর দার্শনিক ও সামাজিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন।

ফিকহ: ফিকহ নিয়ে তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে ঐক্যের প্রচেষ্টা। তিনি মনে করতেন যে চারটি প্রধান মাজহাব (হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি) একে অপরের বিরোধী নয়, বরং প্রতিটি ইসলামের মৌলিক বিধিমালাকে সহজবোধ্যরূপে সর্বসাধারণের জন্য উপস্থাপন করে।

সমাজ সংস্কার: শাহ ওয়ালিউল্লাহ ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতা দূর করতে চেয়েছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, মুসলিম শাসকরা দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য আনতে রাজনৈতিক চিন্তাধারা উপস্থাপন করেন এবং ইসলামি শাসনব্যবস্থার উন্নতির জন্য বিভিন্ন পরামর্শ দেন। মুসলমানদের শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আহমদ শাহ আবদালির (পাঠান শাসক) সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁকে ভারত আক্রমণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ ১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যেখানে মারাঠাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় নিশ্চিত হয়। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদে মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন রোধ করতে ব্যর্থ হয়।

আধ্যাত্মিকতা: শাহ ওয়ালিউল্লাহ সুফিবাদ ও শরিয়াহর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেন। তিনি শরিয়াহ-বিরোধী সুফিবাদ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। তিনি মনে করতেন যে কোরআন ও হাদিসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুফিবাদ মুসলমানদের নৈতিক ও আত্মিক উন্নতি ঘটাতে পারে।

ইসলাম প্রচার: তিনি ইসলামের মৌলিক শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর বইগুলোতে কোরআনের ব্যাখ্যা, হাদিসের বিশ্লেষণ, সমাজ সংস্কার, রাজনৈতিক দর্শন ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার সংমিশ্রণ দেখা যায়।

রচনাবলি

শাহ ওয়ালিউল্লাহ বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা ইসলামি গবেষণার ক্ষেত্রে আজও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কিছু প্রধান গ্রন্থ হলো—

হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা: ইসলামের মূলনীতি ও দর্শন ব্যাখ্যা।

ইজালাতুল খাফা আন খিলাফতিল খুলাফা: খেলাফত ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার ব্যাখ্যা।

আল-ফাওজুল কবির: কোরআনের তাফসিরের মূলনীতি নিয়ে লেখা।

কিরতাসুল জাজি: ইসলামের ইতিহাস ও শিক্ষা সম্পর্কিত রচনা।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

১৭৬২ সালে (১১৭৬ হিজরি) দিল্লিতে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইন্তেকাল করেন। তবে তাঁর চিন্তাধারা ও কর্ম ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে প্রভাব বিস্তার করে আসছে। তাঁর সন্তান ও অনুসারীরা তাঁর শিক্ষাকে প্রচার ও বিস্তৃত করেছেন, যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন ইসলামি আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেছে।

সূত্র

১. শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা

২. মাওলানা আবুল হাসান নদভি, তারিখে দাওয়াত ও আজিমত

৩. মুফতি তাকী উসমানি, ইসলামের ইতিহাস ও মুসলিম উম্মাহ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর ওপর নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ মার্কিন ফেডারেল সংস্থার

ভারত নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রিকশাচালকের সঙ্গে তর্ক, বাংলাদেশিকে ফেরত

আকরামদের প্রথম খবর দেওয়া হয়েছিল, তামিম আর নেই

‘মদের বোতল’ হাতে বৈষম্যবিরোধী নেতা-নেত্রীর ভিডিও, সদস্যপদ স্থগিত

চীনের আগে ভারত সফরে যেতে চেয়েছিলেন ড. ইউনূস: দ্য হিন্দুকে প্রেস সচিব

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত