প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উপাদান: কীভাবে তৈরি হয় প্রশ্নপত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২২, ০৯: ৩০
Thumbnail image

হঠাৎ করেই আলোচনায় এইচএসসি পরীক্ষার একটি প্রশ্নপত্র। বাংলা প্রথম পত্রে ‘সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক’ প্রশ্ন রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। কৌতূহলী অনেকের প্রশ্ন—কীভাবে তৈরি হয় পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র? একটি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে কীভাবে এমন সাম্প্রদায়িক স্পর্শকাতর বিষয় প্রবেশ করল?

যেভাবে তৈরি হয় প্রশ্ন
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি পত্রের জন্য তৈরি করা হয় চার সেট প্রশ্ন। প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন প্রস্তুত করার পর তা সিলগালা করে পাঠিয়ে দেন শিক্ষা বোর্ডে। এরপর বোর্ড দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু করে। দ্বিতীয় ধাপে প্রশ্নপত্র মডারেশন করার জন্য প্রতি পত্রের ক্ষেত্রে চারজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও প্রশ্নপত্রের মডারেশনের কাজ করেন অন্য বোর্ডের শিক্ষকেরা। এখানে প্রশ্নপত্রের সেট তৈরিকারী ও মডারেটরের মধ্যে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকে না।

এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘প্রশ্নপত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল। আমাদের ৯টি শিক্ষা বোর্ড প্রতিটি পত্রের বা একটি পত্রের যদি দুটি বিষয় থাকে, তাহলে প্রতিটি পত্রের চার সেট করে প্রশ্ন তৈরি করে। এই ৯টি বোর্ডের ৩৬টি প্রশ্ন ঢাকা বোর্ডে নিয়ে আসা হয় এবং এরপর লটারি করা হয়। লটারি করে যার ভাগে যেটা পড়ে, সেখান থেকে প্রতি বোর্ডে দুটি করে প্রশ্ন ছাপানো হয়।’

 ‘এখন এই লটারিতে এবার ঢাকা বোর্ডের ভাগ্যে পড়েছে যশোর বোর্ডের প্রশ্ন। সেই দুটি প্রশ্ন ছাপা হয়েছে এবং ওই দুটির মধ্যে একটি পরীক্ষার দিন সকালে আবার ভাগ করে দেওয়া হয় কোনটিতে পরীক্ষা হবে। আর সেটিই পরীক্ষার্থীর হাতে পৌঁছায়।’ যোগ করেন ঢাকা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।

পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢাকা বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণত মডারেটররা আলাদাভাবে চার সেট প্রশ্ন চূড়ান্ত করেন। এরপর সিলগালা করে বোর্ডের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করেন। সিলগালা অবস্থায়ই প্রশ্নপত্র পাঠানো হয় আন্তশিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে। তিনি অন্যান্য বোর্ডের চেয়ারম্যানদের নিয়ে লটারির আয়োজন করেন। এক বোর্ডের চেয়ারম্যান অন্য বোর্ডের প্রশ্নপত্র নির্বাচন করেন লটারিতে। সিলগালা অবস্থায় চারটি সেট থেকে লটারিতে নির্বাচন করা হয় দুটি সেট। তবে কোন সেটে কোন প্রশ্ন আছে, কোন বোর্ডে বিতরণ করা হবে বা কোন প্রশ্ন কোন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে করা তা কারও জানা থাকে না।

এ বিষয়ে জিয়াউল হক বলেন, ‘একটি ভালো প্রশ্নের জন্য একজন ভালো মডারেটর দরকার। প্রশ্নকর্তা যদি তাঁর কাঠামো ঠিক করে না দেন, তাহলে মডারেটর খুব বেশি পরিবর্তন করতে পারেন না। তবে চাইলে মডারেটর প্রশ্নটি বাতিল করতে পারেন। বাতিল করে আবার নতুন প্রশ্ন করতে বোর্ডকে বলতে পারেন। আবার তিনি ঠিক করে দিতে পারেন ভেতরের বিষয়গুলো। প্রশ্নের অসামঞ্জস্য জায়গাগুলো পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে পারেন।’

কীভাবে প্রশ্নকর্তা ও মডারেটর নিয়োগ হয়
এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় পরীক্ষা শুরুর কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষক বাছাই করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রশ্নপত্র প্রণয়নের প্রাথমিক কার্যক্রম।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বেডু) থেকে মূলত শিক্ষকদের মান উন্নয়নের পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণে ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী বা মডারেটর নিয়োগ করা হয়ে থাকে।

সৃজনশীল প্রশ্নপত্র যখন থেকে শুরু হয়েছে, তখন থেকে প্রশ্নপত্র তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। সেখানে প্রশিক্ষণের ফলাফলের ওপর একটা র‍্যাঙ্কিংও করা হয়ে থাকে। ২০০৮ সালে সৃজনশীল চালু হলেও ২০১২ সাল থেকে মূলত এইচএসসি পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন করা হয়ে থাকে।

এত প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার পরও কীভাবে প্রশ্নপত্রে এমন স্পর্শকাতর বিষয় থাকল—এমন প্রশ্নে ঢাকা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান জিয়াউল হক বলেন, ‘এমনও হতে পারে, যশোর বোর্ডে এমন চারজন মানসম্পন্ন শিক্ষকই নেই। তবে আগে যখন প্রতিটি বোর্ড নিজেই প্রশ্ন করত, তখন দেখা যেত যে যশোর বোর্ডের প্রশ্ন করার জন্য অনেক সময় অন্য বোর্ড থেকেও শিক্ষক নেওয়া হতো।’

তিনি বলেন, ‘তবে একটা সময়ে যে বোর্ডের প্রশ্নপত্র, সেটি সেই বোর্ড থেকেই করা হতো। তখন দুটি প্রশ্ন ছাপানো হতো। ওই সময় প্রশ্নের মান ও বোর্ডের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ভিন্ন ভিন্ন বোর্ডের ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নের কারণে মান নিয়ে কথা হয়।’

ঢাকা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘এই সমস্যা সমাধানের জন্য সব বোর্ডের একটি প্রশ্নপত্র দেওয়া হলো। কিন্তু সেটাও মেইনটেন করা যাচ্ছে না। একই প্রশ্ন সব বোর্ডে হওয়ায় প্রশ্ন ফাঁস হতে শুরু করে। প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করার জন্য প্রতিটি বোর্ড আলাদা আলাদা প্রশ্ন করা শুরু করে। তবে যে বোর্ডের শিক্ষক প্রশ্ন করবেন, তা দিয়ে অন্য বোর্ডের পরীক্ষা হবে। দেখা গেল প্রশিক্ষণে ভালো নম্বর আছে তবে তার আগে প্রশ্ন করার অভিজ্ঞতা নেই, যার ফলে এমন বিতর্কিত বিষয় উঠে আসে প্রশ্নে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত