ঢাকা হঠাৎ কেন লোডশেডিংমুক্ত?

সাজ্জাদ হোসেন, ঢাকা
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৩, ২৩: ২৪
আপডেট : ১২ জুন ২০২৩, ১৪: ১৮

দুদিন আগেও রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে লোডশেডিং ছিল অসহনীয়। খোদ ঢাকায় লোডশেডিং হয়েছিল ৪–৫ ঘণ্টা। গ্রামাঞ্চলে সেটি ছাড়িয়ে গিয়েছিল ১০ ঘণ্টার ওপর। তবে সম্প্রতি ঢাকাসহ সারা দেশে বৃষ্টিপাতের পর সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা অনেকখানি কমেছে। গ্রামাঞ্চলে এখনো ৭০০ থেকে ১ হাজার মেগাওয়াটের মতো লোডশেডিং থাকলেও গত ৯ জুন থেকে রাজধানীতে লোডশেডিং নেই।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের (পিজিসিবি) বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং ঢাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলা জানা যায়, আজ রোববারসহ তিন দিন ধরে রাজধানী প্রায় লোডশেডিংমুক্ত।

ডিপিডিসি ও ডেসকো কর্মকর্তারা আজকের পত্রিকাকে জানান, দুই দিন আগেও লোডশেডিংয়ের যে তীব্রতা ছিল ঢাকায় সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে প্রচুর গ্রাহক ফোন করছিলেন। অনেক গ্রাহক অভিযোগ করছিলেন, তাঁদের এলাকায় ৪–৫ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীতে জন–অসন্তোষ প্রশমনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়িয়েছে সরকার।

বিদ্যুৎ বিভাগ, ঢাকার দুটি বিতরণ সংস্থা ও পিজিসিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকায় যেভাবে দিন দিন লোডশেডিং বাড়ছিল সেটি জন–অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এর মধ্যে বিএনপি দেশব্যাপী তীব্র লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে সরব হতে শুরু করে। বিদ্যুতের দাবিতে ঢাকাসহ সারা দেশে হারিকেন মিছিলও করে বিএনপি। সেই সঙ্গে ডিপিডিসি এ ডেসকোতে বিপুলসংখ্যক ক্ষুব্ধ গ্রাহকের ফোনকল আসছিল।

ডিপিডিসি ও ডেসকোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, লোডশেডিং নিয়ে ঢাকার গ্রাহকেরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছিলেন তাতে কর্মকর্তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। ক্ষুব্ধ গ্রাহকেরা সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোতে হামলা করতে পারেন— এমন আশঙ্কাও বাড়ছিল। এই অবস্থায় ডিপিডিসি ও ডেসকোর শীর্ষ কর্মকর্তারা বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে বসে পরিস্থিতি বর্ণনা করে ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর দাবি করেন। 

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকা বলেন, ‘বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে আছে সরকার। এই অবস্থায় ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে বিরক্ত জনগণ বিদ্যুতের দাবিতে ফুঁসে উঠলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সেই আন্দোলন ঢাকা ছাড়িয়ে স্ফুলিঙ্গের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও আছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে সরকার ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে নির্দেশনা দেয়।’

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘৯ তারিখ থেকে আজ পর্যন্ত ঢাকায় লোডশেডিং বলা যায় শূন্যের কোঠায়। অন্যদিকে গরমের তীব্রতা কমে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদাও কমেছে প্রায় আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট। একই সঙ্গে আদানিসহ কিছু তেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়ানোয় বিদ্যুতের জোগানও বেড়েছে গত দুই দিনে। আদানি আগে ৭৫০–৭৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করলেও দুই দিন ধরে সরবরাহ করছে ১ হাজার ৫০ মেগাওয়াটের বেশি।’

ঢাকার লোডশেডিং কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে দেনদরবার করছি বেশ আগে থেকেই। এখন ডিপিডিসি এলাকায় কোনো লোডশেডিং নেই।’

রাজধানীতে লোডশেডিং না থাকায় স্বস্তি প্রকাশ করে ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী বলেন, ‘আমার এলাকায় গতকাল এবং আজকে কোনো লোডশেডিং হয়নি। গত কিছুদিনের চেয়ে আমরা এখন বেশ স্বস্তির পরিস্থিতিতে আছি। আবহাওয়া শীতল হওয়ার পাশাপাশি ঢাকায় বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়ায় লোডশেডিংও নেই। আজ ডেসকো এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা আছে প্রায় ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট এবং সরবরাহও আছে ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট।’

ডিপিডিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সরকার সব সময় অগ্রাধিকার দেয়। তবে কয়েক দিন আগেও সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে পার্থক্য বেশি বেড়ে যাওয়ায় ঢাকায় লোডশেডিং না বাড়িয়ে উপায় ছিল না।’

এদিকে লোডশেডিং কমে এসেছে পল্লি বিদ্যুতায়ন বোর্ডের গ্রাহকদেরও। তিন–চার দিন আগেও গ্রামাঞ্চলে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের মতো থাকলেও সেটি আজ নেমে এসেছে প্রায় ৮০০ মেগাওয়াটের মতো। পল্লি বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া আগের চেয়ে একটু শীতল হওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আমরা এখন মোট চাহিদার ৮–১০ শতাংশ লোডশেডিং পাচ্ছি, যা মোট বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট কম।’

দেবাশীষ চক্রবর্তী জানান, পল্লি বিদ্যুতে গড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুতের চাহিদা আছে। যেখানে গত ৬–৭ জুনের দিকেও ঘাটতি ছিল প্রায় ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট।

উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন না বাড়িয়েও কীভাবে ঢাকাকে লোডশেডিংমুক্ত করা গেল জানতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। প্রতিমন্ত্রী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি, লোডশেডিং পরিস্থিতি আগের তুলনায় একটু একটু করে উন্নতি হবে। এখন সেটা দেখতে পাচ্ছেন। ঢাকায় লোডশেডিং এখন না থাকলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে একটু আধটু লোডশেডিং আছে। আমার আশা, আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে সেটাও থাকবে না।’

পিজিসিবির এক সূত্র জানিয়েছে, আজ বিকেল ৩টার দিকে সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৫৩০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ১২ হাজার ৩৩ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ বিভাগের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য মতে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট। আর সর্বশেষ গত ১৯ এপ্রিল সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট।

তবে বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ এপ্রিল সারা দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াট। আর গত মার্চ পর্যন্ত শীতল আবহাওয়া ও বৃষ্টির কারণে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াট থেকে ১২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের মধ্যে ছিল।

প্রসঙ্গত, তীব্র গরম ও ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের মধ্যে কয়লা-সংকটের কারণে ৫ জুন পটুয়াখালীর পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ৯ জুন চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। ডলার-সংকটের কারণে কয়লা আমদানিও কঠিন হয়ে পড়েছে।

কয়লার আমদানি বিল বকেয়া থাকায় সরবরাহ সংকটে গত ২৪ এপ্রিল থেকে টানা ২৩ দিন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ থাকে। আংশিক বিল পরিশোধের পর কয়লা এলে গত ১৬ মে রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনে ফেরে। তবে ৬৬০ মেগাওয়াটের ইউনিটটি ৩৫০-৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতায় চলছে। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা ৫০ হাজার টন কয়লার সাড়ে ২৬ হাজার টন মোংলা বন্দর থেকে খালাস করা হচ্ছে। বাকিটাও শিগগির আসবে। তবে এ দিয়ে ১৪ দিনের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সচল রাখা যাবে না। এর পরে কবে কয়লা আসবে সেটি নিশ্চিত না।

বিদ্যুৎ সম্পর্কিত আরও খবর পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত