ইশতিয়াক হাসান
থানচি থেকে শুরু হলো নৌ ভ্রমণ। দুই পাশেই সঙ্গী পাহাড়। ডান পাশেরগুলো বেশি উঁচু। পাহাড়ের নিচের দিকে, মাঝে-সাঝে একটা-দুটো বাঁশ, টিনের ঘর। তর তর করে বয়ে চলেছে সাঙ্গু। মিনিট পনেরো-কুড়ি পর, এমন এক জায়গায় চলে এলাম, মনে হলো পানি ফুটছে। ভয় পাবেন না, এটা আমাজনের জঙ্গলের ফুটন্ত পানির নদীর মতো কিছু নয়, নদীটা চড়াই-উতরাই পথে বয়ে যাওয়ায় ও নিচের ছোট ছোট পাথরের কারণে এ কাণ্ড। এখানটায় স্রোতও বেশি। নৌকাটা যখন তীব্র গতিতে এই জায়গাটি পেরোতে লাগল, ভয় ভয় করল, এর চেয়েও বেশি যেটা অনুভব করলাম সেটা রোমাঞ্চ।
স্ত্রী পুনম আর মেয়ে ওয়াফিকাকে নিয়ে বান্দরবান থেকে সকালে রওনা দিয়েছিলাম। চান্দের গাড়িতে থানচি আসার পথে দু-পাশের পাহাড় রাজ্য চোখ জুড়িয়েছে। অবশ্য এ পথে ভ্রমণের সময় সব সময়ই মুগ্ধ চোখে পাহাড় দেখি। আমি আগে এলেও নীলগিরির পরের অংশে এটা পুনমের প্রথম ভ্রমণ। ও বলল এদিকটার পাহাড় আরও সুন্দর। থানচি পৌঁছে দেখি আমাদের নৌকা প্রস্তুত হয়ে আছে। যে হোটেলে উঠব রেমাক্রিতে তার মালিকই নৌকা নিয়ে এসেছেন। তাঁর অবশ্য থানচিতে কিছু বাজার-সদাইও ছিল। অবশ্য এগুলো আমরা পৌঁছার আগেই সেরে রেখেছেন।
টগবগে পানির এলাকা পেরোতেই একটু জুত হয়ে বসলাম। এ সময়ই হঠাৎ প্রায় এক যুগ আগের একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল। সাঙ্গু নদী ধরে চলেছিলাম বড় মোদকের দিকে। মোটামুটি এই এলাকায় আসার পরই এক পলকের জন্য দেখেছিলাম লালচে শরীরটা, একটা ঢাল ধরে উঠছিল। কাকর বা মায়া হরিণ। ভয় পেলে কুকুরের মতো চিৎকার করে বলে ইংরেজি নাম বার্কিং ডিয়ার। বাংলাদেশের অনেক বনে-পাহাড়ে এখনো এ হরিণদের দেখা মেলে। এবারও পাহাড়ে চড়ে বেড়ানো কোনো বন্যপ্রাণীর খোঁজে ইতি-উতি চাইলাম।
মাঝে মাঝেই লম্বা ভেলা বানিয়ে বাঁশ পরিবহন করতে দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার ছোট বাঁশের ভেলা বানিয়ে কাছাকাছির কোনো গন্তব্যে টুকটাক মালামাল নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এখন দুই পাশের পাহাড়ই বেশ খাঁড়া। সেরো বা বন ছাগলেরা এ ধরনের পাথুরে পাহাড় বেয়ে চলায় দারুণ দক্ষ। তাতে কী, তাদের শিকার করার জন্য উৎ পেতে থাকা চিতা বাঘেরাও এমন পথে চলতে ওস্তাদ। তিন্দু পৌঁছাতে ঘণ্টা-সোয়া ঘণ্টা লাগল। গতবার যখন এসেছিলাম তিন্দু বাজাটা ভারি চমৎকার লেগেছিল। খোলামেলা, পরিচ্ছন্ন এক জায়গা মনে হয়েছিল। এখন কী অবস্থা দেখার সুযোগ মিলল না। কারণ এবার আমরা তিন্দু থামালাম না নৌকা।
তিন্দু ছাড়ার একটু পরেই ছোট ও মাঝারি আকারের পাথরের প্রাচুর্য চোখে পড়ল নদীতে। একটু পর চলে এলাম অদ্ভুত সুন্দর সেই জায়গাটিতে। রাজা পাথর, বড় পাথর এমনই নানা নামের বিশাল সব পাথর যেখানে নদীর দখল নিতে মহাব্যস্ত। এই জায়গাটি আমার খুব পছন্দ। আগের বার যখন এসেছিলাম অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম এ পাহাড়রাজ্যে।
পাথরের মাঝখান দিয়ে এঁকে-বেঁকে নৌকা নিয়ে যাওয়ায় রোমাঞ্চই আলাদা। তবে স্রোত অনেক, সঙ্গে আবার স্ত্রী-কন্যা আছে। তাই বিপজ্জনক অংশটা কিনার ধরে পাথরে পাথরে হেঁটে হেঁটে পার হলাম। বড় কয়েকটা পাথরে হাঁচড়ে-পাচড়ে উঠলামও। অবশ্য ওয়াফিকার দায়িত্ব আমাদের মাঝি মানে রিসোর্টের মালিক নিয়ে নিলেন।
আবার নৌকায় ওঠার মিনিট পনেরো পরেই একটা জায়গায় মাঝিকে থামার ইশারা করলাম। প্রায় আধখানা চাঁদের আকারে একটা বাঁক নিয়ে বয়ে যাচ্ছে সাঙ্গু, কিনারে ছোট ছোট পাথরের ওপর দিয়ে কল কল শব্দে ছুটছে জল। নদীর মাঝখানে দ্বীপের মতো তৈরি করেছে। নুড়ি পাথর ভরা ওই দ্বীপে নেমে দেখতে লাগলাম চারপাশের আশ্চর্য ভূ-বৈচিত্র্য। মনে পড়ল এখানে এসে এক যুগের আগের সেই ভ্রমণের সময় আমাদের পঞ্চাশোর্ধ্ব গাইড ডান দিকের পাহাড়টার দিকে হাতের ইশারা করে বলেছিলেন, ‘ওই পাহাড়টা যে, ওখানে একটা মস্ত বাঘ দেখছিলাম যে। আমার বয়স তখন, উনিশ-বিশ। পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বসে ছিলাম। বুক ঢিপ ঢিপ করছিল। ওটা আমারে দেখে নাই।’ হোক সে বহু বছর আগের ঘটনা, তারপরও বাঘের খবর তো! খুশি হয়ে উঠেছিলাম।
মনে পড়ল এদিকেই কোথাও, জায়গাটার নাম সম্ভবত মধু, এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাসহ দারুণ অ্যাডভেঞ্চার হয়েছিল শিকারি এনায়েত মাওলার। সাঙ্গু নদী ধরে নৌকায় করে যাওয়ার পথে এক মুরং পাড়ার লোকেরা চেপে ধরে পাগলা হাতি শিকারের জন্য, ওটার ভয়ে পরিবার সমেত গাছে মাচা বেঁধে থাকতে বাধ্য হচ্ছে তারা। নিভৃতচারী ওই মুরংরা বাংলা জানতেন না, এনায়েত মাওলাদের সঙ্গে নৌকায় থাকা মুরং গাইডেরা দো-ভাষীর কাজ করছিলেন। সেই হাতি শিকার করেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাটি। গাছের ওপর মুরংদের মাচাগুলোর চেহারা আঁকা হয়ে গিয়েছিল মনের পর্দায়। উন্মাদ হাতির খোঁজ করতে গিয়ে জঙ্গলে বাঘের ডাকও শোনেন এনায়েত মাওলা। অবশ্য এই রোমাঞ্চকর ঘটনাপ্রবাহ গত শতকের পঞ্চাশের দশকের। ভাবি, আহ্ সেই আদিম অরণ্য যদি ফিরে পাওয়া যেত!
আবার চলতে শুরু করল নৌকা। নদীটি এঁকে-বেঁকে যাওয়ার পথে পাশাপাশি মাঝেমাঝেই ওপর থেকে নিচে কিংবা নিচে নামছে, যথারীতি জলের তলে নানান পাথরের বিস্তার। ফলে সে ধরনের ফুটতে থাকা পানির এলাকা পাচ্ছি। পেরোবার সময় শরীর ভিজে যাচ্ছে জলে। ওয়াফিকা দেখলাম দারুণ উত্তেজিত। ভয়ের চেয়ে আনন্দই বেশি ওর, চিৎকার করছে রোমাঞ্চিত হয়ে।
মাঝে মাঝে উল্টোদিক থেকে আসা নৌকার দেখা পাচ্ছি। কোনোটাতে স্থানীয় বাসিন্দারা, কোনোটি আবার পর্যটকবোঝাই। পর্যটকদের চেহারাই বলে দিচ্ছে সাঙ্গুর রূপে মজে গেছেন তাঁরা।
কিছুক্ষণের মধ্যে নদীর পাড়ে কয়েকটা দোকান পেলাম। মনে পড়ল এক যুগের সেই ভ্রমণের সময় রাস্তার দু-পাশে এমন দোকান-পাট কিছুই চোখে পড়েনি। এবার মাঝেমধ্যেই নদীর তীরে এমন দোকান চোখে পড়ছে। দোকানগুলোর সামনে মাঝি দাঁড় করাল নৌকা। একটা দোকানে ঢুকলাম আমরা। লেবুর শরবত খেলাম। পুনম, ওয়াফিকা আর আমাদের মাঝি খেলেন কলা, পেঁপে। আমরা যে দোকানে ঢুকলাম সেটির মালিক এক মারমা নারী। বড় অমায়িক। আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়লেন। পাশেই একটা দোলনায় দুলছিল তাঁর ছোট্ট শিশুটি।
এক সময় আমরা চলে এলাম রেমাক্রি ঝরনার কাছে। এদিক দিয়েই রেমাক্রি খাল ধরে চলে গেলে পৌঁছে যাওয়া যায় নাফাখুম। তবে আমরা সেখানে থামলাম না। নৌকা নিয়ে চলে এলাম ডানে আমাদের রিসোর্ট যেখানে সেখানে অর্থাৎ রেমাক্রি বাজারের দিকটায়। দেখলাম চারপাশে আরও কয়েকটি পর্যটক বোঝাই নৌকা এসে থামল। এখানে রেমাক্রির জল বেশ শান্ত। দূরে পাহাড়রাজ্যে এঁকে-বেঁকে সাঙ্গু চলে গেছে মোদক হয়ে লিকরির দিকে। রেমাক্রিতে দুইটা দিন কী করলাম সে গল্প বরং জমা থাক অন্য কোনো দিনের জন্য।
জেনে রাখা ভালো
এখন নৌকা ভাড়া বেড়েছে। দিনে গিয়ে দিনে এলে রেমাক্রি পর্যন্ত নৌকা প্রতি আসা-যাওয়ার ভাড়া চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা পড়বে। সেখানে যদি একদিন কিংবা দুই দিন থাকেন তবে ভাড়াটা পাঁচ হাজারে গিয়ে ঠেকবে। এক নৌকায় সর্বোচ্চ পাঁচজন উঠতে পারবেন।
আগে থেকে গাইড ঠিক না করলে থানচি এসে ঠিক করতে পারেন। আমার জানা মতে গাইডের ভাড়া প্রথম দিন ৮০০ টাকা, দ্বিতীয় দিন ৭০০, পরের দিনগুলোর জন্য ৬০০ করে। গাইডই থানচি থেকে বিজিবি ও থানার অনুমতি নেওয়ার কাজগুলো করে দেবে। তবে সঙ্গে অবশ্যই সবার জাতীয় পরিচয়পত্র রাখতে হবে।
আশা করি নৌ কিংবা জঙ্গল ভ্রমণের সময় পরিবেশের দিকে খেয়াল রাখবেন। চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক-পলিথিন এখানে-সেখানে ফেলবেন না। সাঁতার জানা না থাকলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করবেন।
থানচি থেকে শুরু হলো নৌ ভ্রমণ। দুই পাশেই সঙ্গী পাহাড়। ডান পাশেরগুলো বেশি উঁচু। পাহাড়ের নিচের দিকে, মাঝে-সাঝে একটা-দুটো বাঁশ, টিনের ঘর। তর তর করে বয়ে চলেছে সাঙ্গু। মিনিট পনেরো-কুড়ি পর, এমন এক জায়গায় চলে এলাম, মনে হলো পানি ফুটছে। ভয় পাবেন না, এটা আমাজনের জঙ্গলের ফুটন্ত পানির নদীর মতো কিছু নয়, নদীটা চড়াই-উতরাই পথে বয়ে যাওয়ায় ও নিচের ছোট ছোট পাথরের কারণে এ কাণ্ড। এখানটায় স্রোতও বেশি। নৌকাটা যখন তীব্র গতিতে এই জায়গাটি পেরোতে লাগল, ভয় ভয় করল, এর চেয়েও বেশি যেটা অনুভব করলাম সেটা রোমাঞ্চ।
স্ত্রী পুনম আর মেয়ে ওয়াফিকাকে নিয়ে বান্দরবান থেকে সকালে রওনা দিয়েছিলাম। চান্দের গাড়িতে থানচি আসার পথে দু-পাশের পাহাড় রাজ্য চোখ জুড়িয়েছে। অবশ্য এ পথে ভ্রমণের সময় সব সময়ই মুগ্ধ চোখে পাহাড় দেখি। আমি আগে এলেও নীলগিরির পরের অংশে এটা পুনমের প্রথম ভ্রমণ। ও বলল এদিকটার পাহাড় আরও সুন্দর। থানচি পৌঁছে দেখি আমাদের নৌকা প্রস্তুত হয়ে আছে। যে হোটেলে উঠব রেমাক্রিতে তার মালিকই নৌকা নিয়ে এসেছেন। তাঁর অবশ্য থানচিতে কিছু বাজার-সদাইও ছিল। অবশ্য এগুলো আমরা পৌঁছার আগেই সেরে রেখেছেন।
টগবগে পানির এলাকা পেরোতেই একটু জুত হয়ে বসলাম। এ সময়ই হঠাৎ প্রায় এক যুগ আগের একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল। সাঙ্গু নদী ধরে চলেছিলাম বড় মোদকের দিকে। মোটামুটি এই এলাকায় আসার পরই এক পলকের জন্য দেখেছিলাম লালচে শরীরটা, একটা ঢাল ধরে উঠছিল। কাকর বা মায়া হরিণ। ভয় পেলে কুকুরের মতো চিৎকার করে বলে ইংরেজি নাম বার্কিং ডিয়ার। বাংলাদেশের অনেক বনে-পাহাড়ে এখনো এ হরিণদের দেখা মেলে। এবারও পাহাড়ে চড়ে বেড়ানো কোনো বন্যপ্রাণীর খোঁজে ইতি-উতি চাইলাম।
মাঝে মাঝেই লম্বা ভেলা বানিয়ে বাঁশ পরিবহন করতে দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার ছোট বাঁশের ভেলা বানিয়ে কাছাকাছির কোনো গন্তব্যে টুকটাক মালামাল নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এখন দুই পাশের পাহাড়ই বেশ খাঁড়া। সেরো বা বন ছাগলেরা এ ধরনের পাথুরে পাহাড় বেয়ে চলায় দারুণ দক্ষ। তাতে কী, তাদের শিকার করার জন্য উৎ পেতে থাকা চিতা বাঘেরাও এমন পথে চলতে ওস্তাদ। তিন্দু পৌঁছাতে ঘণ্টা-সোয়া ঘণ্টা লাগল। গতবার যখন এসেছিলাম তিন্দু বাজাটা ভারি চমৎকার লেগেছিল। খোলামেলা, পরিচ্ছন্ন এক জায়গা মনে হয়েছিল। এখন কী অবস্থা দেখার সুযোগ মিলল না। কারণ এবার আমরা তিন্দু থামালাম না নৌকা।
তিন্দু ছাড়ার একটু পরেই ছোট ও মাঝারি আকারের পাথরের প্রাচুর্য চোখে পড়ল নদীতে। একটু পর চলে এলাম অদ্ভুত সুন্দর সেই জায়গাটিতে। রাজা পাথর, বড় পাথর এমনই নানা নামের বিশাল সব পাথর যেখানে নদীর দখল নিতে মহাব্যস্ত। এই জায়গাটি আমার খুব পছন্দ। আগের বার যখন এসেছিলাম অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম এ পাহাড়রাজ্যে।
পাথরের মাঝখান দিয়ে এঁকে-বেঁকে নৌকা নিয়ে যাওয়ায় রোমাঞ্চই আলাদা। তবে স্রোত অনেক, সঙ্গে আবার স্ত্রী-কন্যা আছে। তাই বিপজ্জনক অংশটা কিনার ধরে পাথরে পাথরে হেঁটে হেঁটে পার হলাম। বড় কয়েকটা পাথরে হাঁচড়ে-পাচড়ে উঠলামও। অবশ্য ওয়াফিকার দায়িত্ব আমাদের মাঝি মানে রিসোর্টের মালিক নিয়ে নিলেন।
আবার নৌকায় ওঠার মিনিট পনেরো পরেই একটা জায়গায় মাঝিকে থামার ইশারা করলাম। প্রায় আধখানা চাঁদের আকারে একটা বাঁক নিয়ে বয়ে যাচ্ছে সাঙ্গু, কিনারে ছোট ছোট পাথরের ওপর দিয়ে কল কল শব্দে ছুটছে জল। নদীর মাঝখানে দ্বীপের মতো তৈরি করেছে। নুড়ি পাথর ভরা ওই দ্বীপে নেমে দেখতে লাগলাম চারপাশের আশ্চর্য ভূ-বৈচিত্র্য। মনে পড়ল এখানে এসে এক যুগের আগের সেই ভ্রমণের সময় আমাদের পঞ্চাশোর্ধ্ব গাইড ডান দিকের পাহাড়টার দিকে হাতের ইশারা করে বলেছিলেন, ‘ওই পাহাড়টা যে, ওখানে একটা মস্ত বাঘ দেখছিলাম যে। আমার বয়স তখন, উনিশ-বিশ। পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বসে ছিলাম। বুক ঢিপ ঢিপ করছিল। ওটা আমারে দেখে নাই।’ হোক সে বহু বছর আগের ঘটনা, তারপরও বাঘের খবর তো! খুশি হয়ে উঠেছিলাম।
মনে পড়ল এদিকেই কোথাও, জায়গাটার নাম সম্ভবত মধু, এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাসহ দারুণ অ্যাডভেঞ্চার হয়েছিল শিকারি এনায়েত মাওলার। সাঙ্গু নদী ধরে নৌকায় করে যাওয়ার পথে এক মুরং পাড়ার লোকেরা চেপে ধরে পাগলা হাতি শিকারের জন্য, ওটার ভয়ে পরিবার সমেত গাছে মাচা বেঁধে থাকতে বাধ্য হচ্ছে তারা। নিভৃতচারী ওই মুরংরা বাংলা জানতেন না, এনায়েত মাওলাদের সঙ্গে নৌকায় থাকা মুরং গাইডেরা দো-ভাষীর কাজ করছিলেন। সেই হাতি শিকার করেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাটি। গাছের ওপর মুরংদের মাচাগুলোর চেহারা আঁকা হয়ে গিয়েছিল মনের পর্দায়। উন্মাদ হাতির খোঁজ করতে গিয়ে জঙ্গলে বাঘের ডাকও শোনেন এনায়েত মাওলা। অবশ্য এই রোমাঞ্চকর ঘটনাপ্রবাহ গত শতকের পঞ্চাশের দশকের। ভাবি, আহ্ সেই আদিম অরণ্য যদি ফিরে পাওয়া যেত!
আবার চলতে শুরু করল নৌকা। নদীটি এঁকে-বেঁকে যাওয়ার পথে পাশাপাশি মাঝেমাঝেই ওপর থেকে নিচে কিংবা নিচে নামছে, যথারীতি জলের তলে নানান পাথরের বিস্তার। ফলে সে ধরনের ফুটতে থাকা পানির এলাকা পাচ্ছি। পেরোবার সময় শরীর ভিজে যাচ্ছে জলে। ওয়াফিকা দেখলাম দারুণ উত্তেজিত। ভয়ের চেয়ে আনন্দই বেশি ওর, চিৎকার করছে রোমাঞ্চিত হয়ে।
মাঝে মাঝে উল্টোদিক থেকে আসা নৌকার দেখা পাচ্ছি। কোনোটাতে স্থানীয় বাসিন্দারা, কোনোটি আবার পর্যটকবোঝাই। পর্যটকদের চেহারাই বলে দিচ্ছে সাঙ্গুর রূপে মজে গেছেন তাঁরা।
কিছুক্ষণের মধ্যে নদীর পাড়ে কয়েকটা দোকান পেলাম। মনে পড়ল এক যুগের সেই ভ্রমণের সময় রাস্তার দু-পাশে এমন দোকান-পাট কিছুই চোখে পড়েনি। এবার মাঝেমধ্যেই নদীর তীরে এমন দোকান চোখে পড়ছে। দোকানগুলোর সামনে মাঝি দাঁড় করাল নৌকা। একটা দোকানে ঢুকলাম আমরা। লেবুর শরবত খেলাম। পুনম, ওয়াফিকা আর আমাদের মাঝি খেলেন কলা, পেঁপে। আমরা যে দোকানে ঢুকলাম সেটির মালিক এক মারমা নারী। বড় অমায়িক। আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়লেন। পাশেই একটা দোলনায় দুলছিল তাঁর ছোট্ট শিশুটি।
এক সময় আমরা চলে এলাম রেমাক্রি ঝরনার কাছে। এদিক দিয়েই রেমাক্রি খাল ধরে চলে গেলে পৌঁছে যাওয়া যায় নাফাখুম। তবে আমরা সেখানে থামলাম না। নৌকা নিয়ে চলে এলাম ডানে আমাদের রিসোর্ট যেখানে সেখানে অর্থাৎ রেমাক্রি বাজারের দিকটায়। দেখলাম চারপাশে আরও কয়েকটি পর্যটক বোঝাই নৌকা এসে থামল। এখানে রেমাক্রির জল বেশ শান্ত। দূরে পাহাড়রাজ্যে এঁকে-বেঁকে সাঙ্গু চলে গেছে মোদক হয়ে লিকরির দিকে। রেমাক্রিতে দুইটা দিন কী করলাম সে গল্প বরং জমা থাক অন্য কোনো দিনের জন্য।
জেনে রাখা ভালো
এখন নৌকা ভাড়া বেড়েছে। দিনে গিয়ে দিনে এলে রেমাক্রি পর্যন্ত নৌকা প্রতি আসা-যাওয়ার ভাড়া চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা পড়বে। সেখানে যদি একদিন কিংবা দুই দিন থাকেন তবে ভাড়াটা পাঁচ হাজারে গিয়ে ঠেকবে। এক নৌকায় সর্বোচ্চ পাঁচজন উঠতে পারবেন।
আগে থেকে গাইড ঠিক না করলে থানচি এসে ঠিক করতে পারেন। আমার জানা মতে গাইডের ভাড়া প্রথম দিন ৮০০ টাকা, দ্বিতীয় দিন ৭০০, পরের দিনগুলোর জন্য ৬০০ করে। গাইডই থানচি থেকে বিজিবি ও থানার অনুমতি নেওয়ার কাজগুলো করে দেবে। তবে সঙ্গে অবশ্যই সবার জাতীয় পরিচয়পত্র রাখতে হবে।
আশা করি নৌ কিংবা জঙ্গল ভ্রমণের সময় পরিবেশের দিকে খেয়াল রাখবেন। চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক-পলিথিন এখানে-সেখানে ফেলবেন না। সাঁতার জানা না থাকলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করবেন।
দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মাথার ওপর নীল আকাশে উঁকি দেবে সাদা মেঘ। শরৎকাল বলে ভুল হতে পারে। ভুল ভাঙলে দেখতে পাবেন, মেঘের ভেলা সূর্যের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে হয়ে উঠছে গোলাপি কিংবা লাল। বুঝবেন, আপনি শরতের সাদা মেঘ নয়, দেখছেন তুষারে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
২ দিন আগেকোনো কিছু ওপর থেকে নিচে পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে আমরা সবাই এ বিষয়ে পড়েছি। কিন্তু এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র কাজ করে না। অর্থাৎ সেসব জায়গায় কোনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। যেতে চান সেই সব জায়গায়?
২ দিন আগেশীত, বসন্ত আর বর্ষায় বাংলার নীল নদ সারির রূপ বদলে ফেলে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে দক্ষ মাঝিরাও ভয়ে ভয়ে বইঠা চালান। আর শীতে সারি নদীর নীল পানি দেয় অপার্থিব জগতের খোঁজ। নদীটি ধরে কিছুদূর উজান বাইলেই পাওয়া যাবে লালাখাল জিরো পয়েন্ট।
২ দিন আগেভ্রমণকালে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী না হলে ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেতে পারে। ভ্রমণের সময় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন কিছু উপায়।
২ দিন আগে