পৃথিবীর একমাত্র জাদুঘর

মইনুল হাসান, ফ্রান্স
প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৪, ০৮: ১৪
আপডেট : ১৬ মে ২০২৪, ০৮: ৪৩

ফ্রান্সের দক্ষিণে গ্রাস শহর। ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে, আলপসের কোলে ছবির মতো সুন্দর এই শহর ফ্রান্সের পারফিউমের উৎসকেন্দ্র। এই শহরকে বলা হয় ‘পারফিউমের রাজধানী’। এখানে আছে পৃথিবীর একমাত্র সুগন্ধির জাদুঘর—যার নাম আন্তর্জাতিক সুগন্ধি জাদুঘর। ১৮ মে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। সে উপলক্ষে পৃথিবীর একমাত্র জাদুঘরের গল্প বলা।

দক্ষিণ ফ্রান্সে বহু শতাব্দী ধরে নানা সুগন্ধি ফুলের চাষ হয়। কমলা, জুঁই, বেলি, ল্যাভেন্ডার, রজনীগন্ধা, নার্সিসাস, জেরানিয়াম, আইরিস কিংবা গোলাপের দিগন্তবিস্তীর্ণ মাঠ আছে এখানে। এ যেন ফুলের রাজ্য, এক রূপকথার দেশ। ফ্রান্সের বিখ্যাত পারফিউম তৈরির কারখানাগুলো এ অঞ্চলেই। ফুল ও সুগন্ধি ঘিরে বহু মানুষের বহু বছরের সাধনা, মেধা, পরিশ্রম, নিষ্ঠার কারণেই ইউনেসকো এ শহরকে বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদায় মহিমান্বিত করেছে।

গ্রাস শহরে ঢুকতেই জুঁই ফুলের মিষ্টি সুবাসমাখা বাতাস আমাদের ছুঁয়ে গেল, এ যেন ফুলেল অভ্যর্থনা। একটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল বাগানের মধ্যে উজ্জ্বল কমলা রঙের চারতলা দালান। ১৯৮৯ সাল থেকে এই বিশাল দালানেই সুগন্ধির জাদুঘর। সময়কে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে এখানে। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে প্রাচীনকাল, মধ্যযুগ হয়ে, আধুনিক এবং আজকের দিন পর্যন্ত দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের জন্য প্রায় ৩৮ হাজার বর্গফুটজুড়ে থরে থরে সাজানো আছে সুগন্ধির কাব্যময় ইতিহাস, বিস্ময়কর ঐতিহ্য ও বিবর্তন। সেই সঙ্গে বিজ্ঞান ও সৃজনশীলতার গৌরবগাথা, যেন এক মোহময় পারফিউমের জগৎ। এই জাদুঘরের সংগ্রহে আছে আমাদের উপমহাদেশের হাতির দাঁতের সুগন্ধির কৌটা, গোলাপদানি, কাজলদানিসহ  ৫০ হাজার বস্তুর এক বিশাল ভান্ডার।

প্রবেশমূল্য জনপ্রতি ৬ ইউরো। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ছাড় আছে। টিকিটের সঙ্গে ছোট্ট একটি নির্দেশিকা দেওয়া হয়। ভালোভাবে দেখতে ও জানতে এবং বিভিন্ন জায়গায় রাখা নানা ধরনের বস্তু শুঁকে ঘ্রাণেন্দ্রিয় শাণিত করতে চাইলে হাতে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা সময় রাখতে হবে। একই টিকিটে বেশ কয়েকটি ফুল চাষের মাঠও পরিদর্শন করা যায়। বিশেষ কিছু ছুটির দিন ছাড়া সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এবং জুলাই-আগস্ট মাসে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে আন্তর্জাতিক সুগন্ধি জাদুঘর।

নিচতলা থেকে শুরু করে, এক এক করে চারতলায় পৌঁছে, অন্য পথে নিচে নেমে আসতে হবে এবং একদম শেষে একটি চমৎকার সাজানো-গোছানো বুটিক পেরিয়ে অন্য ফটক দিয়ে বের হতে হবে।

জাদুঘরের নিচতলায় সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ এবং প্রাণিজ উপাদানের ছবিসহ পরিচয় দেওয়া আছে। কানে হেডফোন লাগিয়ে বেশ কয়েকটি ভাষায় সেই সব বর্ণনা শোনার ব্যবস্থাও আছে এখানে। সারি করে সাজানো আছে প্রাচীন সব ধাতব ছাদছোঁয়া যন্ত্রপাতি, বকযন্ত্র, পাত্র আর সুগন্ধি সৃষ্টির শৈল্পিক কলাকৌশলের বর্ণনা। কেউ একজন বর্ণনা করছেন সেই প্রাচীনকালের সৌগন্ধিকদের অসাধারণ কৌশল আর পরিশ্রমের কথা। বলছেন, রসায়ন ও প্রযুক্তির অগ্রগতি কীভাবে সহজ করে দিয়েছে নির্যাস নিষ্কাশন আর সংরক্ষণ পদ্ধতিকে। দেশে দেশে পারফিউমের ব্যবহারের অডিও, ভিডিও বর্ণনার সঙ্গে বহু শতাব্দী আগে ব্যবহৃত সুগন্ধির ছোট-বড় নানা আকার, আকৃতির পাত্র দেখা যাবে এখানে। দেয়ালে টানানো আছে অভিজাত, শৌখিনদের তৈলচিত্র, অতীতের পারফিউমের বর্ণিল সব বিজ্ঞাপন, পোস্টার।

আন্তর্জাতিক সুগন্ধি জাদুঘর, গ্রাস, ফ্রান্স। এখানে সুগন্ধিসহ প্রায় ৫০ হাজার বিভিন্ন দর্শনীয় বস্তু রয়েছে। ছবি: লেখকইতিহাসের প্রথম ধাপ পেরিয়ে আলোকোজ্জ্বল প্রশস্ত একটি হলঘরে কাচের আড়ালে রাখা আছে বিগত বছরগুলোর জগদ্বিখ্যাত মন উতলা করা সব সুগন্ধি। দৃষ্টিকাড়া নকশার বোতলে সব কিংবদন্তি সুগন্ধির পাশেই লেখা আছে তার সৃষ্টির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। বিখ্যাত সব সৌগন্ধিকের জীবনীসহ ছবি। বিভিন্ন কক্ষের দেয়ালে প্রদর্শিত হচ্ছে চলচ্চিত্র, তাতে শৈল্পিক উপস্থাপনায় ফুটে উঠেছে ফ্যাশন, বিলাস, আড়ম্বর আর আভিজাত্যের প্রাচুর্য। যাঁরা অপার সৌন্দর্যবোধ আর উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি কাজে লাগিয়ে সৃষ্টির উল্লাসে রচনা করেছেন সুগন্ধের কাব্যময় ডালা, তাঁদের কথা। রাজরাজড়াদের সুগন্ধিপ্রীতি, তাঁদের সুগন্ধি ব্যবহারের সব আয়োজনও প্রদর্শিত হয়েছে অনেক যত্নে। একটি কক্ষে সাজিয়ে রাখা হয়েছে রানি মারি আঁতোয়ানেতের ভ্রমণকালীন প্রসাধনী এবং সুগন্ধির বেশ বড় একটি কাঠের বাক্স। চাকচিক্যময় আভিজাত্যের জৌলুশে আজও তা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।

একটি সুগন্ধি সৃষ্টির পেছনে কারও একক কোনো কৃতিত্ব নেই। বহু মানুষের সম্মিলিত সাধনা ও পরিশ্রমের ফসল এই পারফিউম। সুগন্ধি ঘিরে আবর্তিত হয়েছে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, গড়ে উঠেছে শিল্প-বাণিজ্য, বিপণনের জগৎজোড়া সুবিশাল এবং প্রেমময় এক জগৎ। সুগন্ধি জাদুঘর যেন এক জাদুর জাদুঘর।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত