সন্তান অনলাইন গেমে, দুশ্চিন্তায় পরিবার

অর্চি হক, ঢাকা
আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২১, ১৩: ২৭
Thumbnail image

রাজধানীর পুরান ঢাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সজল। দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা মোবাইলে গেম খেলে সময় কাটাচ্ছে। মোবাইল পেতেও কোনো সমস্যা নেই তার। কারণ, অনলাইনে ক্লাস থাকায় দিনের একটা বড় সময় তার হাতে থাকছে এই ডিভাইস। সজলের বাবা গেম খেলার জন্য ছেলেকে বকাবকি করেছেন, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। গেমে আসক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। গেম নিয়ে প্রশ্ন করতেই তার সাফ জবাব, সারা দিন বাসায় থেকে কী করব?

এই জবাব শুধু এই শিশুর একার নয়, স্কুলে পড়া প্রায় সব শিশু-কিশোরের একই কথা। তাদের মধ্যে দিনে দিনে গেমের আসক্তি বেড়েই চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ধরনের গেমে আসক্তিকে রোগ হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে।

দেশের কত শিশু-কিশোর এভাবে অনলাইনে গেম খেলে, তার কোনো হিসাব নেই। তবে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, দেশে ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ বিভিন্ন ডিজিটাল গেম খেলে। এর একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে, দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৭৩ লাখ। করোনা শুরুর আগে এই সংখ্যা ছিল প্রায় অর্ধেকের মতো।

ইব্রাহিমপুরে মণিপুর উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ইফতেখার আলম (ছদ্মনাম)। গত বছরের সেপ্টেম্বরে হঠাৎ তার আচরণে পরিবর্তন দেখতে পান তার মা শাহেদা আক্তার। যে ছেলে স্কুল, পড়াশোনা আর খেলাধুলা নিয়েই ব্যস্ত থাকত, সে এখন ধর্মীয় বক্তাদের ওয়াজ দেখে সময় কাটাচ্ছে। শাহেদা আক্তার বললেন, ‘ওর কাছ থেকে যে মোবাইলটা নিয়ে নেব, সেই উপায় তো নাই। অনলাইনে ক্লাস চলে।’

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের শহীদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী জিনিয়া রহমান (ছদ্মনাম)। অনলাইন ক্লাসের জন্য তার মা-বাবা মেয়ের রুমে সেট করে দিয়েছিলেন ডেস্কটপ কম্পিউটারসহ যাবতীয় সব ডিভাইস। কিন্তু কিছুদিন যেতেই দেখা গেল মেয়ের পরীক্ষার ফল অস্বাভাবিকভাবে খারাপ হতে শুরু করেছে। জিনিয়ার মা মেয়ের ওপর কিছুদিন নজরদারি করে দেখলেন সে প্রাপ্তবয়স্কদের বিভিন্ন সাইটে ঘোরাফেরা করছে, আর গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। অগত্যা মেয়ের ঘর থেকে কম্পিউটার বের করে তিনি ডাইনিং রুমে রেখেছেন, মেয়েকে চোখে চোখে রাখার জন্য। শান্ত স্বভাবের জিনিয়া কোনো উচ্চবাচ্য না করেই সেটা মেনে নিয়েছে।

কিন্তু সবাই ওর মতো হয় না। রাজধানীর রূপনগরের বাসিন্দা কলেজশিক্ষক মিন্টু আহমেদ (ছদ্মনাম) জানালেন, তাঁর ছেলেকে নিষিদ্ধ সাইটে ঘোরাফেরা করতে দেখে কম্পিউটার বসার ঘরে সেট করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে ক্ষুব্ধ হয়ে বাসায় ভাঙচুর শুরু করে। বাধ্য হয়ে কম্পিউটার আবার ছেলের ঘরেই ফিরিয়ে দিয়েছেন মিন্টু আহমেদ। দুঃখ করে তিনি বললেন, ‘আমি নিজে আমার ছাত্রদের শিষ্টাচার হওয়ার কথা বলি। অথচ নিজের ছেলেকেই আমি শিষ্টাচার শেখাতে পারলাম না।’

অনলাইন ক্লাসের নামে শিশু-কিশোরদের অবাধে ইন্টারনেটে বিচরণ নিয়ে শঙ্কিত শিক্ষকেরাও। এ বিষয়ে কথা হয় রাজধানীর উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জহুরা বেগমের সঙ্গে। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের সুরক্ষার কথা ভেবে স্কুলগুলো খোলা যাচ্ছে না। অন্যদিকে অভিভাবকেরা বলছেন, বাসায় থেকে অনলাইন ক্লাস করে বাচ্চাদের ক্ষতি হচ্ছে। অনেক অভিযোগ পাচ্ছি আমরা। এগুলো নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’

শিশু-কিশোরদের কম্পিউটার বা মোবাইলে আসক্ত হওয়াটাকে এখন বাধ্য হয়েই মেনে নিচ্ছেন বেশির ভাগ অভিভাবক। তাঁরা বলছেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে করে বাধ্য হয়েই বাচ্চাদের হাতে মোবাইল দিতে হচ্ছে। এতে করে শিশুরা নির্বিঘ্নে বিভিন্ন সাইটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ গেমে আসক্ত হচ্ছে। কেউ প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট দেখে সময় কাটাচ্ছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, জঙ্গিগোষ্ঠী নব্য জেএমবি এখন শিশু–কিশোরদের সংগঠনে টানার ওপর জোর দিচ্ছে। জঙ্গি সদস্যরা এখন অনলাইনে বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে শক্তিশালী বোমা (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস-আইইডি) তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোরদের কীভাবে গেমে আসক্তি এবং কট্টরপন্থা থেকে দূরে রাখা যায়, সে প্রসঙ্গে তিনটি পরামর্শ দিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, প্রথমত, মা-বাবাকে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হবে। দ্বিতীয়ত, যে বাচ্চাটা অনলাইন ক্লাসের নামে গেম বা অন্য কিছুতে আসক্ত হয়ে পড়ছে, তার কথা স্কুলে জানাতে হবে। আর শিশু-কিশোরদের বেশি করে বই পড়তে দিতে হবে। এটা তাদের খারাপ যেকোনো কাজ থেকে দূরে রাখবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত