আবার চড়াও পুলিশ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক
আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২৪, ০২: ১৯
Thumbnail image

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দেওয়া ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ পদযাত্রায় শিক্ষার্থীদের ওপর আবার চড়াও হলো পুলিশ। গতকাল বুধবার শিক্ষার্থীদের থামিয়ে দিতে কোথাও কোথাও কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও লাঠিপেটাও করেছে পুলিশ ও বিজিবি। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে রাজধানী এবং সাত জেলায় অন্তত ১৩০ জন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ শতাধিক আহত হয়েছেন।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ (আমাদের নায়কদের স্মরণ) নামে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহসমন্বয়ক রিফাত রশিদ। বিবৃতিতে জানানো হয়, সারা দেশে আজ বৃহস্পতিবার নির্যাতনের ভয়ংকর দিন-রাতগুলোর স্মৃতিচারণা; শহীদ ও আহতদের নিয়ে পরিবার এবং সহপাঠীদের স্মৃতিচারণা এবং আন্দোলনে হওয়া নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে চিত্রাঙ্কন, গ্রাফিতি, দেয়াললিখন, ফেস্টুন তৈরি, ডিজিটাল পোর্ট্রেট করা হবে। এসব কনটেন্ট অনলাইন ও অফলাইনে প্রচারের মাধ্যমে কর্মসূচি পালন করা হবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা-মামলা, গুমের প্রতিবাদ ও জাতিসংঘ কর্তৃক তদন্তপূর্বক বিচারের দাবিতে গতকাল রাজপথ, সব আদালত ও ক্যাম্পাসে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

রাজধানীতে পথে পথে বাধা
রাজধানীতে গতকাল সকাল থেকেই হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে ব্যাপক পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়। দুপুর ১২টা থেকে হাইকোর্টের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে শুরু করেন। এ সময় অন্তত চার শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। সাড়ে ১২টার দিকে আরও শিক্ষার্থী হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থান নিলে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বিভিন্ন মানবাধিকার ও সংস্কৃতিকর্মী। এ সময় হাইকোর্টের আইনজীবীরাও মিছিল নিয়ে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থান নেন।

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা হাইকোর্ট অভিমুখে রওনা দিলে শিশু একাডেমির সামনে তাঁদের আটকে দেয় পুলিশ। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। হেনস্তার শিকার হন ঢাবির লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক শেহরীন আমিন ভূঁইয়া।

বেলা ৩টায় হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশ ও বিজিবি শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিতে চাইলে তাঁরা বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে তাঁরা শিক্ষা অধিকার চত্বরে অবস্থান নেন। বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সেখানে অবস্থান করে বিভিন্ন স্লোগান দেন।

এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে না পারলেও আদালতের ভেতরে বিক্ষোভ করেছেন আইনজীবীরা। দুপুরে দৈনিক বাংলা মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশ বাধা দিলে তাঁরা মিছিল নিয়ে ফকিরাফুল, নয়াপল্টন, কাকরাইল হয়ে শান্তিনগর যান। বেলা ২টার দিকে মিরপুরের বেনারসিপল্লিতেও বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। 

শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে পুলিশ লাঠিপেটা এবং বেশ কয়েকজনকে আটক করে। গতকাল বরিশাল নগরে। ছবি: আজকের পত্রিকা

জেলায় জেলায় আটক-সংঘর্ষ
খুলনা নগরীর সাতরাস্তার মোড়ে বেলা ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন। তবে তাঁদের সরিয়ে দেয় পুলিশ-বিজিবি। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা ময়লাপোতার মোড়ে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পরে শিক্ষার্থীরা সাত রাস্তার মোড় সড়কে অবস্থান নেন। বেলা ২টার দিকে ময়লাপোতা থেকে বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে সাতরাস্তার মোড়ে শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে। এ সময় শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে পাল্টা ধাওয়া দেন। বেলা ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় খুলনা নগরের বিভিন্ন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্য, দুই সাংবাদিকসহ অন্তত ৫০ জন আহত হন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের সময় তাঁদের অন্তত ৫০ জনকে আটক করা হয়েছে।

সিলেটে শিক্ষার্থীরা বেলা ১১টার দিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়ো হন। পরে তাঁরা পদযাত্রা করে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নগরের সুবিদবাজার মোড়ে পৌঁছালে পুলিশ তাঁদের পথ রোধ করে। তবে শিক্ষার্থীরা ব্যারিকেড ভেঙে সামনে অগ্রসর হন। এ সময় সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। শিক্ষার্থীরাও ইটপাটকেল ছোড়েন। সংঘর্ষে অন্তত ২০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সিলেটের নাগরিক সমাজের সদস্যরা বিকেলে চৌহাট্টা এলাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে গান, মিছিল ও প্রতিবাদী সমাবেশ করেন।

শিক্ষার্থীরা বরিশাল শহরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফকিরবাড়ি রোড থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করার চেষ্টা করেন। এ সময় একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ ও বিজিবি লাঠিপেটা করে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফের শিক্ষার্থীরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাঁরা নগর ভবনের দিকে যেতে চাইলে বাধা দেয় পুলিশ। বেলা পৌনে ১টার দিকে কাকলির মোড় থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ-বিজিবি লাঠিপেটা করে। এতে অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আহত হন। বিক্ষোভের সময় ১৩ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

চট্টগ্রাম নগরে বেলা ১১টার দিকে আদালতের প্রবেশমুখ লালদীঘি এলাকায় অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা আদালতে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। তবে আইনজীবীদের একাংশের সহায়তায় তাঁরা মিছিল-স্লোগানসহ আদালত চত্বরে ঢুকে পড়েন। বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম আদালত ভবনের মূল ফটক বদিউল আলম স্মারক ব্রিজের নিচে বিক্ষোভ করেন তাঁরা। এখানে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটলেও আওয়ামীপন্থী সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ ও বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদের আইনজীবীরা মুখোমুখি অবস্থানে ছিলেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসূচি পালনকালে ছয় শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে তিনজন নগরীর মতিহার থানায় এবং বাকি তিনজন রাজপাড়া থানায় পুলিশি হেফাজতে আছেন বলে নিশ্চিত করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক। এর আগে বেলা পৌনে ৩টার দিকে নগরের মহিষবাথান এলাকায় রাজপাড়া থানা-পুলিশের একটি গাড়ি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। পরে আশপাশে অভিযান চালিয়ে পুলিশ অন্তত আটজনকে আটক করে।

যশোর পৌরসভার সামনে সকালে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। পরে তাঁরা মিছিলের চেষ্টা করলে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এরপর শিক্ষার্থীরা মিছিল করে যশোর পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে চার রাস্তার মোড়ে পৌঁছান। সেখানে তাঁদের লাঠিপেটা করে পুলিশ। এ ছাড়া ৬ শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পুলিশের লাঠিপেটায় অন্তত ২০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।

কুষ্টিয়ায় গত সোমবার থেকে কঠোর অবস্থানে পুলিশ। ওই দিন বিভিন্ন সড়কে তল্লাশি চালিয়ে ৩০ জন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছিল। গতকাল বেলা ৩টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মোড়ে মোড়ে তল্লাশিতে অন্তত ১৬ জনকে আটক করা হয়। তাদের অধিকাংশই ছাত্র।

দিনাজপুর শহরে শহীদ মিনারের পাদদেশে দুপুরে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাঁরা স্লোগান দিতে শুরু করলে পুলিশ ওই এলাকা থেকে ১৮ জনকে আটক করে। এ সময় পুলিশের ভ্যান থেকে চিৎকার করে শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের অপরাধ কী, আমরা আপনাদের কাছে বিচার চাই। কেন আমাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?’

দুপুরে লক্ষ্মীপুর আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। আইনজীবীদের একটি অংশও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা মানববন্ধন করার চেষ্টা করলে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা বাধা দেন। দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলে পুলিশ শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেয়। পরে লক্ষ্মীপুর শহরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীসহ ৮ শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ।

এদিকে চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে চাঁদপুর জেলা জজ আদালত ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। ঝিনাইদহ শহরে দুপুরের পর শিক্ষার্থীরা জর্জকোট এলাকায় যেতে চাই বাধা দেয় পুলিশ। ফরিদপুরে ঢাকা-বরিশাল সড়কে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। টাঙ্গাইলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জজকোর্ট প্রাঙ্গণের পাশে হেলিপ্যাড এলাকায় পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেন। দুপুরে কিশোরগঞ্জ আদালতের সামনে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। নোয়াখালী শহরে দুপুরে হাজারো শিক্ষার্থী বিক্ষোভে অংশ নেন। ময়মনসিংহ শহরে গতকাল পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যে কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা কালিবাড়ি মোড়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। নরসিংদীতেও একই ঘটনা ঘটেছে। হবিগঞ্জ শহরে সড়ক অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এতে আইনজীবীরা সংহতি জানান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত