মন্টি বৈষ্ণব, ঢাকা
‘এই যে নারী দিবস, নারী দিবস কারে বলে, আমরা তো জানি না। আমাদের কারখানায় পুরুষেরা অনেক সুযোগ-সুবিধা পায়, কিন্তু আমরা ওভারটাইম করলেও ন্যায্য মজুরি পাই না।’ কথাটা তৈরি পোশাক কারখানা লোডস্টার ফ্যাশন লিমিটেডের অপারেটর লাইজু বেগমের। নারী দিবস কী, কেন ইত্যাদি না জানলেও বৈষম্যের পাঠটা তিনি নিজের জীবন দিয়েই নিয়েছেন।
আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর সম-অধিকার আদায়ের একটা দিন। পুরো বিশ্ব এই দিবসকে কেন্দ্র করে নানা কর্মসূচি পালন করে। সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং থেকে শুরু করে অনলাইন আর অফলাইনে চলে নানা কর্মসূচি পালনের প্রতিযোগিতা। কিন্তু আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ইতিহাস, সে কথা অনেকেই ভুলতে বসেছেন। লাইজু বেগমের মতো নারীরা এখনো দেশে-বিদেশে বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে।
এই বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘টেকসই আগামীর লক্ষ্যে লৈঙ্গিক সাম্য’। নারীর জেগে ওঠার কথা তো অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকাঠামো কতটা সহায় হয়েছে, সে প্রশ্ন তোলাই যায়।
ফেরা যাক লাইজু বেগমের কাছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের যাত্রা যে নারী শ্রমিকদের হাতে হয়েছিল, লাইজুও তেমনই একজন শ্রমিক। নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার নারীদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দিবসের শুরুটা হলেও বৈষম্যের শেষ হয়নি। লাইজু বেগমেরা তাই নারী দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে না জানলেও ঠিকই জানেন বৈষম্যের প্রকরণ। অথচ নারী দিবসের সূত্রপাত হয়েছিল কিন্তু পোশাক কারখানায় নারীদের ন্যায্য মজুরি ও বাড়তি কাজ বাতিলের দাবিতে করা আন্দোলন থেকে।
লোডস্টার ফ্যাশন লিমিটেডের অপারেটর লাইজু বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের কারখানায় পুরুষেরা অনেক সুযোগ-সুবিধা পায়। কিন্তু আমরা ওভারটাইম করলেও ন্যায্য মজুরি পাই না। আমরা সেই সকাল ৮টায় কারখানায় ঢুকি আর বের হই রাত ৮টায়। কারখানায় অতিরিক্ত সময় কাজ করেও টাকা পাই কম। এই কম টাকা দিয়ে তো সংসার চালাইতে পারি না। আমার তিন বছরের সন্তানের খাবারের টাকা জোগাড় করতে পারি না। ঘরভাড়া দিতে পারি না। যেখানে কম টাকার বাসা খুঁজে পাই, সেখানেই থাকতে হয়।’
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস রচনা করেছিলেন নারী শ্রমিকেরা। স্বল্প মজুরিতে নারী শ্রমিকের সস্তা শ্রম কেনার প্রতিবাদে গড়ে উঠেছিল সেই আন্দোলন। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, সেদিনের নিউইয়র্ক শহরের সেই পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আজও বাংলাদেশের নারী শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্রে পাচ্ছেন না কাজের সঠিক মূল্যায়ন। নারীর কাছ থেকে সস্তায় শ্রম কেনায় কারখানাগুলোর মধ্যে তেমন ভিন্নতা দেখা যায় না। বলা যায়, সেদিনের নিউইয়র্ক শহরে পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের বৈষম্য আজ বাংলাদেশের পোশাক কারখানায়ও বিরাজমান। এর মূল্য দিতে হচ্ছে শুধু সেই শ্রমিককে নয়, তার সন্তানকেও।
লাইজু বেগম বলেন, ‘বাজারের প্রতিটা জিনিসের দাম বেশি। আমরা একদিন হয়তো শাক খাই, আরেকদিন খাই আলু ভর্তা। ভালো খাবার আমরা খুব কম সময়ই খাই। নিজের পোলাটারেও ভালো-মন্দ খাওয়াতে পারি না। এভাবে থাকা আমাদের জন্য অনেক কষ্টের। আমরা তো কারখানায় প্রতিদিন আট ঘণ্টার বেশি কাজ করি। আমরা কেন কম টাকা পাব?’
লাইজুর এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। সভা-সমিতিতে কিংবা নারী দিবসের নানা কর্মসূচিতে নারী-পুরুষ সমানাধিকারের কথা বলা হয়, এবারও হবে। কিন্তু বাংলাদেশে এটি এখনো অনেকটাই কাগজকলমে রয়ে গেছে। লোডস্টার ফ্যাশন লিমিটেডের আরেক অপারেটর রিনা আক্তার বলেন, ‘আমাদের মালিকপক্ষ ন্যায্য টাকা দেয় না। আমি ২০১৪ সাল থেকে ঢাকায় আছি। এই কারখানায় আমরা অসুস্থ হলে ছুটি পাই না। মাঝে মাঝে এখানকার কর্তৃপক্ষ অমানবিক আচরণ করে, গালাগালি করে। আমরা কোথাও গিয়া শান্তি পাই না।’
রিনা আক্তার শুধু কর্মক্ষেত্রে নন, ঘরেও শান্তির খোঁজ পান না। অধিকারের প্রশ্নে সেখানেও তাঁকে একই আচরণ সহ্য করতে হয়। তিনি বলেন, ‘এত খাটাখাটনির পর ঘরে গিয়া শুনতে হয় জামাইয়ের কথা। ঠিকঠাক নাকি কাজ করতে পারি না। আমরা নারীরা কী করব? সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ডিউটি করি। এরপর বাসায় গিয়া সংসারের কাজ। আমি নারী হয়ে ঘরে, কারখানায় এত কাজ করি, কিন্তু আমার জামাই শুধু বাইরে কাজ করে। আমার জামাই ঘরের কোনো কাজকর্ম করে না। তারে ঘরের কাজ করতে বললে গায়ে হাত তোলে।’
রিনা আক্তারের বর পেশায় একজন গাড়িচালক। তাঁরা দুজনই পরিশ্রম করেন। কিন্তু ঘরের পরিশ্রমটা শুধু রিনার জন্যই তোলা থাকে। সেখানে তাঁর স্বামীর হাত চলে না। এটা শুধু রিনার একার অভিজ্ঞতা নয়, কর্মজীবী নারীমাত্রই এ অভিজ্ঞতা কম-বেশি সবার আছে। রিনা বলেন, ‘আমরা তো দুজনই পরিশ্রম করি। আমি একদিন বাসায় দেরি করে এলে বা শরীর খারাপ লাগলে যদি তারে বলি ভাতটা একটু চুলায় বসায় দিয়ো, সে কিন্তু আমার কথা শোনে না। বরং কথা শোনায়, মেয়েদের জন্ম ঘরের কাজের জন্য। আমরা নারীরা আসলেই অসহায়।’
নিজের কাজের পরিসর, যোগ্যতা এবং বৈষম্য—এসব নিয়ে সচেতন রিনা বলেন, ‘আমাকে কারখানার যেই মেশিনে কাজ দেয়, আমি সে মেশিনে কাজ করতে পারি। কিন্তু মাস শেষে অনেক কম টাকা পাই। আমরা তো মালিক থেকে টাকা ভিক্ষা করছি না। আমরা আমাদের শ্রমের বিনিময়ে মাস শেষে বেতন পাই। সে বেতন আবার একই কাজ করা পুরুষদের সমান না। আমরা তো নারী, আমাদের কেউ সম্মান করে না। ঘরেও অত্যাচার সইতে হয়। কারখানায়ও কথা শুনতে হয়। আবার দেখেন নারীরা নির্যাতনের শিকারও হয় বেশি। আমাদের সরকার কি এসব দেখে না? আমরা আমাদের কাজের সমান মজুরি চাই।’
দেশে নারী দিবস নানা আয়োজনে পালন করা হলেও বাল্যবিবাহ, যৌতুকসহ নানাভাবে নারীরা নির্যাতিত। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মোট ২৬৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮৮ জন। তার মধ্যে ৪৬ জন কন্যাশিশুসহ ৭৫ জন ধর্ষণের শিকার, ৩ জন কন্যাশিশুসহ ১২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ১ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে। এ পরিসংখ্যান কিন্তু বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসা খবরের ভিত্তিতে তৈরি। বলে রাখা ভালো—বহু নারী নির্যাতনের খবর সংবাদমাধ্যমে আসেই না। আর মজুরি বৈষম্য রয়ে গেছে সব স্তরে; কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষভাবে।
এ নিয়ে কথা হয় হবিগঞ্জের চা-বাগানের সাধারণ চা-শ্রমিক সন্ধ্যা রানী ভৌমিকের সঙ্গে। চা-বাগানে নারী-পুরুষ বৈষম্যের একটা চিত্র তাঁর কাছ থেকে পাওয়া গেল। বললেন, ‘আমি চা-বাগানে ১০ বছর ধরে কাজ করছি। আমাদের এখানে নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য না থাকলেও গাছ ছাঁটাইয়ের সময় শ্রম বৈষম্যের কবলে পড়তে হয়। যেমন আমরা যে সময়ে ১ হাজার ২০০ গাছের চারা কাটি, ঠিক সেই সময়ে পুরুষেরা কাটে ২০০ গাছের চারা। এই কাজ ছেলেরা ৬ ঘণ্টা করলেও নারীদের করতে হয় ৮ ঘণ্টা। এ ক্ষেত্রে ছেলেরা কম চারা গাছ কাটলেও কেউ কিছু বলে না। কিন্তু আমরা কম চারা গাছ কাটলে আমাদের টাকা কেটে রাখে। এ ভারী অন্যায়। আমাদের শ্রমের কি কোনো মূল্য নেই?’
সন্ধ্যা রানী নারী দিবস ও এর ইতিহাস সম্পর্কে জানেন। এ ক্ষেত্রে তিনি রিনা ও লাইজুর চেয়ে এগিয়ে বলা যায়। নারী দিবস কেন পালন করা হয়, জানতে চাইলে সন্ধ্যা রানী বলেন, ‘নারী দিবসটা হচ্ছে ১৮৫৭ সালে নারীদের মজুরি বৈষম্য কমানোর জন্য আন্দোলন হয়েছিল, সেখান থেকে। সেখানে নারীরা এই আন্দোলন সংগঠিত করেছিল। সেই আন্দোলনে মূল ভূমিকা পালন করেন ক্লারা জেটকিন নামের এক নেত্রী। তিনি এই দিবসের সূচনা করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি যেটা বুঝি সেটা হলো, নারীরা এখনো তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমাদের বাগানগুলো টিকিয়ে রাখছে নারীরা। তারাই কাজ করে বেশি। কিন্তু দিন শেষে নারীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।’
সন্ধ্যা রানী এক অর্থে ঠিকই বলেছেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস সম্পর্কে জানতে হলে ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চে যেতে হবে। ঘটনাস্থল ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহর। ন্যায্য মজুরির দাবিতে রাস্তায় নামেন সুচ কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেদিনের আন্দোলনরত নারী শ্রমিকদের আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল অতিরিক্ত শ্রমঘণ্টা বাতিল, কর্মক্ষেত্রে অমানবিক আচরণ, ন্যায্য মজুরি, কাজের সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন দাবি। সেদিনের সুচ কারখানার নারী শ্রমিকদের মিছিলে চলে সরকারি বাহিনীর দমনপীড়ন। গ্রেপ্তার করা হয় আন্দোলনকারীদের। ফলে এই আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ে। জোরদার হয় আন্দোলন। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তিন বছর পর ১৮৬০ সালে সুচ কারখানার নারী শ্রমিকেরা তাঁদের নিজস্ব ইউনিয়ন গঠন করেন। এরপর ১৯০৮ সালে ৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকেরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত শ্রম বাতিলের দাবিতে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা এই আন্দোলনে প্রায় ২০ হাজার নারী শ্রমিক অংশ নেন। কর্মক্ষেত্রে নারীদের সম-অধিকারের ঐক্যবদ্ধ এ আন্দোলন থেকেই এই দিবসের সূচনা।
এরপর এল ঐতিহাসিক ১৯১০ সাল। জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেতা ক্লারা জেটকিন কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নারীদের অধিকারের দিন হিসেবে নারী দিবস ঘোষণার দাবি জানান। এই সম্মেলনে ১৭টি দেশ থেকে প্রায় ১০০ জন নারী প্রতিনিধি অংশ নেন। সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। পরে বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক নেতারা দিনটি পালনের বিশেষ উদ্যোগ নেন। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্য জাতিসংঘ বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায়। এরপর থেকে সারা বিশ্বে নারীর সম-অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যথাযথ মর্যাদায় পালন হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বাংলাদেশেও হচ্ছে। কিন্তু লাইজু বেগম, রিনা আক্তার, সন্ধ্যা রানীরা যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছেন।
‘এই যে নারী দিবস, নারী দিবস কারে বলে, আমরা তো জানি না। আমাদের কারখানায় পুরুষেরা অনেক সুযোগ-সুবিধা পায়, কিন্তু আমরা ওভারটাইম করলেও ন্যায্য মজুরি পাই না।’ কথাটা তৈরি পোশাক কারখানা লোডস্টার ফ্যাশন লিমিটেডের অপারেটর লাইজু বেগমের। নারী দিবস কী, কেন ইত্যাদি না জানলেও বৈষম্যের পাঠটা তিনি নিজের জীবন দিয়েই নিয়েছেন।
আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর সম-অধিকার আদায়ের একটা দিন। পুরো বিশ্ব এই দিবসকে কেন্দ্র করে নানা কর্মসূচি পালন করে। সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং থেকে শুরু করে অনলাইন আর অফলাইনে চলে নানা কর্মসূচি পালনের প্রতিযোগিতা। কিন্তু আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ইতিহাস, সে কথা অনেকেই ভুলতে বসেছেন। লাইজু বেগমের মতো নারীরা এখনো দেশে-বিদেশে বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে।
এই বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘টেকসই আগামীর লক্ষ্যে লৈঙ্গিক সাম্য’। নারীর জেগে ওঠার কথা তো অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকাঠামো কতটা সহায় হয়েছে, সে প্রশ্ন তোলাই যায়।
ফেরা যাক লাইজু বেগমের কাছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের যাত্রা যে নারী শ্রমিকদের হাতে হয়েছিল, লাইজুও তেমনই একজন শ্রমিক। নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার নারীদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দিবসের শুরুটা হলেও বৈষম্যের শেষ হয়নি। লাইজু বেগমেরা তাই নারী দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে না জানলেও ঠিকই জানেন বৈষম্যের প্রকরণ। অথচ নারী দিবসের সূত্রপাত হয়েছিল কিন্তু পোশাক কারখানায় নারীদের ন্যায্য মজুরি ও বাড়তি কাজ বাতিলের দাবিতে করা আন্দোলন থেকে।
লোডস্টার ফ্যাশন লিমিটেডের অপারেটর লাইজু বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের কারখানায় পুরুষেরা অনেক সুযোগ-সুবিধা পায়। কিন্তু আমরা ওভারটাইম করলেও ন্যায্য মজুরি পাই না। আমরা সেই সকাল ৮টায় কারখানায় ঢুকি আর বের হই রাত ৮টায়। কারখানায় অতিরিক্ত সময় কাজ করেও টাকা পাই কম। এই কম টাকা দিয়ে তো সংসার চালাইতে পারি না। আমার তিন বছরের সন্তানের খাবারের টাকা জোগাড় করতে পারি না। ঘরভাড়া দিতে পারি না। যেখানে কম টাকার বাসা খুঁজে পাই, সেখানেই থাকতে হয়।’
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস রচনা করেছিলেন নারী শ্রমিকেরা। স্বল্প মজুরিতে নারী শ্রমিকের সস্তা শ্রম কেনার প্রতিবাদে গড়ে উঠেছিল সেই আন্দোলন। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, সেদিনের নিউইয়র্ক শহরের সেই পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আজও বাংলাদেশের নারী শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্রে পাচ্ছেন না কাজের সঠিক মূল্যায়ন। নারীর কাছ থেকে সস্তায় শ্রম কেনায় কারখানাগুলোর মধ্যে তেমন ভিন্নতা দেখা যায় না। বলা যায়, সেদিনের নিউইয়র্ক শহরে পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের বৈষম্য আজ বাংলাদেশের পোশাক কারখানায়ও বিরাজমান। এর মূল্য দিতে হচ্ছে শুধু সেই শ্রমিককে নয়, তার সন্তানকেও।
লাইজু বেগম বলেন, ‘বাজারের প্রতিটা জিনিসের দাম বেশি। আমরা একদিন হয়তো শাক খাই, আরেকদিন খাই আলু ভর্তা। ভালো খাবার আমরা খুব কম সময়ই খাই। নিজের পোলাটারেও ভালো-মন্দ খাওয়াতে পারি না। এভাবে থাকা আমাদের জন্য অনেক কষ্টের। আমরা তো কারখানায় প্রতিদিন আট ঘণ্টার বেশি কাজ করি। আমরা কেন কম টাকা পাব?’
লাইজুর এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। সভা-সমিতিতে কিংবা নারী দিবসের নানা কর্মসূচিতে নারী-পুরুষ সমানাধিকারের কথা বলা হয়, এবারও হবে। কিন্তু বাংলাদেশে এটি এখনো অনেকটাই কাগজকলমে রয়ে গেছে। লোডস্টার ফ্যাশন লিমিটেডের আরেক অপারেটর রিনা আক্তার বলেন, ‘আমাদের মালিকপক্ষ ন্যায্য টাকা দেয় না। আমি ২০১৪ সাল থেকে ঢাকায় আছি। এই কারখানায় আমরা অসুস্থ হলে ছুটি পাই না। মাঝে মাঝে এখানকার কর্তৃপক্ষ অমানবিক আচরণ করে, গালাগালি করে। আমরা কোথাও গিয়া শান্তি পাই না।’
রিনা আক্তার শুধু কর্মক্ষেত্রে নন, ঘরেও শান্তির খোঁজ পান না। অধিকারের প্রশ্নে সেখানেও তাঁকে একই আচরণ সহ্য করতে হয়। তিনি বলেন, ‘এত খাটাখাটনির পর ঘরে গিয়া শুনতে হয় জামাইয়ের কথা। ঠিকঠাক নাকি কাজ করতে পারি না। আমরা নারীরা কী করব? সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ডিউটি করি। এরপর বাসায় গিয়া সংসারের কাজ। আমি নারী হয়ে ঘরে, কারখানায় এত কাজ করি, কিন্তু আমার জামাই শুধু বাইরে কাজ করে। আমার জামাই ঘরের কোনো কাজকর্ম করে না। তারে ঘরের কাজ করতে বললে গায়ে হাত তোলে।’
রিনা আক্তারের বর পেশায় একজন গাড়িচালক। তাঁরা দুজনই পরিশ্রম করেন। কিন্তু ঘরের পরিশ্রমটা শুধু রিনার জন্যই তোলা থাকে। সেখানে তাঁর স্বামীর হাত চলে না। এটা শুধু রিনার একার অভিজ্ঞতা নয়, কর্মজীবী নারীমাত্রই এ অভিজ্ঞতা কম-বেশি সবার আছে। রিনা বলেন, ‘আমরা তো দুজনই পরিশ্রম করি। আমি একদিন বাসায় দেরি করে এলে বা শরীর খারাপ লাগলে যদি তারে বলি ভাতটা একটু চুলায় বসায় দিয়ো, সে কিন্তু আমার কথা শোনে না। বরং কথা শোনায়, মেয়েদের জন্ম ঘরের কাজের জন্য। আমরা নারীরা আসলেই অসহায়।’
নিজের কাজের পরিসর, যোগ্যতা এবং বৈষম্য—এসব নিয়ে সচেতন রিনা বলেন, ‘আমাকে কারখানার যেই মেশিনে কাজ দেয়, আমি সে মেশিনে কাজ করতে পারি। কিন্তু মাস শেষে অনেক কম টাকা পাই। আমরা তো মালিক থেকে টাকা ভিক্ষা করছি না। আমরা আমাদের শ্রমের বিনিময়ে মাস শেষে বেতন পাই। সে বেতন আবার একই কাজ করা পুরুষদের সমান না। আমরা তো নারী, আমাদের কেউ সম্মান করে না। ঘরেও অত্যাচার সইতে হয়। কারখানায়ও কথা শুনতে হয়। আবার দেখেন নারীরা নির্যাতনের শিকারও হয় বেশি। আমাদের সরকার কি এসব দেখে না? আমরা আমাদের কাজের সমান মজুরি চাই।’
দেশে নারী দিবস নানা আয়োজনে পালন করা হলেও বাল্যবিবাহ, যৌতুকসহ নানাভাবে নারীরা নির্যাতিত। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মোট ২৬৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮৮ জন। তার মধ্যে ৪৬ জন কন্যাশিশুসহ ৭৫ জন ধর্ষণের শিকার, ৩ জন কন্যাশিশুসহ ১২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ১ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে। এ পরিসংখ্যান কিন্তু বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসা খবরের ভিত্তিতে তৈরি। বলে রাখা ভালো—বহু নারী নির্যাতনের খবর সংবাদমাধ্যমে আসেই না। আর মজুরি বৈষম্য রয়ে গেছে সব স্তরে; কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষভাবে।
এ নিয়ে কথা হয় হবিগঞ্জের চা-বাগানের সাধারণ চা-শ্রমিক সন্ধ্যা রানী ভৌমিকের সঙ্গে। চা-বাগানে নারী-পুরুষ বৈষম্যের একটা চিত্র তাঁর কাছ থেকে পাওয়া গেল। বললেন, ‘আমি চা-বাগানে ১০ বছর ধরে কাজ করছি। আমাদের এখানে নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য না থাকলেও গাছ ছাঁটাইয়ের সময় শ্রম বৈষম্যের কবলে পড়তে হয়। যেমন আমরা যে সময়ে ১ হাজার ২০০ গাছের চারা কাটি, ঠিক সেই সময়ে পুরুষেরা কাটে ২০০ গাছের চারা। এই কাজ ছেলেরা ৬ ঘণ্টা করলেও নারীদের করতে হয় ৮ ঘণ্টা। এ ক্ষেত্রে ছেলেরা কম চারা গাছ কাটলেও কেউ কিছু বলে না। কিন্তু আমরা কম চারা গাছ কাটলে আমাদের টাকা কেটে রাখে। এ ভারী অন্যায়। আমাদের শ্রমের কি কোনো মূল্য নেই?’
সন্ধ্যা রানী নারী দিবস ও এর ইতিহাস সম্পর্কে জানেন। এ ক্ষেত্রে তিনি রিনা ও লাইজুর চেয়ে এগিয়ে বলা যায়। নারী দিবস কেন পালন করা হয়, জানতে চাইলে সন্ধ্যা রানী বলেন, ‘নারী দিবসটা হচ্ছে ১৮৫৭ সালে নারীদের মজুরি বৈষম্য কমানোর জন্য আন্দোলন হয়েছিল, সেখান থেকে। সেখানে নারীরা এই আন্দোলন সংগঠিত করেছিল। সেই আন্দোলনে মূল ভূমিকা পালন করেন ক্লারা জেটকিন নামের এক নেত্রী। তিনি এই দিবসের সূচনা করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি যেটা বুঝি সেটা হলো, নারীরা এখনো তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমাদের বাগানগুলো টিকিয়ে রাখছে নারীরা। তারাই কাজ করে বেশি। কিন্তু দিন শেষে নারীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।’
সন্ধ্যা রানী এক অর্থে ঠিকই বলেছেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস সম্পর্কে জানতে হলে ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চে যেতে হবে। ঘটনাস্থল ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহর। ন্যায্য মজুরির দাবিতে রাস্তায় নামেন সুচ কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেদিনের আন্দোলনরত নারী শ্রমিকদের আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল অতিরিক্ত শ্রমঘণ্টা বাতিল, কর্মক্ষেত্রে অমানবিক আচরণ, ন্যায্য মজুরি, কাজের সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন দাবি। সেদিনের সুচ কারখানার নারী শ্রমিকদের মিছিলে চলে সরকারি বাহিনীর দমনপীড়ন। গ্রেপ্তার করা হয় আন্দোলনকারীদের। ফলে এই আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ে। জোরদার হয় আন্দোলন। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তিন বছর পর ১৮৬০ সালে সুচ কারখানার নারী শ্রমিকেরা তাঁদের নিজস্ব ইউনিয়ন গঠন করেন। এরপর ১৯০৮ সালে ৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকেরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত শ্রম বাতিলের দাবিতে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা এই আন্দোলনে প্রায় ২০ হাজার নারী শ্রমিক অংশ নেন। কর্মক্ষেত্রে নারীদের সম-অধিকারের ঐক্যবদ্ধ এ আন্দোলন থেকেই এই দিবসের সূচনা।
এরপর এল ঐতিহাসিক ১৯১০ সাল। জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেতা ক্লারা জেটকিন কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নারীদের অধিকারের দিন হিসেবে নারী দিবস ঘোষণার দাবি জানান। এই সম্মেলনে ১৭টি দেশ থেকে প্রায় ১০০ জন নারী প্রতিনিধি অংশ নেন। সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। পরে বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক নেতারা দিনটি পালনের বিশেষ উদ্যোগ নেন। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্য জাতিসংঘ বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায়। এরপর থেকে সারা বিশ্বে নারীর সম-অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যথাযথ মর্যাদায় পালন হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বাংলাদেশেও হচ্ছে। কিন্তু লাইজু বেগম, রিনা আক্তার, সন্ধ্যা রানীরা যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছেন।
দেশের সব টিভি চ্যানেল ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দিনে কমপক্ষে দুবার প্রচার করতে হবে ‘জুলাই অনির্বাণ’ ভিডিওচিত্র। আজ শুক্রবার (২২ নভেম্বর) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ কথা জানায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগ জনগণকে অবহিত করার লক্ষ্যে তথ্য..
১ ঘণ্টা আগেনতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন ও অপর চার নির্বাচন কমিশনারের শপথ আগামী রোববার অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ রোববার বেলা দেড়টায় সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে তাঁদের শপথ পাঠ করাবেন। সুপ্রিম কোর্টের জনসংযোগ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে এ কথা জানান।
২ ঘণ্টা আগেনির্বাচনের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে সরকার বলে জানিয়েছেন ভূমি, পর্যটন ও বেসামরিক বিমান উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। আজ শুক্রবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিআইসিসিতে এশিয়ান আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা-২০২৪ পরিদর্শন শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা জানান।
২ ঘণ্টা আগেঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ভিসা আবেদনকারীদের জন্য নতুন ঘোষণা দিয়েছে। সহজ হয়েছে সাক্ষাৎকারবিহীন ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া। বিস্তারিত জানুন।
২ ঘণ্টা আগে