সালেহীন আরশাদী
ভোরে হাতে বানানো রুটি-তরকারি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কুয়াশামাখা হিম ঠান্ডায় রডোডেনড্রন, দেবদারু আর পাইন বনের মাঝ দিয়ে চলতে শুরু করলাম। পথজুড়ে থোকা থোকা লাল ফুল ঝুলে আছে। প্রথমে ১০০ মিটারের মতো চড়াই। এরপর পথ নিচে নামতে নামতে একেবারে রোলওয়ালিং খোলায় নেমে গেছে। হিমবাহ গলে আসা নদী সব ভেঙেচুরে নিচে নেমে আসছে। বড় বড় বোল্ডারে নদীর পানি আছড়ে পড়ার শব্দ গিরিখাতের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে আরও জোরালো হয়ে উঠছে।
এক ঘণ্টা হাঁটার পর বেশ খোলা একটি জায়গায় চলে এলাম। জায়গাটির নাম কেলচে। এখানে বেশ বড় একটি কমিউনিটি লজ বানানো আছে। সেই সঙ্গে লজের সামনের সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠে কেউ চাইলে ক্যাম্পিংও করতে পারে। নেপালের সংরক্ষিত অঞ্চলের ট্রেকিং রুটগুলোর দুর্গম অংশে যেখানে গ্রাম নেই, সেসব জায়গায় এমন অনেক কমিউনিটি লজ আছে। এই লজগুলো স্থানীয় বাসিন্দারা পাঁচ-দশ বছরের জন্য লিজ নিয়ে ট্রেকারদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা চালু রাখে।
নদীর উজান ধরে পথ। গন্তব্য ওপরে। পুরো পথে কংক্রিটের সিঁড়ি বানানো। এত লম্বা সময় ধরে সিঁড়ি ভাঙতে খুব বিরক্ত লাগছে। ২০১৫ সালে নেপালে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল, তাতে রোলওয়ালিং অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়; বিশেষ করে ট্রেকিং ট্রেইলগুলো ভূমিধসে একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ট্রেইলগুলো ঠিকঠাক করে সিঁড়ি বানিয়ে কংক্রিট দিয়ে ঢালাই করে দেওয়া হয়েছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থার আর্থিক সহযোগিতায়। নদীর ওপর কিছু নতুন সাসপেনশন ব্রিজ বানানো হয়েছে। কিছু জায়গায় স্টিলের কাঠামোর ব্রিজও দেখলাম।
আজ আকাশ মেঘলা। বেলা বাড়ার পরেও সূর্যের দেখা নেই। নদীর পাড় থেকে পথ আবার ওপরে উঠে গেল। আবার শুরু হলো অরণ্য। শতবর্ষী দেবদারু, ওক আর পাইনগাছের ভিড়ে কিছু ম্যাগনোলিয়া ও রডোডেনড্রন নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। পাইনের শুকনো পাতা আর ওক ফল পথজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। ঘণ্টা দুয়েক পর পাহাড়ের ওপরের একটি খোলা জায়গা থেকে নিচে নীল চালের একটি ঘর দেখতে পেলাম। ওই তো ডোং ডাং!
অনেকখানি উতরানোর পর নদীর পাড়ে বানানো চমৎকার একটি দোতলা কাঠের লজে চলে এলাম। ডোং ডাংয়ে দুটি কমিউনিটি লজ আছে। আমি উঠলাম সোনাম শেরপার লজে। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী ১২ বছরের ছেলে ডেন্ডিকে নিয়ে সিজনের সময় এই লজ চালান। তাঁদের বাড়ি সিমিগাঁও। ওখানে তাঁদের ফসলের খেত আছে। কিন্তু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই সামান্য। সেই সামান্য জমিতে তাঁরা আলু, ভুট্টা আর বজরা চাষ করেন। কিন্তু সেই ফসলে পুরো বছর কাটে না। তাই এই লজটা লিজ নিয়েছেন।
পিঠ থেকে ভারী ব্যাকপ্যাকটা নামিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে দেখি, ঘরের কর্ত্রী চা বানানোর আয়োজন করছেন। জিজ্ঞেস করলেন, মাখন চা খাব কি না। ইয়াকের মাখন দিয়ে তৈরি এই ‘পো চা’ তিব্বতের ঐতিহ্যবাহী পানীয়। গন্ধের ব্যাপারে সংবেদনশীল হলে এই নতুন স্বাদের চা পান মুশকিল হতে পারে। রোমে গিয়ে নাকি রোমান হতে হয়। তাই না করলাম না। ইয়াকের দুধ, ফেটানো মাখন ও লবণ দিয়ে চুলায় জ্বাল দেওয়া কালো রঙের ক্বাথের মতো জিনিসটি বাঁশের তৈরি একটি লম্বা পাত্রে ঢেলে দিলেন। তিব্বতি ভাষায় পাত্রটির নাম চাদুং। মোটা বাঁশের পাত্রে সব উপকরণ রেখে আরেকটি চিকন বাঁশ দিয়ে ভালোভাবে পিষে মিশিয়ে নিয়ে মিশ্রণটি আবারও চুলায় জ্বাল দিলে তৈরি হয় সেই বিখ্যাত ইয়াকের মাখনের চা।
আজ চায়ের স্বাদ খারাপ লাগল না। একটু নোনতা, টক। এই চায়ের স্বাদ বোধ হয় ইয়াকের দুধ আর মাখনের গুণের ওপর নির্ভর করে। চা শেষ করতে না করতেই রাতের খাবারের ডাক এল। এখানে সন্ধ্যাবেলা খেয়ে রাত আটটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। যস্মিন দেশে যদাচার। ভাতের সঙ্গে ডাল আর আলু সয়ার তরকারি খেয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম। শহুরে নিশাচর মানুষ পাহাড়ে এলে দেহের জৈব ঘড়ির কাঁটা কীভাবে ঘুরে যায়, তার নিগূঢ় তত্ত্বের তালাশ করতে করতে ঘুমিয়েও গেলাম।
ঝকঝকে রোদ উঠেছে। সোনালি আলোয় কুলকুল বয়ে চলা শান্ত নদীটিতে মনে হচ্ছে ফিরোজা রঙের শাড়ি সাজিয়ে রেখেছে কেউ। পরবর্তী গন্তব্য বেদিং পৌঁছাতে হাজার মিটারের মতো চড়াই ঠেঙাতে হবে। তাই সাতসকালে হাঁটতে শুরু করলাম। ভোরের এই সময়টা কেমন যেন অপার্থিব মনে হয়। পাহাড়ের এক ঢাল দিয়ে কাত হয়ে সোনালি আলো নেমে আসে। হালকা হিমভাবে তখনো প্রকৃতির জড়তা পুরোপুরি কাটে না, একই সঙ্গে শুরু হয় পশুপাখির হট্টগোল। এই সময়টা পাহাড়ের এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকতেই বেশি ভালো লাগে। কিন্তু আজ উপায় নেই, অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। (ক্রমশ)
ভোরে হাতে বানানো রুটি-তরকারি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কুয়াশামাখা হিম ঠান্ডায় রডোডেনড্রন, দেবদারু আর পাইন বনের মাঝ দিয়ে চলতে শুরু করলাম। পথজুড়ে থোকা থোকা লাল ফুল ঝুলে আছে। প্রথমে ১০০ মিটারের মতো চড়াই। এরপর পথ নিচে নামতে নামতে একেবারে রোলওয়ালিং খোলায় নেমে গেছে। হিমবাহ গলে আসা নদী সব ভেঙেচুরে নিচে নেমে আসছে। বড় বড় বোল্ডারে নদীর পানি আছড়ে পড়ার শব্দ গিরিখাতের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে আরও জোরালো হয়ে উঠছে।
এক ঘণ্টা হাঁটার পর বেশ খোলা একটি জায়গায় চলে এলাম। জায়গাটির নাম কেলচে। এখানে বেশ বড় একটি কমিউনিটি লজ বানানো আছে। সেই সঙ্গে লজের সামনের সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠে কেউ চাইলে ক্যাম্পিংও করতে পারে। নেপালের সংরক্ষিত অঞ্চলের ট্রেকিং রুটগুলোর দুর্গম অংশে যেখানে গ্রাম নেই, সেসব জায়গায় এমন অনেক কমিউনিটি লজ আছে। এই লজগুলো স্থানীয় বাসিন্দারা পাঁচ-দশ বছরের জন্য লিজ নিয়ে ট্রেকারদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা চালু রাখে।
নদীর উজান ধরে পথ। গন্তব্য ওপরে। পুরো পথে কংক্রিটের সিঁড়ি বানানো। এত লম্বা সময় ধরে সিঁড়ি ভাঙতে খুব বিরক্ত লাগছে। ২০১৫ সালে নেপালে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল, তাতে রোলওয়ালিং অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়; বিশেষ করে ট্রেকিং ট্রেইলগুলো ভূমিধসে একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ট্রেইলগুলো ঠিকঠাক করে সিঁড়ি বানিয়ে কংক্রিট দিয়ে ঢালাই করে দেওয়া হয়েছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থার আর্থিক সহযোগিতায়। নদীর ওপর কিছু নতুন সাসপেনশন ব্রিজ বানানো হয়েছে। কিছু জায়গায় স্টিলের কাঠামোর ব্রিজও দেখলাম।
আজ আকাশ মেঘলা। বেলা বাড়ার পরেও সূর্যের দেখা নেই। নদীর পাড় থেকে পথ আবার ওপরে উঠে গেল। আবার শুরু হলো অরণ্য। শতবর্ষী দেবদারু, ওক আর পাইনগাছের ভিড়ে কিছু ম্যাগনোলিয়া ও রডোডেনড্রন নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। পাইনের শুকনো পাতা আর ওক ফল পথজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। ঘণ্টা দুয়েক পর পাহাড়ের ওপরের একটি খোলা জায়গা থেকে নিচে নীল চালের একটি ঘর দেখতে পেলাম। ওই তো ডোং ডাং!
অনেকখানি উতরানোর পর নদীর পাড়ে বানানো চমৎকার একটি দোতলা কাঠের লজে চলে এলাম। ডোং ডাংয়ে দুটি কমিউনিটি লজ আছে। আমি উঠলাম সোনাম শেরপার লজে। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী ১২ বছরের ছেলে ডেন্ডিকে নিয়ে সিজনের সময় এই লজ চালান। তাঁদের বাড়ি সিমিগাঁও। ওখানে তাঁদের ফসলের খেত আছে। কিন্তু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই সামান্য। সেই সামান্য জমিতে তাঁরা আলু, ভুট্টা আর বজরা চাষ করেন। কিন্তু সেই ফসলে পুরো বছর কাটে না। তাই এই লজটা লিজ নিয়েছেন।
পিঠ থেকে ভারী ব্যাকপ্যাকটা নামিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে দেখি, ঘরের কর্ত্রী চা বানানোর আয়োজন করছেন। জিজ্ঞেস করলেন, মাখন চা খাব কি না। ইয়াকের মাখন দিয়ে তৈরি এই ‘পো চা’ তিব্বতের ঐতিহ্যবাহী পানীয়। গন্ধের ব্যাপারে সংবেদনশীল হলে এই নতুন স্বাদের চা পান মুশকিল হতে পারে। রোমে গিয়ে নাকি রোমান হতে হয়। তাই না করলাম না। ইয়াকের দুধ, ফেটানো মাখন ও লবণ দিয়ে চুলায় জ্বাল দেওয়া কালো রঙের ক্বাথের মতো জিনিসটি বাঁশের তৈরি একটি লম্বা পাত্রে ঢেলে দিলেন। তিব্বতি ভাষায় পাত্রটির নাম চাদুং। মোটা বাঁশের পাত্রে সব উপকরণ রেখে আরেকটি চিকন বাঁশ দিয়ে ভালোভাবে পিষে মিশিয়ে নিয়ে মিশ্রণটি আবারও চুলায় জ্বাল দিলে তৈরি হয় সেই বিখ্যাত ইয়াকের মাখনের চা।
আজ চায়ের স্বাদ খারাপ লাগল না। একটু নোনতা, টক। এই চায়ের স্বাদ বোধ হয় ইয়াকের দুধ আর মাখনের গুণের ওপর নির্ভর করে। চা শেষ করতে না করতেই রাতের খাবারের ডাক এল। এখানে সন্ধ্যাবেলা খেয়ে রাত আটটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। যস্মিন দেশে যদাচার। ভাতের সঙ্গে ডাল আর আলু সয়ার তরকারি খেয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম। শহুরে নিশাচর মানুষ পাহাড়ে এলে দেহের জৈব ঘড়ির কাঁটা কীভাবে ঘুরে যায়, তার নিগূঢ় তত্ত্বের তালাশ করতে করতে ঘুমিয়েও গেলাম।
ঝকঝকে রোদ উঠেছে। সোনালি আলোয় কুলকুল বয়ে চলা শান্ত নদীটিতে মনে হচ্ছে ফিরোজা রঙের শাড়ি সাজিয়ে রেখেছে কেউ। পরবর্তী গন্তব্য বেদিং পৌঁছাতে হাজার মিটারের মতো চড়াই ঠেঙাতে হবে। তাই সাতসকালে হাঁটতে শুরু করলাম। ভোরের এই সময়টা কেমন যেন অপার্থিব মনে হয়। পাহাড়ের এক ঢাল দিয়ে কাত হয়ে সোনালি আলো নেমে আসে। হালকা হিমভাবে তখনো প্রকৃতির জড়তা পুরোপুরি কাটে না, একই সঙ্গে শুরু হয় পশুপাখির হট্টগোল। এই সময়টা পাহাড়ের এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকতেই বেশি ভালো লাগে। কিন্তু আজ উপায় নেই, অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। (ক্রমশ)
১৯৫১ সাল। ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভি এলেন পৃথিমপাশা জমিদারবাড়িতে। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার! এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা ইরান থেকে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
২ দিন আগেশীতে কাপড় ভালো রাখতে সেগুলোকে যেমন রোদে মেলে দিতে হয়, সম্পর্ক উন্নয়নে মাঝেমধ্যে তেমনি ভ্রমণেও যেতে হয়। শীত চলে এসেছে। ভ্রমণপ্রেমীরা হয়ে উঠেছেন সরব।
২ দিন আগেপর্যটন বন্ধে কারফিউ! হ্যাঁ, তেমনটিই ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গ্রামের নাম বুকচন হ্যানোক। দক্ষিণ কোরিয়ার জংনো জেলায় এর অবস্থান। বুকচন হ্যানোক দেশটির ‘মাস্ট ভিজিট’ পর্যটন গন্তব্য।
২ দিন আগেভ্রমণের স্বাদ একবার রক্তে ঢুকলে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। এক অদৃশ্য তাড়না কাজ করতে থাকে ভেতরে-ভেতরে।
২ দিন আগে