জেরুজালেমের স্মৃতি

ইয়াসির আরাফাত
Thumbnail image

আমার জন্ম আশির দশকের একদম শেষ প্রান্তে, যখন ফিলিস্তিন ইস্যু সমগ্র বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় ছিল। সেই সময় ফিলিস্তিনের নেতা ছিলেন ইয়াসির আরাফাত। তাঁর নামেই দাদা আমার নাম রেখেছিলেন। ইয়াসির আরাফাত ও ফিলিস্তিনের ইন্তিফাদা দেখতে দেখতে বড় হলাম। সব সময়ই ইচ্ছা ছিল জেরুজালেম ঘুরতে যাব, আল আকসায় নামাজ আদায় করব, জেরুজালেমের সেই বিখ্যাত সোনালি গম্বুজ দেখব।

অবশেষে সেই ইচ্ছা আমার পূরণ হলো ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে। লন্ডন থেকে বিমানে তেল আবিব, সেখান থেকে একটি শেয়ার ট্যাক্সিতে জেরুজালেম। ফিলিস্তিনের নিজস্ব কোনো এয়ারপোর্ট নেই, আকাশপথে ফিলিস্তিন যেতে হলে তেল আবিব হয়েই যেতে হবে।

সেই এয়ারপোর্টে অনেক মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, এমন ঘটনা অনেক শুনেছি। তবে আমাকে কোনো হয়রানির শিকার হতে হয়নি। কিন্তু সঙ্গে থাকা এক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশকে দেখেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা এয়ারপোর্টে বসিয়ে রেখে পরের ফ্লাইটে লন্ডনে পাঠিয়ে দিতে!

যাহোক, ট্যাক্সি আমাকে নামিয়ে দিল অটোমানদের আমলে নির্মিত জেরুজালেমের বিখ্যাত দামাস্কাস গেটের সামনে। কয়েক শ বছর ধরে এটিই হচ্ছে জেরুজালেমে প্রবেশের প্রধান দরজা। মন তর সইছিল না জলদি গেটের ভেতরে প্রবেশ করে আল আকসায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যথিত হলাম চারপাশের পরিবেশ দেখে। দামাস্কাস গেটের চারপাশে আর্মি চেকপয়েন্ট।

প্রতিটি চেকপয়েন্টে ইসরায়েলি সৈন্যরা দাঁড়িয়ে আছে। দরজা দিয়ে শহরের ভেতরে প্রবেশ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো যেন কয়েক শ বছর পেছনে অটোমানদের আমলে ফিরে গেছি। ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। হাজার বছরের পুরোনো এই শহর এখনো প্রচণ্ড ব্যস্ত।

জেরুজালেমের বিখ্যাত দামাস্কাস গেট। কয়েক শ বছর এটিই হচ্ছে জেরুজালেমে প্রবেশের প্রধান দরজা।জেরুজালেম ওল্ড সিটি চারটি ভাগে বিভক্ত—মুসলিম পাড়া, খ্রিষ্টান পাড়া, আর্মেনিয়ান পাড়া ও ইহুদি পাড়া। এর মধ্যে মুসলিম পাড়াটিই বড় ও জনবহুল। শহরটি শুধু মুসলিমদের জন্যই পবিত্র, তা নয়। আব্রাহামিক প্রতিটি ধর্মের জন্যই পবিত্র। জেরুজালেম খ্রিষ্টানদের জন্য পবিত্র। কারণ, এখানেই জেসাসকে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছিল বলে কথিত আছে এবং এখানেই অবস্থিত খ্রিষ্টানদের পবিত্র গির্জা হোলি সেপালকার। এখানেই অবস্থিত তাদের পবিত্র ম্যারির কবর। শহরটি ইহুদিদের জন্য পবিত্র। কারণ, তোরাহ্ অনুযায়ী জেরুজালেম হচ্ছে তাদের প্রমিস ল্যান্ড এবং এখানেই ছিল সোলায়মান (আ.)-এর প্রথম টেম্পল, যেটি পুনর্নির্মাণ করেন ইহুদিদের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজা হেরোড। সেই টেম্পলের একটি দেয়াল এখনো দৃশ্যমান, যেটি ওয়েস্টার্ন ওয়াল কিংবা ওয়েলিং ওয়াল নামে প্রসিদ্ধ। এই দেয়ালের সামনেই ২৪ ঘণ্টা ইহুদিরা তাদের ইবাদত করে থাকে। এ শহরে আছে মুসলিমদের পবিত্র আল আকসা, যে আল আকসা ছিল ইসলামের প্রথম কিবলা এবং যেখান থেকে শুরু হয়েছিল পবিত্র মিরাজের। এ কারণেই জেরুজালেম দ্য হোলি সিটি নামে পরিচিত। এসব কারণেই বর্তমানের জেরুজালেমের সংকটের শেষ নেই।

শহরের বেশির ভাগ বাসিন্দা মুসলিম হলেও প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঘুরতে আসে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় স্থানগুলো দেখতে ও উপাসনা করতে। এটি হচ্ছে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ধর্মের একটি মিলনস্থল। এই সবকিছুর মধ্যে একটি বিষয় শুধু হৃদয় ব্যথিত করছিল– পবিত্র এই শহরের অলিগলিতে ভারী অস্ত্র কাঁধে ইসরায়েলি সৈন্যদের উপস্থিতি। যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই ইসরায়েলের সৈন্য অস্ত্র নিয়ে টহল দিচ্ছে। এই চিত্র দেখেই বুঝে নিয়েছিলাম, এ শহরের নাগরিকেরা স্বাধীন নয়। শহরের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই।

আমি এসেছিলাম আল আকসা দেখতে। আর তাই হোটেলে প্রবেশ করার আগে প্রথমে গেলাম আল আকসা চত্বরেই। সে মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে তারপর হোটেলে গেলাম বিশ্রামের জন্য।

জেরুজালেমের গলিতে অস্ত্রধারী ইসরায়েলি সেনাসন্ধ্যার দিকে বের হয়ে আল আকসায় মাগরিবের নামাজ আদায় করে বের হলাম শহরের ইহুদি পাড়া ঘুরতে। মুসলিম পাড়াতে সবাই যেমন মুসলিম, ঠিক একইভাবে এই ইহুদি পাড়ার সবাই ইহুদি। গেলাম ওয়েস্টার্ন ওয়াল ভিজিট করতে, যেখানে মাথা ঠেকিয়ে ইহুদিরা কান্নাকাটি করে (এ কারণেই এই দেয়ালের আরেকটি নাম হচ্ছে ওয়েলিং ওয়াল)। ওয়ালের পাশেই একটি সিনাগগ অর্থাৎ ইহুদিদের উপাসনালয় রয়েছে। সেখানে ঢুকে গেলাম। চতুর্দিকে অসংখ্য ইহুদি দলে দলে তাদের তোরাহ্ পাঠ এবং ইবাদত করছে।

পরের দিন সকালে গেলাম খ্রিষ্টানদের পবিত্র হোলি সেপুলকোর গির্জায়, যেখানে যিশুকে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছিল। এই গির্জার ভেতরে চারটি অংশ রয়েছে—খ্রিষ্টধর্মের চারটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের জন্য চারটি অংশ। যিশুকে ক্রুশ বিদ্ধ করার পর যে পাথরের ওপর তাঁকে রাখা হয়েছিল, সেই পাথর এখানে সংরক্ষিত আছে।

এই গির্জার ঠিক পাশেই অবস্থিত ওমর (রা.) মসজিদ। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) যখন জেরুজালেম বিজয় করে এই শহরে প্রবেশ করেন, তখন তৎকালীন হোলি সিপালকারের পাদরি হজরত ওমর (রা.)-কে আমন্ত্রণ জানান পবিত্র সেই গির্জার ভেতরে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের জন্য। ওমর (রা.) এই বলে সেখানে নামাজ আদায় করেননি যে তিনি যদি সেখানে নামাজ আদায় করেন, তাহলে একসময় মুসলিমরা সেই গির্জাকে মসজিদে পরিণত করতে পারে। তখন তিনি গির্জার পাশে দুই রাকাত শুকরিয়ানা নামাজ আদায় করেন আর সেখানেই অবস্থিত ওমর মসজিদ। খলিফার ব্যক্তিত্ব ও উদারতা দেখে সেই পাদরি তখন গির্জার চাবি খলিফা ওমরকে দিয়ে দেন। এত শত বছর পর আজও সেই গির্জার চাবি একটি মুসলিম পরিবারের কাছেই সংরক্ষিত। প্রতিদিন ভোরে এক মুসলিম এসে খুলে দিয়ে যায় খ্রিষ্টানদের পবিত্র এই গির্জার দরজা। 

লেখক: লন্ডনপ্রবাসী পর্যটক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত