অনলাইন ডেস্ক
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফেরাতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১১ সালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান অপরিবর্তিত রেখে জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবারও সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে তা অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। একই বছরের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে আপিলটি খারিজ করে রায় দেন।
২০১৭ সালের ১ আগস্ট আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পরে একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর ওই রায় রিভিউ চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
আজ রোববার রিভিউ আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এই রায় দেন। এর ফলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরে এল বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা চালু হলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে সরিয়ে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির হাতে নেওয়া হয়।
তবে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনকালে সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী এনে সেই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে দেওয়া, যার প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতি।
উচ্চ আদালতের কোনো বিচারপতি যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন কিংবা অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হন, তাহলে তাঁকে কীভাবে অপসারণ করা হবে এ বিষয়ে ২০১৪ সালে আবার সংবিধান সংশোধন করে আওয়ামী লীগ। ষোড়শ সংশোধনীতে বলা হয়, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে থাকবে।
সংবিধানের এই সংশোধনীর তীব্র বিরোধিতা করে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং আইনজীবীদের বিভিন্ন সংগঠন। সরকার এর মাধ্যমে বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে বলে তারা অভিযোগ করে।
যদিও তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে গেলেও তাঁরা কোনো বিচারকের রায় পছন্দ না হলেই তাঁকে সরিয়ে দিতে পারবেন, ব্যাপারটা সেরকম নয়। বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও অযোগ্যতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে। আর এই অভিযোগ যাচাই করবে একটি পৃথক স্বাধীন সংস্থা। সুতরাং এখানে এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগের সুযোগ নেই।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কী?
বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাস নানা উত্থান-পতনের ঘটনায় ভরপুর। উচ্চ আদালত সামরিক শাসনের সব চিহ্ন মুছে দিলেও সামরিক ফরমানবলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান সব সময় অটুট রেখেছেন।
বিখ্যাত মাসদার হোসেন মামলায়, ৫২ ডিএলআর (এডি) ৮২, সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার ওপর দীর্ঘ রায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ভূমিকা উল্লেখ করা হয়।
বিচারকেরা যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন কিংবা গুরুতর অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হন, সে ক্ষেত্রে তাদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক তদন্ত করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ও জ্যেষ্ঠ বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত এ কাউন্সিল বিচারকদের আচরণবিধিও নির্ধারণের কাজ করবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর দফায় বলা আছে, একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকবে, যা এই অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলে উল্লিখিত হবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুজন কর্মে প্রবীণ তাঁদের নিয়ে গঠিত হবে।
এই পদ্ধতিতে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোনো সময় কাউন্সিলের সদস্য এ রকম কোনো বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন অথবা কাউন্সিলের কোনো সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন, অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো কারণে কাজ করতে অসমর্থ হন, তাহলে কাউন্সিলের যাঁরা সদস্য আছেন, তাঁদের মধ্যে পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসেবে কাজ করবেন।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাজ
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬ (৪) অনুসারে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের দুই ধরনের দায়িত্ব রয়েছে:
১. বিচারকদের জন্য আচরণবিধি (Code of Conduct) প্রণয়ন এবং
২. বিচারকগণের আচরণ ও সামর্থ্য সংক্রান্তে তদন্ত করা
বিগত ৭ই মে ২০০০ তারিখে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জনাব লতিফুর রহমান, বিচারপতি বি বি রায় চৌধুরী ও বিচারপতি জনাব এ এম মাহমুদুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথমবারের মতো আচরণবিধি প্রণয়ন করেন। এ ছাড়া, আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী মামলায় ৩৯টি এবং মো. ইদ্রিসুর রহমান বনাম সৈয়দ শাহিদুর রহমান, ৬৮ ডিএলআর (এডি) ২৫৮, মামলায় ৪০টি আচরণবিধি নির্ধারণ করেন। ইদ্রিসুর রহমান মামলায় আদালত উল্লেখ করে যে, প্রদত্ত আচরণবিধিসমূহ চূড়ান্ত নয় বরং ব্যাখ্যামূলক ও উদাহরণ স্বরূপ। একজন বিচারককে শত বছরের প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুন ও নীতি-নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ইতিহাস
১৯৭২ সালে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬-এ অসদাচরণ ও অক্ষমতার কারণে একজন বিচারপতিকে অপসারণের বিধান রাখা হয়। সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির ওপর অপসারণের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের সর্বময় ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসন জারি হয়। সংবিধানের কার্যকারিতা স্থগিত করা হয়। The Second Proclamation (Tenth Amendment) Order, ১৯৭৭ জারি করে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ’৯৬-এ প্রথমবারের মতো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান সন্নিবেশ করা হয়। এরপর সংসদ অধিবেশনে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে আগে জারি করা সব আইনের বৈধতা দেওয়া হয়। ১৯৮২ সালে আবারও সামরিক শাসন জারি হয়। The Martial Law Proclamation (First Amendment) Order, ১৯৮২ প্রণয়ন করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসককে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৯৮৬ সালে সংসদ আবার সংসদ অধিবেশন বসে এবং The Constitution Final Revival Order, ১৯৮৬-এর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।
২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগ খন্দকার দেলোয়ার হোসেন বনাম ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস, ৬২ ডিএলআর (এডি) ২৯৮, মামলায় সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আপিল বিভাগ ওই সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। তবে অধিকতর স্বচ্ছতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বিবেচনায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান আদালত বলবৎ রাখেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ আবেদন করে। আপিল বিভাগ রিভিউ নিষ্পত্তি করে সামরিক ফরমানে জারিকৃত আইন–কানুনগুলোতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে সংসদকে ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। ২০১১ সালের ৩০ জুন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান অপরিবর্তিত রেখে জাতীয় সংসদ পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে।
তিন বছর পর ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা আবার সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের কিছু আইনজীবী এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। ওই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সরকার আপিল করে। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই আদালত সর্বসম্মতি ক্রমে আপিলটি খারিজ করেন এবং ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে যা বলছেন আইনজীবীরা
আজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শুনানিতে অংশ নেন। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস আদালতের অনুমতি নিয়ে শুনানিতে অংশ নেন।
এই রায়ের ফলে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অসমর্থতা ও পেশাগত অসদাচরণের কোনো অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ থেকে ৮ পর্যন্ত বিধান ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যম বাতিল করা হয়েছিল। এগুলো পুনর্বহাল করেছেন আপিল বিভাগ।
এই রায় ঐতিহাসিক বলে প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল।
আরও খবর পড়ুন:
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফেরাতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১১ সালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান অপরিবর্তিত রেখে জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবারও সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে তা অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। একই বছরের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে আপিলটি খারিজ করে রায় দেন।
২০১৭ সালের ১ আগস্ট আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পরে একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর ওই রায় রিভিউ চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
আজ রোববার রিভিউ আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এই রায় দেন। এর ফলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরে এল বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা চালু হলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে সরিয়ে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির হাতে নেওয়া হয়।
তবে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনকালে সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী এনে সেই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে দেওয়া, যার প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতি।
উচ্চ আদালতের কোনো বিচারপতি যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন কিংবা অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হন, তাহলে তাঁকে কীভাবে অপসারণ করা হবে এ বিষয়ে ২০১৪ সালে আবার সংবিধান সংশোধন করে আওয়ামী লীগ। ষোড়শ সংশোধনীতে বলা হয়, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে থাকবে।
সংবিধানের এই সংশোধনীর তীব্র বিরোধিতা করে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং আইনজীবীদের বিভিন্ন সংগঠন। সরকার এর মাধ্যমে বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে বলে তারা অভিযোগ করে।
যদিও তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে গেলেও তাঁরা কোনো বিচারকের রায় পছন্দ না হলেই তাঁকে সরিয়ে দিতে পারবেন, ব্যাপারটা সেরকম নয়। বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও অযোগ্যতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে। আর এই অভিযোগ যাচাই করবে একটি পৃথক স্বাধীন সংস্থা। সুতরাং এখানে এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগের সুযোগ নেই।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কী?
বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাস নানা উত্থান-পতনের ঘটনায় ভরপুর। উচ্চ আদালত সামরিক শাসনের সব চিহ্ন মুছে দিলেও সামরিক ফরমানবলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান সব সময় অটুট রেখেছেন।
বিখ্যাত মাসদার হোসেন মামলায়, ৫২ ডিএলআর (এডি) ৮২, সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার ওপর দীর্ঘ রায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ভূমিকা উল্লেখ করা হয়।
বিচারকেরা যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন কিংবা গুরুতর অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হন, সে ক্ষেত্রে তাদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক তদন্ত করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ও জ্যেষ্ঠ বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত এ কাউন্সিল বিচারকদের আচরণবিধিও নির্ধারণের কাজ করবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর দফায় বলা আছে, একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকবে, যা এই অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলে উল্লিখিত হবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুজন কর্মে প্রবীণ তাঁদের নিয়ে গঠিত হবে।
এই পদ্ধতিতে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোনো সময় কাউন্সিলের সদস্য এ রকম কোনো বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন অথবা কাউন্সিলের কোনো সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন, অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো কারণে কাজ করতে অসমর্থ হন, তাহলে কাউন্সিলের যাঁরা সদস্য আছেন, তাঁদের মধ্যে পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসেবে কাজ করবেন।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাজ
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬ (৪) অনুসারে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের দুই ধরনের দায়িত্ব রয়েছে:
১. বিচারকদের জন্য আচরণবিধি (Code of Conduct) প্রণয়ন এবং
২. বিচারকগণের আচরণ ও সামর্থ্য সংক্রান্তে তদন্ত করা
বিগত ৭ই মে ২০০০ তারিখে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জনাব লতিফুর রহমান, বিচারপতি বি বি রায় চৌধুরী ও বিচারপতি জনাব এ এম মাহমুদুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথমবারের মতো আচরণবিধি প্রণয়ন করেন। এ ছাড়া, আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী মামলায় ৩৯টি এবং মো. ইদ্রিসুর রহমান বনাম সৈয়দ শাহিদুর রহমান, ৬৮ ডিএলআর (এডি) ২৫৮, মামলায় ৪০টি আচরণবিধি নির্ধারণ করেন। ইদ্রিসুর রহমান মামলায় আদালত উল্লেখ করে যে, প্রদত্ত আচরণবিধিসমূহ চূড়ান্ত নয় বরং ব্যাখ্যামূলক ও উদাহরণ স্বরূপ। একজন বিচারককে শত বছরের প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুন ও নীতি-নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ইতিহাস
১৯৭২ সালে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬-এ অসদাচরণ ও অক্ষমতার কারণে একজন বিচারপতিকে অপসারণের বিধান রাখা হয়। সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির ওপর অপসারণের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের সর্বময় ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসন জারি হয়। সংবিধানের কার্যকারিতা স্থগিত করা হয়। The Second Proclamation (Tenth Amendment) Order, ১৯৭৭ জারি করে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ’৯৬-এ প্রথমবারের মতো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান সন্নিবেশ করা হয়। এরপর সংসদ অধিবেশনে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে আগে জারি করা সব আইনের বৈধতা দেওয়া হয়। ১৯৮২ সালে আবারও সামরিক শাসন জারি হয়। The Martial Law Proclamation (First Amendment) Order, ১৯৮২ প্রণয়ন করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসককে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৯৮৬ সালে সংসদ আবার সংসদ অধিবেশন বসে এবং The Constitution Final Revival Order, ১৯৮৬-এর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।
২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগ খন্দকার দেলোয়ার হোসেন বনাম ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস, ৬২ ডিএলআর (এডি) ২৯৮, মামলায় সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আপিল বিভাগ ওই সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। তবে অধিকতর স্বচ্ছতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বিবেচনায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান আদালত বলবৎ রাখেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ আবেদন করে। আপিল বিভাগ রিভিউ নিষ্পত্তি করে সামরিক ফরমানে জারিকৃত আইন–কানুনগুলোতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে সংসদকে ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। ২০১১ সালের ৩০ জুন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান অপরিবর্তিত রেখে জাতীয় সংসদ পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে।
তিন বছর পর ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা আবার সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের কিছু আইনজীবী এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। ওই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সরকার আপিল করে। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই আদালত সর্বসম্মতি ক্রমে আপিলটি খারিজ করেন এবং ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে যা বলছেন আইনজীবীরা
আজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শুনানিতে অংশ নেন। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস আদালতের অনুমতি নিয়ে শুনানিতে অংশ নেন।
এই রায়ের ফলে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অসমর্থতা ও পেশাগত অসদাচরণের কোনো অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ থেকে ৮ পর্যন্ত বিধান ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যম বাতিল করা হয়েছিল। এগুলো পুনর্বহাল করেছেন আপিল বিভাগ।
এই রায় ঐতিহাসিক বলে প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল।
আরও খবর পড়ুন:
অন্য যে কোনো পেশা, ব্যবসা কিংবা সরকারি, আধা–সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সঙ্গে কর্মসম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে তাঁদের প্রেস মিনিস্টার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যোগদানের তারিখ থেকে এই নিয়োগ কার্যকর হবে।
৩৭ মিনিট আগেবিগত সময়ে বঞ্চিত হওয়া অতিরিক্ত সচিবদের গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি দিয়ে চাকরি থেকে বিদায় করবে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান আজ রোববার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান...
২ ঘণ্টা আগেসরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার সময় এক মাস বাড়ানো হয়েছে। চলতি বছরের সম্পদ বিবরণী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা জমা দেওয়া যাবে...
২ ঘণ্টা আগেপাঁচটি বিসিএসের মাধ্যমে ক্যাডার পদে ১২ হাজার ৭১০ জন এবং নন-ক্যাডারে ৫ হাজার ৪৩৯ জনসহ মোট ১৮ হাজার ১৪৯ জনকে নিয়োগ দেবে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান আজ রোববার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।
৩ ঘণ্টা আগে