মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’ স্বীকৃতি পেলেন শামসুদ্দিন

সাজন আহম্মেদ পাপন, কিশোরগঞ্জ 
প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২২: ২৪

১৯৭১ সাল। শামসুদ্দিন আহমেদ তখন টগবগে যুবক। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত রাজশাহী সদরে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সরকারি চাকরিজীবী হয়েও পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল তৎকালীন মহকুমা কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে নিয়ে তানোর থানায় সরকারি জিপে চড়ে সংগ্রাম কমিটির এক সভায় যোগ দিতে গিয়ে রাস্তায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক ও শহীদ হন। পরে পাকিস্তানিরা তাঁর রাজশাহীর বাসাটিও পুড়িয়ে দেয়। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা তখন কিশোরগঞ্জে ছিলেন। স্বাধীনতার পর টানা ৬ মাস তাঁর লাশটি খোঁজে স্বজনেরা। 

পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পরও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তাঁর নাম স্থান পায়নি। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী শামসুদ্দিন আহমেদের অবসানের কথা সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হলেও পরে কেউ খবর নেয়নি পরিবারটির। 

স্বামী হারিয়ে শামসুদ্দিন আহমেদের স্ত্রী তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক রুস্তম আলীর মেয়ে সিদ্দিকা বেগম দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে পড়েন বিপাকে। ১১০ টাকা বেতনে কিশোরগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি নেন। স্বামীর শহীদ মর্যাদা পেতে আজীবন সংগ্রাম করে ২০০৬ সালের ৬ মে মৃত্যুবরণ করেন সিদ্দিকা বেগম। দীর্ঘদিন বিভিন্ন দপ্তরে ধরনা দিয়েও তাঁর পরিবার কোনো সাড়া পায়নি। 

মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পর অবশেষে শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্বীকৃতি পেলেন কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলা সদরের সাচাইল গ্রামের বাসিন্দা শামসুদ্দিন আহমেদ। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁর নাম। গেজেট ৪২৭–এর ৩য় তালিকায় তাঁর ক্রমিক নং ৯২। 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় শামসুদ্দিন আহমেদ স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তাঁর বড় ছেলে ক্যাপ্টেন (অব.) সালাহ উদ্দিন আহমেদ সেলু। 

সালাহ উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘স্বাধীনতা পরবর্তী টানা ছয় বছর লাশের সন্ধান চলে, আত্মীয়–স্বজন হন্যে হয়ে খুঁজে কোনো হদিস পায়নি। আমি অভিভূত, আপ্লুত! ৫২ বছর পর স্বীকৃতি! নিঃসন্দেহে মন্ত্রী মহোদয় ও মন্ত্রণালয় প্রশংসার দাবিদার; তাঁদের নিবিষ্ট আন্তরিকতার জন্য। এ এক বিরল অভিজ্ঞতা, পরম শান্তির।’ 

মায়ের কথা স্মরণ করে সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘১৯৯৭ সালে আমার মা সিদ্দিকা বেগম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে স্বামীর শহীদ স্বীকৃতির জন্য একটি হৃদয়স্পর্শী চিঠি লেখেন। তিনি লেখেন, “স্বামীর লাশটিও ওরা ফেরত দেয়নি। আপনজন হারানোর ব্যথাটুকু ভুলে গেছি দেশের স্বাধীন লাল সূর্যটুকু দেখে। কিন্তু শূন্যতাতো পূরণ হওয়ার নয়। অনেক প্রতিকূলতার মাঝে দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে লালন–পালন করেছি। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সাহায্য–সহযোগিতা তো দূরের কথা সামান্যতম সহানুভূতিটুকুও পাইনি।’ ”

শামসুদ্দিন আহমেদের ছেলে সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭২ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশ সরকারের গেজেটের সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সেকশন নং ED/J1-77 / 72-396 অংশে শামসুদ্দিন আহমেদের ঘটনাটি স্থান পায়। গেজেটে বলা হয়, ‘Mr. Shamsuddin Ahmed was arrested by the pakistani army on the 14 th april 1971 at Rajshahi and was leter killed by said army on that day. ’

গেজেটের তথ্য অনুযায়ী, শামসুদ্দিন আহমেদ ১৯৬৪ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে চাকরিতে যোগ দেন। তিনি সরকারি বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। 

তৎকালীন সরকারের কেবিনেট সচিব এম এম জামান স্বাক্ষরিত এ গেজেটে শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক এবং সমবেদনা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সরকারিভাবে মুদ্রিত শহীদদের তালিকায় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। 

এদিকে ২০০৭ সালে তাড়াইল প্রশাসন ‘তাড়াইল উপজেলা স্মারক গ্রন্থ’ প্রকাশ করে। বইটির ৮০ পৃষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধে শামসুদ্দিন আহমেদের আত্মত্যাগের বিষয়টি বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শামসুদ্দিন আহমেদের ছেলে সালাহ উদ্দিন আহমেদ। 

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘অনেক বছর পরে হলেও তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন। এটা আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী শামসুদ্দিন আহমেদের পরিবারকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত