ইজাজুল হক, ঢাকা
পবিত্র কোরআনের সুরা ইউসুফে আল্লাহ তাআলা নবী ইউসুফ (আ.)-এর জীবনের রোমাঞ্চকর গল্প তুলে ধরেছেন। এই গল্পের অনেক চমৎকার ও উল্লেখযোগ্য দিকের একটি হলো—কঠিন দুর্ভিক্ষের আগমুহূর্তে তিনি মিসরের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সফলভাবে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করেন। সুরা ইউসুফের আলোকে এ ঘটনার প্রেক্ষাপট এবং দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ইউসুফ (আ.)-এর পদক্ষেপগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
মিসরের বাদশাহর অদ্ভুত স্বপ্ন
হজরত ইউসুফ (আ.) তখন জুলেখার মিথ্যা অভিযোগে মিসরের কারাগারে বন্দী। একদিন মিসরের বাদশাহ এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। রাজ্যের সভাসদগণকে ডেকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা চেয়ে বললেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখলাম, সাতটি জীর্ণশীর্ণ গাভি সাতটি হৃষ্টপুষ্ট গাভিকে খেয়ে ফেলছে, (আর দেখলাম) সাতটি সবুজ সতেজ শিষ আর অন্য সাতটি শুকনো। হে সভাসদগণ, আমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা দাও, যদি তোমরা ব্যাখ্যা করতে পারো।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৩)
সভাসদগণ বললেন, ‘নিতান্ত কল্পনাপ্রসূত স্বপ্ন। আর আমরা এ ধরনের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে অভ্যস্ত নই।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৪)
ইউসুফ (আ.)-এর খোঁজ মিলল যেভাবে
কারাগারে একই সেলে ইউসুফ (আ.)-এর দুই সঙ্গী ছিলেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি তাঁদের আস্থা অর্জন করেছিলেন। ইউসুফ (আ.)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী তাঁদের একজন মৃত্যুদণ্ড পান, অন্যজন জেল থেকে মুক্তি পান এবং বাদশাহর সেবক পদে নিয়োগ পান। দ্বিতীয়জনকে জেল থেকে বের হওয়ার আগে ইউসুফ (আ.) বলেছিলেন, ‘তোমার মনিবের কাছে আমার কথা বলিও।’ (সুরা ইউসুফ: ৪২) মুক্ত হওয়ার পর তিনি সে কথা ভুলে যান। বাদশাহর এই অদ্ভুত স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাওয়ার সময়ও ইউসুফ (আ.)-এর কথা মনে পড়েনি তাঁর।
অনেক দিন পর বাদশাহর সেই সেবকের ইউসুফ (আ.)-এর কথা মনে পড়ে এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেওয়ায় তাঁর পারদর্শিতার কথাও মনে পড়ে। তখন তিনি বাদশাহর কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা এনে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কারাগারের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি চান এবং বলেন, ‘আমি আপনাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দেব, তবে আমাকে কারাগারের ভেতরে পাঠান।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৫)
ইউসুফ (আ.)-এর চমৎকার ব্যাখ্যা
বাদশাহ সেবককে কারাগারের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। সেবক গিয়ে ইউসুফ (আ.)-এর কাছে বাদশাহের স্বপ্নের ঘটনা খুলে বললেন এবং ব্যাখ্যা চাইলেন। ইউসুফ (আ.) স্বপ্নের এক চমৎকার ব্যাখ্যা দিলেন। সাতটি হৃষ্টপুষ্ট গাভি ও সাতটি সতেজ শিষের ব্যাখ্যা ও করণীয় সম্পর্কে বললেন, ‘তোমরা সাত বছর একাধারে চাষ করবে। এরপর যখন তোমরা ফসল কাটবে, তখন অল্প যা খাবে, বাকি শস্য শিষসমেত সংরক্ষণ করবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৭)
এরপর সেই গাভিগুলোকে সাতটি জীর্ণশীর্ণ গাভির খেয়ে ফেলা এবং সাতটি শুকনো শিষের ব্যাখ্যা ও করণীয় সম্পর্কে বললেন, ‘এরপর সাতটি কঠিন বছর আসবে। এ সময়ের জন্য আগে তোমরা যা সঞ্চয় করেছিলে, তা লোকে খাবে। এরপর একটি বছর আসবে, যখন মানুষের কল্যাণে প্রচুর বৃষ্টি হবে এবং মানুষ যথেষ্ট ভোগ-বিলাস করবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৮-৪৯)
বাদশাহর বিশ্বস্ততা অর্জন
ইউসুফ (আ.)-এর ব্যাখ্যা বাদশাহর পছন্দ হলো। তিনি বললেন, ‘তাঁকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ দূত কারাগারে এসে ইউসুফ (আ.)কে সুখবর দিলেন। ইউসুফ (আ.) বললেন, ‘বাদশাহর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, যেসব নারী হাত কেটে ফেলেছিল এবং যে মিথ্যা অভিযোগে আমি বন্দী আছি, তা সমাধান না হলে আমি যাব না।’ বাদশাহ বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নিলেন এবং অভিযোগকারী জুলেখা অপরাধ স্বীকার করে নেন। ফলে ইউসুফ (আ.) নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্ত হলেন। (সুরা ইউসুফের ৫০ থেকে ৫৩ নম্বর আয়াতের সারমর্ম)
এরপর বাদশাহ বললেন, ‘তাঁকে আমার কাছে নিয়ে এসো, আমি তাঁকে আমার দরবারে বিশেষভাবে সম্মানিত করব।’ (সুরা ইউসুফ: ৫৪)
ইউসুফ (আ.) বাদশাহর সঙ্গে বৈঠক করলেন। বাদশাহ তাঁর কথায় দারুণভাবে প্রভাবিত হলেন এবং তাঁকে উপদেষ্টা নিয়োগ দিলেন। বাদশাহ বললেন, ‘আজ আপনি আমাদের কাছে খুবই মর্যাদাশীল ও বিশ্বস্ত হিসেবে পরিগণিত।’ (সুরা ইউসুফ: ৫৪)
স্বেচ্ছায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ
ইউসুফ (আ.) জানতেন, আসন্ন দুর্ভিক্ষের সময় জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই অদক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থেকে সরাতে হবে। যোগ্য কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে। ফলে আল্লাহর আদেশে তিনি বাদশাহর কাছে অর্থ, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পদের আবেদন করে বলেন, ‘আপনি আমাকে দেশের ধনভান্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত করুন। আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও বিজ্ঞ।’ (সুরা ইউসুফ: ৫৫)
আসন্ন বিপদ থেকে জনগণকে রক্ষা করতে বাদশাহর কাছেও ইউসুফ (আ.)-এর বিকল্প ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন আল্লাহর নবী ও বিশ্বস্ততম ব্যক্তি। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, জাতীয় সংকটকালে গণমানুষের স্বার্থে যোগ্যদের নেতৃত্বের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা দোষের নয়।
সর্বোচ্চ উৎপাদন ও দীর্ঘমেয়াদি মজুত
দায়িত্ব নিয়েই ইউসুফ (আ.) সর্বোচ্চ খাদ্য উৎপাদনে মনোনিবেশ করেন এবং আসন্ন দুর্ভিক্ষের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রকল্প হাতে নেন। যেমনটি তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যার সময় বলেছিলেন, ‘তোমরা সাত বছর একাধারে চাষ করবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৭)
এরপর শস্য মজুত করেন এবং দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ইউসুফ (আ.)-এর ভাষায়, ‘এরপর যখন তোমরা ফসল কাটবে, তখন তোমরা অল্প খাবে, বাকি শস্য শিষসমেত সংরক্ষণ করবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৭)
অপচয় রোধ এবং সুষম বণ্টন
দায়িত্ব নিয়ে ইউসুফ (আ.) রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়-অপব্যয় বন্ধ করেন এবং শস্যের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করেন। যেমন—কোরআনের আয়াতে ‘তোমরা অল্প যা খাবে, বাকি শস্য মজুত করবে’ বলার মাধ্যমে ইউসুফ (আ.) ভোক্তাদের মধ্যে অপচয়-অপব্যয় কমিয়ে আনার কথা আগেই বলেছেন। উৎপাদন থেকে কম খরচ করে বিপদের সময়ের জন্য সঞ্চয় করতে বলেছেন।
ইউসুফ (আ.)-এর সতর্কতা জারির কারণে মিসরের মানুষ দুর্ভিক্ষের জন্য ফসল সঞ্চয় করে রাখে এবং দুর্ভিক্ষের সময় নিজেদের সঞ্চিত ফসল ভোগ করতে থাকে। যেমন—পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এরপর সাতটি কঠিন বছর আসবে। এই সময়ের জন্য আগে তোমরা যা সঞ্চয় করেছিলে, তা লোকে খাবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৮)
ফলে রাজভান্ডারে সঞ্চিত ফসলগুলো পরিকল্পিতভাবে অভাবীদের মধ্যে বণ্টিত হতে থাকে। এ কারণে মিসরের মানুষের তেমন কোনো দুর্ভোগ ও অভাব ছিল না। বরং পাশের ফিলিস্তিনসহ অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও মিসর থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে। ইউসুফ (আ.)-এর ভাইয়েরা খাবার সংগ্রহ করতেই মিসরে এসেছিলেন।
নিজেই শস্য বণ্টন করতেন ইউসুফ (আ.)
ঐতিহাসিকদের মতে, দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ইউসুফ (আ.)-ই প্রথম রেশন কার্ড চালু করেন। ইউসুফ (আ.) নিজেই দুর্ভিক্ষকালীন কর্মকাণ্ডগুলো সরাসরি তদারক করতেন। সুরা ইউসুফের পরের আয়াতগুলোতে দেখা যায়, ইউসুফ (আ.)-এর ভাইয়েরা শস্য সংগ্রহে মিসরে এলে তিনিই সরাসরি তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করেন এবং বাবা-মায়ের খোঁজখবরও নেন। আবার তাঁদের আসতে বলেন এবং সহোদর বিনইয়ামিনকেও নিয়ে আসতে বলেন। পরেরবার বিনইয়ামিনকে নিয়ে এলে তাঁকে কৌশলে রেখে দেন ইউসুফ (আ.)।
এসব ঘটনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইউসুফ (আ.) নিজেই শস্য বণ্টনের কাজ তদারক করতেন এবং সবার আসা-যাওয়া পর্যবেক্ষণ করতেন। ফলে কারও অন্যায় সুবিধা নেওয়ার এবং দুর্নীতি করার সুযোগ সেখানে ছিল না।
দুর্ভিক্ষের পরের জন্য পরিকল্পনা
দুর্ভিক্ষের পরের সময়ের জন্য যথেষ্ট বীজও সংরক্ষণ করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন ইউসুফ (আ.)। স্বপ্নের ব্যাখ্যা থেকেই বিষয়টি বোঝা যায়। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তবে সেই অল্পটুকু বাদে, যা তোমরা (বীজ হিসেবে) সংরক্ষণ করবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৮)
ফলে দেখা গেছে, দুর্ভিক্ষের পর এতই ভালো ফলন হলো যে মানুষ খুব সুখে জীবনযাপন করতে লাগল। কোরআনের ভাষায়—‘এরপর একটি বছর আসবে, যখন মানুষের কল্যাণে প্রচুর বৃষ্টি হবে এবং মানুষ যথেষ্ট ভোগবিলাস করবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৯)
সুরা ইউসুফকে আল্লাহ তাআলা ‘আহসানুল কাসাস’ বা ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ আখ্যা দিয়েছেন। দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার পাশাপাশি এই গল্পের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এ সুরায় রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ। আল্লাহ তাআলা আমাদের বোঝার ও অনুধাবন করার তৌফিক দিন।
পবিত্র কোরআনের সুরা ইউসুফে আল্লাহ তাআলা নবী ইউসুফ (আ.)-এর জীবনের রোমাঞ্চকর গল্প তুলে ধরেছেন। এই গল্পের অনেক চমৎকার ও উল্লেখযোগ্য দিকের একটি হলো—কঠিন দুর্ভিক্ষের আগমুহূর্তে তিনি মিসরের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সফলভাবে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করেন। সুরা ইউসুফের আলোকে এ ঘটনার প্রেক্ষাপট এবং দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ইউসুফ (আ.)-এর পদক্ষেপগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
মিসরের বাদশাহর অদ্ভুত স্বপ্ন
হজরত ইউসুফ (আ.) তখন জুলেখার মিথ্যা অভিযোগে মিসরের কারাগারে বন্দী। একদিন মিসরের বাদশাহ এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। রাজ্যের সভাসদগণকে ডেকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা চেয়ে বললেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখলাম, সাতটি জীর্ণশীর্ণ গাভি সাতটি হৃষ্টপুষ্ট গাভিকে খেয়ে ফেলছে, (আর দেখলাম) সাতটি সবুজ সতেজ শিষ আর অন্য সাতটি শুকনো। হে সভাসদগণ, আমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা দাও, যদি তোমরা ব্যাখ্যা করতে পারো।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৩)
সভাসদগণ বললেন, ‘নিতান্ত কল্পনাপ্রসূত স্বপ্ন। আর আমরা এ ধরনের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে অভ্যস্ত নই।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৪)
ইউসুফ (আ.)-এর খোঁজ মিলল যেভাবে
কারাগারে একই সেলে ইউসুফ (আ.)-এর দুই সঙ্গী ছিলেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি তাঁদের আস্থা অর্জন করেছিলেন। ইউসুফ (আ.)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী তাঁদের একজন মৃত্যুদণ্ড পান, অন্যজন জেল থেকে মুক্তি পান এবং বাদশাহর সেবক পদে নিয়োগ পান। দ্বিতীয়জনকে জেল থেকে বের হওয়ার আগে ইউসুফ (আ.) বলেছিলেন, ‘তোমার মনিবের কাছে আমার কথা বলিও।’ (সুরা ইউসুফ: ৪২) মুক্ত হওয়ার পর তিনি সে কথা ভুলে যান। বাদশাহর এই অদ্ভুত স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাওয়ার সময়ও ইউসুফ (আ.)-এর কথা মনে পড়েনি তাঁর।
অনেক দিন পর বাদশাহর সেই সেবকের ইউসুফ (আ.)-এর কথা মনে পড়ে এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেওয়ায় তাঁর পারদর্শিতার কথাও মনে পড়ে। তখন তিনি বাদশাহর কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা এনে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কারাগারের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি চান এবং বলেন, ‘আমি আপনাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দেব, তবে আমাকে কারাগারের ভেতরে পাঠান।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৫)
ইউসুফ (আ.)-এর চমৎকার ব্যাখ্যা
বাদশাহ সেবককে কারাগারের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। সেবক গিয়ে ইউসুফ (আ.)-এর কাছে বাদশাহের স্বপ্নের ঘটনা খুলে বললেন এবং ব্যাখ্যা চাইলেন। ইউসুফ (আ.) স্বপ্নের এক চমৎকার ব্যাখ্যা দিলেন। সাতটি হৃষ্টপুষ্ট গাভি ও সাতটি সতেজ শিষের ব্যাখ্যা ও করণীয় সম্পর্কে বললেন, ‘তোমরা সাত বছর একাধারে চাষ করবে। এরপর যখন তোমরা ফসল কাটবে, তখন অল্প যা খাবে, বাকি শস্য শিষসমেত সংরক্ষণ করবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৭)
এরপর সেই গাভিগুলোকে সাতটি জীর্ণশীর্ণ গাভির খেয়ে ফেলা এবং সাতটি শুকনো শিষের ব্যাখ্যা ও করণীয় সম্পর্কে বললেন, ‘এরপর সাতটি কঠিন বছর আসবে। এ সময়ের জন্য আগে তোমরা যা সঞ্চয় করেছিলে, তা লোকে খাবে। এরপর একটি বছর আসবে, যখন মানুষের কল্যাণে প্রচুর বৃষ্টি হবে এবং মানুষ যথেষ্ট ভোগ-বিলাস করবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৮-৪৯)
বাদশাহর বিশ্বস্ততা অর্জন
ইউসুফ (আ.)-এর ব্যাখ্যা বাদশাহর পছন্দ হলো। তিনি বললেন, ‘তাঁকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ দূত কারাগারে এসে ইউসুফ (আ.)কে সুখবর দিলেন। ইউসুফ (আ.) বললেন, ‘বাদশাহর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, যেসব নারী হাত কেটে ফেলেছিল এবং যে মিথ্যা অভিযোগে আমি বন্দী আছি, তা সমাধান না হলে আমি যাব না।’ বাদশাহ বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নিলেন এবং অভিযোগকারী জুলেখা অপরাধ স্বীকার করে নেন। ফলে ইউসুফ (আ.) নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্ত হলেন। (সুরা ইউসুফের ৫০ থেকে ৫৩ নম্বর আয়াতের সারমর্ম)
এরপর বাদশাহ বললেন, ‘তাঁকে আমার কাছে নিয়ে এসো, আমি তাঁকে আমার দরবারে বিশেষভাবে সম্মানিত করব।’ (সুরা ইউসুফ: ৫৪)
ইউসুফ (আ.) বাদশাহর সঙ্গে বৈঠক করলেন। বাদশাহ তাঁর কথায় দারুণভাবে প্রভাবিত হলেন এবং তাঁকে উপদেষ্টা নিয়োগ দিলেন। বাদশাহ বললেন, ‘আজ আপনি আমাদের কাছে খুবই মর্যাদাশীল ও বিশ্বস্ত হিসেবে পরিগণিত।’ (সুরা ইউসুফ: ৫৪)
স্বেচ্ছায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ
ইউসুফ (আ.) জানতেন, আসন্ন দুর্ভিক্ষের সময় জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই অদক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থেকে সরাতে হবে। যোগ্য কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে। ফলে আল্লাহর আদেশে তিনি বাদশাহর কাছে অর্থ, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পদের আবেদন করে বলেন, ‘আপনি আমাকে দেশের ধনভান্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত করুন। আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও বিজ্ঞ।’ (সুরা ইউসুফ: ৫৫)
আসন্ন বিপদ থেকে জনগণকে রক্ষা করতে বাদশাহর কাছেও ইউসুফ (আ.)-এর বিকল্প ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন আল্লাহর নবী ও বিশ্বস্ততম ব্যক্তি। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, জাতীয় সংকটকালে গণমানুষের স্বার্থে যোগ্যদের নেতৃত্বের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা দোষের নয়।
সর্বোচ্চ উৎপাদন ও দীর্ঘমেয়াদি মজুত
দায়িত্ব নিয়েই ইউসুফ (আ.) সর্বোচ্চ খাদ্য উৎপাদনে মনোনিবেশ করেন এবং আসন্ন দুর্ভিক্ষের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রকল্প হাতে নেন। যেমনটি তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যার সময় বলেছিলেন, ‘তোমরা সাত বছর একাধারে চাষ করবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৭)
এরপর শস্য মজুত করেন এবং দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ইউসুফ (আ.)-এর ভাষায়, ‘এরপর যখন তোমরা ফসল কাটবে, তখন তোমরা অল্প খাবে, বাকি শস্য শিষসমেত সংরক্ষণ করবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৭)
অপচয় রোধ এবং সুষম বণ্টন
দায়িত্ব নিয়ে ইউসুফ (আ.) রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়-অপব্যয় বন্ধ করেন এবং শস্যের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করেন। যেমন—কোরআনের আয়াতে ‘তোমরা অল্প যা খাবে, বাকি শস্য মজুত করবে’ বলার মাধ্যমে ইউসুফ (আ.) ভোক্তাদের মধ্যে অপচয়-অপব্যয় কমিয়ে আনার কথা আগেই বলেছেন। উৎপাদন থেকে কম খরচ করে বিপদের সময়ের জন্য সঞ্চয় করতে বলেছেন।
ইউসুফ (আ.)-এর সতর্কতা জারির কারণে মিসরের মানুষ দুর্ভিক্ষের জন্য ফসল সঞ্চয় করে রাখে এবং দুর্ভিক্ষের সময় নিজেদের সঞ্চিত ফসল ভোগ করতে থাকে। যেমন—পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এরপর সাতটি কঠিন বছর আসবে। এই সময়ের জন্য আগে তোমরা যা সঞ্চয় করেছিলে, তা লোকে খাবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৮)
ফলে রাজভান্ডারে সঞ্চিত ফসলগুলো পরিকল্পিতভাবে অভাবীদের মধ্যে বণ্টিত হতে থাকে। এ কারণে মিসরের মানুষের তেমন কোনো দুর্ভোগ ও অভাব ছিল না। বরং পাশের ফিলিস্তিনসহ অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও মিসর থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে। ইউসুফ (আ.)-এর ভাইয়েরা খাবার সংগ্রহ করতেই মিসরে এসেছিলেন।
নিজেই শস্য বণ্টন করতেন ইউসুফ (আ.)
ঐতিহাসিকদের মতে, দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ইউসুফ (আ.)-ই প্রথম রেশন কার্ড চালু করেন। ইউসুফ (আ.) নিজেই দুর্ভিক্ষকালীন কর্মকাণ্ডগুলো সরাসরি তদারক করতেন। সুরা ইউসুফের পরের আয়াতগুলোতে দেখা যায়, ইউসুফ (আ.)-এর ভাইয়েরা শস্য সংগ্রহে মিসরে এলে তিনিই সরাসরি তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করেন এবং বাবা-মায়ের খোঁজখবরও নেন। আবার তাঁদের আসতে বলেন এবং সহোদর বিনইয়ামিনকেও নিয়ে আসতে বলেন। পরেরবার বিনইয়ামিনকে নিয়ে এলে তাঁকে কৌশলে রেখে দেন ইউসুফ (আ.)।
এসব ঘটনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইউসুফ (আ.) নিজেই শস্য বণ্টনের কাজ তদারক করতেন এবং সবার আসা-যাওয়া পর্যবেক্ষণ করতেন। ফলে কারও অন্যায় সুবিধা নেওয়ার এবং দুর্নীতি করার সুযোগ সেখানে ছিল না।
দুর্ভিক্ষের পরের জন্য পরিকল্পনা
দুর্ভিক্ষের পরের সময়ের জন্য যথেষ্ট বীজও সংরক্ষণ করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন ইউসুফ (আ.)। স্বপ্নের ব্যাখ্যা থেকেই বিষয়টি বোঝা যায়। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তবে সেই অল্পটুকু বাদে, যা তোমরা (বীজ হিসেবে) সংরক্ষণ করবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৮)
ফলে দেখা গেছে, দুর্ভিক্ষের পর এতই ভালো ফলন হলো যে মানুষ খুব সুখে জীবনযাপন করতে লাগল। কোরআনের ভাষায়—‘এরপর একটি বছর আসবে, যখন মানুষের কল্যাণে প্রচুর বৃষ্টি হবে এবং মানুষ যথেষ্ট ভোগবিলাস করবে।’ (সুরা ইউসুফ: ৪৯)
সুরা ইউসুফকে আল্লাহ তাআলা ‘আহসানুল কাসাস’ বা ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ আখ্যা দিয়েছেন। দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার পাশাপাশি এই গল্পের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এ সুরায় রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ। আল্লাহ তাআলা আমাদের বোঝার ও অনুধাবন করার তৌফিক দিন।
৭ ধরনের গুনাহকে বিধ্বংসী আখ্যা দিয়ে তা থেকে বিরত থাকার জন্য বিশেষভাবে উপদেশ দিয়েছেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। (রিয়াদুস সালেহিন: ১৮০২) কাজগুলো হলো—
১৭ ঘণ্টা আগেসড়ককে মানুষের চলাচলের উপযোগী করা ইমানের পরিচায়ক। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ইমানের ৭০টির বেশি শাখা আছে, এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান শাখা হলো, এ কথার স্বীকৃতি দেওয়া যে, আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আর সবচেয়ে নিচের শাখাটি হলো, সড়কে কোনো কষ্টদায়ক বস্তু বা প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা সরিয়ে দেওয়া।’ (
২ দিন আগেশীতকালে দিনের দৈর্ঘ্য বছরের যেকোনো সময়ের তুলনায় কম হয় এবং আবহাওয়া থাকে শীতল, যা রোজা রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী সময়। অপর দিকে শীতের রাত অনেক দীর্ঘ হয়, ফলে রাতের প্রথম প্রহরে ঘুমিয়ে নিয়ে শেষ প্রহরে আল্লাহর ইবাদত ও তাহাজ্জুদে মগ্ন হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া যায়। এ কারণে হাদিসে শীতকালকে ইবাদতের বসন্তক
৩ দিন আগেআল্লাহ মানুষকে দুভাবে পরীক্ষা করেন। বিপদ দিয়ে এবং নিয়ামত দিয়ে। নিয়ামতের পরীক্ষা বিপদের পরীক্ষার চেয়ে কঠিন। বিপদের সময় মানুষ আল্লাহর স্মরণ করে; তার সাহায্য প্রার্থনা করে।
৪ দিন আগে