Ajker Patrika

লিচু এবং একটি প্রেমকাহিনি

ড. তৈফুর রহমান
লিচু এবং একটি প্রেমকাহিনি

ইয়াং উহুয়ান ছিলেন চীনের তাং রাজবংশের সম্রাট য়ুয়ানঝংয়ের (৬৮৫-৭৬২) প্রিয়তম উপপত্নী। প্রাচীন চীনা কিংবদন্তির যে চার সেরা সুন্দরীর কথা বলা হয়, ইয়াং ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি ইয়াং গিফেই নামেও পরিচিত।

লিচু ছিল পরাক্রমশালী সম্রাটের এই সুন্দরী প্রিয়তমার অতি পছন্দের ফল।

সম্রাট য়ুয়ানঝংয়ের রাজধানী ছিল উত্তর চীনের জিয়ানে। সেখানে লিচু জন্মায় না। লিচু পাওয়া যায় দক্ষিণ চীনের অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে, যা জিয়ান থেকে অনেক দূরে। লিচু এমন এক ফল, যা অল্প কয়েক সপ্তাহ পাওয়া যায়, আর গাছ থেকে পাড়ামাত্রই স্বাদ হারাতে শুরু করে। দুই-তিন দিনের মধ্যে না খেলে টক টক গন্ধ হয়ে যায়। সেই টসটসে লাবণ্য বা ভুবনমোহিনী স্বাদ অথবা পাগলপারা সুঘ্রাণ কোনোটাই আর থাকে না।

কিন্তু সুন্দরী ইয়াংয়ের আবদার, তাঁকে তাজা লিচু খাওয়াতেই হবে, কমসে কম শখানেক—প্রায় প্রতিদিন! রাজ আবদার বলে কথা। সম্রাট বললেন, ‘তথাস্তু’।

রাজধানী জিয়ানের সবচেয়ে কাছাকাছি লিচু জন্মে সিচুয়ান প্রদেশে। কাছাকাছি বলতে সে-ও শ তিনেক মাইলের ধাক্কা। সেখান থেকে দ্রুততম সময়ে অনাঘ্রাতা লিচু রাজধানীতে আনা যাবে কীভাবে? উপায় বের হলো, ঘোড়ার ডাক। অর্থাৎ লিচু পাড়ামাত্র টুকরিতে লতাপাতা দিয়ে মুড়িয়ে তুলে দেওয়া হবে অশ্বারোহীর হাতে। দ্রুতগামী ঘোড়া ছুটবে রাজধানীর পানে। কিছুদূর যেতেই অপেক্ষমাণ আরেক বাহকের হাতে তুলে দেওয়া হবে সেই লিচুর ভান্ডার। এভাবে রিলে দৌড়ের মতো একের পর এক ঘোড়া বদলে বদলে লিচু পৌঁছে যাবে প্রাসাদের প্রান্তে। সেই অশ্ব ক্ষুরধ্বনি শ্রবণ করে লাস্যময়ী ইয়াংয়ের অধরে ফুটে উঠবে হাসির রেখা, যার রোমান্টিকতা পরের শতাব্দীর কবি দু-মু অমর করে রেখেছেন তাঁর কবিতার ছত্রে।

আমি কল্পনায় দেখতে পাই, এই উপাখ্যানের নায়িকা সখী পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন প্রাসাদের বাগানে, অতি যত্নে খোসা ছাড়িয়ে একটা একটা করে লিচু আলতো হাতে চিনামাটির পাত্রে রাখা হচ্ছে। সেখান থেকে ‘শুভ্র গোলক’ ইয়াংয়ের ওষ্ঠ, অধর ও জিহ্বায় বিগলিত হয়ে যাচ্ছে নিতান্তই আলস্যে। আর তাতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ম-ম এক নেশাময় ঘ্রাণ।

বাগানের ভ্রমর পর্যন্ত বিভ্রান্ত—সে ফুলের দিকে যাবে, নাকি ওই অজানা ফলের সুবাস এবং সুধার লোভে গিয়ে মাছি তাড়ানো ঝালরের বাড়ি খেয়ে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হবে?
‘রূপসী ইয়াংয়ের মতো সৌভাগ্য যদি আমার হতো!’ এমন চিন্তা কি উঁকি দিচ্ছে আপনাদের মনে? যদি দেয়, তবে এর পরের ইতিহাস শুনলে সে চিন্তা উবে যাবে।

শাবানার ‘এত সুখ কি আমার কপালে সইবে’-এর মতো ইয়াংয়ের কপালেও সুখ বেশি দিন সইল না। তাঁর চাচাতো কি মামাতো ভাই সম্রাটের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকিয়ে বিদ্রোহ করে বসল। সে বিদ্রোহের কারণে সম্রাট প্রাণ নিয়ে প্রাসাদ থেকে পালাচ্ছেন। এমন সময় তাঁর সহচরেরা বলল, ‘জাঁহাপনা, আপনার প্রিয়া ইয়াং এই কুকর্মের সঙ্গে জড়িত। তাঁকে এভাবে রেখে যাওয়া ঠিক বীরের কাজ হচ্ছে না। অনুমতি দেন তো তাঁর সানডে-মানডে ক্লোজ করে আসি। আসল বদমাশকে না পাই, তার বোনকে মেরে ভাইকে একটা শাস্তি না দিলেই নয়, মহামান্য।’ সম্রাট অনুমতি দিলেন, হয়তো ইচ্ছার বিরুদ্ধেই।

অনুচরদের একজন গিয়ে গলা টিপে মেরে রেখে এল সম্রাটের একদা প্রিয়তমা সঙ্গিনীকে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৭ বছর। সেটা ৭৫৬ সালের কথা।

ইয়াংয়ের স্মরণেই 
হয়তো চীনে একটি লিচুর জাতের নামকরণ হয়েছে ‘স্মাইলিং কনকিউবাইন’, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘হাস্যোজ্জ্বল উপপত্নী’। 
দেশে এখন লিচুর রাজত্ব চলছে। আমার এক চায়নিজ ছাত্রীর কাছ থেকে শোনা এই গল্প তাই মনে পড়ে গেল। সেই ছাত্রীর বলা গল্প এবং আরও কয়েকটি লেখা পড়ে লিচু নিয়ে এই অমর প্রেমকাহিনির মিসিং পয়েন্টগুলো একখানে জোড়া লাগিয়ে দিলাম। যাতে লিচু খাওয়ার সময় আপনাদের মনে পড়ে এক কিংবদন্তি সুন্দরীর কথা। 

লেখক: প্রযুক্তিবিদ, ইনফিনিয়াম ইউকে লিমিটেড, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত