মোবাইল ফোনে কথা বলার আদব

ড. এ এন এম মাসউদুর রহমান
Thumbnail image

বর্তমান সময়ে পারস্পরিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম মোবাইল ফোন। তারহীন এই ফোন এখন মানুষের হাতে হাতে। পারস্পরিক যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, কেনাকাটা, লেখাপড়াসহ বিভিন্ন তথ্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই আদান-প্রদান করা হয়ে থাকে। এটি আমাদের জীবন চলার পথ সাবলীল করেছে। এতে ইন্টারনেট যুক্ত হওয়ায় ই-মেইল, মেসেঞ্জার, টুইটার, ইউটিউবসহ বিভিন্ন প্রোগ্রামের ব্যবহার সহজ হয়েছে। উপকারী এই যন্ত্র ব্যবহারের কিছু আদব রয়েছে। এখানে কিছু আদবের কথা তুলে ধরা হলো—

সালাম দিয়ে কথা শুরু করা
মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় সালাম দিয়ে কথা শুরু করা সুন্নত। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সালামের আগে কথা শুরু করে, তার কথার উত্তর দিয়ো না।’ (সহিহুল জামে)। একইভাবে একজনের সঙ্গে একাধিকবার ফোন করা হলেও প্রতিবারই সালাম বিনিময় করা এবং কথা শেষে সালাম দেওয়া সুন্নত। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ মজলিশে উপস্থিত হলে যেন সালাম দেয় এবং মজলিশ থেকে বিদায়ের সময়ও যেন সালাম দেয়। প্রথম সালাম শেষ সালাম অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ (আবু দাউদ) 

নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলা
সালামের পর নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বললে ভুল-বোঝাবুঝি থেকে মুক্ত থাকা যায়। জাবির (রা.) বলেন, ‘আমি আমার বাবার ঋণসংক্রান্ত বিষয়ে জানার জন্য মহানবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে তাঁর দরজায় কড়া নাড়লাম। তিনি বললেন, “কে?” আমি বললাম, “আমি।” তখন তিনি ধমকের সুরে বললেন, “আমি আমি?” মনে হয় তিনি এটা অপছন্দ করেন। (বুখারি) 

অনুমতি নিয়ে কথা বলা
কোনো কোনো লোক মোবাইল করেই কথা বলা শুরু করেন। এমন না করে কথা বলার জন্য অনুমতি নেওয়া বা তার কথা বলার মতো পর্যাপ্ত সময় আছে কি না, জেনে কথা বলা ভদ্রতা। এরপর প্রয়োজনীয় কথা দ্রুত সেরে নেওয়া ভদ্রতা।

নিচু স্বরে কথা বলা
এমনভাবে কথা বলতে হবে, যাতে অন্য প্রান্তের মানুষ শুনতে পায়। কোনোভাবেই রুক্ষভাবে উচ্চ আওয়াজে কথা বলা সমীচীন নয়। কেননা, এমন আওয়াজ গাধার আওয়াজের সঙ্গে তুলনীয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি পদচারণে মধ্যপন্থা অবলম্বন করো এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করো। নিশ্চয়ই সবচেয়ে অপছন্দের স্বর হলো গাধার স্বর।’ (সুরা লুকমান: ১৯) 

প্রয়োজনীয় কথা বলা
ফোন বা মোবাইল ফোন অতিরিক্ত কথা বলার যন্ত্র নয়। বরং এতে একান্ত প্রয়োজনীয় কথা সংক্ষেপে বলতে হবে। কেননা, অধিক কথা বলতে গেলে পাপসংশ্লিষ্ট কথাও হতে পারে। তাই অপ্রয়োজনীয় কথা পরিহার করাই শ্রেয়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘মানুষের জন্য ইসলামের সৌন্দর্য হলো, তার অনর্থক বিষয় পরিহার করা।’ (ইবনে মাজাহ) 

ধীরে ধীরে বুঝিয়ে কথা বলা
মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় ধীরে ধীরে কথা বলা উচিত, যাতে অন্য প্রান্তের শ্রোতা বুঝতে পারেন। প্রয়োজনে কথা বোঝার জন্য ফের বলতে হবে। আনাস (রা.) বলেন, যখন মহানবী (সা.) কথা বলতেন, তখন তিনি তা তিনবার বলতেন, যাতে তা বোধগম্য হয়।’ (বুখারি) আয়েশা (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.) এমনভাবে কথা বলতেন, কোনো গণনাকারী তা গুনতে চাইলে গণনা করতে পারতেন।’ (বুখারি) 

হাসিমুখে কথা বলা
কারও সঙ্গে মুখ ভার করে অথবা গোমড়ামুখে কথা বলা উচিত নয়, বরং হাসিমুখে কথা বলাই কল্যাণকর। এতে পারস্পরিক সম্পর্ক যেমন দৃঢ় ও গাঢ় হয়, তেমনি তাতে সওয়াবও রয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমার হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তোমার ভাইয়ের সামনে উপস্থিত হওয়া তোমার জন্য সদকাস্বরূপ।’ (তিরমিজি) 

মর্যাদা অনুসারে কথা বলা
যাঁর কাছে কল করা হচ্ছে, তাঁর মর্যাদার প্রতি লক্ষ রেখে কথা বলা উচিত। যে ব্যক্তি যতটুকু সম্মান পাওয়ার হকদার, তাঁকে ততটুকু সম্মান দিয়ে শালীনতা বজায় রাখা ইসলামের দাবি। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.) আমাদের মানুষের পদমর্যাদা অনুসারে স্থান দিতে আদেশ করেছেন।’ (মুসলিম) 

নামাজ ও ঘুমের সময় কল না দেওয়া
দিনে-রাতে পাঁচবার নামাজ আদায়ের সময় কাউকে কল দেওয়া বা মেসেজ পাঠানো উচিত নয়। এতে নামাজের একাগ্রতা নষ্ট হয় এবং পার্শ্ববর্তী মুসল্লিদের নামাজ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ঘুম আল্লাহ তাআলার বড় নিয়ামত। সারা দিনের কর্মক্লান্তি শেষে মানুষ যখন রাতে ঘুমায়, সেই ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে কাউকে কল দেওয়া অনুচিত।

মিথ্যা তথ্য পরিবেশন না করা
মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় সত্য ও সঠিক তথ্য পরিবেশন করা আবশ্যক। কথা বলার সময় কোনো তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়া তা অন্যের কাছে পরিবেশন করা উচিত নয়। এমনকি স্বীয় অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে সঠিক স্থানের নাম না বলে অন্য স্থানের নাম বললে তা-ও মিথ্যাচারের শামিল। আর জেনেশুনে মিথ্যা বলা কবিরা গুনাহ।

ইচ্ছাকৃত কল রিসিভ না করা অনুচিত
কেউ কেউ আছেন, যাঁরা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কল রিসিভ করেন না, অথচ অন্য প্রান্ত থেকে বারবার কল হয়েই যাচ্ছে। একইভাবে কেউ কেউ মোবাইল ফোন সাইলেন্ট করে রাখেন। ফলে তাঁকে কল করে কোনো উত্তর পাওয়া সম্ভব হয় না। উভয় অবস্থায় ক্ষতির আশঙ্কা থাকতে পারে। কারণ যিনি কল করছেন, তিনি গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংবাদ পাঠাতে চাইছেন। কিন্তু তা না পাঠানোর কারণে কারও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

মোবাইল ফোন বর্তমান সময়ের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। এটির যেমন নানাবিধ উপকার রয়েছে, তেমনি অপকারও রয়েছে। তাই মোবাইল ফোন ব্যবহারে সুন্নত পদ্ধতি অবলম্বন করা আবশ্যক।

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত