জাহীদ রেজা নূর

১৭ এপ্রিল কী ঘটেছিল এই দেশে? ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল?
১৭ এপ্রিল তারিখটায় পৌঁছাতে হলে মেলে ধরতে হয় ইতিহাসের ডানা। এই দিনে বৈদ্যনাথতলা হয়ে ওঠে মুজিবনগর। কেন মুজিবনগর? মুজিব তো তখন নেই। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরেছে ইয়াহিয়া। বিচারের নাম করে শেখ মুজিবকে হত্যা করার তোড়জোড় চলছে তখন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের শপথ নেওয়ার জন্য যে জায়গাটি বেছে নেওয়া হলো, তার নাম তো আর কিছুই হতে পারে না। তাই বৈদ্যনাথতলা রাতারাতি বদলে গিয়ে নাম ধারণ করল মুজিবনগর। মুজিব তখন প্রতিটি মানুষের প্রাণের শক্তি, মুজিব তখন নিজেই একটি দেশের প্রতিচ্ছবি।
সেই ইতিহাস কি ভুলে যাবে মানুষ?
কবিরা যদিও বলে থাকেন, ‘লোকে ভুলে যেতে চায়, সহজেই ভোলে।’ কিন্তু সবাই কি ভোলে? সবকিছু কি ভোলা যায়? ভুলিয়ে দিতে চাইলেও মনের কোনো সূক্ষ্ণ কোণে সত্য কি জেগে থাকে না? নাকি সবই গরল ভেল?
সেই প্রচণ্ড পৈশাচিকতার পর প্রতিদিন চলছিল বাঙালি নিধন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১০ এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার। ১৭ এপ্রিল সেই সরকার কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত হয় এই সরকার।
২
ইয়াহিয়া ও তার সামরিক জান্তা বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিল তার হানাদার বাহিনীকে, ২৫ মার্চ রাতে। সেই একাত্তরের কথাই তো বলছি। মুখে বলছিল আলোচনা চলছে। কেন এ রকম মিথ্যে বলছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট? অপারেশন সার্চলাইটের ঝান্ডা-বরদাররা ছিল ইয়াহিয়ার পাশেই। তারা অবিরত ইয়াহিয়ার কানে কানে বলে চলেছিল, ইয়াহিয়া যেন শেখ মুজিবকে বুঝতে না দেন তার মনের মধ্যে কী আছে। বলে চলেছিল, আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, পরিষদ বসার সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখার ভান করাকে যেন প্রাধান্য দেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। সমস্যা-অন্তে আছে সমাধান—এ রকম কথাই তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজনীতির মঞ্চে।
কিন্তু তখন তো প্লেনভর্তি সৈন্য আসছে ঢাকায়।
কেন আসছে?
তখন তো পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা চলে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে।
কেন যাচ্ছে?
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানিদের আসতে দেওয়া হচ্ছে না বাংলায়।
কেন দেওয়া হচ্ছে না?
অন্ধকার যে ঘণীভূত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এ দেশের ভাগ্যে, সেটা কি আঁচ করা যাচ্ছিল তখন?
৩
১৭ এপ্রিলের মুজিবনগরে এসে দাঁড়াতে হলে আমাদের তো আগের কিছু কথা বলে নিতেই হবে। নইলে কীভাবে দিনটি এল, কীভাবে বাংলার মানুষ জানল, মানচিত্রে একটি নতুন দেশের জন্ম হয়েছে, বাংলাদেশ তার নাম?
এই দেশের রাষ্ট্রপতির নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি তখন পাকিস্তানের জেলে। তার পরও তাঁকেই কেন প্রেসিডেন্ট করা হলো নবগঠিত এই দেশের?
এ প্রশ্ন কি জেগে ওঠে না আজকের তরুণের মনে?
কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে টিটকারি মেরে বলে থাকে, তিনি তো পালিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে!
ডাহা মিথ্যা কথা! মেরুদণ্ড সোজা রেখে এই সব অপপ্রচারকারীকে সিকান্দর আবু জাফরের ভাষায় বলতে হয়, ‘তুমি বাংলা ছাড়ো!’ কেন বলতে হয়? বলতে হয় এ কারণে যে, বাংলার ইতিহাস না জানলে এই ‘পালিয়ে যাওয়া’ তত্ত্বই গিলে খেতে হবে।
যে মানুষটিকে গ্রেপ্তার করতে পারলে বিচারিক প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝোলানো যায়, সেই মানুষটি কি জানতেন না, ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী তাঁকে হত্যা করতে পারে? জানতেন না, স্বল্পকাল আগে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তাঁকে ফাঁসির দড়িতে লটকে দেওয়ার কত চেষ্টাই না করেছিল? প্রবল গণ-আন্দোলন, তথা গণ-অভ্যুত্থানই জেলের তালা ভেঙে শেখ মুজিবকে ফিরিয়ে এনেছিল মুক্ত পৃথিবীতে?
শেখ মুজিব নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
আর তাঁর নামেই এসেছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ।
৪
মুজিবনগর সরকার গঠনের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছিল না। তবে ভারত শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে গেছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকারকে যুদ্ধের শেষ সময়েই কেবল স্বীকৃতি দিয়েছে।
আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও যুদ্ধ পরিচালনা ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচারণা চালানোর ব্যাপারে ভারতের দিক থেকে মুজিবনগর সরকার কোনো বাধা পায়নি। আর এই স্বীকৃতি দেওয়া-না-দেওয়ার বিষয়টি ভারতকে কৌশলগত সুবিধা দিয়েছে। অর্থাৎ, একটি স্বীকৃত রাষ্ট্র না হওয়ায় ভারতের বিরুদ্ধে একটি নতুন রাষ্ট্রকে মদদ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনতে পারেনি পাকিস্তান।
একটু পেছন ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাব, পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা বাঙালিকে দলমত-নির্বিশেষে একাত্ম করেছে। পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান আসন্ন পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে যে বিক্ষোভ শুরু হয়, তার রেশ অপারেশন সার্চলাইট পর্যন্তই চলে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই অসাধারণ ভাষণের পর আর কারও কোনো সন্দেহ থাকেনি যে, আজ হোক, কাল হোক বাংলাদেশের জন্ম একটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাকিস্তানিরাই বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু করে সেই সময়টিকে তৈরি করে দিল।
সত্তরের নির্বাচনে ৬ দফার ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ছিল অবধারিত। কিন্তু ইয়াহিয়া-ভুট্টো এবং তাদের সামরিক জান্তার দল ভিন্ন কৌশল নিয়েছিল। কৌশল না বলে বাঙালি হত্যার ষড়যন্ত্র বললেই তা লক্ষভেদী হবে। ইয়াহিয়া বিক্ষোভের জবাব দিতে চেয়েছিলেন অস্ত্রের ভাষায়। কিন্তু ততদিনে এই আন্দোলন হয়ে উঠেছে স্বতঃস্ফূর্ত। মোটামুটি সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আন্দোলনে শরিক মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মেনে চলছিলেন। ২৫ মার্চ সামরিক বাহিনী যেভাবে সাধারণ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাতে সেই রক্ষক্ষয়ী নৃশংসতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় অবস্থিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যারা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের বিপরীত পক্ষ ছিল, তারাও এক হয়ে বাংলাদেশীদের এককাট্টা করে দেয়। ফলে পাকিস্তানিরা এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে প্রাথমিকভাবে নিজেদের জয়ী মনে করলেও মূলত তাদের এই জয় ছিল সাময়িক আর এই সময়ের ইতিহাসের ভ্রূণে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ সরকার।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। তাতে লেখা ছিল, ‘শাসনতন্ত্র রচনার অভিপ্রায়ে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া শাসনতন্ত্র রচনা করার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান না করে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখে এবং আলাপ -আলোচনা চলাকালে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’
নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আরও ঘোষণা করেন, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এ সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানের অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন এবং অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। যেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণা বা প্রক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্টস ১০ এপ্রিল হয়েছে, তাই আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণের তারিখ ১৭ এপ্রিল নির্ধারিত হয়।
১১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণে বলেন, ‘২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয় দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন, তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার জন্য আমরা যেমন জীবন দিতে পারি, তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশি শত্রু সেনাদের চিরতরে হটিয়ে দিতে সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কাছে শত্রু যত যত প্রবল পরাক্রম হোক না কেন, পরাজয় বরন করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম, তাহলে নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়তো কিছুদিনের জন্য হরেও পিছিয়ে যেত।’
তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত।’
বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়েছিল ১৩ এপ্রিল। শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রীসভার অন্য সদস্যরা হলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান।
১৪ এপ্রিল জনসাধারণের প্রতি বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু নির্দেশাবলি জারি করেন। এবং এদিন অস্থায়ী সরকারের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কর্নেল ওসমানিকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়াও আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে মেজর খালেদ মোশাররফকে সিলেট কুমিল্লা অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর জিয়াউর রহমানকে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম নোয়াখালী অঞ্চলের দায়িত্ব। ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল অঞ্চলের দায়িত্ব পান মেজর শফিউল্লাহ। আর মেজর এম এ ওসমান পান দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলের দায়িত্ব।
৫
এবার ১৭ এপ্রিলের ঘটনা শোনা যাক কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে।
প্রথমেই পাবনার সাবেক ডিসি ও পরবর্তীকালে মুজিবনগর সরকারের অন্যতম সচিব মোহাম্মদ নূরুল কাদেরের কথা আলোচনায় আনতে পারি।
কেমন ছিল সেদিন বৈদ্যনাথতলা বা মুজিবনগর?
মোহাম্মদ নূরুল কাদেরের ভাষায়, ‘নির্ধারিত স্থানে মঞ্চ তৈরি হলো, আশপাশের বাড়ি থেকে চৌকি এবং বাঁশ আনা হলো। উন্মুক্ত মঞ্চ এটি। উপরে শামিয়ানা কিংবা ব্যনার কোনোটাই লাগানো সম্ভব হলো না। নিভৃত গ্রাম এলাকা। লোকবসতি শহরের তুলনায় অনেক কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে যে আয়োজন, তাতেও মানুষ হলো প্রচুর। দেখতে দেখতে সভাস্থলে অন্তত হাজার পাঁচেক লোক জমায়েত হলো।’
তিনি লিখছেন, ‘পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ক্যাপ্টেন হাফিজ ও আমার ওপর অর্পিত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা যে সব পথ দিয়ে এই এলাকায় প্রবেশ করতে পারে, এমন জায়গাগুলোতে আমরা কড়া পাহারার ব্যবস্থা করি। তখন বেলা এগারোটা। আমগাছের ফাঁক দিয়ে এপ্রিলের সূর্যের নিশানা। আমবাগানের ভেতর কয়েক হাজার দর্শক। ক্ষণে ক্ষণে গগনবিদারী শ্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ উত্তেজনা বিরাজ করছে পুরো এলাকায়। কারণ উপস্থিত সবাই এমন এক দৃশ্য দেখতে যাচ্ছে, যা কারো পক্ষেই ইতিপূর্বে দেখা সম্ভব হয়নি। একটি জাতির জীবনে এ ধরনের অনুষ্ঠান অত্যন্ত বিরল ঘটনা। এই বিরল ঘটনা প্রত্যক্ষ করল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় উপস্থিত প্রায় ৫ হাজার মানুষ। বৈদ্যনাথতলা হয়ে গেল মুজিবনগর। (একাত্তর আমার, মোহাম্মদ নূরুল কাদের, পৃষ্ঠা ৪৭)।
মোহাম্মদ নূরুল কাদের তার স্মৃতিচারণে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রমের কথা বলেছেন। হাফিজু উদ্দিন আহমদ তাঁর ‘সৈনিকের জীবন, গৌরবের একাত্তর, রক্তাক্ত পঁচাত্তর নামের বইয়ে লিখেছেন, ’ ১০ এপ্রিল ভারতের সহায়তায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল সে সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথতলা। তিনদিক থেকে ভারতীয় ভূখণ্ড বেষ্টিত। এখানে বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে আমবাগান। সেখানে দুটি কাঠের চৌকি জোড়া দিয়ে মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। কোনো সাজসজ্জা বা জৌলুস নেই। হাজার হাজার জনতা সীমান্তের উভয় পার থেকে এসে আমবাগানে সমবেত হয়েছে। সবার চোখে মুখে ঔৎসুক্য।
‘আমরা বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে বৈদ্যনাথ তলায় পৌঁছলাম। নেতারা যথাসময়েই সেখানে এসে পৌঁছুলেন। রাষ্ট্রপতিকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার দায়িত্ব ইপিআর সেনাদলের। কিন্তু আমাদের পৌঁছুতে কিছুটা দেরি হওয়ায় এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আটজন আনসারের সমন্বয়ে একটি দল নিয়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ‘গার্ড অব অনার’ দেন।
এখানেই দেখা হলো প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানির সঙ্গে। তিনি ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে আর্মি সার্ভিস কোরে কমিশনপ্রাপ্ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাঁর চালচলন বা ম্যানারিজমে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য দৃশ্যমান। হালকা-পাতলা গড়ন, প্রখর ব্যক্তিতের অধিকারী। বিশাল গোঁফ তার মুখমণ্ডলের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সহজেই সমীহ আদায় করে। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে তিনি পদাতিক বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত হন এবং প্রথম ইস্টবেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার রূপে দায়িত্ব পালন করেন। আমাকে দেখে ভারি খুশি হলেন প্রধান সেনাপতি ওসমানি। পিঠ চাপড়ে দিয়ে অভিনন্দন জানালেন, ‘ওহ মাই বয়! জলি গুড শো।’
‘থ্যাংক য়্যু, স্যার।’ আমি বললাম।
‘আমি পরদিন বেনাপোল যাব সিনিয়র টাইগারদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য।’ ওসমানি বললেন।
‘মোস্ট ওয়েলকাম স্যার। আমরা অপেক্ষায় থাকব।’ আমি বললাম।
উপস্থিত চারজন সেনা কর্মকর্তা মেজর ওসমান, ক্যাপ্টেন এ টি সালাউদ্দিন, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে পরিচিত হলেন প্রধান সেনাপতি। ছোটমঞ্চের পাশে ছয়টি ফোল্ডিং চেয়ারে উপবিষ্ট হলাম ভারতের লে. কর্ণেল মেঘ সিংসহ আমরা ছয় অফিসার।
একটু পরই অনুষ্ঠান শুরু হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হলো। কিন্তু তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। ফলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি রুপে শপথ গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ মন্ত্রী রুপে শপথ নেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। কর্নেল ওসমানিকে মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক মুভি ক্যামেরা নিয়ে এই অনুষ্ঠান কাভার করেন। শপথগ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ইংরেজি ভাষায় চমৎকার একটি বক্তব্য দেন। বাঙালিদের বঞ্চনার ইতিহাস, ২৫ মার্চের গণহত্যা, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার কথা তিনি মর্মস্পর্শী ভাষায় উপস্থাপন করেন। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আবেদন জানান। হাজার হাজার শ্রোতা-দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার সে বক্তব্য শোনেন। আম্রকাননের অনুষ্ঠান, পরিবেশ, পরিস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। হাজারো মুক্তিকামী মানুষের পদভারে প্রকম্পিত। কয়েক কিলোমিটার দূরেই পলাশীর আম্রকানন। ১৭৫৭ সালে সেখানেই বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আজ আরেক আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য আবার উদিত হলো।
মুজিবনগর সরকারের কেবিনেট সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচটি ইমাম নামেই তিনি পরিচিত) মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে বলছেন, ‘আমাদের সরকার মূলত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, যেটি আমরা বলতাম, তার প্রধান দপ্তর বা হেড কোয়ার্টার ছিল মুজিবনগর।
আপনারা সবাই জানেন যে, মুজিবনগর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মেহেরপুর জেলায় আমবাগানে। পলাশীর বিখ্যাত আমবাগানের কাছেই সেই জায়গাটিতেই মুজিবনগর। মুজিব নগরেই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়। স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। আমাদের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার নামেই মুজিবনগর করা হয়। আর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, অন্য মন্ত্রীরা ছিলেন এম মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ। আরও অনেক বড় নেতা ছিলেন।
যুদ্ধকালীন যে পরিস্থিতি, তাতে দ্বিতীয় মহাযুদবধ বা পরবর্তীকালেও যে সমস্ত প্রবাসী সরকার দেখেন, তারা কিন্তু নিরাপত্তার কারণে, রাজনৈতিক কারণে ঠিক একটি জায়গায় কোনো সময়েই থাকেননি। মুজিবনগর হেডকোয়ার্টার ছিল বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে। আমাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও ছিল। কিন্তু আমাদের মূল দপ্তর ছিল কোলকাতায়, থিয়েটার রোডে। সেখানেই আমাদের যৌথ বাহিনী, মিত্র বাহিনীর হেড কোয়াটার ছিল। (বাংলাদেশ ১৯৭১, সম্পাদনা আফসান চৌধুরী, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১১)।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের স্মৃতিচারণ এক্ষেত্রে খুব ভালো একটি সংযোজন হতে পারে। দীর্ঘ সে স্মৃতিচারণের নির্দিষ্ট একটি অংশই এখানে দেওয়া হলো:
‘আমরা বঙ্গবন্ধুকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আত্মগোপনের জন্য চাপ দিই। তিনি আত্মগোপনের কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আত্মগোপনের জন্য তিনি পূর্ব থেকেই বঙ্গবন্ধুকে বলে আসছেন। তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। তিনি প্রশ্ন করেন, আমাকে নিয়ে তোরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আত্মগোপন সম্ভব নয়। আমার হয়তো মৃত্যু হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’
এরপর তিনি বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তাজউদ্দীন আহমদসহ তিনি সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছুলেন। তারপর বলছেন, ‘সীমান্ত থেকে কিছু দূরে একটি জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট খালের ওপর একটি ব্রিটিশ যুগের তৈরি কালভার্ট। কালভার্টের ওপর তাজউদ্দীন ভাই ও আমি বসে আছি। আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে তৌফিক ও মাহবুবকে ওপারে পাঠাই। কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। অফিসারটি জানান, আমাদের তিনি যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে ছাউনিতে নিয়ে যেতে এসেছেন।’
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই বিএসএফের আঞ্চলিকপ্রধান গোলক মজুমদার ছাউনিতে এসে পৌছলেন। তিনি জানান, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। তার সঙ্গে কলকাতা যাওয়ার জন্য আমাদের অনুরোধ করেন। তবে দিল্লির সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয়।
মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তিনি জানান, আমাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে এই ফ্লাইটে দিল্লি থেকে একজন কর্মকর্তা আসবেন। বিমান থেকে ছয় ফুটেরও বেশি লম্বা একজন লোক নেমে সোজা আমাদের গাড়িতে উঠলেন। মজুমদার তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি হলেন বিএসএফের প্রধান রুস্তমজি। রুস্তমজি একসময় ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নিরাপত্তাপ্রধান ছিলেন। নেহরু পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর খুবই আস্থাভাজন।’
‘এদিকে আমার কাপড়-চোপড়ের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। গাড়িতেই শুরু হয় আলোচনা। রুস্তমজির প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কোথায়? মজুমদারের প্রথম প্রশ্নও ছিল এটাই। এর পরে আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সকলেরই প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কেমন আছে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা তৈরি ছিলাম। দলীয় নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধাসহ সকলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের ব্যাপারে আমরা একই উত্তর দিয়েছি। আমরা যা বলতে চেয়েছি তা হলো বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমরা তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাচ্ছি। তিনি জানেন, আমরা কোথায় আছি। তিনি আমাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। সময় হলে বা প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি উপযুক্ত স্থানে আমাদের সাথে দেখা করবেন।’
‘একটি সুন্দর বাড়িতে (আসাম হাউস) আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। একটি ঘরে আমি আর তাজউদ্দীন ভাই, অন্য ঘরে রুস্তমজি। আমরা খুবই ক্লান্ত। স্নান করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সাথে অতিরিক্ত কোনো কাপড় নেই। রুস্তমজি আমার পরিধেয় বস্ত্রের অভাবের কথা জেনে তার ইস্ত্রি করা।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ
“৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন ভাই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তাদের কোনো সহযোগী ছিল না। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী প্রথম প্রশ্ন করেন। “হাউ ইজ শেখ মুজিব, ইজ হি অল রাইট?” (শেখ মুজিব কেমন আছেন?) মিসেস গান্ধীর প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন ভাই বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর স্থান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ২৫ মার্চের পর তাঁর সঙ্গে আমাদের আর যোগাযোগ হয়নি।’ সাক্ষাতে তাজউদ্দীন ভাই আরও বলেন, বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোনো মূল্যে এই স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে।”
“তাজউদ্দীন ভাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, পাকিস্তান আমাদের আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাতে পারে। যে কোনো মূল্যে পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। আমাদের অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহের। মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধে তাজউদ্দীন ভাই ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন। বাংলাদেশের নেতা জানান, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে জোটনিরপেক্ষ। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়। সকল গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহায়তা আমরা চাই।”
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ
‘পরদিন তাজউদ্দীন ভাই দ্বিতীয়বারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। ইন্দিরা গান্ধী জানান, বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবশ্য এই খবর পাকিস্তান সরকার তখনো সরকারিভাবে প্রকাশ করেনি।’
‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাজউদ্দীন ভাই বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। সিদ্ধান্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, তাঁদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর প্রচারের জন্য একটি বেতার স্টেশন স্থাপনের বিষয়েও আলোচনা হয়। ...দিল্লিতে বসেই তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা টেপ করা হয়। বক্তৃতার পূর্বে আমার কণ্ঠ থেকে ঘোষণা প্রচারিত হয়-এখন তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দেবেন। এর পর তাজউদ্দীন ভাই বক্তৃতা শুরু করেন।’
‘...মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা চিন্তা করি। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। পাক দস্যুরা সেখানে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গা রাজধানী করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত তা আর গোপন থাকেনি। চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে আমাদের নতুন স্থানের কথা চিন্তা করতে হলো। এই নিয়ে গোলক মজুমদারের সাথে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে সবাই একমত হন যে, যেখানেই আমরা অনুষ্ঠান করি না কেন, পাক বাহিনীর বিমান হামলার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলাকে মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।’
“স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের খসড়াটি কোনো একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে দেখাতে পারলে ভালো হতো। ইতোমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। এদের মধ্যে সুব্রত রায় চৌধুরীর নাম আমি শুনেছি। রায় চৌধুরীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। বিএসএফের মাধ্যমে রায় চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনি রাজি হলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার যে আইনানুগ অধিকার, তা মানবাধিকারের একটা অংশ। এই কথা স্বাধীনতার সনদে ফুটে উঠেছে। তিনি জানান, তিনি এর ওপর একটা বই লিখবেন। এই ঘোষণাপত্রের একটা কপি তাকে দেওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করলেন। এর পর আইন ব্যবসা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর বই লেখা শুরু করেন। তার রচিত বইটির নাম হচ্ছে ‘জেনেসিস অব বাংলাদেশ’।’
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন
“এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি তৈরি করা হচ্ছে। জানা গেল প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সামরিক পোশাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তার সামরিক পোশাক প্রয়োজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোশাক দিতে বললাম। তাদের স্টকে ওসমানীর গায়ের কোনো পোশাক পাওয়া গেল না। সেই রাতে কাপড় কিনে, দর্জি ডেকে তাঁর জন্য পোশাক তৈরি করা হলো। শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার ভার আমার ও আবদুল মান্নানের ওপর ছিল। ১৬ এপ্রিল আমরা দুজনে কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দুজন প্রতিনিধি বিদেশি সাংবাদিকদের সাথে মিলিত হই। সমস্ত প্রেসক্লাব লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই।”
‘সমবেত সাংবাদিকদের পরদিন ১৭ এপ্রিল কাকডাকা ভোরে প্রেসক্লাবে হাজির হতে অনুরোধ জানাই। বললাম, তখন তাদের আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বিশেষ বার্তা দেওয়া হবে। সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার জন্য আমাদের গাড়ি তৈরি থাকবে বলেও জানালাম। বিএসএফের চট্টোপাধ্যায়কে বলি আমাদের জন্য ১০০টি গাড়ির ব্যবস্থা করতে। এর ৫০টা থাকবে প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের বহন করার জন্য। অবশিষ্ট ৫০টার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পৌছানো হবে।’
‘রাত ১২টা থেকে নেতাদের গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। বলে দেওয়া হলো, কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না। সকালবেলা আমরা একত্র হব।
গাড়ির চালক নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবেন। সাইক্লোস্টাইল করা স্বাধীনতা সনদের কপিগুলো গুছিয়ে নিলাম।
১৭ এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের দিন। সারা রাত ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ওসমানী একটি গাড়িতে রওনা হয়ে যান। আমি ও আবদুল মান্নান ভোরের দিকে পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। ভোরেও ক্লাবে লোক ধরেনি। ক্লাবের বাইরেও অনেক লোক দাঁড়িয়ে ছিল।’
‘সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে বিনীতভাবে বললাম, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। তাদের জানালাম স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করবে। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। কেউ জানতে চাইলেন কিভাবে যাবেন, কোথায় যাবেন। আমি পুনরায় বলি, আমি আপনাদের সঙ্গে রয়েছি, পথ দেখিয়ে দেব। আমাদের গাড়িগুলো তখন প্রেসক্লাবের সামনে। উৎসাহিত সাংবাদিকরা গাড়িতে ওঠেন। তাদের অনেকের কাঁধে ক্যামেরা। ৫০-৬০টা গাড়িযোগে রওনা হলাম গন্তব্যস্থানের দিকে। আমি ও আবদুল মান্নান দুজন দুই গাড়িতে। আমার গাড়িতে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন। পথে তাদের সাথে অনেক কথা হলো। শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত স্থান আম্রকাননে পৌছতে বেলা ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রায় শেষ। মাহবুব ও তৌফিক ইলাহী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। আগেই ঠিক করা হয়েছিল যে, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ পাঠ করবেন।’
আমবাগানে মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ
‘কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। একটি ছোট্ট মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী। সংবাদ সম্মেলনে প্রধান প্রশ্ন ছিল সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। তাঁর সাথে আমাদের চিন্তার (বিস্তর) যোগাযোগ রয়েছে। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু শত্রুশিবিরে বন্দি। কিন্তু আমরা তা বলতে চাইনি। পাক বাহিনী বলুক এটাই আমরা চাচ্ছিলাম। কারণ আমরা যদি বলি বঙ্গবন্ধু পাক শিবিরে, আর তারা যদি অস্বীকার করে তা হলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আর আমরা যদি বলি তিনি দেশের ভেতরে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন হানাদাররা বলে বসবে তিনি বন্দি।’
‘আমবাগানের অনুষ্ঠানে ভরদুপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। হাজারো কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো ইত্যাদি স্লোগান। আমার কাজ ছিল দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করে সাংবাদিকদের ফেরত পাঠানো। দুপুরের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সাংবাদিকদের গাড়িযোগে ফেরত পাঠানো হলো। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ফেরেন সন্ধ্যায়।’
(মুজিবনগর, কাঠামো ও কার্যকারণ, সম্পাদনা আফসান চৌধুরী, পৃষ্ঠা ১১৪-১২৫)
এই বর্ণনার পর নিশ্চয় যে কোনো বিবেচক পাঠক বুঝতে পারবেন, ১৭ এপ্রিল কীভাবে আমাদের হয়েছিল।

১৭ এপ্রিল কী ঘটেছিল এই দেশে? ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল?
১৭ এপ্রিল তারিখটায় পৌঁছাতে হলে মেলে ধরতে হয় ইতিহাসের ডানা। এই দিনে বৈদ্যনাথতলা হয়ে ওঠে মুজিবনগর। কেন মুজিবনগর? মুজিব তো তখন নেই। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরেছে ইয়াহিয়া। বিচারের নাম করে শেখ মুজিবকে হত্যা করার তোড়জোড় চলছে তখন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের শপথ নেওয়ার জন্য যে জায়গাটি বেছে নেওয়া হলো, তার নাম তো আর কিছুই হতে পারে না। তাই বৈদ্যনাথতলা রাতারাতি বদলে গিয়ে নাম ধারণ করল মুজিবনগর। মুজিব তখন প্রতিটি মানুষের প্রাণের শক্তি, মুজিব তখন নিজেই একটি দেশের প্রতিচ্ছবি।
সেই ইতিহাস কি ভুলে যাবে মানুষ?
কবিরা যদিও বলে থাকেন, ‘লোকে ভুলে যেতে চায়, সহজেই ভোলে।’ কিন্তু সবাই কি ভোলে? সবকিছু কি ভোলা যায়? ভুলিয়ে দিতে চাইলেও মনের কোনো সূক্ষ্ণ কোণে সত্য কি জেগে থাকে না? নাকি সবই গরল ভেল?
সেই প্রচণ্ড পৈশাচিকতার পর প্রতিদিন চলছিল বাঙালি নিধন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১০ এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার। ১৭ এপ্রিল সেই সরকার কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত হয় এই সরকার।
২
ইয়াহিয়া ও তার সামরিক জান্তা বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিল তার হানাদার বাহিনীকে, ২৫ মার্চ রাতে। সেই একাত্তরের কথাই তো বলছি। মুখে বলছিল আলোচনা চলছে। কেন এ রকম মিথ্যে বলছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট? অপারেশন সার্চলাইটের ঝান্ডা-বরদাররা ছিল ইয়াহিয়ার পাশেই। তারা অবিরত ইয়াহিয়ার কানে কানে বলে চলেছিল, ইয়াহিয়া যেন শেখ মুজিবকে বুঝতে না দেন তার মনের মধ্যে কী আছে। বলে চলেছিল, আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, পরিষদ বসার সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখার ভান করাকে যেন প্রাধান্য দেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। সমস্যা-অন্তে আছে সমাধান—এ রকম কথাই তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজনীতির মঞ্চে।
কিন্তু তখন তো প্লেনভর্তি সৈন্য আসছে ঢাকায়।
কেন আসছে?
তখন তো পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা চলে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে।
কেন যাচ্ছে?
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানিদের আসতে দেওয়া হচ্ছে না বাংলায়।
কেন দেওয়া হচ্ছে না?
অন্ধকার যে ঘণীভূত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এ দেশের ভাগ্যে, সেটা কি আঁচ করা যাচ্ছিল তখন?
৩
১৭ এপ্রিলের মুজিবনগরে এসে দাঁড়াতে হলে আমাদের তো আগের কিছু কথা বলে নিতেই হবে। নইলে কীভাবে দিনটি এল, কীভাবে বাংলার মানুষ জানল, মানচিত্রে একটি নতুন দেশের জন্ম হয়েছে, বাংলাদেশ তার নাম?
এই দেশের রাষ্ট্রপতির নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি তখন পাকিস্তানের জেলে। তার পরও তাঁকেই কেন প্রেসিডেন্ট করা হলো নবগঠিত এই দেশের?
এ প্রশ্ন কি জেগে ওঠে না আজকের তরুণের মনে?
কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে টিটকারি মেরে বলে থাকে, তিনি তো পালিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে!
ডাহা মিথ্যা কথা! মেরুদণ্ড সোজা রেখে এই সব অপপ্রচারকারীকে সিকান্দর আবু জাফরের ভাষায় বলতে হয়, ‘তুমি বাংলা ছাড়ো!’ কেন বলতে হয়? বলতে হয় এ কারণে যে, বাংলার ইতিহাস না জানলে এই ‘পালিয়ে যাওয়া’ তত্ত্বই গিলে খেতে হবে।
যে মানুষটিকে গ্রেপ্তার করতে পারলে বিচারিক প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝোলানো যায়, সেই মানুষটি কি জানতেন না, ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী তাঁকে হত্যা করতে পারে? জানতেন না, স্বল্পকাল আগে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তাঁকে ফাঁসির দড়িতে লটকে দেওয়ার কত চেষ্টাই না করেছিল? প্রবল গণ-আন্দোলন, তথা গণ-অভ্যুত্থানই জেলের তালা ভেঙে শেখ মুজিবকে ফিরিয়ে এনেছিল মুক্ত পৃথিবীতে?
শেখ মুজিব নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
আর তাঁর নামেই এসেছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ।
৪
মুজিবনগর সরকার গঠনের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছিল না। তবে ভারত শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে গেছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকারকে যুদ্ধের শেষ সময়েই কেবল স্বীকৃতি দিয়েছে।
আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও যুদ্ধ পরিচালনা ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচারণা চালানোর ব্যাপারে ভারতের দিক থেকে মুজিবনগর সরকার কোনো বাধা পায়নি। আর এই স্বীকৃতি দেওয়া-না-দেওয়ার বিষয়টি ভারতকে কৌশলগত সুবিধা দিয়েছে। অর্থাৎ, একটি স্বীকৃত রাষ্ট্র না হওয়ায় ভারতের বিরুদ্ধে একটি নতুন রাষ্ট্রকে মদদ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনতে পারেনি পাকিস্তান।
একটু পেছন ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাব, পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা বাঙালিকে দলমত-নির্বিশেষে একাত্ম করেছে। পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান আসন্ন পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে যে বিক্ষোভ শুরু হয়, তার রেশ অপারেশন সার্চলাইট পর্যন্তই চলে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই অসাধারণ ভাষণের পর আর কারও কোনো সন্দেহ থাকেনি যে, আজ হোক, কাল হোক বাংলাদেশের জন্ম একটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাকিস্তানিরাই বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু করে সেই সময়টিকে তৈরি করে দিল।
সত্তরের নির্বাচনে ৬ দফার ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ছিল অবধারিত। কিন্তু ইয়াহিয়া-ভুট্টো এবং তাদের সামরিক জান্তার দল ভিন্ন কৌশল নিয়েছিল। কৌশল না বলে বাঙালি হত্যার ষড়যন্ত্র বললেই তা লক্ষভেদী হবে। ইয়াহিয়া বিক্ষোভের জবাব দিতে চেয়েছিলেন অস্ত্রের ভাষায়। কিন্তু ততদিনে এই আন্দোলন হয়ে উঠেছে স্বতঃস্ফূর্ত। মোটামুটি সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আন্দোলনে শরিক মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মেনে চলছিলেন। ২৫ মার্চ সামরিক বাহিনী যেভাবে সাধারণ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাতে সেই রক্ষক্ষয়ী নৃশংসতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় অবস্থিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যারা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের বিপরীত পক্ষ ছিল, তারাও এক হয়ে বাংলাদেশীদের এককাট্টা করে দেয়। ফলে পাকিস্তানিরা এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে প্রাথমিকভাবে নিজেদের জয়ী মনে করলেও মূলত তাদের এই জয় ছিল সাময়িক আর এই সময়ের ইতিহাসের ভ্রূণে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ সরকার।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। তাতে লেখা ছিল, ‘শাসনতন্ত্র রচনার অভিপ্রায়ে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া শাসনতন্ত্র রচনা করার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান না করে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখে এবং আলাপ -আলোচনা চলাকালে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’
নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আরও ঘোষণা করেন, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এ সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানের অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন এবং অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। যেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণা বা প্রক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্টস ১০ এপ্রিল হয়েছে, তাই আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণের তারিখ ১৭ এপ্রিল নির্ধারিত হয়।
১১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণে বলেন, ‘২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয় দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন, তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার জন্য আমরা যেমন জীবন দিতে পারি, তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশি শত্রু সেনাদের চিরতরে হটিয়ে দিতে সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কাছে শত্রু যত যত প্রবল পরাক্রম হোক না কেন, পরাজয় বরন করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম, তাহলে নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়তো কিছুদিনের জন্য হরেও পিছিয়ে যেত।’
তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত।’
বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়েছিল ১৩ এপ্রিল। শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রীসভার অন্য সদস্যরা হলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান।
১৪ এপ্রিল জনসাধারণের প্রতি বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু নির্দেশাবলি জারি করেন। এবং এদিন অস্থায়ী সরকারের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কর্নেল ওসমানিকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়াও আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে মেজর খালেদ মোশাররফকে সিলেট কুমিল্লা অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর জিয়াউর রহমানকে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম নোয়াখালী অঞ্চলের দায়িত্ব। ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল অঞ্চলের দায়িত্ব পান মেজর শফিউল্লাহ। আর মেজর এম এ ওসমান পান দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলের দায়িত্ব।
৫
এবার ১৭ এপ্রিলের ঘটনা শোনা যাক কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে।
প্রথমেই পাবনার সাবেক ডিসি ও পরবর্তীকালে মুজিবনগর সরকারের অন্যতম সচিব মোহাম্মদ নূরুল কাদেরের কথা আলোচনায় আনতে পারি।
কেমন ছিল সেদিন বৈদ্যনাথতলা বা মুজিবনগর?
মোহাম্মদ নূরুল কাদেরের ভাষায়, ‘নির্ধারিত স্থানে মঞ্চ তৈরি হলো, আশপাশের বাড়ি থেকে চৌকি এবং বাঁশ আনা হলো। উন্মুক্ত মঞ্চ এটি। উপরে শামিয়ানা কিংবা ব্যনার কোনোটাই লাগানো সম্ভব হলো না। নিভৃত গ্রাম এলাকা। লোকবসতি শহরের তুলনায় অনেক কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে যে আয়োজন, তাতেও মানুষ হলো প্রচুর। দেখতে দেখতে সভাস্থলে অন্তত হাজার পাঁচেক লোক জমায়েত হলো।’
তিনি লিখছেন, ‘পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ক্যাপ্টেন হাফিজ ও আমার ওপর অর্পিত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা যে সব পথ দিয়ে এই এলাকায় প্রবেশ করতে পারে, এমন জায়গাগুলোতে আমরা কড়া পাহারার ব্যবস্থা করি। তখন বেলা এগারোটা। আমগাছের ফাঁক দিয়ে এপ্রিলের সূর্যের নিশানা। আমবাগানের ভেতর কয়েক হাজার দর্শক। ক্ষণে ক্ষণে গগনবিদারী শ্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ উত্তেজনা বিরাজ করছে পুরো এলাকায়। কারণ উপস্থিত সবাই এমন এক দৃশ্য দেখতে যাচ্ছে, যা কারো পক্ষেই ইতিপূর্বে দেখা সম্ভব হয়নি। একটি জাতির জীবনে এ ধরনের অনুষ্ঠান অত্যন্ত বিরল ঘটনা। এই বিরল ঘটনা প্রত্যক্ষ করল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় উপস্থিত প্রায় ৫ হাজার মানুষ। বৈদ্যনাথতলা হয়ে গেল মুজিবনগর। (একাত্তর আমার, মোহাম্মদ নূরুল কাদের, পৃষ্ঠা ৪৭)।
মোহাম্মদ নূরুল কাদের তার স্মৃতিচারণে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রমের কথা বলেছেন। হাফিজু উদ্দিন আহমদ তাঁর ‘সৈনিকের জীবন, গৌরবের একাত্তর, রক্তাক্ত পঁচাত্তর নামের বইয়ে লিখেছেন, ’ ১০ এপ্রিল ভারতের সহায়তায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল সে সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথতলা। তিনদিক থেকে ভারতীয় ভূখণ্ড বেষ্টিত। এখানে বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে আমবাগান। সেখানে দুটি কাঠের চৌকি জোড়া দিয়ে মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। কোনো সাজসজ্জা বা জৌলুস নেই। হাজার হাজার জনতা সীমান্তের উভয় পার থেকে এসে আমবাগানে সমবেত হয়েছে। সবার চোখে মুখে ঔৎসুক্য।
‘আমরা বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে বৈদ্যনাথ তলায় পৌঁছলাম। নেতারা যথাসময়েই সেখানে এসে পৌঁছুলেন। রাষ্ট্রপতিকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার দায়িত্ব ইপিআর সেনাদলের। কিন্তু আমাদের পৌঁছুতে কিছুটা দেরি হওয়ায় এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আটজন আনসারের সমন্বয়ে একটি দল নিয়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ‘গার্ড অব অনার’ দেন।
এখানেই দেখা হলো প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানির সঙ্গে। তিনি ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে আর্মি সার্ভিস কোরে কমিশনপ্রাপ্ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাঁর চালচলন বা ম্যানারিজমে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য দৃশ্যমান। হালকা-পাতলা গড়ন, প্রখর ব্যক্তিতের অধিকারী। বিশাল গোঁফ তার মুখমণ্ডলের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সহজেই সমীহ আদায় করে। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে তিনি পদাতিক বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত হন এবং প্রথম ইস্টবেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার রূপে দায়িত্ব পালন করেন। আমাকে দেখে ভারি খুশি হলেন প্রধান সেনাপতি ওসমানি। পিঠ চাপড়ে দিয়ে অভিনন্দন জানালেন, ‘ওহ মাই বয়! জলি গুড শো।’
‘থ্যাংক য়্যু, স্যার।’ আমি বললাম।
‘আমি পরদিন বেনাপোল যাব সিনিয়র টাইগারদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য।’ ওসমানি বললেন।
‘মোস্ট ওয়েলকাম স্যার। আমরা অপেক্ষায় থাকব।’ আমি বললাম।
উপস্থিত চারজন সেনা কর্মকর্তা মেজর ওসমান, ক্যাপ্টেন এ টি সালাউদ্দিন, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে পরিচিত হলেন প্রধান সেনাপতি। ছোটমঞ্চের পাশে ছয়টি ফোল্ডিং চেয়ারে উপবিষ্ট হলাম ভারতের লে. কর্ণেল মেঘ সিংসহ আমরা ছয় অফিসার।
একটু পরই অনুষ্ঠান শুরু হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হলো। কিন্তু তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। ফলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি রুপে শপথ গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ মন্ত্রী রুপে শপথ নেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। কর্নেল ওসমানিকে মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক মুভি ক্যামেরা নিয়ে এই অনুষ্ঠান কাভার করেন। শপথগ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ইংরেজি ভাষায় চমৎকার একটি বক্তব্য দেন। বাঙালিদের বঞ্চনার ইতিহাস, ২৫ মার্চের গণহত্যা, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার কথা তিনি মর্মস্পর্শী ভাষায় উপস্থাপন করেন। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আবেদন জানান। হাজার হাজার শ্রোতা-দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার সে বক্তব্য শোনেন। আম্রকাননের অনুষ্ঠান, পরিবেশ, পরিস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। হাজারো মুক্তিকামী মানুষের পদভারে প্রকম্পিত। কয়েক কিলোমিটার দূরেই পলাশীর আম্রকানন। ১৭৫৭ সালে সেখানেই বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আজ আরেক আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য আবার উদিত হলো।
মুজিবনগর সরকারের কেবিনেট সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচটি ইমাম নামেই তিনি পরিচিত) মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে বলছেন, ‘আমাদের সরকার মূলত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, যেটি আমরা বলতাম, তার প্রধান দপ্তর বা হেড কোয়ার্টার ছিল মুজিবনগর।
আপনারা সবাই জানেন যে, মুজিবনগর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মেহেরপুর জেলায় আমবাগানে। পলাশীর বিখ্যাত আমবাগানের কাছেই সেই জায়গাটিতেই মুজিবনগর। মুজিব নগরেই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়। স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। আমাদের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার নামেই মুজিবনগর করা হয়। আর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, অন্য মন্ত্রীরা ছিলেন এম মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ। আরও অনেক বড় নেতা ছিলেন।
যুদ্ধকালীন যে পরিস্থিতি, তাতে দ্বিতীয় মহাযুদবধ বা পরবর্তীকালেও যে সমস্ত প্রবাসী সরকার দেখেন, তারা কিন্তু নিরাপত্তার কারণে, রাজনৈতিক কারণে ঠিক একটি জায়গায় কোনো সময়েই থাকেননি। মুজিবনগর হেডকোয়ার্টার ছিল বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে। আমাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও ছিল। কিন্তু আমাদের মূল দপ্তর ছিল কোলকাতায়, থিয়েটার রোডে। সেখানেই আমাদের যৌথ বাহিনী, মিত্র বাহিনীর হেড কোয়াটার ছিল। (বাংলাদেশ ১৯৭১, সম্পাদনা আফসান চৌধুরী, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১১)।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের স্মৃতিচারণ এক্ষেত্রে খুব ভালো একটি সংযোজন হতে পারে। দীর্ঘ সে স্মৃতিচারণের নির্দিষ্ট একটি অংশই এখানে দেওয়া হলো:
‘আমরা বঙ্গবন্ধুকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আত্মগোপনের জন্য চাপ দিই। তিনি আত্মগোপনের কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আত্মগোপনের জন্য তিনি পূর্ব থেকেই বঙ্গবন্ধুকে বলে আসছেন। তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। তিনি প্রশ্ন করেন, আমাকে নিয়ে তোরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আত্মগোপন সম্ভব নয়। আমার হয়তো মৃত্যু হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’
এরপর তিনি বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তাজউদ্দীন আহমদসহ তিনি সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছুলেন। তারপর বলছেন, ‘সীমান্ত থেকে কিছু দূরে একটি জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট খালের ওপর একটি ব্রিটিশ যুগের তৈরি কালভার্ট। কালভার্টের ওপর তাজউদ্দীন ভাই ও আমি বসে আছি। আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে তৌফিক ও মাহবুবকে ওপারে পাঠাই। কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। অফিসারটি জানান, আমাদের তিনি যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে ছাউনিতে নিয়ে যেতে এসেছেন।’
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই বিএসএফের আঞ্চলিকপ্রধান গোলক মজুমদার ছাউনিতে এসে পৌছলেন। তিনি জানান, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। তার সঙ্গে কলকাতা যাওয়ার জন্য আমাদের অনুরোধ করেন। তবে দিল্লির সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয়।
মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তিনি জানান, আমাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে এই ফ্লাইটে দিল্লি থেকে একজন কর্মকর্তা আসবেন। বিমান থেকে ছয় ফুটেরও বেশি লম্বা একজন লোক নেমে সোজা আমাদের গাড়িতে উঠলেন। মজুমদার তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি হলেন বিএসএফের প্রধান রুস্তমজি। রুস্তমজি একসময় ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নিরাপত্তাপ্রধান ছিলেন। নেহরু পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর খুবই আস্থাভাজন।’
‘এদিকে আমার কাপড়-চোপড়ের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। গাড়িতেই শুরু হয় আলোচনা। রুস্তমজির প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কোথায়? মজুমদারের প্রথম প্রশ্নও ছিল এটাই। এর পরে আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সকলেরই প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কেমন আছে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা তৈরি ছিলাম। দলীয় নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধাসহ সকলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের ব্যাপারে আমরা একই উত্তর দিয়েছি। আমরা যা বলতে চেয়েছি তা হলো বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমরা তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাচ্ছি। তিনি জানেন, আমরা কোথায় আছি। তিনি আমাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। সময় হলে বা প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি উপযুক্ত স্থানে আমাদের সাথে দেখা করবেন।’
‘একটি সুন্দর বাড়িতে (আসাম হাউস) আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। একটি ঘরে আমি আর তাজউদ্দীন ভাই, অন্য ঘরে রুস্তমজি। আমরা খুবই ক্লান্ত। স্নান করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সাথে অতিরিক্ত কোনো কাপড় নেই। রুস্তমজি আমার পরিধেয় বস্ত্রের অভাবের কথা জেনে তার ইস্ত্রি করা।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ
“৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন ভাই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তাদের কোনো সহযোগী ছিল না। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী প্রথম প্রশ্ন করেন। “হাউ ইজ শেখ মুজিব, ইজ হি অল রাইট?” (শেখ মুজিব কেমন আছেন?) মিসেস গান্ধীর প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন ভাই বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর স্থান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ২৫ মার্চের পর তাঁর সঙ্গে আমাদের আর যোগাযোগ হয়নি।’ সাক্ষাতে তাজউদ্দীন ভাই আরও বলেন, বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোনো মূল্যে এই স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে।”
“তাজউদ্দীন ভাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, পাকিস্তান আমাদের আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাতে পারে। যে কোনো মূল্যে পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। আমাদের অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহের। মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধে তাজউদ্দীন ভাই ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন। বাংলাদেশের নেতা জানান, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে জোটনিরপেক্ষ। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়। সকল গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহায়তা আমরা চাই।”
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ
‘পরদিন তাজউদ্দীন ভাই দ্বিতীয়বারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। ইন্দিরা গান্ধী জানান, বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবশ্য এই খবর পাকিস্তান সরকার তখনো সরকারিভাবে প্রকাশ করেনি।’
‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাজউদ্দীন ভাই বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। সিদ্ধান্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, তাঁদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর প্রচারের জন্য একটি বেতার স্টেশন স্থাপনের বিষয়েও আলোচনা হয়। ...দিল্লিতে বসেই তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা টেপ করা হয়। বক্তৃতার পূর্বে আমার কণ্ঠ থেকে ঘোষণা প্রচারিত হয়-এখন তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দেবেন। এর পর তাজউদ্দীন ভাই বক্তৃতা শুরু করেন।’
‘...মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা চিন্তা করি। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। পাক দস্যুরা সেখানে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গা রাজধানী করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত তা আর গোপন থাকেনি। চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে আমাদের নতুন স্থানের কথা চিন্তা করতে হলো। এই নিয়ে গোলক মজুমদারের সাথে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে সবাই একমত হন যে, যেখানেই আমরা অনুষ্ঠান করি না কেন, পাক বাহিনীর বিমান হামলার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলাকে মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।’
“স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের খসড়াটি কোনো একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে দেখাতে পারলে ভালো হতো। ইতোমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। এদের মধ্যে সুব্রত রায় চৌধুরীর নাম আমি শুনেছি। রায় চৌধুরীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। বিএসএফের মাধ্যমে রায় চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনি রাজি হলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার যে আইনানুগ অধিকার, তা মানবাধিকারের একটা অংশ। এই কথা স্বাধীনতার সনদে ফুটে উঠেছে। তিনি জানান, তিনি এর ওপর একটা বই লিখবেন। এই ঘোষণাপত্রের একটা কপি তাকে দেওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করলেন। এর পর আইন ব্যবসা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর বই লেখা শুরু করেন। তার রচিত বইটির নাম হচ্ছে ‘জেনেসিস অব বাংলাদেশ’।’
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন
“এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি তৈরি করা হচ্ছে। জানা গেল প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সামরিক পোশাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তার সামরিক পোশাক প্রয়োজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোশাক দিতে বললাম। তাদের স্টকে ওসমানীর গায়ের কোনো পোশাক পাওয়া গেল না। সেই রাতে কাপড় কিনে, দর্জি ডেকে তাঁর জন্য পোশাক তৈরি করা হলো। শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার ভার আমার ও আবদুল মান্নানের ওপর ছিল। ১৬ এপ্রিল আমরা দুজনে কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দুজন প্রতিনিধি বিদেশি সাংবাদিকদের সাথে মিলিত হই। সমস্ত প্রেসক্লাব লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই।”
‘সমবেত সাংবাদিকদের পরদিন ১৭ এপ্রিল কাকডাকা ভোরে প্রেসক্লাবে হাজির হতে অনুরোধ জানাই। বললাম, তখন তাদের আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বিশেষ বার্তা দেওয়া হবে। সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার জন্য আমাদের গাড়ি তৈরি থাকবে বলেও জানালাম। বিএসএফের চট্টোপাধ্যায়কে বলি আমাদের জন্য ১০০টি গাড়ির ব্যবস্থা করতে। এর ৫০টা থাকবে প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের বহন করার জন্য। অবশিষ্ট ৫০টার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পৌছানো হবে।’
‘রাত ১২টা থেকে নেতাদের গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। বলে দেওয়া হলো, কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না। সকালবেলা আমরা একত্র হব।
গাড়ির চালক নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবেন। সাইক্লোস্টাইল করা স্বাধীনতা সনদের কপিগুলো গুছিয়ে নিলাম।
১৭ এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের দিন। সারা রাত ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ওসমানী একটি গাড়িতে রওনা হয়ে যান। আমি ও আবদুল মান্নান ভোরের দিকে পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। ভোরেও ক্লাবে লোক ধরেনি। ক্লাবের বাইরেও অনেক লোক দাঁড়িয়ে ছিল।’
‘সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে বিনীতভাবে বললাম, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। তাদের জানালাম স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করবে। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। কেউ জানতে চাইলেন কিভাবে যাবেন, কোথায় যাবেন। আমি পুনরায় বলি, আমি আপনাদের সঙ্গে রয়েছি, পথ দেখিয়ে দেব। আমাদের গাড়িগুলো তখন প্রেসক্লাবের সামনে। উৎসাহিত সাংবাদিকরা গাড়িতে ওঠেন। তাদের অনেকের কাঁধে ক্যামেরা। ৫০-৬০টা গাড়িযোগে রওনা হলাম গন্তব্যস্থানের দিকে। আমি ও আবদুল মান্নান দুজন দুই গাড়িতে। আমার গাড়িতে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন। পথে তাদের সাথে অনেক কথা হলো। শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত স্থান আম্রকাননে পৌছতে বেলা ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রায় শেষ। মাহবুব ও তৌফিক ইলাহী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। আগেই ঠিক করা হয়েছিল যে, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ পাঠ করবেন।’
আমবাগানে মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ
‘কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। একটি ছোট্ট মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী। সংবাদ সম্মেলনে প্রধান প্রশ্ন ছিল সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। তাঁর সাথে আমাদের চিন্তার (বিস্তর) যোগাযোগ রয়েছে। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু শত্রুশিবিরে বন্দি। কিন্তু আমরা তা বলতে চাইনি। পাক বাহিনী বলুক এটাই আমরা চাচ্ছিলাম। কারণ আমরা যদি বলি বঙ্গবন্ধু পাক শিবিরে, আর তারা যদি অস্বীকার করে তা হলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আর আমরা যদি বলি তিনি দেশের ভেতরে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন হানাদাররা বলে বসবে তিনি বন্দি।’
‘আমবাগানের অনুষ্ঠানে ভরদুপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। হাজারো কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো ইত্যাদি স্লোগান। আমার কাজ ছিল দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করে সাংবাদিকদের ফেরত পাঠানো। দুপুরের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সাংবাদিকদের গাড়িযোগে ফেরত পাঠানো হলো। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ফেরেন সন্ধ্যায়।’
(মুজিবনগর, কাঠামো ও কার্যকারণ, সম্পাদনা আফসান চৌধুরী, পৃষ্ঠা ১১৪-১২৫)
এই বর্ণনার পর নিশ্চয় যে কোনো বিবেচক পাঠক বুঝতে পারবেন, ১৭ এপ্রিল কীভাবে আমাদের হয়েছিল।
জাহীদ রেজা নূর

১৭ এপ্রিল কী ঘটেছিল এই দেশে? ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল?
১৭ এপ্রিল তারিখটায় পৌঁছাতে হলে মেলে ধরতে হয় ইতিহাসের ডানা। এই দিনে বৈদ্যনাথতলা হয়ে ওঠে মুজিবনগর। কেন মুজিবনগর? মুজিব তো তখন নেই। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরেছে ইয়াহিয়া। বিচারের নাম করে শেখ মুজিবকে হত্যা করার তোড়জোড় চলছে তখন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের শপথ নেওয়ার জন্য যে জায়গাটি বেছে নেওয়া হলো, তার নাম তো আর কিছুই হতে পারে না। তাই বৈদ্যনাথতলা রাতারাতি বদলে গিয়ে নাম ধারণ করল মুজিবনগর। মুজিব তখন প্রতিটি মানুষের প্রাণের শক্তি, মুজিব তখন নিজেই একটি দেশের প্রতিচ্ছবি।
সেই ইতিহাস কি ভুলে যাবে মানুষ?
কবিরা যদিও বলে থাকেন, ‘লোকে ভুলে যেতে চায়, সহজেই ভোলে।’ কিন্তু সবাই কি ভোলে? সবকিছু কি ভোলা যায়? ভুলিয়ে দিতে চাইলেও মনের কোনো সূক্ষ্ণ কোণে সত্য কি জেগে থাকে না? নাকি সবই গরল ভেল?
সেই প্রচণ্ড পৈশাচিকতার পর প্রতিদিন চলছিল বাঙালি নিধন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১০ এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার। ১৭ এপ্রিল সেই সরকার কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত হয় এই সরকার।
২
ইয়াহিয়া ও তার সামরিক জান্তা বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিল তার হানাদার বাহিনীকে, ২৫ মার্চ রাতে। সেই একাত্তরের কথাই তো বলছি। মুখে বলছিল আলোচনা চলছে। কেন এ রকম মিথ্যে বলছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট? অপারেশন সার্চলাইটের ঝান্ডা-বরদাররা ছিল ইয়াহিয়ার পাশেই। তারা অবিরত ইয়াহিয়ার কানে কানে বলে চলেছিল, ইয়াহিয়া যেন শেখ মুজিবকে বুঝতে না দেন তার মনের মধ্যে কী আছে। বলে চলেছিল, আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, পরিষদ বসার সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখার ভান করাকে যেন প্রাধান্য দেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। সমস্যা-অন্তে আছে সমাধান—এ রকম কথাই তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজনীতির মঞ্চে।
কিন্তু তখন তো প্লেনভর্তি সৈন্য আসছে ঢাকায়।
কেন আসছে?
তখন তো পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা চলে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে।
কেন যাচ্ছে?
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানিদের আসতে দেওয়া হচ্ছে না বাংলায়।
কেন দেওয়া হচ্ছে না?
অন্ধকার যে ঘণীভূত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এ দেশের ভাগ্যে, সেটা কি আঁচ করা যাচ্ছিল তখন?
৩
১৭ এপ্রিলের মুজিবনগরে এসে দাঁড়াতে হলে আমাদের তো আগের কিছু কথা বলে নিতেই হবে। নইলে কীভাবে দিনটি এল, কীভাবে বাংলার মানুষ জানল, মানচিত্রে একটি নতুন দেশের জন্ম হয়েছে, বাংলাদেশ তার নাম?
এই দেশের রাষ্ট্রপতির নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি তখন পাকিস্তানের জেলে। তার পরও তাঁকেই কেন প্রেসিডেন্ট করা হলো নবগঠিত এই দেশের?
এ প্রশ্ন কি জেগে ওঠে না আজকের তরুণের মনে?
কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে টিটকারি মেরে বলে থাকে, তিনি তো পালিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে!
ডাহা মিথ্যা কথা! মেরুদণ্ড সোজা রেখে এই সব অপপ্রচারকারীকে সিকান্দর আবু জাফরের ভাষায় বলতে হয়, ‘তুমি বাংলা ছাড়ো!’ কেন বলতে হয়? বলতে হয় এ কারণে যে, বাংলার ইতিহাস না জানলে এই ‘পালিয়ে যাওয়া’ তত্ত্বই গিলে খেতে হবে।
যে মানুষটিকে গ্রেপ্তার করতে পারলে বিচারিক প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝোলানো যায়, সেই মানুষটি কি জানতেন না, ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী তাঁকে হত্যা করতে পারে? জানতেন না, স্বল্পকাল আগে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তাঁকে ফাঁসির দড়িতে লটকে দেওয়ার কত চেষ্টাই না করেছিল? প্রবল গণ-আন্দোলন, তথা গণ-অভ্যুত্থানই জেলের তালা ভেঙে শেখ মুজিবকে ফিরিয়ে এনেছিল মুক্ত পৃথিবীতে?
শেখ মুজিব নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
আর তাঁর নামেই এসেছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ।
৪
মুজিবনগর সরকার গঠনের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছিল না। তবে ভারত শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে গেছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকারকে যুদ্ধের শেষ সময়েই কেবল স্বীকৃতি দিয়েছে।
আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও যুদ্ধ পরিচালনা ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচারণা চালানোর ব্যাপারে ভারতের দিক থেকে মুজিবনগর সরকার কোনো বাধা পায়নি। আর এই স্বীকৃতি দেওয়া-না-দেওয়ার বিষয়টি ভারতকে কৌশলগত সুবিধা দিয়েছে। অর্থাৎ, একটি স্বীকৃত রাষ্ট্র না হওয়ায় ভারতের বিরুদ্ধে একটি নতুন রাষ্ট্রকে মদদ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনতে পারেনি পাকিস্তান।
একটু পেছন ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাব, পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা বাঙালিকে দলমত-নির্বিশেষে একাত্ম করেছে। পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান আসন্ন পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে যে বিক্ষোভ শুরু হয়, তার রেশ অপারেশন সার্চলাইট পর্যন্তই চলে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই অসাধারণ ভাষণের পর আর কারও কোনো সন্দেহ থাকেনি যে, আজ হোক, কাল হোক বাংলাদেশের জন্ম একটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাকিস্তানিরাই বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু করে সেই সময়টিকে তৈরি করে দিল।
সত্তরের নির্বাচনে ৬ দফার ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ছিল অবধারিত। কিন্তু ইয়াহিয়া-ভুট্টো এবং তাদের সামরিক জান্তার দল ভিন্ন কৌশল নিয়েছিল। কৌশল না বলে বাঙালি হত্যার ষড়যন্ত্র বললেই তা লক্ষভেদী হবে। ইয়াহিয়া বিক্ষোভের জবাব দিতে চেয়েছিলেন অস্ত্রের ভাষায়। কিন্তু ততদিনে এই আন্দোলন হয়ে উঠেছে স্বতঃস্ফূর্ত। মোটামুটি সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আন্দোলনে শরিক মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মেনে চলছিলেন। ২৫ মার্চ সামরিক বাহিনী যেভাবে সাধারণ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাতে সেই রক্ষক্ষয়ী নৃশংসতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় অবস্থিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যারা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের বিপরীত পক্ষ ছিল, তারাও এক হয়ে বাংলাদেশীদের এককাট্টা করে দেয়। ফলে পাকিস্তানিরা এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে প্রাথমিকভাবে নিজেদের জয়ী মনে করলেও মূলত তাদের এই জয় ছিল সাময়িক আর এই সময়ের ইতিহাসের ভ্রূণে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ সরকার।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। তাতে লেখা ছিল, ‘শাসনতন্ত্র রচনার অভিপ্রায়ে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া শাসনতন্ত্র রচনা করার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান না করে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখে এবং আলাপ -আলোচনা চলাকালে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’
নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আরও ঘোষণা করেন, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এ সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানের অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন এবং অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। যেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণা বা প্রক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্টস ১০ এপ্রিল হয়েছে, তাই আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণের তারিখ ১৭ এপ্রিল নির্ধারিত হয়।
১১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণে বলেন, ‘২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয় দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন, তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার জন্য আমরা যেমন জীবন দিতে পারি, তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশি শত্রু সেনাদের চিরতরে হটিয়ে দিতে সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কাছে শত্রু যত যত প্রবল পরাক্রম হোক না কেন, পরাজয় বরন করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম, তাহলে নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়তো কিছুদিনের জন্য হরেও পিছিয়ে যেত।’
তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত।’
বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়েছিল ১৩ এপ্রিল। শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রীসভার অন্য সদস্যরা হলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান।
১৪ এপ্রিল জনসাধারণের প্রতি বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু নির্দেশাবলি জারি করেন। এবং এদিন অস্থায়ী সরকারের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কর্নেল ওসমানিকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়াও আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে মেজর খালেদ মোশাররফকে সিলেট কুমিল্লা অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর জিয়াউর রহমানকে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম নোয়াখালী অঞ্চলের দায়িত্ব। ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল অঞ্চলের দায়িত্ব পান মেজর শফিউল্লাহ। আর মেজর এম এ ওসমান পান দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলের দায়িত্ব।
৫
এবার ১৭ এপ্রিলের ঘটনা শোনা যাক কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে।
প্রথমেই পাবনার সাবেক ডিসি ও পরবর্তীকালে মুজিবনগর সরকারের অন্যতম সচিব মোহাম্মদ নূরুল কাদেরের কথা আলোচনায় আনতে পারি।
কেমন ছিল সেদিন বৈদ্যনাথতলা বা মুজিবনগর?
মোহাম্মদ নূরুল কাদেরের ভাষায়, ‘নির্ধারিত স্থানে মঞ্চ তৈরি হলো, আশপাশের বাড়ি থেকে চৌকি এবং বাঁশ আনা হলো। উন্মুক্ত মঞ্চ এটি। উপরে শামিয়ানা কিংবা ব্যনার কোনোটাই লাগানো সম্ভব হলো না। নিভৃত গ্রাম এলাকা। লোকবসতি শহরের তুলনায় অনেক কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে যে আয়োজন, তাতেও মানুষ হলো প্রচুর। দেখতে দেখতে সভাস্থলে অন্তত হাজার পাঁচেক লোক জমায়েত হলো।’
তিনি লিখছেন, ‘পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ক্যাপ্টেন হাফিজ ও আমার ওপর অর্পিত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা যে সব পথ দিয়ে এই এলাকায় প্রবেশ করতে পারে, এমন জায়গাগুলোতে আমরা কড়া পাহারার ব্যবস্থা করি। তখন বেলা এগারোটা। আমগাছের ফাঁক দিয়ে এপ্রিলের সূর্যের নিশানা। আমবাগানের ভেতর কয়েক হাজার দর্শক। ক্ষণে ক্ষণে গগনবিদারী শ্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ উত্তেজনা বিরাজ করছে পুরো এলাকায়। কারণ উপস্থিত সবাই এমন এক দৃশ্য দেখতে যাচ্ছে, যা কারো পক্ষেই ইতিপূর্বে দেখা সম্ভব হয়নি। একটি জাতির জীবনে এ ধরনের অনুষ্ঠান অত্যন্ত বিরল ঘটনা। এই বিরল ঘটনা প্রত্যক্ষ করল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় উপস্থিত প্রায় ৫ হাজার মানুষ। বৈদ্যনাথতলা হয়ে গেল মুজিবনগর। (একাত্তর আমার, মোহাম্মদ নূরুল কাদের, পৃষ্ঠা ৪৭)।
মোহাম্মদ নূরুল কাদের তার স্মৃতিচারণে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রমের কথা বলেছেন। হাফিজু উদ্দিন আহমদ তাঁর ‘সৈনিকের জীবন, গৌরবের একাত্তর, রক্তাক্ত পঁচাত্তর নামের বইয়ে লিখেছেন, ’ ১০ এপ্রিল ভারতের সহায়তায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল সে সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথতলা। তিনদিক থেকে ভারতীয় ভূখণ্ড বেষ্টিত। এখানে বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে আমবাগান। সেখানে দুটি কাঠের চৌকি জোড়া দিয়ে মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। কোনো সাজসজ্জা বা জৌলুস নেই। হাজার হাজার জনতা সীমান্তের উভয় পার থেকে এসে আমবাগানে সমবেত হয়েছে। সবার চোখে মুখে ঔৎসুক্য।
‘আমরা বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে বৈদ্যনাথ তলায় পৌঁছলাম। নেতারা যথাসময়েই সেখানে এসে পৌঁছুলেন। রাষ্ট্রপতিকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার দায়িত্ব ইপিআর সেনাদলের। কিন্তু আমাদের পৌঁছুতে কিছুটা দেরি হওয়ায় এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আটজন আনসারের সমন্বয়ে একটি দল নিয়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ‘গার্ড অব অনার’ দেন।
এখানেই দেখা হলো প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানির সঙ্গে। তিনি ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে আর্মি সার্ভিস কোরে কমিশনপ্রাপ্ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাঁর চালচলন বা ম্যানারিজমে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য দৃশ্যমান। হালকা-পাতলা গড়ন, প্রখর ব্যক্তিতের অধিকারী। বিশাল গোঁফ তার মুখমণ্ডলের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সহজেই সমীহ আদায় করে। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে তিনি পদাতিক বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত হন এবং প্রথম ইস্টবেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার রূপে দায়িত্ব পালন করেন। আমাকে দেখে ভারি খুশি হলেন প্রধান সেনাপতি ওসমানি। পিঠ চাপড়ে দিয়ে অভিনন্দন জানালেন, ‘ওহ মাই বয়! জলি গুড শো।’
‘থ্যাংক য়্যু, স্যার।’ আমি বললাম।
‘আমি পরদিন বেনাপোল যাব সিনিয়র টাইগারদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য।’ ওসমানি বললেন।
‘মোস্ট ওয়েলকাম স্যার। আমরা অপেক্ষায় থাকব।’ আমি বললাম।
উপস্থিত চারজন সেনা কর্মকর্তা মেজর ওসমান, ক্যাপ্টেন এ টি সালাউদ্দিন, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে পরিচিত হলেন প্রধান সেনাপতি। ছোটমঞ্চের পাশে ছয়টি ফোল্ডিং চেয়ারে উপবিষ্ট হলাম ভারতের লে. কর্ণেল মেঘ সিংসহ আমরা ছয় অফিসার।
একটু পরই অনুষ্ঠান শুরু হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হলো। কিন্তু তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। ফলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি রুপে শপথ গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ মন্ত্রী রুপে শপথ নেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। কর্নেল ওসমানিকে মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক মুভি ক্যামেরা নিয়ে এই অনুষ্ঠান কাভার করেন। শপথগ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ইংরেজি ভাষায় চমৎকার একটি বক্তব্য দেন। বাঙালিদের বঞ্চনার ইতিহাস, ২৫ মার্চের গণহত্যা, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার কথা তিনি মর্মস্পর্শী ভাষায় উপস্থাপন করেন। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আবেদন জানান। হাজার হাজার শ্রোতা-দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার সে বক্তব্য শোনেন। আম্রকাননের অনুষ্ঠান, পরিবেশ, পরিস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। হাজারো মুক্তিকামী মানুষের পদভারে প্রকম্পিত। কয়েক কিলোমিটার দূরেই পলাশীর আম্রকানন। ১৭৫৭ সালে সেখানেই বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আজ আরেক আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য আবার উদিত হলো।
মুজিবনগর সরকারের কেবিনেট সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচটি ইমাম নামেই তিনি পরিচিত) মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে বলছেন, ‘আমাদের সরকার মূলত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, যেটি আমরা বলতাম, তার প্রধান দপ্তর বা হেড কোয়ার্টার ছিল মুজিবনগর।
আপনারা সবাই জানেন যে, মুজিবনগর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মেহেরপুর জেলায় আমবাগানে। পলাশীর বিখ্যাত আমবাগানের কাছেই সেই জায়গাটিতেই মুজিবনগর। মুজিব নগরেই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়। স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। আমাদের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার নামেই মুজিবনগর করা হয়। আর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, অন্য মন্ত্রীরা ছিলেন এম মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ। আরও অনেক বড় নেতা ছিলেন।
যুদ্ধকালীন যে পরিস্থিতি, তাতে দ্বিতীয় মহাযুদবধ বা পরবর্তীকালেও যে সমস্ত প্রবাসী সরকার দেখেন, তারা কিন্তু নিরাপত্তার কারণে, রাজনৈতিক কারণে ঠিক একটি জায়গায় কোনো সময়েই থাকেননি। মুজিবনগর হেডকোয়ার্টার ছিল বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে। আমাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও ছিল। কিন্তু আমাদের মূল দপ্তর ছিল কোলকাতায়, থিয়েটার রোডে। সেখানেই আমাদের যৌথ বাহিনী, মিত্র বাহিনীর হেড কোয়াটার ছিল। (বাংলাদেশ ১৯৭১, সম্পাদনা আফসান চৌধুরী, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১১)।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের স্মৃতিচারণ এক্ষেত্রে খুব ভালো একটি সংযোজন হতে পারে। দীর্ঘ সে স্মৃতিচারণের নির্দিষ্ট একটি অংশই এখানে দেওয়া হলো:
‘আমরা বঙ্গবন্ধুকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আত্মগোপনের জন্য চাপ দিই। তিনি আত্মগোপনের কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আত্মগোপনের জন্য তিনি পূর্ব থেকেই বঙ্গবন্ধুকে বলে আসছেন। তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। তিনি প্রশ্ন করেন, আমাকে নিয়ে তোরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আত্মগোপন সম্ভব নয়। আমার হয়তো মৃত্যু হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’
এরপর তিনি বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তাজউদ্দীন আহমদসহ তিনি সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছুলেন। তারপর বলছেন, ‘সীমান্ত থেকে কিছু দূরে একটি জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট খালের ওপর একটি ব্রিটিশ যুগের তৈরি কালভার্ট। কালভার্টের ওপর তাজউদ্দীন ভাই ও আমি বসে আছি। আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে তৌফিক ও মাহবুবকে ওপারে পাঠাই। কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। অফিসারটি জানান, আমাদের তিনি যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে ছাউনিতে নিয়ে যেতে এসেছেন।’
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই বিএসএফের আঞ্চলিকপ্রধান গোলক মজুমদার ছাউনিতে এসে পৌছলেন। তিনি জানান, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। তার সঙ্গে কলকাতা যাওয়ার জন্য আমাদের অনুরোধ করেন। তবে দিল্লির সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয়।
মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তিনি জানান, আমাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে এই ফ্লাইটে দিল্লি থেকে একজন কর্মকর্তা আসবেন। বিমান থেকে ছয় ফুটেরও বেশি লম্বা একজন লোক নেমে সোজা আমাদের গাড়িতে উঠলেন। মজুমদার তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি হলেন বিএসএফের প্রধান রুস্তমজি। রুস্তমজি একসময় ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নিরাপত্তাপ্রধান ছিলেন। নেহরু পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর খুবই আস্থাভাজন।’
‘এদিকে আমার কাপড়-চোপড়ের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। গাড়িতেই শুরু হয় আলোচনা। রুস্তমজির প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কোথায়? মজুমদারের প্রথম প্রশ্নও ছিল এটাই। এর পরে আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সকলেরই প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কেমন আছে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা তৈরি ছিলাম। দলীয় নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধাসহ সকলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের ব্যাপারে আমরা একই উত্তর দিয়েছি। আমরা যা বলতে চেয়েছি তা হলো বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমরা তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাচ্ছি। তিনি জানেন, আমরা কোথায় আছি। তিনি আমাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। সময় হলে বা প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি উপযুক্ত স্থানে আমাদের সাথে দেখা করবেন।’
‘একটি সুন্দর বাড়িতে (আসাম হাউস) আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। একটি ঘরে আমি আর তাজউদ্দীন ভাই, অন্য ঘরে রুস্তমজি। আমরা খুবই ক্লান্ত। স্নান করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সাথে অতিরিক্ত কোনো কাপড় নেই। রুস্তমজি আমার পরিধেয় বস্ত্রের অভাবের কথা জেনে তার ইস্ত্রি করা।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ
“৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন ভাই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তাদের কোনো সহযোগী ছিল না। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী প্রথম প্রশ্ন করেন। “হাউ ইজ শেখ মুজিব, ইজ হি অল রাইট?” (শেখ মুজিব কেমন আছেন?) মিসেস গান্ধীর প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন ভাই বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর স্থান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ২৫ মার্চের পর তাঁর সঙ্গে আমাদের আর যোগাযোগ হয়নি।’ সাক্ষাতে তাজউদ্দীন ভাই আরও বলেন, বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোনো মূল্যে এই স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে।”
“তাজউদ্দীন ভাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, পাকিস্তান আমাদের আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাতে পারে। যে কোনো মূল্যে পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। আমাদের অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহের। মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধে তাজউদ্দীন ভাই ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন। বাংলাদেশের নেতা জানান, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে জোটনিরপেক্ষ। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়। সকল গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহায়তা আমরা চাই।”
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ
‘পরদিন তাজউদ্দীন ভাই দ্বিতীয়বারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। ইন্দিরা গান্ধী জানান, বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবশ্য এই খবর পাকিস্তান সরকার তখনো সরকারিভাবে প্রকাশ করেনি।’
‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাজউদ্দীন ভাই বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। সিদ্ধান্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, তাঁদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর প্রচারের জন্য একটি বেতার স্টেশন স্থাপনের বিষয়েও আলোচনা হয়। ...দিল্লিতে বসেই তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা টেপ করা হয়। বক্তৃতার পূর্বে আমার কণ্ঠ থেকে ঘোষণা প্রচারিত হয়-এখন তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দেবেন। এর পর তাজউদ্দীন ভাই বক্তৃতা শুরু করেন।’
‘...মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা চিন্তা করি। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। পাক দস্যুরা সেখানে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গা রাজধানী করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত তা আর গোপন থাকেনি। চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে আমাদের নতুন স্থানের কথা চিন্তা করতে হলো। এই নিয়ে গোলক মজুমদারের সাথে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে সবাই একমত হন যে, যেখানেই আমরা অনুষ্ঠান করি না কেন, পাক বাহিনীর বিমান হামলার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলাকে মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।’
“স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের খসড়াটি কোনো একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে দেখাতে পারলে ভালো হতো। ইতোমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। এদের মধ্যে সুব্রত রায় চৌধুরীর নাম আমি শুনেছি। রায় চৌধুরীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। বিএসএফের মাধ্যমে রায় চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনি রাজি হলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার যে আইনানুগ অধিকার, তা মানবাধিকারের একটা অংশ। এই কথা স্বাধীনতার সনদে ফুটে উঠেছে। তিনি জানান, তিনি এর ওপর একটা বই লিখবেন। এই ঘোষণাপত্রের একটা কপি তাকে দেওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করলেন। এর পর আইন ব্যবসা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর বই লেখা শুরু করেন। তার রচিত বইটির নাম হচ্ছে ‘জেনেসিস অব বাংলাদেশ’।’
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন
“এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি তৈরি করা হচ্ছে। জানা গেল প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সামরিক পোশাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তার সামরিক পোশাক প্রয়োজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোশাক দিতে বললাম। তাদের স্টকে ওসমানীর গায়ের কোনো পোশাক পাওয়া গেল না। সেই রাতে কাপড় কিনে, দর্জি ডেকে তাঁর জন্য পোশাক তৈরি করা হলো। শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার ভার আমার ও আবদুল মান্নানের ওপর ছিল। ১৬ এপ্রিল আমরা দুজনে কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দুজন প্রতিনিধি বিদেশি সাংবাদিকদের সাথে মিলিত হই। সমস্ত প্রেসক্লাব লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই।”
‘সমবেত সাংবাদিকদের পরদিন ১৭ এপ্রিল কাকডাকা ভোরে প্রেসক্লাবে হাজির হতে অনুরোধ জানাই। বললাম, তখন তাদের আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বিশেষ বার্তা দেওয়া হবে। সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার জন্য আমাদের গাড়ি তৈরি থাকবে বলেও জানালাম। বিএসএফের চট্টোপাধ্যায়কে বলি আমাদের জন্য ১০০টি গাড়ির ব্যবস্থা করতে। এর ৫০টা থাকবে প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের বহন করার জন্য। অবশিষ্ট ৫০টার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পৌছানো হবে।’
‘রাত ১২টা থেকে নেতাদের গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। বলে দেওয়া হলো, কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না। সকালবেলা আমরা একত্র হব।
গাড়ির চালক নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবেন। সাইক্লোস্টাইল করা স্বাধীনতা সনদের কপিগুলো গুছিয়ে নিলাম।
১৭ এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের দিন। সারা রাত ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ওসমানী একটি গাড়িতে রওনা হয়ে যান। আমি ও আবদুল মান্নান ভোরের দিকে পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। ভোরেও ক্লাবে লোক ধরেনি। ক্লাবের বাইরেও অনেক লোক দাঁড়িয়ে ছিল।’
‘সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে বিনীতভাবে বললাম, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। তাদের জানালাম স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করবে। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। কেউ জানতে চাইলেন কিভাবে যাবেন, কোথায় যাবেন। আমি পুনরায় বলি, আমি আপনাদের সঙ্গে রয়েছি, পথ দেখিয়ে দেব। আমাদের গাড়িগুলো তখন প্রেসক্লাবের সামনে। উৎসাহিত সাংবাদিকরা গাড়িতে ওঠেন। তাদের অনেকের কাঁধে ক্যামেরা। ৫০-৬০টা গাড়িযোগে রওনা হলাম গন্তব্যস্থানের দিকে। আমি ও আবদুল মান্নান দুজন দুই গাড়িতে। আমার গাড়িতে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন। পথে তাদের সাথে অনেক কথা হলো। শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত স্থান আম্রকাননে পৌছতে বেলা ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রায় শেষ। মাহবুব ও তৌফিক ইলাহী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। আগেই ঠিক করা হয়েছিল যে, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ পাঠ করবেন।’
আমবাগানে মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ
‘কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। একটি ছোট্ট মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী। সংবাদ সম্মেলনে প্রধান প্রশ্ন ছিল সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। তাঁর সাথে আমাদের চিন্তার (বিস্তর) যোগাযোগ রয়েছে। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু শত্রুশিবিরে বন্দি। কিন্তু আমরা তা বলতে চাইনি। পাক বাহিনী বলুক এটাই আমরা চাচ্ছিলাম। কারণ আমরা যদি বলি বঙ্গবন্ধু পাক শিবিরে, আর তারা যদি অস্বীকার করে তা হলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আর আমরা যদি বলি তিনি দেশের ভেতরে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন হানাদাররা বলে বসবে তিনি বন্দি।’
‘আমবাগানের অনুষ্ঠানে ভরদুপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। হাজারো কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো ইত্যাদি স্লোগান। আমার কাজ ছিল দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করে সাংবাদিকদের ফেরত পাঠানো। দুপুরের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সাংবাদিকদের গাড়িযোগে ফেরত পাঠানো হলো। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ফেরেন সন্ধ্যায়।’
(মুজিবনগর, কাঠামো ও কার্যকারণ, সম্পাদনা আফসান চৌধুরী, পৃষ্ঠা ১১৪-১২৫)
এই বর্ণনার পর নিশ্চয় যে কোনো বিবেচক পাঠক বুঝতে পারবেন, ১৭ এপ্রিল কীভাবে আমাদের হয়েছিল।

১৭ এপ্রিল কী ঘটেছিল এই দেশে? ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল?
১৭ এপ্রিল তারিখটায় পৌঁছাতে হলে মেলে ধরতে হয় ইতিহাসের ডানা। এই দিনে বৈদ্যনাথতলা হয়ে ওঠে মুজিবনগর। কেন মুজিবনগর? মুজিব তো তখন নেই। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরেছে ইয়াহিয়া। বিচারের নাম করে শেখ মুজিবকে হত্যা করার তোড়জোড় চলছে তখন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের শপথ নেওয়ার জন্য যে জায়গাটি বেছে নেওয়া হলো, তার নাম তো আর কিছুই হতে পারে না। তাই বৈদ্যনাথতলা রাতারাতি বদলে গিয়ে নাম ধারণ করল মুজিবনগর। মুজিব তখন প্রতিটি মানুষের প্রাণের শক্তি, মুজিব তখন নিজেই একটি দেশের প্রতিচ্ছবি।
সেই ইতিহাস কি ভুলে যাবে মানুষ?
কবিরা যদিও বলে থাকেন, ‘লোকে ভুলে যেতে চায়, সহজেই ভোলে।’ কিন্তু সবাই কি ভোলে? সবকিছু কি ভোলা যায়? ভুলিয়ে দিতে চাইলেও মনের কোনো সূক্ষ্ণ কোণে সত্য কি জেগে থাকে না? নাকি সবই গরল ভেল?
সেই প্রচণ্ড পৈশাচিকতার পর প্রতিদিন চলছিল বাঙালি নিধন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১০ এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার। ১৭ এপ্রিল সেই সরকার কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত হয় এই সরকার।
২
ইয়াহিয়া ও তার সামরিক জান্তা বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিল তার হানাদার বাহিনীকে, ২৫ মার্চ রাতে। সেই একাত্তরের কথাই তো বলছি। মুখে বলছিল আলোচনা চলছে। কেন এ রকম মিথ্যে বলছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট? অপারেশন সার্চলাইটের ঝান্ডা-বরদাররা ছিল ইয়াহিয়ার পাশেই। তারা অবিরত ইয়াহিয়ার কানে কানে বলে চলেছিল, ইয়াহিয়া যেন শেখ মুজিবকে বুঝতে না দেন তার মনের মধ্যে কী আছে। বলে চলেছিল, আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, পরিষদ বসার সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখার ভান করাকে যেন প্রাধান্য দেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। সমস্যা-অন্তে আছে সমাধান—এ রকম কথাই তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজনীতির মঞ্চে।
কিন্তু তখন তো প্লেনভর্তি সৈন্য আসছে ঢাকায়।
কেন আসছে?
তখন তো পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা চলে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে।
কেন যাচ্ছে?
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানিদের আসতে দেওয়া হচ্ছে না বাংলায়।
কেন দেওয়া হচ্ছে না?
অন্ধকার যে ঘণীভূত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এ দেশের ভাগ্যে, সেটা কি আঁচ করা যাচ্ছিল তখন?
৩
১৭ এপ্রিলের মুজিবনগরে এসে দাঁড়াতে হলে আমাদের তো আগের কিছু কথা বলে নিতেই হবে। নইলে কীভাবে দিনটি এল, কীভাবে বাংলার মানুষ জানল, মানচিত্রে একটি নতুন দেশের জন্ম হয়েছে, বাংলাদেশ তার নাম?
এই দেশের রাষ্ট্রপতির নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি তখন পাকিস্তানের জেলে। তার পরও তাঁকেই কেন প্রেসিডেন্ট করা হলো নবগঠিত এই দেশের?
এ প্রশ্ন কি জেগে ওঠে না আজকের তরুণের মনে?
কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে টিটকারি মেরে বলে থাকে, তিনি তো পালিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে!
ডাহা মিথ্যা কথা! মেরুদণ্ড সোজা রেখে এই সব অপপ্রচারকারীকে সিকান্দর আবু জাফরের ভাষায় বলতে হয়, ‘তুমি বাংলা ছাড়ো!’ কেন বলতে হয়? বলতে হয় এ কারণে যে, বাংলার ইতিহাস না জানলে এই ‘পালিয়ে যাওয়া’ তত্ত্বই গিলে খেতে হবে।
যে মানুষটিকে গ্রেপ্তার করতে পারলে বিচারিক প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝোলানো যায়, সেই মানুষটি কি জানতেন না, ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী তাঁকে হত্যা করতে পারে? জানতেন না, স্বল্পকাল আগে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তাঁকে ফাঁসির দড়িতে লটকে দেওয়ার কত চেষ্টাই না করেছিল? প্রবল গণ-আন্দোলন, তথা গণ-অভ্যুত্থানই জেলের তালা ভেঙে শেখ মুজিবকে ফিরিয়ে এনেছিল মুক্ত পৃথিবীতে?
শেখ মুজিব নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
আর তাঁর নামেই এসেছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ।
৪
মুজিবনগর সরকার গঠনের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছিল না। তবে ভারত শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে গেছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকারকে যুদ্ধের শেষ সময়েই কেবল স্বীকৃতি দিয়েছে।
আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও যুদ্ধ পরিচালনা ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচারণা চালানোর ব্যাপারে ভারতের দিক থেকে মুজিবনগর সরকার কোনো বাধা পায়নি। আর এই স্বীকৃতি দেওয়া-না-দেওয়ার বিষয়টি ভারতকে কৌশলগত সুবিধা দিয়েছে। অর্থাৎ, একটি স্বীকৃত রাষ্ট্র না হওয়ায় ভারতের বিরুদ্ধে একটি নতুন রাষ্ট্রকে মদদ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনতে পারেনি পাকিস্তান।
একটু পেছন ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাব, পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা বাঙালিকে দলমত-নির্বিশেষে একাত্ম করেছে। পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান আসন্ন পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে যে বিক্ষোভ শুরু হয়, তার রেশ অপারেশন সার্চলাইট পর্যন্তই চলে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই অসাধারণ ভাষণের পর আর কারও কোনো সন্দেহ থাকেনি যে, আজ হোক, কাল হোক বাংলাদেশের জন্ম একটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাকিস্তানিরাই বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু করে সেই সময়টিকে তৈরি করে দিল।
সত্তরের নির্বাচনে ৬ দফার ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ছিল অবধারিত। কিন্তু ইয়াহিয়া-ভুট্টো এবং তাদের সামরিক জান্তার দল ভিন্ন কৌশল নিয়েছিল। কৌশল না বলে বাঙালি হত্যার ষড়যন্ত্র বললেই তা লক্ষভেদী হবে। ইয়াহিয়া বিক্ষোভের জবাব দিতে চেয়েছিলেন অস্ত্রের ভাষায়। কিন্তু ততদিনে এই আন্দোলন হয়ে উঠেছে স্বতঃস্ফূর্ত। মোটামুটি সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আন্দোলনে শরিক মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মেনে চলছিলেন। ২৫ মার্চ সামরিক বাহিনী যেভাবে সাধারণ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাতে সেই রক্ষক্ষয়ী নৃশংসতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় অবস্থিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যারা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের বিপরীত পক্ষ ছিল, তারাও এক হয়ে বাংলাদেশীদের এককাট্টা করে দেয়। ফলে পাকিস্তানিরা এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে প্রাথমিকভাবে নিজেদের জয়ী মনে করলেও মূলত তাদের এই জয় ছিল সাময়িক আর এই সময়ের ইতিহাসের ভ্রূণে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ সরকার।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। তাতে লেখা ছিল, ‘শাসনতন্ত্র রচনার অভিপ্রায়ে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া শাসনতন্ত্র রচনা করার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান না করে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখে এবং আলাপ -আলোচনা চলাকালে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’
নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আরও ঘোষণা করেন, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এ সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানের অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন এবং অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। যেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণা বা প্রক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্টস ১০ এপ্রিল হয়েছে, তাই আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণের তারিখ ১৭ এপ্রিল নির্ধারিত হয়।
১১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণে বলেন, ‘২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয় দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন, তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার জন্য আমরা যেমন জীবন দিতে পারি, তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশি শত্রু সেনাদের চিরতরে হটিয়ে দিতে সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কাছে শত্রু যত যত প্রবল পরাক্রম হোক না কেন, পরাজয় বরন করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম, তাহলে নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়তো কিছুদিনের জন্য হরেও পিছিয়ে যেত।’
তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত।’
বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়েছিল ১৩ এপ্রিল। শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রীসভার অন্য সদস্যরা হলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান।
১৪ এপ্রিল জনসাধারণের প্রতি বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু নির্দেশাবলি জারি করেন। এবং এদিন অস্থায়ী সরকারের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কর্নেল ওসমানিকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়াও আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে মেজর খালেদ মোশাররফকে সিলেট কুমিল্লা অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর জিয়াউর রহমানকে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম নোয়াখালী অঞ্চলের দায়িত্ব। ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল অঞ্চলের দায়িত্ব পান মেজর শফিউল্লাহ। আর মেজর এম এ ওসমান পান দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলের দায়িত্ব।
৫
এবার ১৭ এপ্রিলের ঘটনা শোনা যাক কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে।
প্রথমেই পাবনার সাবেক ডিসি ও পরবর্তীকালে মুজিবনগর সরকারের অন্যতম সচিব মোহাম্মদ নূরুল কাদেরের কথা আলোচনায় আনতে পারি।
কেমন ছিল সেদিন বৈদ্যনাথতলা বা মুজিবনগর?
মোহাম্মদ নূরুল কাদেরের ভাষায়, ‘নির্ধারিত স্থানে মঞ্চ তৈরি হলো, আশপাশের বাড়ি থেকে চৌকি এবং বাঁশ আনা হলো। উন্মুক্ত মঞ্চ এটি। উপরে শামিয়ানা কিংবা ব্যনার কোনোটাই লাগানো সম্ভব হলো না। নিভৃত গ্রাম এলাকা। লোকবসতি শহরের তুলনায় অনেক কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে যে আয়োজন, তাতেও মানুষ হলো প্রচুর। দেখতে দেখতে সভাস্থলে অন্তত হাজার পাঁচেক লোক জমায়েত হলো।’
তিনি লিখছেন, ‘পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ক্যাপ্টেন হাফিজ ও আমার ওপর অর্পিত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা যে সব পথ দিয়ে এই এলাকায় প্রবেশ করতে পারে, এমন জায়গাগুলোতে আমরা কড়া পাহারার ব্যবস্থা করি। তখন বেলা এগারোটা। আমগাছের ফাঁক দিয়ে এপ্রিলের সূর্যের নিশানা। আমবাগানের ভেতর কয়েক হাজার দর্শক। ক্ষণে ক্ষণে গগনবিদারী শ্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ উত্তেজনা বিরাজ করছে পুরো এলাকায়। কারণ উপস্থিত সবাই এমন এক দৃশ্য দেখতে যাচ্ছে, যা কারো পক্ষেই ইতিপূর্বে দেখা সম্ভব হয়নি। একটি জাতির জীবনে এ ধরনের অনুষ্ঠান অত্যন্ত বিরল ঘটনা। এই বিরল ঘটনা প্রত্যক্ষ করল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় উপস্থিত প্রায় ৫ হাজার মানুষ। বৈদ্যনাথতলা হয়ে গেল মুজিবনগর। (একাত্তর আমার, মোহাম্মদ নূরুল কাদের, পৃষ্ঠা ৪৭)।
মোহাম্মদ নূরুল কাদের তার স্মৃতিচারণে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রমের কথা বলেছেন। হাফিজু উদ্দিন আহমদ তাঁর ‘সৈনিকের জীবন, গৌরবের একাত্তর, রক্তাক্ত পঁচাত্তর নামের বইয়ে লিখেছেন, ’ ১০ এপ্রিল ভারতের সহায়তায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল সে সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথতলা। তিনদিক থেকে ভারতীয় ভূখণ্ড বেষ্টিত। এখানে বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে আমবাগান। সেখানে দুটি কাঠের চৌকি জোড়া দিয়ে মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। কোনো সাজসজ্জা বা জৌলুস নেই। হাজার হাজার জনতা সীমান্তের উভয় পার থেকে এসে আমবাগানে সমবেত হয়েছে। সবার চোখে মুখে ঔৎসুক্য।
‘আমরা বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে বৈদ্যনাথ তলায় পৌঁছলাম। নেতারা যথাসময়েই সেখানে এসে পৌঁছুলেন। রাষ্ট্রপতিকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার দায়িত্ব ইপিআর সেনাদলের। কিন্তু আমাদের পৌঁছুতে কিছুটা দেরি হওয়ায় এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আটজন আনসারের সমন্বয়ে একটি দল নিয়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ‘গার্ড অব অনার’ দেন।
এখানেই দেখা হলো প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানির সঙ্গে। তিনি ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে আর্মি সার্ভিস কোরে কমিশনপ্রাপ্ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাঁর চালচলন বা ম্যানারিজমে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য দৃশ্যমান। হালকা-পাতলা গড়ন, প্রখর ব্যক্তিতের অধিকারী। বিশাল গোঁফ তার মুখমণ্ডলের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সহজেই সমীহ আদায় করে। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে তিনি পদাতিক বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত হন এবং প্রথম ইস্টবেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার রূপে দায়িত্ব পালন করেন। আমাকে দেখে ভারি খুশি হলেন প্রধান সেনাপতি ওসমানি। পিঠ চাপড়ে দিয়ে অভিনন্দন জানালেন, ‘ওহ মাই বয়! জলি গুড শো।’
‘থ্যাংক য়্যু, স্যার।’ আমি বললাম।
‘আমি পরদিন বেনাপোল যাব সিনিয়র টাইগারদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য।’ ওসমানি বললেন।
‘মোস্ট ওয়েলকাম স্যার। আমরা অপেক্ষায় থাকব।’ আমি বললাম।
উপস্থিত চারজন সেনা কর্মকর্তা মেজর ওসমান, ক্যাপ্টেন এ টি সালাউদ্দিন, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে পরিচিত হলেন প্রধান সেনাপতি। ছোটমঞ্চের পাশে ছয়টি ফোল্ডিং চেয়ারে উপবিষ্ট হলাম ভারতের লে. কর্ণেল মেঘ সিংসহ আমরা ছয় অফিসার।
একটু পরই অনুষ্ঠান শুরু হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হলো। কিন্তু তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। ফলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি রুপে শপথ গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ মন্ত্রী রুপে শপথ নেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। কর্নেল ওসমানিকে মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক মুভি ক্যামেরা নিয়ে এই অনুষ্ঠান কাভার করেন। শপথগ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ইংরেজি ভাষায় চমৎকার একটি বক্তব্য দেন। বাঙালিদের বঞ্চনার ইতিহাস, ২৫ মার্চের গণহত্যা, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার কথা তিনি মর্মস্পর্শী ভাষায় উপস্থাপন করেন। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আবেদন জানান। হাজার হাজার শ্রোতা-দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার সে বক্তব্য শোনেন। আম্রকাননের অনুষ্ঠান, পরিবেশ, পরিস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। হাজারো মুক্তিকামী মানুষের পদভারে প্রকম্পিত। কয়েক কিলোমিটার দূরেই পলাশীর আম্রকানন। ১৭৫৭ সালে সেখানেই বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আজ আরেক আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য আবার উদিত হলো।
মুজিবনগর সরকারের কেবিনেট সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচটি ইমাম নামেই তিনি পরিচিত) মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে বলছেন, ‘আমাদের সরকার মূলত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, যেটি আমরা বলতাম, তার প্রধান দপ্তর বা হেড কোয়ার্টার ছিল মুজিবনগর।
আপনারা সবাই জানেন যে, মুজিবনগর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মেহেরপুর জেলায় আমবাগানে। পলাশীর বিখ্যাত আমবাগানের কাছেই সেই জায়গাটিতেই মুজিবনগর। মুজিব নগরেই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়। স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। আমাদের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার নামেই মুজিবনগর করা হয়। আর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, অন্য মন্ত্রীরা ছিলেন এম মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ। আরও অনেক বড় নেতা ছিলেন।
যুদ্ধকালীন যে পরিস্থিতি, তাতে দ্বিতীয় মহাযুদবধ বা পরবর্তীকালেও যে সমস্ত প্রবাসী সরকার দেখেন, তারা কিন্তু নিরাপত্তার কারণে, রাজনৈতিক কারণে ঠিক একটি জায়গায় কোনো সময়েই থাকেননি। মুজিবনগর হেডকোয়ার্টার ছিল বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে। আমাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও ছিল। কিন্তু আমাদের মূল দপ্তর ছিল কোলকাতায়, থিয়েটার রোডে। সেখানেই আমাদের যৌথ বাহিনী, মিত্র বাহিনীর হেড কোয়াটার ছিল। (বাংলাদেশ ১৯৭১, সম্পাদনা আফসান চৌধুরী, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১১)।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের স্মৃতিচারণ এক্ষেত্রে খুব ভালো একটি সংযোজন হতে পারে। দীর্ঘ সে স্মৃতিচারণের নির্দিষ্ট একটি অংশই এখানে দেওয়া হলো:
‘আমরা বঙ্গবন্ধুকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আত্মগোপনের জন্য চাপ দিই। তিনি আত্মগোপনের কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আত্মগোপনের জন্য তিনি পূর্ব থেকেই বঙ্গবন্ধুকে বলে আসছেন। তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। তিনি প্রশ্ন করেন, আমাকে নিয়ে তোরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আত্মগোপন সম্ভব নয়। আমার হয়তো মৃত্যু হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’
এরপর তিনি বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তাজউদ্দীন আহমদসহ তিনি সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছুলেন। তারপর বলছেন, ‘সীমান্ত থেকে কিছু দূরে একটি জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট খালের ওপর একটি ব্রিটিশ যুগের তৈরি কালভার্ট। কালভার্টের ওপর তাজউদ্দীন ভাই ও আমি বসে আছি। আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে তৌফিক ও মাহবুবকে ওপারে পাঠাই। কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। অফিসারটি জানান, আমাদের তিনি যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে ছাউনিতে নিয়ে যেতে এসেছেন।’
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই বিএসএফের আঞ্চলিকপ্রধান গোলক মজুমদার ছাউনিতে এসে পৌছলেন। তিনি জানান, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। তার সঙ্গে কলকাতা যাওয়ার জন্য আমাদের অনুরোধ করেন। তবে দিল্লির সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয়।
মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তিনি জানান, আমাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে এই ফ্লাইটে দিল্লি থেকে একজন কর্মকর্তা আসবেন। বিমান থেকে ছয় ফুটেরও বেশি লম্বা একজন লোক নেমে সোজা আমাদের গাড়িতে উঠলেন। মজুমদার তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি হলেন বিএসএফের প্রধান রুস্তমজি। রুস্তমজি একসময় ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নিরাপত্তাপ্রধান ছিলেন। নেহরু পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর খুবই আস্থাভাজন।’
‘এদিকে আমার কাপড়-চোপড়ের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। গাড়িতেই শুরু হয় আলোচনা। রুস্তমজির প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কোথায়? মজুমদারের প্রথম প্রশ্নও ছিল এটাই। এর পরে আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সকলেরই প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কেমন আছে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা তৈরি ছিলাম। দলীয় নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধাসহ সকলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের ব্যাপারে আমরা একই উত্তর দিয়েছি। আমরা যা বলতে চেয়েছি তা হলো বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমরা তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাচ্ছি। তিনি জানেন, আমরা কোথায় আছি। তিনি আমাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। সময় হলে বা প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি উপযুক্ত স্থানে আমাদের সাথে দেখা করবেন।’
‘একটি সুন্দর বাড়িতে (আসাম হাউস) আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। একটি ঘরে আমি আর তাজউদ্দীন ভাই, অন্য ঘরে রুস্তমজি। আমরা খুবই ক্লান্ত। স্নান করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সাথে অতিরিক্ত কোনো কাপড় নেই। রুস্তমজি আমার পরিধেয় বস্ত্রের অভাবের কথা জেনে তার ইস্ত্রি করা।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ
“৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন ভাই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তাদের কোনো সহযোগী ছিল না। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী প্রথম প্রশ্ন করেন। “হাউ ইজ শেখ মুজিব, ইজ হি অল রাইট?” (শেখ মুজিব কেমন আছেন?) মিসেস গান্ধীর প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন ভাই বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর স্থান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ২৫ মার্চের পর তাঁর সঙ্গে আমাদের আর যোগাযোগ হয়নি।’ সাক্ষাতে তাজউদ্দীন ভাই আরও বলেন, বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোনো মূল্যে এই স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে।”
“তাজউদ্দীন ভাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, পাকিস্তান আমাদের আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাতে পারে। যে কোনো মূল্যে পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। আমাদের অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহের। মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধে তাজউদ্দীন ভাই ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন। বাংলাদেশের নেতা জানান, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে জোটনিরপেক্ষ। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়। সকল গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহায়তা আমরা চাই।”
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ
‘পরদিন তাজউদ্দীন ভাই দ্বিতীয়বারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। ইন্দিরা গান্ধী জানান, বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবশ্য এই খবর পাকিস্তান সরকার তখনো সরকারিভাবে প্রকাশ করেনি।’
‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাজউদ্দীন ভাই বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। সিদ্ধান্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, তাঁদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর প্রচারের জন্য একটি বেতার স্টেশন স্থাপনের বিষয়েও আলোচনা হয়। ...দিল্লিতে বসেই তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা টেপ করা হয়। বক্তৃতার পূর্বে আমার কণ্ঠ থেকে ঘোষণা প্রচারিত হয়-এখন তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দেবেন। এর পর তাজউদ্দীন ভাই বক্তৃতা শুরু করেন।’
‘...মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা চিন্তা করি। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। পাক দস্যুরা সেখানে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গা রাজধানী করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত তা আর গোপন থাকেনি। চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে আমাদের নতুন স্থানের কথা চিন্তা করতে হলো। এই নিয়ে গোলক মজুমদারের সাথে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে সবাই একমত হন যে, যেখানেই আমরা অনুষ্ঠান করি না কেন, পাক বাহিনীর বিমান হামলার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলাকে মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।’
“স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের খসড়াটি কোনো একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে দেখাতে পারলে ভালো হতো। ইতোমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। এদের মধ্যে সুব্রত রায় চৌধুরীর নাম আমি শুনেছি। রায় চৌধুরীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। বিএসএফের মাধ্যমে রায় চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনি রাজি হলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার যে আইনানুগ অধিকার, তা মানবাধিকারের একটা অংশ। এই কথা স্বাধীনতার সনদে ফুটে উঠেছে। তিনি জানান, তিনি এর ওপর একটা বই লিখবেন। এই ঘোষণাপত্রের একটা কপি তাকে দেওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করলেন। এর পর আইন ব্যবসা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর বই লেখা শুরু করেন। তার রচিত বইটির নাম হচ্ছে ‘জেনেসিস অব বাংলাদেশ’।’
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন
“এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি তৈরি করা হচ্ছে। জানা গেল প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সামরিক পোশাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তার সামরিক পোশাক প্রয়োজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোশাক দিতে বললাম। তাদের স্টকে ওসমানীর গায়ের কোনো পোশাক পাওয়া গেল না। সেই রাতে কাপড় কিনে, দর্জি ডেকে তাঁর জন্য পোশাক তৈরি করা হলো। শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার ভার আমার ও আবদুল মান্নানের ওপর ছিল। ১৬ এপ্রিল আমরা দুজনে কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দুজন প্রতিনিধি বিদেশি সাংবাদিকদের সাথে মিলিত হই। সমস্ত প্রেসক্লাব লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই।”
‘সমবেত সাংবাদিকদের পরদিন ১৭ এপ্রিল কাকডাকা ভোরে প্রেসক্লাবে হাজির হতে অনুরোধ জানাই। বললাম, তখন তাদের আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বিশেষ বার্তা দেওয়া হবে। সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার জন্য আমাদের গাড়ি তৈরি থাকবে বলেও জানালাম। বিএসএফের চট্টোপাধ্যায়কে বলি আমাদের জন্য ১০০টি গাড়ির ব্যবস্থা করতে। এর ৫০টা থাকবে প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের বহন করার জন্য। অবশিষ্ট ৫০টার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পৌছানো হবে।’
‘রাত ১২টা থেকে নেতাদের গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। বলে দেওয়া হলো, কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না। সকালবেলা আমরা একত্র হব।
গাড়ির চালক নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবেন। সাইক্লোস্টাইল করা স্বাধীনতা সনদের কপিগুলো গুছিয়ে নিলাম।
১৭ এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের দিন। সারা রাত ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ওসমানী একটি গাড়িতে রওনা হয়ে যান। আমি ও আবদুল মান্নান ভোরের দিকে পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। ভোরেও ক্লাবে লোক ধরেনি। ক্লাবের বাইরেও অনেক লোক দাঁড়িয়ে ছিল।’
‘সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে বিনীতভাবে বললাম, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। তাদের জানালাম স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করবে। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। কেউ জানতে চাইলেন কিভাবে যাবেন, কোথায় যাবেন। আমি পুনরায় বলি, আমি আপনাদের সঙ্গে রয়েছি, পথ দেখিয়ে দেব। আমাদের গাড়িগুলো তখন প্রেসক্লাবের সামনে। উৎসাহিত সাংবাদিকরা গাড়িতে ওঠেন। তাদের অনেকের কাঁধে ক্যামেরা। ৫০-৬০টা গাড়িযোগে রওনা হলাম গন্তব্যস্থানের দিকে। আমি ও আবদুল মান্নান দুজন দুই গাড়িতে। আমার গাড়িতে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন। পথে তাদের সাথে অনেক কথা হলো। শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত স্থান আম্রকাননে পৌছতে বেলা ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রায় শেষ। মাহবুব ও তৌফিক ইলাহী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। আগেই ঠিক করা হয়েছিল যে, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ পাঠ করবেন।’
আমবাগানে মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ
‘কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। একটি ছোট্ট মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী। সংবাদ সম্মেলনে প্রধান প্রশ্ন ছিল সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। তাঁর সাথে আমাদের চিন্তার (বিস্তর) যোগাযোগ রয়েছে। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু শত্রুশিবিরে বন্দি। কিন্তু আমরা তা বলতে চাইনি। পাক বাহিনী বলুক এটাই আমরা চাচ্ছিলাম। কারণ আমরা যদি বলি বঙ্গবন্ধু পাক শিবিরে, আর তারা যদি অস্বীকার করে তা হলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আর আমরা যদি বলি তিনি দেশের ভেতরে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন হানাদাররা বলে বসবে তিনি বন্দি।’
‘আমবাগানের অনুষ্ঠানে ভরদুপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। হাজারো কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো ইত্যাদি স্লোগান। আমার কাজ ছিল দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করে সাংবাদিকদের ফেরত পাঠানো। দুপুরের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সাংবাদিকদের গাড়িযোগে ফেরত পাঠানো হলো। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ফেরেন সন্ধ্যায়।’
(মুজিবনগর, কাঠামো ও কার্যকারণ, সম্পাদনা আফসান চৌধুরী, পৃষ্ঠা ১১৪-১২৫)
এই বর্ণনার পর নিশ্চয় যে কোনো বিবেচক পাঠক বুঝতে পারবেন, ১৭ এপ্রিল কীভাবে আমাদের হয়েছিল।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা হলেও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
৮ ঘণ্টা আগে
সুদান থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু রাতেই দেশটির আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শান্ত মন্ডল। কুড়িগ্রামে শান্তদের বাড়িতে এখন চলছে শুধুই মাতম।
৮ ঘণ্টা আগে
আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের কয়েক দিন আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানো যাচ্ছে না বুঝতে পেরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে শেষ মরণ আঘাত হানে পাকিস্তানি বাহিনী।
১১ ঘণ্টা আগে
প্রেস উইং জানিয়েছে, আগামীকাল দুপুরে ওসমান হাদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসক দল ও ভ্রমণসংক্রান্ত সব প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে।
১৩ ঘণ্টা আগেশাহরিয়ার হাসান, ঢাকা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা হলেও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন রাজনৈতিক নেতারাসহ জুলাই যোদ্ধারা। সরকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলেও এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনী প্রচার নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন হাল। নির্বাচনের ট্রেন চলা শুরু হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাবাচ্ছে সবাইকে। পরিস্থিতি ঠিক করতে এখনই দৃশ্যমান ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।
ওসমান হাদি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গত শুক্রবার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে প্রকাশ্যে মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তরা ব্যাটারিচালিত রিকশায় বসা ওসমান হাদির মাথায় গুলি করে। এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাদির সার্বিক অবস্থা এখনো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে মেডিকেল বোর্ড।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চোরাগোপ্তা হামলা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার এবং নাশকতার আশঙ্কার মধ্যে এ ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে থমথমে ভাব নেমে এসেছে। তফসিলের পর যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল, তাও কমে গেছে।
সূত্র বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে মাঠপর্যায় থেকেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়গুলো জানানো হয়েছে। গত শনিবার পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) সঙ্গে দেশের সব রেঞ্জের ডিআইজি ও মহানগর পুলিশের কমিশনারদের বৈঠকেও এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে পরামর্শ এসেছে।
জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং কোনো প্রার্থী অনিরাপদ বোধ করলে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হবে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে গতকাল রোববার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওই বৈঠকেও চোরাগোপ্তা হামলা ও জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রসঙ্গে ওঠে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি, যাতে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা পরিকল্পনা আরও কার্যকর করা যায়। তবে নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রকার শঙ্কা নেই বলে জানানো হয়েছে।’
এদিকে বিভিন্ন ইস্যুতে বিভক্তি থাকলেও ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় প্রধান সব রাজনৈতিক দল আবার এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণাও এসেছে। ওই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এরশাদউল্লাহর গণসংযোগের সময় গুলিতে একজন নিহত ও প্রার্থীসহ দুজন আহত হন। অবশ্য সেখানে হত্যার লক্ষ্য ছিলেন সন্ত্রাসী সরোয়ার। এরপর ২৭ নভেম্বর পাবনা-৪ আসনে জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী আবু তালেব মণ্ডলের গণসংযোগকে কেন্দ্র করে হামলা ও সংঘর্ষ হয়। এর পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক বিরোধকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা ভিন্ন। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়েছে। এই ঘটনার পর কোনো কোনো দল থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও উঠেছে।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, কয়েক দিন ধরে বাসে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল হামলার মাধ্যমে আতঙ্ক তৈরির একটি চেষ্টা চলছে। তবে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় নির্বাচনের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নির্বাচন যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
ওসমান হাদির ওপর হামলাকে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার একটি সুপরিকল্পিত চেষ্টা হিসেবে দেখছেন রাজনীতিকদের অনেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই একটি পক্ষ নির্বাচন ঠেকানোর হুমকি দিয়ে আসছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারও ঘটনাটিকে নির্বাচনবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বিবৃতিতে বলেছেন, নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের সহিংসতা বরদাশত করা হবে না। জনগণের নিরাপত্তা ও প্রার্থীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, কোথায় কোথায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও শত্রুতা বেশি, কোথায় শক্ত প্রার্থী রয়েছেন—এসব জায়গায় আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এমন ঘটনা যেকোনোভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে। করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট সব তথ্য সংগ্রহ ও গোয়েন্দা চ্যানেলকে সক্রিয় করতে হবে এবং অন্য কাজের চেয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এদিকে প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে শনিবার আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে কমিটি করা হয়েছে। অপারেশন ডেভিল হান্ট-২ শুরুর ঘোষণাও দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এদিকে গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সব রাজনৈতিক দলের জন্য পুলিশ নিরাপত্তা প্রটোকল দেবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলেছে, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলোতে আওয়ামী লীগের শাসনামলে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র ছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর সঙ্গে জড়িত চিহ্নিত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি পেশাদার সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনার আলোকে অবৈধ অস্ত্রের সরবরাহপথ চিহ্নিত করা এবং অস্ত্রের পেছনে থাকা অর্থের জোগানদাতাদের শনাক্ত করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ শুরু করেছে।
এদিকে গত বছরের ৫ আগস্ট পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে জোর দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, লুণ্ঠিত ১ হাজার ৩৩৭টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। এগুলোর মধ্যে প্রায় ৪০০টি পিস্তল রয়েছে।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, সীমান্ত দিয়ে দেশে অস্ত্র প্রবেশের আশঙ্কার পাশাপাশি লুট হওয়া অস্ত্রগুলো কোনো অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সেটিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। অভিযানে এসব বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
নতুন নিরাপত্তা পরিকল্পনা
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের দাবি করেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ও জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের নিরাপত্তা পরিকল্পনা নতুন করে সাজানো হচ্ছে। যেকোনো মূল্যে প্রার্থীদের এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, নির্বাচনের সময় যেকোনো ঝুঁকি মোকাবিলা করতে এবং নির্বাচনকে শঙ্কামুক্ত রাখতে সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রার্থীদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, প্রার্থীদের সঙ্গে সশস্ত্র প্রহরী থাকবে এবং গোয়েন্দা সংস্থা সম্ভাব্য ঝুঁকি ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সতর্ক করবে। প্রার্থীদের ঠিক কোন জায়গায় যাওয়া নিরাপদ বা ঝুঁকিপূর্ণ সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা হলেও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন রাজনৈতিক নেতারাসহ জুলাই যোদ্ধারা। সরকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলেও এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনী প্রচার নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন হাল। নির্বাচনের ট্রেন চলা শুরু হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাবাচ্ছে সবাইকে। পরিস্থিতি ঠিক করতে এখনই দৃশ্যমান ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।
ওসমান হাদি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গত শুক্রবার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে প্রকাশ্যে মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তরা ব্যাটারিচালিত রিকশায় বসা ওসমান হাদির মাথায় গুলি করে। এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাদির সার্বিক অবস্থা এখনো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে মেডিকেল বোর্ড।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চোরাগোপ্তা হামলা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার এবং নাশকতার আশঙ্কার মধ্যে এ ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে থমথমে ভাব নেমে এসেছে। তফসিলের পর যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল, তাও কমে গেছে।
সূত্র বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে মাঠপর্যায় থেকেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়গুলো জানানো হয়েছে। গত শনিবার পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) সঙ্গে দেশের সব রেঞ্জের ডিআইজি ও মহানগর পুলিশের কমিশনারদের বৈঠকেও এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে পরামর্শ এসেছে।
জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং কোনো প্রার্থী অনিরাপদ বোধ করলে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হবে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে গতকাল রোববার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওই বৈঠকেও চোরাগোপ্তা হামলা ও জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রসঙ্গে ওঠে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি, যাতে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা পরিকল্পনা আরও কার্যকর করা যায়। তবে নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রকার শঙ্কা নেই বলে জানানো হয়েছে।’
এদিকে বিভিন্ন ইস্যুতে বিভক্তি থাকলেও ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় প্রধান সব রাজনৈতিক দল আবার এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণাও এসেছে। ওই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এরশাদউল্লাহর গণসংযোগের সময় গুলিতে একজন নিহত ও প্রার্থীসহ দুজন আহত হন। অবশ্য সেখানে হত্যার লক্ষ্য ছিলেন সন্ত্রাসী সরোয়ার। এরপর ২৭ নভেম্বর পাবনা-৪ আসনে জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী আবু তালেব মণ্ডলের গণসংযোগকে কেন্দ্র করে হামলা ও সংঘর্ষ হয়। এর পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক বিরোধকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা ভিন্ন। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়েছে। এই ঘটনার পর কোনো কোনো দল থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও উঠেছে।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, কয়েক দিন ধরে বাসে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল হামলার মাধ্যমে আতঙ্ক তৈরির একটি চেষ্টা চলছে। তবে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় নির্বাচনের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নির্বাচন যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
ওসমান হাদির ওপর হামলাকে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার একটি সুপরিকল্পিত চেষ্টা হিসেবে দেখছেন রাজনীতিকদের অনেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই একটি পক্ষ নির্বাচন ঠেকানোর হুমকি দিয়ে আসছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারও ঘটনাটিকে নির্বাচনবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বিবৃতিতে বলেছেন, নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের সহিংসতা বরদাশত করা হবে না। জনগণের নিরাপত্তা ও প্রার্থীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, কোথায় কোথায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও শত্রুতা বেশি, কোথায় শক্ত প্রার্থী রয়েছেন—এসব জায়গায় আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এমন ঘটনা যেকোনোভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে। করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট সব তথ্য সংগ্রহ ও গোয়েন্দা চ্যানেলকে সক্রিয় করতে হবে এবং অন্য কাজের চেয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এদিকে প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে শনিবার আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে কমিটি করা হয়েছে। অপারেশন ডেভিল হান্ট-২ শুরুর ঘোষণাও দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এদিকে গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সব রাজনৈতিক দলের জন্য পুলিশ নিরাপত্তা প্রটোকল দেবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলেছে, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলোতে আওয়ামী লীগের শাসনামলে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র ছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর সঙ্গে জড়িত চিহ্নিত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি পেশাদার সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনার আলোকে অবৈধ অস্ত্রের সরবরাহপথ চিহ্নিত করা এবং অস্ত্রের পেছনে থাকা অর্থের জোগানদাতাদের শনাক্ত করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ শুরু করেছে।
এদিকে গত বছরের ৫ আগস্ট পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে জোর দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, লুণ্ঠিত ১ হাজার ৩৩৭টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। এগুলোর মধ্যে প্রায় ৪০০টি পিস্তল রয়েছে।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, সীমান্ত দিয়ে দেশে অস্ত্র প্রবেশের আশঙ্কার পাশাপাশি লুট হওয়া অস্ত্রগুলো কোনো অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সেটিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। অভিযানে এসব বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
নতুন নিরাপত্তা পরিকল্পনা
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের দাবি করেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ও জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের নিরাপত্তা পরিকল্পনা নতুন করে সাজানো হচ্ছে। যেকোনো মূল্যে প্রার্থীদের এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, নির্বাচনের সময় যেকোনো ঝুঁকি মোকাবিলা করতে এবং নির্বাচনকে শঙ্কামুক্ত রাখতে সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রার্থীদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, প্রার্থীদের সঙ্গে সশস্ত্র প্রহরী থাকবে এবং গোয়েন্দা সংস্থা সম্ভাব্য ঝুঁকি ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সতর্ক করবে। প্রার্থীদের ঠিক কোন জায়গায় যাওয়া নিরাপদ বা ঝুঁকিপূর্ণ সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে।

১৭ এপ্রিল তারিখটায় পৌঁছুতে হলে মেলে ধরতে হয় ইতিহাসের ডানা। এই দিনটিতে বৈদ্যনাথতলা হয়ে ওঠে মুজিবনগর। কেন মুজিবনগর? মুজিব তো তখন নেই। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরেছে ইয়াহিয়া। বিচারের নাম করে শেখ মুজিবকে হত্যা করার তোড়জোড় চলছে তখন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের শপথ নেওয়ার জন্য যে জায়গাটি বেছে নেওয়া হলো...
১৭ এপ্রিল ২০২৫
সুদান থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু রাতেই দেশটির আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শান্ত মন্ডল। কুড়িগ্রামে শান্তদের বাড়িতে এখন চলছে শুধুই মাতম।
৮ ঘণ্টা আগে
আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের কয়েক দিন আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানো যাচ্ছে না বুঝতে পেরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে শেষ মরণ আঘাত হানে পাকিস্তানি বাহিনী।
১১ ঘণ্টা আগে
প্রেস উইং জানিয়েছে, আগামীকাল দুপুরে ওসমান হাদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসক দল ও ভ্রমণসংক্রান্ত সব প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে।
১৩ ঘণ্টা আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

সুদান থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু রাতেই দেশটির আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শান্ত মন্ডল। কুড়িগ্রামে শান্তদের বাড়িতে এখন চলছে শুধুই মাতম।
শুধু শান্ত নন, সুদানের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ওই ঘাঁটিতে হামলায় সেনাবাহিনীর আরও তিন সৈনিক এবং দুই কর্মচারী নিহত হয়েছেন। সবার বাড়িতে এখন মাতম চলছে। তাঁদের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজন ও প্রতিবেশীদের কেউ।
২০১৮ সালে সৈনিক পদে যোগ দেওয়া শান্ত গত ৭ নভেম্বর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুদানে যান। এক বছর আগে বিয়ে করেছিলেন তিনি। শান্তর স্ত্রী এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সাটমাধাই ডারারপাড়ে শান্ত মন্ডলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা, সেখানে কান্নার কোনো শব্দ নেই। শান্তর মা সাহেরা বেগম বিছানায় বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। কথা নেই, কান্নাও নেই। ছেলের নাম উচ্চারণ করলেই চোখ ভিজে ওঠে সাহেরা বেগম এবং পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনদের। লাশ দেশে এলে বাবার কবরের পাশে দাফনের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। এখন তাঁরা লাশ আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। শান্তর ভাই সোহাগ মন্ডল বলেন, ‘যাওয়ার সময় মায়ের পা ছুঁয়ে দোয়া নিয়েছিল। কেউ ভাবেনি, সেটিই হবে তার শেষ দেখা। এমন মৃত্যু আমাদের কল্পনার বাইরে।’
শনিবার সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের কাদুগলি লজিস্টিক ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী। এতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মধ্যে করপোরাল মো. মাসুদ রানা (নাটোর) এবং সৈনিকদের মধ্যে মো. মমিনুল ইসলাম (কুড়িগ্রাম), শামীম রেজা (রাজবাড়ী), শান্ত মন্ডল (কুড়িগ্রাম), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) এবং লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা) নিহত হন।
এ ঘটনায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান (কুষ্টিয়া), সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন (দিনাজপুর), করপোরাল আফরোজা পারভিন ইতি (ঢাকা), ল্যান্স করপোরাল মহিবুল ইসলাম (বরগুনা); সৈনিক মো. মেজবাউল কবির (কুড়িগ্রাম), মোসা. উম্মে হানি আক্তার (রংপুর), চুমকি আক্তার (মানিকগঞ্জ) ও মো. মানাজির আহসান (নোয়াখালী) আহত হয়েছেন বলে আইএসপিআর জানিয়েছে।
হামলায় নিহত কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার তারাকান্দি গ্রামের মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম তিন ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে শোকের আবহ চলছে বাড়িতে। জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমে সহকর্মীদের কাছ থেকে খবর পাই। এরপর ভোরে সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফোন করে নিশ্চিত করেন।’ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার স্বামীর ছবি আর তিন বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিস্তব্ধ হয়ে আছেন। বৃদ্ধ বাবা হজরত আলী রহমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি শুনছি, বোমা ফালাইয়া আমার ছেলেরে মাইরা ফেলছে। এ দুঃখ কেমনে সহ্য করমু?’
হামলায় নিহত মমিনুল ইসলামের বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের পারুলেরপাড় গ্রামে। তাঁর বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, ছোট মেয়ের বয়স ৪ বছর। মমিনুলের পরিবারের সদস্যরা জানান, শনিবার বিকেলে ভিডিও কলে বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলেন মমিনুল। কয়েক ঘণ্টা পরই আসে মৃত্যুর খবর। প্রতিবেশীরা জানান, খবর শোনার পর স্ত্রী ও মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাবা আব্দুল করিম বলেন, ‘আমার ছেলে ভালো মানুষ ছিল। আল্লাহ হয়তো তাকে ভালোবাসেন বলেই শহীদের মৃত্যু দিয়েছেন।’
ড্রোন হামলায় নিহত গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মহদীপুর ইউনিয়নের আমলাগাছি গ্রামের সবুজ মিয়া ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। এক বছর আগে বিয়ে করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবরে মা, স্ত্রীসহ স্বজনেরা শোকে ভেঙে পড়েছেন। গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
হামলায় নিহত রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের হোগলাডাঙ্গী গ্রামের আলমগীর ফকিরের ছেলে শামীম রেজা ছিলেন তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
শামীম রেজার ছোট ভাই সোহান ফকির বলেন, ‘টেলিভিশনে সুদানের ঘটনার খবর দেখার পর থেকে আমরা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ভাইয়ের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। রাত ১২টার পর আমরা নিশ্চিত হই ভাই আর নেই। গত শুক্রবার তিনি বাড়িতে ভিডিও কলে শেষবার কথা বলেছিলেন।’
শামীম রেজার বাবা আলমগীর ফকির কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে ৭ মাস আগে বিদেশে গেছে। শুক্রবারও কথা বলেছি। শামীম তখন বলল, আব্বু তুমি ভালো থেকো আমি ডিউটিতে যাব। আমার ছেলেকে এনে দাও তোমরা।’
নাটোরের লালপুর উপজেলার আরবাব ইউনিয়নের বোয়ালিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ রানা নিহত হওয়ার খবরে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তিনি সাহার উদ্দিনের ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মাসুদ ছিলেন সবার বড়। ২০০৬ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর দুই ভাইও সেনাবাহিনীর সদস্য।
মাসুদ রানার স্ত্রী আসমাউল হুসনা আঁখি বলেন, ‘তিনি আমার মেয়েকে এতিম করে চলে গেলেন। বাকি জীবন আমরা কীভাবে কাটাব? গতকালও আমাদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছিলেন। আজ তিনি নেই ভাবতেই পারছি না।’
ড্রোন হামলায় হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি নিহত শান্তিরক্ষীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে আহত শান্তিরক্ষীদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
আহত শান্তিরক্ষীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে আইএসপিআর বলেছে, তাঁদের মধ্যে সৈনিক মেজবাউল কবিরের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। বর্তমানে তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। আহত অন্যদের উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে স্থানান্তর করা হয়েছে, তাঁরা সবাই শঙ্কামুক্ত।
আন্তোনিও গুতেরেসের শোক
বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গতকাল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। গুতেরেস প্রধান উপদেষ্টাকে বলেন, ‘আমি গভীর সমবেদনা জানাতে ফোন করেছি। আমি এই ঘটনায় খুবই মর্মাহত।’
হামলার ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ড. ইউনূসও শান্তিরক্ষীদের মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি তিনি আহত সেনাসদস্যদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার এবং নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে জাতিসংঘকে অনুরোধ জানান।

সুদান থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু রাতেই দেশটির আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শান্ত মন্ডল। কুড়িগ্রামে শান্তদের বাড়িতে এখন চলছে শুধুই মাতম।
শুধু শান্ত নন, সুদানের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ওই ঘাঁটিতে হামলায় সেনাবাহিনীর আরও তিন সৈনিক এবং দুই কর্মচারী নিহত হয়েছেন। সবার বাড়িতে এখন মাতম চলছে। তাঁদের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজন ও প্রতিবেশীদের কেউ।
২০১৮ সালে সৈনিক পদে যোগ দেওয়া শান্ত গত ৭ নভেম্বর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুদানে যান। এক বছর আগে বিয়ে করেছিলেন তিনি। শান্তর স্ত্রী এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সাটমাধাই ডারারপাড়ে শান্ত মন্ডলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা, সেখানে কান্নার কোনো শব্দ নেই। শান্তর মা সাহেরা বেগম বিছানায় বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। কথা নেই, কান্নাও নেই। ছেলের নাম উচ্চারণ করলেই চোখ ভিজে ওঠে সাহেরা বেগম এবং পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনদের। লাশ দেশে এলে বাবার কবরের পাশে দাফনের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। এখন তাঁরা লাশ আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। শান্তর ভাই সোহাগ মন্ডল বলেন, ‘যাওয়ার সময় মায়ের পা ছুঁয়ে দোয়া নিয়েছিল। কেউ ভাবেনি, সেটিই হবে তার শেষ দেখা। এমন মৃত্যু আমাদের কল্পনার বাইরে।’
শনিবার সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের কাদুগলি লজিস্টিক ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী। এতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মধ্যে করপোরাল মো. মাসুদ রানা (নাটোর) এবং সৈনিকদের মধ্যে মো. মমিনুল ইসলাম (কুড়িগ্রাম), শামীম রেজা (রাজবাড়ী), শান্ত মন্ডল (কুড়িগ্রাম), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) এবং লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা) নিহত হন।
এ ঘটনায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান (কুষ্টিয়া), সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন (দিনাজপুর), করপোরাল আফরোজা পারভিন ইতি (ঢাকা), ল্যান্স করপোরাল মহিবুল ইসলাম (বরগুনা); সৈনিক মো. মেজবাউল কবির (কুড়িগ্রাম), মোসা. উম্মে হানি আক্তার (রংপুর), চুমকি আক্তার (মানিকগঞ্জ) ও মো. মানাজির আহসান (নোয়াখালী) আহত হয়েছেন বলে আইএসপিআর জানিয়েছে।
হামলায় নিহত কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার তারাকান্দি গ্রামের মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম তিন ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে শোকের আবহ চলছে বাড়িতে। জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমে সহকর্মীদের কাছ থেকে খবর পাই। এরপর ভোরে সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফোন করে নিশ্চিত করেন।’ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার স্বামীর ছবি আর তিন বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিস্তব্ধ হয়ে আছেন। বৃদ্ধ বাবা হজরত আলী রহমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি শুনছি, বোমা ফালাইয়া আমার ছেলেরে মাইরা ফেলছে। এ দুঃখ কেমনে সহ্য করমু?’
হামলায় নিহত মমিনুল ইসলামের বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের পারুলেরপাড় গ্রামে। তাঁর বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, ছোট মেয়ের বয়স ৪ বছর। মমিনুলের পরিবারের সদস্যরা জানান, শনিবার বিকেলে ভিডিও কলে বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলেন মমিনুল। কয়েক ঘণ্টা পরই আসে মৃত্যুর খবর। প্রতিবেশীরা জানান, খবর শোনার পর স্ত্রী ও মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাবা আব্দুল করিম বলেন, ‘আমার ছেলে ভালো মানুষ ছিল। আল্লাহ হয়তো তাকে ভালোবাসেন বলেই শহীদের মৃত্যু দিয়েছেন।’
ড্রোন হামলায় নিহত গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মহদীপুর ইউনিয়নের আমলাগাছি গ্রামের সবুজ মিয়া ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। এক বছর আগে বিয়ে করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবরে মা, স্ত্রীসহ স্বজনেরা শোকে ভেঙে পড়েছেন। গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
হামলায় নিহত রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের হোগলাডাঙ্গী গ্রামের আলমগীর ফকিরের ছেলে শামীম রেজা ছিলেন তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
শামীম রেজার ছোট ভাই সোহান ফকির বলেন, ‘টেলিভিশনে সুদানের ঘটনার খবর দেখার পর থেকে আমরা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ভাইয়ের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। রাত ১২টার পর আমরা নিশ্চিত হই ভাই আর নেই। গত শুক্রবার তিনি বাড়িতে ভিডিও কলে শেষবার কথা বলেছিলেন।’
শামীম রেজার বাবা আলমগীর ফকির কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে ৭ মাস আগে বিদেশে গেছে। শুক্রবারও কথা বলেছি। শামীম তখন বলল, আব্বু তুমি ভালো থেকো আমি ডিউটিতে যাব। আমার ছেলেকে এনে দাও তোমরা।’
নাটোরের লালপুর উপজেলার আরবাব ইউনিয়নের বোয়ালিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ রানা নিহত হওয়ার খবরে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তিনি সাহার উদ্দিনের ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মাসুদ ছিলেন সবার বড়। ২০০৬ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর দুই ভাইও সেনাবাহিনীর সদস্য।
মাসুদ রানার স্ত্রী আসমাউল হুসনা আঁখি বলেন, ‘তিনি আমার মেয়েকে এতিম করে চলে গেলেন। বাকি জীবন আমরা কীভাবে কাটাব? গতকালও আমাদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছিলেন। আজ তিনি নেই ভাবতেই পারছি না।’
ড্রোন হামলায় হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি নিহত শান্তিরক্ষীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে আহত শান্তিরক্ষীদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
আহত শান্তিরক্ষীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে আইএসপিআর বলেছে, তাঁদের মধ্যে সৈনিক মেজবাউল কবিরের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। বর্তমানে তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। আহত অন্যদের উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে স্থানান্তর করা হয়েছে, তাঁরা সবাই শঙ্কামুক্ত।
আন্তোনিও গুতেরেসের শোক
বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গতকাল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। গুতেরেস প্রধান উপদেষ্টাকে বলেন, ‘আমি গভীর সমবেদনা জানাতে ফোন করেছি। আমি এই ঘটনায় খুবই মর্মাহত।’
হামলার ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ড. ইউনূসও শান্তিরক্ষীদের মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি তিনি আহত সেনাসদস্যদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার এবং নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে জাতিসংঘকে অনুরোধ জানান।

১৭ এপ্রিল তারিখটায় পৌঁছুতে হলে মেলে ধরতে হয় ইতিহাসের ডানা। এই দিনটিতে বৈদ্যনাথতলা হয়ে ওঠে মুজিবনগর। কেন মুজিবনগর? মুজিব তো তখন নেই। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরেছে ইয়াহিয়া। বিচারের নাম করে শেখ মুজিবকে হত্যা করার তোড়জোড় চলছে তখন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের শপথ নেওয়ার জন্য যে জায়গাটি বেছে নেওয়া হলো...
১৭ এপ্রিল ২০২৫
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা হলেও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
৮ ঘণ্টা আগে
আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের কয়েক দিন আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানো যাচ্ছে না বুঝতে পেরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে শেষ মরণ আঘাত হানে পাকিস্তানি বাহিনী।
১১ ঘণ্টা আগে
প্রেস উইং জানিয়েছে, আগামীকাল দুপুরে ওসমান হাদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসক দল ও ভ্রমণসংক্রান্ত সব প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে।
১৩ ঘণ্টা আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের কয়েক দিন আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানো যাচ্ছে না বুঝতে পেরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে শেষ মরণ আঘাত হানে পাকিস্তানি বাহিনী। পরিকল্পিতভাবে একযোগে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বিজয়ের পরই তাঁদের অনেকের ক্ষতবিক্ষত মরদেহের সন্ধান মেলে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী স্থানীয় আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরাই মূলত বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল। আর এই দুই বাহিনীর মূল শক্তি ছিল স্বাধীনতাবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীরা। পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের আগে ঢাকা শহরে ঘন ঘন কারফিউয়ের মধ্যে মাইক্রোবাস নিয়ে বেরিয়ে অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নেওয়া হয়েছিল। তাদের সহায়তা করেছিল ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীরা।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালে ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় জন শিক্ষক, ছয় জন সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে ছাত্রসংঘের দুই কেন্দ্রীয় নেতা ও আলবদর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। পলাতক আশরাফুজ্জামান বর্তমানে আছেন যুক্তরাষ্ট্রে, আর মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে। কোনো দেশই তাদের ফেরত দিচ্ছে না।
ট্রাইব্যনালের ১৫৪ পৃষ্ঠার রায়ে উঠে এসেছে, কীভাবে আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীন ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আল বদর সদস্যদের নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যার পর বধ্যভূমিতে লাশ গুম করেছিলেন। আশরাফুজ্জামান ছিলেন হত্যাযজ্ঞের ‘চিফ এক্সিকিউটর’ ও মুঈনুদ্দীন ‘অপারেশন ইনচার্জ’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে উদ্ধার করা ব্যক্তিগত দিনপঞ্জিতে হত্যার পরিকল্পনা ও একটি তালিকাও পাওয়া যায়।
জামায়াতের এই দুই ছাত্র নেতা ও তাদের সহযোগীদের হাতে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য।

সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, এএনএম গোলাম মুস্তাফা, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, শহীদুল্লাহ কায়সার এবং চিকিৎসক মো. মর্তুজা, মো. ফজলে রাব্বি ও আলিম চৌধুরীকেও হত্যার পর গুম করে তারা।
‘ফ্যাসিস্ট’ জামায়াত
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের রায়ে উঠে এসেছিল। আদালত বলেছিল, সেই সময় জামায়াতে ইসলামী একটি ফ্যাসিস্ট সংগঠন হিসাবে কাজ করেছে। ‘কিলিং স্কোয়াড’ আল বদরের নিয়ন্ত্রণ জামায়াতের হাতেই ছিল।
রায়ে বলা হয়, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ফ্যাসিস্ট জামায়াতে ইসলামীর সংগঠিত মহাপরিকল্পনার আলোকেই সে সময় আল বদর বাহিনীকে নামানো হয়। বাঙালি জাতিকে প্যারালাইজড করতে তারা বুদ্ধিজীবী-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিহীন করতে চেয়েছিল।
একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর দৈনিক শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীনকে অপহরণের পর হত্যার বিষয়টি উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, ‘সন্তানের জন্য সেলিনা পারভীন প্রাণ ভিক্ষা চান, তাকে ছেড়ে দিতে বলেন। তার ছোট একটি ছেলে রয়েছে, যাকে দেখাশুনা করার আর কেউ নেই। কিন্তু নিষ্ঠুর হত্যাকারীরা তাকে ছাড়েনি। বেয়নেট দিয়ে তাকে তাতক্ষণিকভাবে হত্যা করা হয় বলে প্রসিকিউশনের ২২ নম্বর সাক্ষী জানিয়েছেন। সেলিনা পারভীন ছিলেন একজন মা। ভীতিকর আক্রমণ কেবল সেলিনা পারভীনের ওপরই করা হয় নাই। বরং মাতৃত্বের ওপরও হয়েছে। এটা বরং মাতৃহন্তাও। অবর্ণনীয় এই নিষ্ঠুরতা মানবতার বিবেককে আঘাত করেছে।’
এর আগে জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধকালীন আমির গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ে দলটিকে ‘সন্ত্রাসী দল’ আখ্যা দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সরকারের আমলে পুলিশ প্রহরায় মুঈনুদ্দীনকে দেশে আসার সুযোগ করে দেয়ায় ওই দুই সামরিক শাসককেও ধিক্কার জানানো হয়েছে রায়ের পর্যবেক্ষণে।
রায়ে বলা হয়, ‘এটা জাতির বড় একটি বিরাট লজ্জা (গ্রেট শেম) যে, জিয়া ও এরশাদ তাকে গ্রামের বাড়িতে যেতে দিয়েছেন। আত্মগোপনে গিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া এই আসামিকে সে সময় পুলিশি নিরাপত্তাও দেয়া হয়। বিচারের মুখোমুখি করার পরিবর্তে তাকে রাষ্ট্রীয় মেশিনারি দিয়ে সম্মান দেয়া হলো।’

আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের কয়েক দিন আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানো যাচ্ছে না বুঝতে পেরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে শেষ মরণ আঘাত হানে পাকিস্তানি বাহিনী। পরিকল্পিতভাবে একযোগে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বিজয়ের পরই তাঁদের অনেকের ক্ষতবিক্ষত মরদেহের সন্ধান মেলে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী স্থানীয় আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরাই মূলত বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল। আর এই দুই বাহিনীর মূল শক্তি ছিল স্বাধীনতাবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীরা। পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের আগে ঢাকা শহরে ঘন ঘন কারফিউয়ের মধ্যে মাইক্রোবাস নিয়ে বেরিয়ে অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নেওয়া হয়েছিল। তাদের সহায়তা করেছিল ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীরা।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালে ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় জন শিক্ষক, ছয় জন সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে ছাত্রসংঘের দুই কেন্দ্রীয় নেতা ও আলবদর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। পলাতক আশরাফুজ্জামান বর্তমানে আছেন যুক্তরাষ্ট্রে, আর মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে। কোনো দেশই তাদের ফেরত দিচ্ছে না।
ট্রাইব্যনালের ১৫৪ পৃষ্ঠার রায়ে উঠে এসেছে, কীভাবে আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীন ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আল বদর সদস্যদের নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যার পর বধ্যভূমিতে লাশ গুম করেছিলেন। আশরাফুজ্জামান ছিলেন হত্যাযজ্ঞের ‘চিফ এক্সিকিউটর’ ও মুঈনুদ্দীন ‘অপারেশন ইনচার্জ’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে উদ্ধার করা ব্যক্তিগত দিনপঞ্জিতে হত্যার পরিকল্পনা ও একটি তালিকাও পাওয়া যায়।
জামায়াতের এই দুই ছাত্র নেতা ও তাদের সহযোগীদের হাতে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য।

সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, এএনএম গোলাম মুস্তাফা, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, শহীদুল্লাহ কায়সার এবং চিকিৎসক মো. মর্তুজা, মো. ফজলে রাব্বি ও আলিম চৌধুরীকেও হত্যার পর গুম করে তারা।
‘ফ্যাসিস্ট’ জামায়াত
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের রায়ে উঠে এসেছিল। আদালত বলেছিল, সেই সময় জামায়াতে ইসলামী একটি ফ্যাসিস্ট সংগঠন হিসাবে কাজ করেছে। ‘কিলিং স্কোয়াড’ আল বদরের নিয়ন্ত্রণ জামায়াতের হাতেই ছিল।
রায়ে বলা হয়, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ফ্যাসিস্ট জামায়াতে ইসলামীর সংগঠিত মহাপরিকল্পনার আলোকেই সে সময় আল বদর বাহিনীকে নামানো হয়। বাঙালি জাতিকে প্যারালাইজড করতে তারা বুদ্ধিজীবী-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিহীন করতে চেয়েছিল।
একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর দৈনিক শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীনকে অপহরণের পর হত্যার বিষয়টি উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, ‘সন্তানের জন্য সেলিনা পারভীন প্রাণ ভিক্ষা চান, তাকে ছেড়ে দিতে বলেন। তার ছোট একটি ছেলে রয়েছে, যাকে দেখাশুনা করার আর কেউ নেই। কিন্তু নিষ্ঠুর হত্যাকারীরা তাকে ছাড়েনি। বেয়নেট দিয়ে তাকে তাতক্ষণিকভাবে হত্যা করা হয় বলে প্রসিকিউশনের ২২ নম্বর সাক্ষী জানিয়েছেন। সেলিনা পারভীন ছিলেন একজন মা। ভীতিকর আক্রমণ কেবল সেলিনা পারভীনের ওপরই করা হয় নাই। বরং মাতৃত্বের ওপরও হয়েছে। এটা বরং মাতৃহন্তাও। অবর্ণনীয় এই নিষ্ঠুরতা মানবতার বিবেককে আঘাত করেছে।’
এর আগে জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধকালীন আমির গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ে দলটিকে ‘সন্ত্রাসী দল’ আখ্যা দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সরকারের আমলে পুলিশ প্রহরায় মুঈনুদ্দীনকে দেশে আসার সুযোগ করে দেয়ায় ওই দুই সামরিক শাসককেও ধিক্কার জানানো হয়েছে রায়ের পর্যবেক্ষণে।
রায়ে বলা হয়, ‘এটা জাতির বড় একটি বিরাট লজ্জা (গ্রেট শেম) যে, জিয়া ও এরশাদ তাকে গ্রামের বাড়িতে যেতে দিয়েছেন। আত্মগোপনে গিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া এই আসামিকে সে সময় পুলিশি নিরাপত্তাও দেয়া হয়। বিচারের মুখোমুখি করার পরিবর্তে তাকে রাষ্ট্রীয় মেশিনারি দিয়ে সম্মান দেয়া হলো।’

১৭ এপ্রিল তারিখটায় পৌঁছুতে হলে মেলে ধরতে হয় ইতিহাসের ডানা। এই দিনটিতে বৈদ্যনাথতলা হয়ে ওঠে মুজিবনগর। কেন মুজিবনগর? মুজিব তো তখন নেই। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরেছে ইয়াহিয়া। বিচারের নাম করে শেখ মুজিবকে হত্যা করার তোড়জোড় চলছে তখন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের শপথ নেওয়ার জন্য যে জায়গাটি বেছে নেওয়া হলো...
১৭ এপ্রিল ২০২৫
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা হলেও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
৮ ঘণ্টা আগে
সুদান থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু রাতেই দেশটির আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শান্ত মন্ডল। কুড়িগ্রামে শান্তদের বাড়িতে এখন চলছে শুধুই মাতম।
৮ ঘণ্টা আগে
প্রেস উইং জানিয়েছে, আগামীকাল দুপুরে ওসমান হাদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসক দল ও ভ্রমণসংক্রান্ত সব প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে।
১৩ ঘণ্টা আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে আগামীকাল সোমবার দুপুরে একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হবে।
আজ রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান, এভারকেয়ার হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জাফর, ওসমান হাদির ভাই ওমর বিন হাদির মধ্যে এক জরুরি কল কনফারেন্সে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। পরে প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, গত দুদিন ধরে ওসমান হাদির চিকিৎসার জন্য সরকার সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার কয়েকটি হাসপাতালে যোগাযোগ করেছে। আজ এভারকেয়ার হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলের পরামর্শে ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার পর প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, বর্তমানে ওসমান হাদির শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল ও অপরিবর্তিত রয়েছে।
আগামীকাল দুপুরে ওসমান হাদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসক দল ও ভ্রমণসংক্রান্ত সব প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের অ্যাকসিডেন্ট ইমার্জেন্সি বিভাগে তাঁর চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ওসমান হাদির চিকিৎসাসংক্রান্ত সব ব্যয় রাষ্ট্রীয়ভাবে বহন করা হবে। তাঁর চিকিৎসাপ্রক্রিয়া সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন ড. ইউনূস।
ওসমান হাদির দ্রুত সুস্থতা কামনায় দেশবাসীর কাছে দোয়া ও প্রার্থনা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে আগামীকাল সোমবার দুপুরে একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হবে।
আজ রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান, এভারকেয়ার হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জাফর, ওসমান হাদির ভাই ওমর বিন হাদির মধ্যে এক জরুরি কল কনফারেন্সে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। পরে প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, গত দুদিন ধরে ওসমান হাদির চিকিৎসার জন্য সরকার সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার কয়েকটি হাসপাতালে যোগাযোগ করেছে। আজ এভারকেয়ার হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলের পরামর্শে ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার পর প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, বর্তমানে ওসমান হাদির শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল ও অপরিবর্তিত রয়েছে।
আগামীকাল দুপুরে ওসমান হাদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসক দল ও ভ্রমণসংক্রান্ত সব প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের অ্যাকসিডেন্ট ইমার্জেন্সি বিভাগে তাঁর চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ওসমান হাদির চিকিৎসাসংক্রান্ত সব ব্যয় রাষ্ট্রীয়ভাবে বহন করা হবে। তাঁর চিকিৎসাপ্রক্রিয়া সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন ড. ইউনূস।
ওসমান হাদির দ্রুত সুস্থতা কামনায় দেশবাসীর কাছে দোয়া ও প্রার্থনা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।

১৭ এপ্রিল তারিখটায় পৌঁছুতে হলে মেলে ধরতে হয় ইতিহাসের ডানা। এই দিনটিতে বৈদ্যনাথতলা হয়ে ওঠে মুজিবনগর। কেন মুজিবনগর? মুজিব তো তখন নেই। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরেছে ইয়াহিয়া। বিচারের নাম করে শেখ মুজিবকে হত্যা করার তোড়জোড় চলছে তখন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের শপথ নেওয়ার জন্য যে জায়গাটি বেছে নেওয়া হলো...
১৭ এপ্রিল ২০২৫
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা হলেও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
৮ ঘণ্টা আগে
সুদান থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু রাতেই দেশটির আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শান্ত মন্ডল। কুড়িগ্রামে শান্তদের বাড়িতে এখন চলছে শুধুই মাতম।
৮ ঘণ্টা আগে
আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের কয়েক দিন আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানো যাচ্ছে না বুঝতে পেরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে শেষ মরণ আঘাত হানে পাকিস্তানি বাহিনী।
১১ ঘণ্টা আগে