ডিজিটাল আইন: নাম বদল করে নতুন আইন, অর্থহীন বলছে সম্পাদক পরিষদ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ২২: ৫৪
Thumbnail image

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে নতুন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে। শাস্তি কমানো ও অজামিনযোগ্য কিছু ধরা জামিনযোগ্য করা ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় নাম বদল করে নতুন আইন করা অর্থহীন বলে মনে করছে সম্পাদক পরিষদ।

আজ বুধবার সম্পাদক পরিষদের পক্ষে সভাপতি মাহফুজ আমান ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ভাষ্য থেকে সংবাদমাধ্যমে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে সম্পাদক পরিষদ শঙ্কামুক্ত হতে পারছে না। কারণ কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি কমানো ও অজামিনযোগ্য কিছু ধরা জামিনযোগ্য করা ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৬ ধারাগুলো অজামিনযোগ্য ছিল। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে এসব ধারা জামিনযোগ্য থাকছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় ২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিল, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণ হয়েছে। একই সঙ্গে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে যেই আইনটি করার ঘোষণা দিয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায় সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার সময় সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজনদের উদ্বেগ আমলে নেয়নি। সেই আইন সংশোধন বাতিল বা নতুন কিছু করার ক্ষেত্রে অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও তাঁদের মতামত নেওয়া হবে সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেরকম কিছু না করেই সরকার প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া তৈরি এবং তা আইনে পরিণত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের অংশীজনসহ জনমনে প্রশ্ন দেখা দেওয়া স্বাভাবিক।

সম্পাদক পরিষদ প্রস্তাবিত সাইবার আইনে সাংবাদিকদের জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে, সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে মানহানির মামলায় সাংবাদিকদের শাস্তি কারাদণ্ডের বদলে ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধানের কথা বলা হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, দণ্ডবিধি ১৮৬০–এর অধীনে মানহানির দায়ে যে শাস্তির বিধান আছে, সেটা সংশোধন না করা হলে নতুন বিধান অকার্যকর হতে বাধ্য। দ্বিতীয়ত ২৫ লাখ টাকা জরিমানা শোধ না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শেষ পর্যন্ত কারাদণ্ডই ভোগ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা প্রচলিত ফৌজদারি আইনে যে অপরাধের শাস্তির বিধান রয়েছে, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে বিধিবিধান আছে তার পরিবর্তে এসব শাস্তির বিধানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। 

এতে আরও বলা হয়, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় ধারা দুটি বাতিলের পক্ষে জোরালো দাবি উঠেছে। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেওয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশি মতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাটি রেখে দেওয়া হয়েছে। এই ধারার মাধ্যমে শাস্তির মাত্রা কিছু কমানো হলেও ঔপনিবেশিক আমলের ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে রেখে দেওয়া হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে শাসকগোষ্ঠী এ দেশের মানুষকে সন্দেহ করত বলে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন জারি করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে এই আইন থাকার কোনো যুক্তি আছে বলে মনে করি না।’ 

অন্য দিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী, পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ এই ধারা বলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধারাটিও যেহেতু বহাল থাকছে তাই নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলা প্রত্যাহার ও কারাবন্দীদের মুক্তির দাবি জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক, সেটা আমরাও চাই। কিন্তু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনও যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, সে জন্য এটি চূড়ান্ত করার আগে সংবাদমাধ্যমের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করি। যেহেতু সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেহেতু এই আইনে করা মামলাগুলোও প্রত্যাহার এবং এই আইনে যারা ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং কারাভোগ করেছেন, তাঁদের মুক্তি দেওয়া হোক।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত